আসসালামু আলাইকুম!

আমার সোদর-প্রতিম তরুণ-দল ও ছাত্রবৃন্দ। আপনাদের অনেকে বহুদিন থেকে এই দীন ফকিরের কাছে আসা-যাওয়া করছেন- যারা আসেন না তাঁরাও নাকি আশা করে বসে আছেন শির্নির আশায়! যে ফকিরের ঝুলি রইল আজও শূন্য, আল্লাহর পরম রহমতের আশা যে ভিক্ষু আজও ঊর্ধ্বের পানে হাত পেতে বসে আছে, তারই কাছে যখন আপনারা হাত পাতেন, তখন আমার আঁখি অশ্রুতে ভরে ওঠে। পরম করুণাময়ের পরম রহমত পাওয়ার শুভক্ষণ যখন এল ঘনিয়ে যে ভাণ্ডার হতে তাঁর অনন্ত শক্তি অসীম করুণা নিয়ত বিতরিত হচ্ছে সেই অতি গোপন ভাণ্ডারের দ্বারে পৌঁছে যদি আমি আপনাদের আহ্বানে পিছু ফিরে চাই, তাহলে বঞ্চিত শুধু আমিই হব না, হবেন আপনারা যাদের জন্য আমার এই তপস্যা, এই হজ্জ্ব-যাত্রা। আরাফাতের ময়দানের তকবির যখন শুনতে পাচ্ছি- পবিত্র কাবাঘরের ছায়া যখন আকাশের নীল শিসায় ফুটে উঠেছে- তখন আমার আত্মীয় যারা তারাই যদি পিছু ডেকে ফিরাতে চায়, তাহলে আমার দুনিয়া ও আখেরাত দুই হবে বরবাদ। আমার এই ঘোর দুর্দিনের, দুর্যোগের মরুভূমি নিয়ে তীর্থযাত্রা হবে নিষ্ফল। সলুক (journey) ও তরিকতেই (path) হবে আমার মৃত্যু ।

বন্ধুগণ! আল্লাহ জানেন, আমার অমৃতের সাধনা- আমার মুক্তির, আজাদির সাধনা আমার একার জন্য নয়। অমৃত যদি পাই, মুক্তি যদি পাই- সে অমৃতে মুক্তিতে আপনাদের সকলের হিস্সা আছে। শুধু পরম গোপনকে জানাই আমার সাধনা নয়- তাঁকে জেনে তাকে পেয়ে প্রকাশ-জগতে আমার জন্যই আমার এ তপস্যা। আজ যখন আমার বন্ধুদের ভাইদের কাছ থেকে যশ-খ্যাতি-অভিনন্দনের ডালি আসে তা গ্রহণ করতে ভয়ে আমার হাত আড়ষ্ট হয়ে আসে। আমি জানি, এ অভিনন্দন গ্রহণ করার আমার কোনো অধিকার নাই।

যে-দেশে লোক ভাড়া করে যশ-খ্যাতি-অভিনন্দনের থালা ও মালার প্রোপাগাণ্ডা চলে, সে দেশে আমি কেন যে বহু বৎসর ধরে আপনাদের আমন্ত্রণ ও অভিনন্দনকে অস্বীকার করে আসছি- তার একমাত্র কারণ, আমার একদা এক শুভ প্রভাতে কেন যেন মনে হয়েছিল, বাইরের মালায় যার হাত পড়ল বাঁধা, অন্তর্লোকের ঊর্ধ্বের পরম দান থেকে সে হাত হল চির-বঞ্চিত। বাইরের ক্ষুদ্র প্রশংসায় যার পাত্র উঠলো পুরে- অমৃত পরিবেশনের শুভক্ষণে সে হল অপাত্র। কে করবে দেশকে স্বাধীন, কে আনবে মুক্তি? কোথায় সেই স্বাধীন মুক্ত আত্মা? যে নিজে নিত্য

কামনা বাসনা লোভ অহঙ্কার ঈর্ষার কাছে নিত্য পরাজিত- সেই বদ্ধজীবে কে আনবে জয়ের শুভ্র নির্মাল্য? যার অন্তর বাহির সমস্তটা রইল আত্মতৃপ্তির ক্ষুধায় পূর্ণ- সেই ক্ষুধিত মূর্তি আজ বাইরে ত্যাগের গেরুয়া ও খেলকা পরে কৌমের দেশের জনগণকে নিয়ে চলেছে মৃত্যুর পথে, জাহান্নামের পথে। “ডেমন” ও “ডার্ক ফোর্সের” শক্তি বিপুল কিন্তু এ শক্তি কল্যাণের পথে নিয়ে যায় না- এদের পথ “সেরাতুল মুস্তাকিম” নয়- এ পথ ‘গজবের”, অভিশাপের পথ। এ পথে আল্লাহর রহমতের ছায়া নাই এ পথের পথিকের অন্তরে আল্লাহর ভয় নাই। আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহর রসূলের প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধা থাকে যে মুসলমানের কোরআন মজিদের এক হরফও যারা হৃদয়ঙ্গম করে তারা জাত ভাইকে জাতিকে এমন মিথ্যার পথ দিয়ে নিয়ে যায় না। এদের খেলকার ভিতরে, এদের চোগা চাপকানের অন্দরে যাঁদের অর্ন্তদৃষ্টি যায়, তাঁরা দেখবেন- এরা সুদখোর কাবুলির চেয়েও ভীষণ-দৈত্যের চেয়েও ভয়ঙ্কর। কাবুলি সুদ পেলে রেহাই দেয়, এরা সুদে-মূলে সাবাড় করতে চায়। অন্তরে আল্লাহর করুণার এক কণাও যে পেয়েছে, তার কখনো এই বীভৎস লোভী মূর্তি দেখা যায় না। সে কখনো বাইরের যশ খ্যাতি-ঐশ্বর্যের মোহে জোঁকের মত কওমকে জাতিকে রক্ত শুষে মেরে ফেলে না। অন্তরে যে আল-ফাজালিল আজিম- পরম প্রসাদ দাতা আল্লাহর প্রসাদ পেল না- সেই বাইরের এই দস্যুবৃত্তি করে বেড়ায়। তথাকথিত স্বাধীন দেশেও এই শাক্ত মাতাল দানবের উৎপাত চলেছে ভারতেও চলেছে এই শক্তি-লোভীর সাম্যহীন ভেদলীলা। যে দৃষ্টির দর্শন- শক্তি এই দেওয়ালের ওপারে পৌঁছায় না, সেই খর্বদৃষ্টি অন্ধের ইঙ্গিতে চলেছে অগণন জনগণ । এই নেতাদের শক্তি নাই, কিন্তু অতি কূটবুদ্ধি আছে; যৌবন নাই, কিন্তু যৌবনের কাঁধে ভর করে জয়যাত্রার মিছিল বের করার প্রখর বুদ্ধি আছে। এই জয়যাত্রার মিছিলকে আমি দেখেছি জানাজার মিছিলের মত। জরাগ্রস্ত জইফ্ যারা তাঁদের উপর আমার ব্যক্তিগত কোন অশ্রদ্ধা নেই- আমার বর্তমান ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে পরিচিত যাঁরা, তারা জানেন আমার চেয়ে তাঁদের কেউ বেশি শ্রদ্ধা করেন না। আল্লাহ জানেন তাঁদের বুজর্গ বলে পদধূলি নিতে আমার এতটুকু দ্বিধা নেই। কিন্তু তাঁরা যখন জাতীয় মহাযুদ্ধের সেনাপতি হয়ে অগ্নে চলতে চান তখনই আমার পায় হাসি। আমি এই জায়গায় তাদের সালাম বা নমস্কার করতে পারিনি। জরার প্রধান ধর্ম হলো- অতি সাবধানে পা টিপে টিপে বিচার করতে করতে চলা। এই অতি সাবধানীরা (ভিরু নাই বললাম) অগ্রগমনের পথ পরিষ্কার না করে পশ্চাতে “রিট্রিট” করার পথ উন্মুক্ত রাখতে চান । আগে চলো মারো জোয়ান-হেইয়ো” বলে এগুতে এগুতে যেই এসে পড়লো চৌরিচোরার দুটো খুনোখুনি, অমনি সেনাপতির কণ্ঠে ক্রন্দন ধ্বনিত হল – “পিছু হটো, পিছু হটো।” গণ-ঐরাবতের পায়ে কার্পাস তুলো চরকাকাটা সূতোর পুঁটুলি বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও তার বিপুল আয়তনের জন্য দুটো চারটে লোক মারা গেল এইটাই সেনাপতির চোখে পড়ল আর (ভারতের কথা ছেড়ে দিলাম) এই বাংলাদেশে যে কালাজ্বর আর ম্যালেরিয়ায় বছরে বছরে এগার লক্ষ করে লোক cold blooded murdered হচ্ছে সেদিকে একচক্ষু সেনাপতির দৃষ্টি পড়ল না। কানা হরিণের মত তাঁর মৃত্যুবরণও এল তাই ঐ ভয়ের পথ দিয়েই। মৃত্যু ভয় যার হয়ত নিজের গেছে- কিন্তু অন্যের মৃত্যু দেখলে যার মৃত্যু-

যন্ত্রণা হয় ভয়ে কৃর্ম-অবতার হয়ে যান- তিনি আর যাই করুন অমৃতসাগরের তীরে নিয়ে যাওয়ার সাধনা তাঁর নিষ্ফল হয়েছে। সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারের মধ্যে যিনি পরম নিত্যম, নিত্য পূর্ণম- তাঁকে যিনি উপলব্ধি করলেন না, তাঁর সংহার রূপকে যিনি অস্বীকার করলেন, ভয়ের পশ্চাতে অভয়কে দেখালেন না তিনি আর যাই পান-পূর্ণকে পাননি। তবু কাঠ পুড়ছে বলে, যে শুধু কাঠের ধ্বংসই দেখল, আগুনের সৃষ্টি দেখল না, তার দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন নয়। এর এক চোখে দৃষ্টি আছে আর বাকি যারা তারা একেবারে দৃষ্টিহীন অন্ধ। এরা হাতে বড় বড় মশাল জ্বেলে চলেছেন- কিন্তু অন্ধের হাতে মশাল যত না আলো দেয় তার চেয়ে ঘর পোড়ায় বেশি।

এই জরাগ্রস্ত সেনাপতিদের বাহন আজ দেশের যুবক-শক্তি। এই যুবকদের কাঁধে চড়ে এঁরা যশঃ খ্যাতি ঐশ্বর্যের ফল পেড়ে খাচ্ছেন। বাহক-বৃন্দ তার অংশ চাইলে বলেন- আমরা ফল খেয়ে আঁটি ফেললে সেই আঁটিতে যে গাছ গজাবে তারই ফল তোমরা খেয়ো। এই আঁটির আশায় যুবকদের কণ্ঠে জরার জয়গান করে চেঁচাতে চেঁচাতে আজ বাঁশের চাঁচাড়িতে পরিণত হয়েছে, চাকরির দরখাস্তের পাতা পেলে দলে দলে যুবক, দেখতে তীর্থের কাকের মত হ্যাঁ করে বসে আছে- ভোট ভিক্ষা করে তাদের ঠোঁট গেছে ছিঁড়ে, মোট বয়ে কোট হয়েছে নিমস্তিন, পথে ঘুরে ঘুরে পায়জামা পরিণত হয়েছে জাঙ্গিয়ায় কিন্তু দরখাস্তের পাতায় পোলাও আর পড়ল না। দু’চার জনের পাতায় যা পড়ল- তার চেহারা দেখে বাবুর্চির ‘বাবুর’ “চি” শব্দ দুয়ের উপর আসে ধিক্কার। যুবকেরা নিজেরাই জানেন, “ইয়ে দুঙ্গা উয়ো দুঙ্গা” বলে যারা চোগা চাপকানের পকেট দেখান- তাঁদের চাকরি বা অন্য যে কোন কল্যাণ-দানের শক্তি অতি সামান্য। তাদের ইচ্ছা থাকলেও দেওয়ার শক্তি নেই। তবু শিক্ষিত তরুণেরা স-ভগ্নি তাঁদের বয়ে বেড়াচ্ছেন- এই আশায় যে, কোন বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে কে জানে? যারা অন্যের ক্ষুধা দূর করার জন্য নিজের ক্ষুধা আগে মেটান- তাঁরা ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরতের বা তাঁর আসহাবদের শিক্ষা কখনো গ্রহণ করেননি। নিজেরা সাততলা দালানের আশ্রয়ে থেকে নিরাশ্রয় জনগণের জন্য কাঁদলে- তা কখনো তাদের হৃদয় স্পর্শ করবে না। অন্ধকূপে যে গেছে পড়ে- সাত মহলার উপর থেকে “আরে কম জোর ওঠ- আরে কম-বত ওঠ” বলে চেঁচালে সে কুয়া থেকে উঠতে পারবে না। উপরওয়ালার নেতার হুকুমে কুয়া থেকে উঠতে গিয়ে তার বুক যাবে ছিঁড়ে-পা যাবে ভেঙে। যিনি সত্যিকার অন্ধকূপ থেকে উদ্ধার করতে চান- তিনি তাঁর সভ্য পোশাক, কালচারের কালচে-পড়া মুখোশ খুলে কুয়ায় নেমে কাঁধ দিয়ে ঊর্ধ্বে তোলেন। এই কোটি কোটি নিরন্ন নিরাশ্রয়ের বেদনায় যার ক্ষুধার অন্ন মুখে উঠবে না ঐ ভিক্ষুকদের সাথে পথে পথে করবেন ভিক্ষা- ঐ নিরাশ্রয়ের সাথে গাছ তলা হবে যার আশ্রয় ইট পাথর হবে যার উপাধান- ছিন্ন কন্থা হবে যার এক মাত্র আবরণ সেই পরম বৈরাগীই এই বাঙলার ভারতের মহাভারত বিশ্বের অনাগত সেনাপতি-নেতা- লিডার ইমাম। যিনি অন্তরে আল্লাহর আনন্দরূপকে প্রাপ্ত হননি- পরম শান্তের শাস্তির প্রাসাদ যিনি পাননি তিনি এই পথের দুঃখকে অগণিত জনগণের জন্য এই দারিদ্র্য-অনাহার-উৎপীড়ন-আঘাতকে সহ্য করতেই পারবেন না। অন্তরে পরম ঐশ্বর্য পেয়েও যিনি পরম ভিক্ষু অনস্ত আসক্তির ভোগের মাঝে যিনি নিরাসক্ত নির্লোভ নিরডিমান নিরহঙ্কার সেই পরম অভেদজ্ঞানী পরম সাম্য সুন্দরের প্রতীক্ষায় আমি দিন গুনছি। তাঁর আনন্দ-সুন্দর জ্যোতি মাঝে মাঝে ঝলকে ওঠে হে আমার প্রিয়তম তরুণবৃন্দ- তোমাদের চোখে মুখে। তাঁর অজর অমর অক্ষয় তনুর বজ্র শক্তির ঝিলিক দেখি তোমাদের শক্তিতে তাঁর অভয় সুন্দর দক্ষিণ হাতের আভাষ পাই তোমাদের বাহুতে। তোমরা ডাকো, ডাকো, তাঁকে তোমাদেরই মাঝে, জরাজীর্ণ দেহে নয়, লোভ অহঙ্কার ঈর্যার অপবিত্র দেহে নয়- তোমাদেরই শুদ্ধদেহে সেই সর্বভয়মুক্ত সর্বভেদ-জ্ঞান-মুক্ত শক্তি-সাধনায় পূর্ণসিদ্ধ মহাপুরুষকে ডাকো তোমাদেরই মাঝে।

আমি আল্লাহর পবিত্র নাম নিয়ে এই আশার বাণী শোনাচ্ছি- তিনি প্রকাশিত হবেন তোমাদেরই মাঝে। জরাজীর্ণ দেহে নয়। তোমাদের আকাঙ্ক্ষা, তোমাদের প্রার্থনা আমার মত মহামূর্খকে লিখালেন কবিতা, গাওয়ালের গান- তাঁর শক্তি এই নাম গোত্রহীনের হাতে দিলেন আশার বাঁশি, আহ্বানের তূর্য, রুদ্রের ডমরু বিষাণ। তোমরা চাও- আরো চাও- দেখবে তোমাদেরই মাঝে চির-চাওয়া রুদ্র-সুন্দর আসবেন নেমে।

আল্লাহ তাঁর এই দাসের- বান্দার জীবনকে ভেঙে চুরে মিসমার করে নতুন করে গড়েছেন।

আমার আজও ভয় হয় যশঃখ্যাতির প্রলোভনকে; ‘যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ’। সেদিন আল্লাহ তাঁর এই বান্দার অন্তরে-বাহিরের সর্বসত্তাকে তাঁর বলে গ্রহণ করবেন- আমার বলে কিছুই থাকবে না- যেদিন আমার পরম স্বামী পরম প্রভুর দরবার থেকে পাব ফরমান সেই দিন আমি তাঁরই ইঙ্গিতে কর্মে নামব; তার আগে নয়। আল্লাহ আমায় সর্ব প্রলোভন হতে রক্ষা করুন। শুদ্ধজ্ঞান ও শুদ্ধপ্রেমের মিলনে তখন সে কর্ম হবে তাঁর কর্ম। এ বান্দার নয় শুদ্ধ কর্ম। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই আল্লাহর রহমত আমি পেয়েছি- আমার পরম প্রিয় “আল, গফুরুস ওদুদ” (পরম ক্ষমা সুন্দর ও প্রেমময়) আমায় নাজাত দিয়েছেন- কিন্তু অন্যকে মুক্ত করার শক্তি তিনি দেননি।

তার জন্য আমার কোন ব্যস্ততা নেই। শান্ত হয়ে অটল ধৈর্য নিয়ে সেই শুভক্ষণের জন্য বসে আছি। যখন তার শক্তি নেমে আসবে আমাদেরই কারুর মাঝে তুষার গলে স্রোতস্বিনী মত অনন্ত প্রবাহে, আপনাদের যারই মাঝে সেই শক্তি আসবে- সেই সেনানীর আদেশ এই বান্দা হাসিমুখে পালন করে ধন্য হবে। আল্লাহর সেই শক্তিকে গ্রহণ করার জন্য নিজেকে এই পৃথিবীর ঊর্ধ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়। অটল শান্ত ধ্যানী হতে হয়। ঊর্ধ্বে সঞ্চরণশীল মেঘদলকে সমতলভূমি গ্রহণ করতে পারে না- তাকে গ্রহণ করে সমতলের (plain-এর ঊর্ধ্বে যে অটল গিরিচূড়া উঠেছে সে। সেই ঊর্ধ্বে গিরিচূড়ায় সঞ্চিত হয় সেই মেঘদল তুষাররূপে। সেই তুষার বিগলিত হয়ে প্রবাহিত হলে অনুর্বর উপত্যকার অধিবাসীরা তার প্রসাদ পায়, তার দুই কূলে বাসা বাঁধে, তাদের অনুর্বর ক্ষেত্র উর্বর হয়, ফলে-ফুলে ভরে ওঠে। আল্লাহর উর্ধ্বের জালাল-শক্তিকে স্পর্শ করতে হবে তাদের, যারা দেশকে জনগণকে পরিচালিত করতে চান। বদ্ধ পুকুরের পানি দিয়ে দেশকে শস্য-শ্যামল করা যায় না। আপনাদের তরুণেরা প্রত্যেকেই অনাগত লিডার- তাই আপনাদের এই ঊর্ধ্বের কথা বললাম।

যদিও আমি সেই নিরক্ষরদের একজন। আপনারা জেনে রাখুন- আল্লাহ ছাড়া আর কিছুর কামনা আমার নেই- “লিডার” হওয়ার লোভ ও দুর্মতি থেকে আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। আজ মোল্লা-মৌলভী সাহেবদের মুসলমানির ফখরের কাছে টেকা দায়। কিন্তু তাঁদের আজ যদি বলি যে, ইসলামের অর্থ আত্মসমর্পণ আল্লাহতায়ালায় সেই গরম আত্মসমর্পণ কার হয়েছে? আল্লাহে পূর্ণ আত্মসমর্পণ- যার হয়েছে তিনি এই দুনিয়াকে এই মুহূর্তে ফেরদৌসে পরিণত করতে পারেন। আমরা কথায় কথায় অন্য ধর্মাবলম্বী ও নিজ ধর্মের জ্ঞানবাদীদের কাফের বলে থাকি। এই কাফেরের অর্থ আবরণ, বা যা আবৃত করে রাখে। কাফের ও ইংরাজি “কভার” এক ধাতু থেকে উৎপন্ন কিনা ভাষা-তত্ত্ববিদরা বলবেন। আল্লাহ ও আমার মাঝে যতক্ষণ আবরণ রইল, ততক্ষণ আমি কাফের, অর্থাৎ আমার পরম তত্ত্ব, আমার শক্তি ও সত্য ততক্ষণ আবৃত। এমন একজন মুসলমানেরও যদি বাঙলায় কেন, সারা দুনিয়ায় সন্ধান পান- আমি তাঁর কাছে মুরিদ হতে রাজি আছি। আমার মধ্যে যতক্ষণ আবরণ অর্থাৎ ভেদাভেদ-জ্ঞান, সংস্কার, কোন প্রকার বাধা বন্ধন আছে ততক্ষণ আমার মাঝে “কুফর ও আছে। আমি সর্ববন্ধন-মুক্ত, সংস্কার-মুক্ত সর্বভেদাভেদ জ্ঞানমুক্ত না হলে- সেই পরম নিবারণ পরম মুক্ত আল্লাহকে পাব না আমার শক্তিতে। শক্তিমান পুরুষই কওমের, জাতির, দেশের, বিশ্বের ইমাম হন- অধিনায়ক হন। অন্য দিক যাঁকে ধরতে পারেনি, সেই পরম দিগম্বরের করুণা পাবে এই সব দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য লোভীর দল? যে জাতির পবিত্র কোরানের প্রথম শিক্ষা- “আলহামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামিন। ” – সমস্ত প্রশংসা মহিমা যশঃখ্যাতি আল্লাহর প্রাপ্য, আমার নয়- সেই আয়েত দিনে শতবার উচ্চারণ করেও যারা ভোগের পাকে পড়ে রইলেন কর্দম-বিলাসী মহিষের মত তাঁরা আর যাই হন আল্লাহর ও তাঁর রসূলের কৃপা পাননি। আল্লাহর কৃপাপ্রাপ্ত একজন মুসলমানই যথেষ্ট, sixty percent তিনি গণনা করেন না। নিত্য-আজাদ মুসলমানকে তিনি গোলামখানায় নিয়ে যান না। যারা অনাগত “বদর” “ওহোদের” যুদ্ধে বীর শহীদান হতে পারত- জাতির দেশের সেই শ্রেষ্ঠ শক্তিমান সন্তানদের তিনি কশাই-খানায় পাঠান না। যে দৃষ্টি আপাত-মধুর লভ্যের লোভে তলোয়ারকে করে ঝিঙে চাঁচা বঁটি, মাটি খোঁড়ার খোন্তা সে দূরদর্শী দ্রষ্টা নয়। অন্যের মাল পয়মাল করে নিজে ধনী হওয়ার গুপ্ত লোভ তার অন্তরে জটিল সাপের মত ফণা গুটিয়ে আছে। তার মাথায় মণি থাকলেও সে বিষধর ফণী। তাকে এড়িয়ে চলতে হবে। যে তরুণের বাজুতে শোভা পেত এম আজমের তাবিজ, সেই হাতে বাঁধা আজ ভোট ভিক্ষার ঝুলি। যে কণ্ঠের তকবির ধ্বনি আল্লাহর আরশ কাঁপিয়ে তুলতে পারে, সেই কণ্ঠ আজ নেতার জয়ধ্বনিতে হল কলঙ্কিত। হে তরুণ! তোমরা কি যাবে ঐ লোভের পথে ঐ গোলামির কশাইখানায়? আজ চাকুরি-লোভী বাঙালি হিন্দু-জাতির দুর্দশা দেখ। চাকুরি যদি এরা গ্রহণ না করত, তা হলে এই বাঙালি অসাধ্য সাধন করতে পারত। যে লোকগুলো এক-পেট-পিলে আর এক পিঠ অপমান নিয়ে মরল- (মরতে তাদের হলই কিংবা যারা বাচল তারা হয়ে রইল মরারও বাড়া) তারা না হয় দুদিন আগেই মরত। মরে স্বাধীনতা আনলে তাদের বাপ-মা-ছেলে-মেয়ে আরও ঐশ্বর্য পেত, যশ পেত সম্মান পেত। তাদের ভালো খোরাক পোশাকের ব্যবস্থা স্বাধীন ভারত করত। যে কয়টা মৃত্যু-বিলাসী- হাঁ, মৃত্যু ওদের আনন্দ-বিলাস ছিল বৈ কি বাঙালি ছেলের মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পাঞ্জা কমল সেই নাম-না-জানা শহীদদের প্রসাদে দেশে যতটুকু এল স্বায়ত্তশাসন- তারই ছিবড়ে নিয়ে আজ আমরা কামড়া-কামড়ি করছি। আজ মুসলমান ছেলেরা সেই আত্মত্যাগীদের আত্মার কাছে শির উঁচু করে দাঁড়াতে পারে? জেহাদের পথে শহীদানদের মৃত্যুসঙ্কুল পথে এগিয়ে যেতে পারি? আমি গেয়েছি এই শহীদদেরই জয়গাথা। তাদেরই জন্য আজও আমি লুকিয়ে কাঁদি । আল্লাহর রহমত পেয়েইও তাদেরে কথা- তাদের ত্যাগ মনে পড়লে আমি শিশুর মত চিৎকার করে কাঁদি। যে নিত্য-শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছি, সেই শাস্তির অটল আসন আমার টলতে থাকে।

আমি জানি, তোমাদের মাঝে বহু তরুণ আছে যাদের রূহ, আত্মা জাগ্রত। যারা বাইরের সমান, লোভ, খ্যাতি সব কিছু বিসর্জন দিয়ে রাহে লিল্লাহ আপনাকে সদকা দিতে রাজি আছেন- আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা করি- তাঁরা কি গ্রহণ করবেন দুনিয়ার এই ক্ষণিক ভোগের পথ? তাঁরা কি গ্রহণ করবেন না এই মহামন্ত্র- “ইন্না সালাতি ও নুসুকি ওয়া মাইয়্যায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহে রাব্বিল আলামিন” – “আমার সব প্রার্থনা, নামাজ, রোজা তপস্যা জীবন-মরণ সব কিছু বিশ্বের একমাত্র পরম প্রভু আল্লাহর পবিত্র নামে নিবেদিত।” যে সংসারের সুখের জন্য তুমি আজ এত লালায়িত, তুমি কি বলতে পার, এই সভা হতে বাড়ি যাওয়ার আগেই তোমার যে লালসা চিরকালের জন্য ফুরিয়ে যাবে না? তোমার বাপ-মা ছেলে-মেয়ে ভাই বোনের জন্য তুমি চিন্তা করে তাদের কি দুঃখ-দারিদ্র্যমুক্ত করতে পেরেছ বা পার? তুমি কি জান, তোমার জন্মেও যেমন তোমার হাত নেই- তোমার বা তোমার আত্মীয়ের মৃত্যুতেও তেমনি তোমার কোন হাত নেই। যে কোন মুহূর্তে তোমার পিতা-মাতার সাধ-আশাকে মৃত্যু তার স্থূল হাত দিয়ে মুছে ফেলতে পারে। তুমি কি জান, তোমার বা তোমার পিতামাতার ভার তোমার হাতে নেই- এই ভার একমাত্র যাঁর হাতে সেই আল্লাহর শক্তিতে নির্ভর কর তাঁর পরমাশ্রয়ে তোমার আত্মীয়-স্বজনকে সমর্পণ করে রাহে লিল্লাহে আত্মনিবেদন কর। আমি আল্লাহর পবিত্র নাম নিয়ে বলছি- এই আত্মনিবেদনেই তুমি তোমার আত্মীয়দের অভাবগ্রস্ত অবস্থা থেকে মুক্ত করতে পারবে। বিশ্বাস কর আল্লাহ আল-গনি, তাঁর কোন অভাব নেই নিত্য পূর্ণ যে তাঁকে ডেকে তিনি তার সমস্ত অভাব দূরে করেন, তাকে পরম কল্যাণের পথে হাত ধরে নিয়ে যান। বিশ্বাস কর- তাতে আত্ম নিবেদন করলে তুমি বাদশাহর বাদশাহ যিনি তাঁর পরম করুণা প্রাপ্ত হবে। যে অদৃশ্য শক্তি হাতের পুতুল আমরা সেই অনন্ত অপরিমাণ শক্তি যে উৎস হতে নিয়ত উৎসারিত হচ্ছে- সেইখানে খোঁজ পরম ঐশ্বর্যের সন্ধান। গোলামখানায় কতলগাহে সে ঐশ্বর্যের এক কণাও নাই।

লিডারের কাছে শক্তি ভিক্ষা করো না- আল্লাহ এতে নারাজ হন- শক্তি ভিক্ষা করো একমাত্র আল্লাহর কাছে। জয়ধ্বনি মহিমা কীর্তন করো একমাত্র আল্লাহর। বন্ধু। আমি জানি, তোমাদের অনেকেরই পানে চেয়ে আছে সেই অগ্রপথিকের নিশান তুলে জয়যাত্রার পথে চলতে। আল্লাহ জানেন, আমি আত্মপ্রতারণা করি নাই, আমি তাঁর বিষাণ বাজানোর আদেশ পেয়েছি, নিশান ধরার হুকুম পাইনি। তবে পঙ্গু যার কৃপায় গিরি লঙ্ঘন করে- যার করুণায় জন্মঅন্ধের চক্ষে সাত আসমানের দ্বার খুলে যায় তার কৃপা যদি পাচ্ছ, তার আদেশ যদি আসে আমি আপনাদের বিনা আহ্বানে এসে ডাকব…..

ভেঙেছে দুয়ার জেগেছে জোয়ার রেঙেছে পূর্বাচল,
খুলে গেছে দেখ দুর্গতি-ভরা দুর্গের অর্গল।
মৃত্যুর মাঝে অমৃত যিনি- এনেছে তাঁহার বাণী,
পেয়েছি তাঁহার পরমাশ্রয়, আর ভয় নাহি মানি।
সকল ভয়ের মাঝে রাজে যাঁর পরম অভয় কোল,
সেই কোলে যেতে আয় রে, কে দিবি মরণ-দোলাতে দোল!

[১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর (১৩৪৭ সালের ৭ই পৌষ) রোববার কোলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে কোলকাতা মুসলিম ছাত্র সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে কাজী নজরুল ইসলামের ভাষণ।

→ বাংলা একাডেমী প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী ৪র্থ খণ্ড থেকে সংকলিত

১১৯৪ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top