শ্রীযুক্ত সুকুমার সেনের নাম বাংলা সাহিত্যে বিশেষতঃ ঐতিহাসিক সাহিত্যে সুপরিচিত। বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে ইতিহাস লিখিয়া তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন। তাহার পাণ্ডিত্য ও বিদ্যাবত্তা নিঃসন্দেহে অতি উচ্চদরের। তিনি অকুতোভয়, সত্য মিথ্যা যাহাই লিখুন, তজ্জন্য কাহারও কোন পরোয়া করেন না। তাহার বিদ্যার এমনই জোর যে, সমালোচকের ভ্রুকুটিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট প্রদর্শন করিয়া তাহার কলম সমান বেগেই চলিতে থাকে। যাহাদের ধর্ম্মে সত্যকে বসুমতীর সহিত ওজনে বেশী ভারী করা হইয়াছে, সেই সত্যের প্রতি তাহার কণামাত্র শ্রদ্ধা নাই। পাঠকগণ আমার এরূপ প্রত্যেক কথার প্রমাণ পাইবেন তাঁহার বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে এবং তাহার সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ইসলামী বাঙ্গালা সাহিত্য’ নামক গ্রন্থে। দৃষ্টান্ত দিয়া বলিতে গেলে প্রবন্ধ-কলেবর অত্যন্ত বড় হইবে। তাই আজ কেবল শেষোক্ত গ্রন্থ সম্বন্ধেই কয়েকটি কথা বলিব।
পাকিস্তানের কোন পত্রিকা দেখা সুকুমার বাবুর পক্ষে সম্ভব না হইতে পারে মনে করিয়া এই প্রবন্ধকৃত বিষয়টি কলিকাতার ‘শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত করিয়া তাহার নিকট তাঁহার ঐরূপ লেখার প্রমাণ জানিতে চাহিয়াছিলাম। পাঠকগণ দেখিবেন তাঁহার প্রমাণ দেওয়ার কোন উপায়ই নাই। তাই কোন কথা না বলিয়া তিনি কাপুরুষের মত মুখ লুকাইয়া আছেন।
– লেখক
তিনি গ্রন্থ লিখিয়াছেন ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্য’ সম্বন্ধে কিন্তু গ্রন্থের নাম দিয়াছেন ‘ইসলামী বাংলা সাহিত্য’। প্রথমতঃ ইসলাম একটি ধর্ম্মের নাম। যারা ইসলাম ধর্ম মানিয়া চলে তাদের বলা হয় ‘মুসলমান’। ‘ইসলামী বাংলা সাহিত্য বলিলে তার অর্থ দাড়ায় “ইসলাম ধৰ্ম্ম বিষয়ক সাহিত্য। অবশ্য মুসলমানেরাও অনেক সময় ইসলাম শব্দের অপপ্রয়োগ করে। মুসলমান সম্পর্কিত সবকিছু ‘মুসলিম এবং ঐ ধর্ম সম্পর্ক সবকিছু ইসলামিক।
দ্বিতীয়তঃ মুসলমান রচিত সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্য এবং তাহা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অবশ্য আলোচ্য বিষয় এবং অপরিহার্য অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তজ্জন্য পৃথক নামে গ্রন্থ রচনায় স্বভাবতঃই মনে হয়, -চণ্ডালোশ্বপচানান্তু বহির্গ্রামাৎ প্রতিশ্রয় ইত্যাদি নীতিই যেন প্রয়োগ করা হইয়াছে। ইহাতে ডাক্তার সুকুমার সেনের মনোভাবের প্রতি মুসলমানের মনে অশ্রদ্ধার ভাব জন্মিবার যথেষ্ট কারণ থাকিলেও তৎপ্রতি ভ্রুক্ষেপ করিবার লোক তিনি নহেন। এমনই নিৰ্ভীক তিনি। আলোচনা-যোগ্য বহু মুসলমান কবি থাকা সত্ত্বেও তিনি মাত্র কয়েকজনের কথা আলোচনা করিয়াছেন। এসব আলোচনায় তিনি মুসলমানদিগকে যুগপৎ পিঠ থাবড়ানি ও কানমলা দিয়া ক্ষান্ত হইয়াছেন। ন্যায়সঙ্গত যুক্তিতর্ক অগ্রাহ্য করিয়া তিনি অনেক কবির আবির্ভাবকাল সম্বন্ধেও তাঁহার অযৌক্তিক মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করিয়াছেন। তাহার গ্রন্থের এতদধিক সমালোচনা আজ আমার উদ্দেশ্য নহে।
পাঠকগণকে একথা বলিয়া দেওয়া বোধহয় অনাবশ্যক যে, সত্যের সন্ধান ও উদ্ধারই ঐতিহাসিকের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ও একমাত্র ভূষণ। সুকুমার বাবু সেরূপ একজন সত্যসন্ধানী ঐতিহাসিক হইয়া কিভাবে সত্যের মস্তকে পদাঘাত করিয়া সত্য-লেশ শূন্য কথা প্রচার করিতে সঙ্কোচ বোধ করেন নাই, এ স্থলে আমি তাহারই দুইটি দৃষ্টান্ত পাঠকগণের সম্মুখে উপস্থিত করিতেছি।
প্রথম দৃষ্টান্ত – তদীয় গ্রন্থের ৩০ পৃষ্ঠায় লিখিত হইয়াছে, “পুত্রকে (আলাওলকে) হাম্মাদরা কন্দী কারে রোসাঙ্গে নিয়ে এসে রাজার ফৌজে বিক্রি করলে”।
উদ্ধৃত কথাগুলিতে যে সত্যের লেশমাত্র নাই তাহা স্বয়ং আলাওলের উক্তিই প্রমাণ করিবে। যথা :
“কার্য্যগতি যাইতে পন্থে বিধির ঘঠন।
হাম্মাদের নৌকা সঙ্গে হইল দরশন।
বহু যুদ্ধ আছিল সহিদ হৈল তাত।
রণক্ষতে ভোগ যোগে আইলুম এখাত ।
কহিতে বহুল কথা দুঃখ আপনার।
রোসাঙ্গে আসিয়া হৈলুম রাজ আসোয়ার।”
(পদ্মাবতী)
“কাৰ্য্য হেতু পন্থ ক্রমে আছে কৰ্ম্ম-লেখা।
দুষ্ট হাম্মাদ সঙ্গে হই গেল দেখা
বহু যুদ্ধ করিয়া সহিদ হৈল বাপ
রণক্ষতে রোসাঙ্গে আইলুম মহাপাপ ৷৷
না পাইলুম সহিদ পদ আছে আয়ু শেষ।
রাজ আসোয়ার হৈলুম আসি এই দেশ৷৷’ (সেকান্দরনামা)
“কাৰ্য্য হেতু পন্থে যাইতে নৌকার গমণে।
দৈবগতি হৈল দেখা হাম্মাদের সনে।।
বহু যুদ্ধ করিয়া সহিদ হৈল পিতা।
রণক্ষতে ভাগ্যবলে আমি আইলুং এথা ॥
কতেক আপনা দুঃখ কহিনু প্রকাশি।
রাজ আসওয়ার হৈলুং রোসাঙ্গেত আসি।’
(লোর-চন্দ্রানী)
আলাওল তো বলিয়াছেন, হাম্মাদের সঙ্গে যুদ্ধে পিতাকে হারাইয়া নিজে রণক্ষত হইয়া তিনি রোসাঙ্গে গমন করেন এবং রাজার আসোয়ার হন। সুকুমারবাবু উল্লিখিত রূপ অদ্ভুত সন্দেশ কোথায় পাইলেন?
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত-
তাঁহার গ্রন্থের ৩১ পৃষ্ঠায় তিনি লিখিয়াছেন ‘রাজ্যার্থ ভাগিনী ভগিনীর পালিতপুত্র রাজকুমার মাগন ঠাকুরের অনুরোধে…।
সুকুমার বাবু একজন অগাধ-বিদ্যা বিদ্বান ও পণ্ডিত বলিয়া দেশে মশহুর। তিনি আলাওলের গ্রন্থগুলি কখনও পড়িবার অবসর পান নাই। তথাপি আলাগুলের কথা লিখিয়া বিদ্যা ও পাণ্ডিত্য জাহির করিবার তাহার এত শখ কেন, কি জানি। উপরের কথাগুলিতে তাঁহার যে অজ্ঞতা সূচিত হইয়াছে, তাহা অত্যন্ত শোচনীয় ও লজ্জাজনক। যে বিষয়ে যাহার পূর্ণ জ্ঞান নাই, সে বিষয়ে বিদ্যা জাহিরের চেষ্টা করিয়া লোকের উপহাস্যস্পদ হওয়া অপেক্ষা নীরব থাকাই বুদ্ধিমানের কার্য্য।
প্রাগুদ্ধৃত বাক্যে একটি কথাও সত্য নাই। এখানে প্রকৃত কথা কি। নিম্নে তা বলিতেছি। আলাওল লিখিয়াছেন,-
“ছিলিম শাহার বংশ৷ যদ্যপি হইল ধ্বংস
নৃপগিরি হইল রাজ্য পাল।
****
এক পুত্র এক কন্যা সংসারেতে ধন্য ধন্যা
জনমিল নৃপতি সম্ভব।
চলিতে ত্রিদিব স্থান পুত্রে কৈলা রাজ্য দান
যারে দেখি লজ্জিত বাসব।
*
ছাদ উমদোর নাম রূপে গুণে অনুপাম
মহাবুদ্ধি ভাগ্য অতিরেক।”
(পদ্মাবতী)
অর্থাৎ আরাকান রাজা সলিম শাহ (Meng Radzaggy) ১৫৯১-১৬১২ খৃঃ অঃ পর্যন্ত রাজত্ব করিবার পর তৎ-পুত্র Meng- Kha Moung ১৬১২-১৬২২ খ্রীঃ অব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তারপর তৎপুত্র থিরিপু-ধৰ্ম্মা (Thirithu Dharma) ১৬২২-১৬৩৮ খ্রী:অ: পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তৎপর তৎপুত্র Meng Tsani (মেঙ্গ সানি) মাত্র ২৮ দিন রাজত্ব করিবার পর এই বংশ বিলুপ্ত হয়। অতঃপর রাজা থা-সা-টার (Thatsa-ta ১৫২৫-৩১ খ্রী: অ:) প্রপৌত্র নর-বদি-গ্যি (আলাওলের ‘নৃপগিরি’) রাজা হন। তাঁহার রাজ্যকাল (১৬৩৮-৪৫ খৃঃ অঃ) তারপর তাঁহার পুত্র থা-দো-মিস্তার (আলাওলের ‘ছাদ উমদার) রাজপদে অভিষিক্ত হন। (আরাকানের ইতিহাস স্রষ্টব্য)।
দেখা যাইতেছে, রাজা নর-বাদি-গ্যির এক পুত্র ও এক কন্যা ছিল। মৃত্যুকালে তিনি পুত্রকে রাজ্য দিয়া যান এবং কন্যাকে রোসাঙ্গের অধিবাসী মাগন নামক ছিদ্দিক বংশজাত এক মহাশয় মোছলমানের হাতে (অভিভাবকত্বে) রাখিয়া যান। পরে সেই কন্যা তাহার ভাই উক্ত পুত্রের সঙ্গে পরিণীতা হইয়া মুখ্য পাটেশ্বরী হন ( মঘ রাজাদের মধ্যে সহোদরা ভগ্নীকে বিবাহ করার প্রথা প্রচলিত ছিল )। সুতরাং মাগন সেই কন্যার পালিত পুত্র না হইয়া বরং তাহার অভিভাবক ছিলেন। সেই কন্যা পাটরাণী হইয়া মাগনকে প্রধান আমাত্যপদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। এস্থলে আলাওলের লেখা দেখিলেই পাঠকেরা সকল কথা স্পষ্টরূপে বুঝিতে পারিবেন।
“যখান আছিল বৃদ্ধ নির্ণ অধিকারী।
যশস্বিনী রাজ-গৃহে আছিল কুমারী।।
পরম সুন্দরী কন্যা অতি সুচরিতা।
বহু স্নেহে নৃপতি পোষিল নিম্ন সুতা।।
বহু ধন-রত্ন দিলা বহুল ভাণ্ডার।
বহুল কিঙ্কর দিলা বহু অলংকার ।
কন্যার শৈশব দেখি ভাবে নরনাথ।
এতেক সম্পদ সমর্পিমু কার হাত।
এক মহাপুরুষ আছিল সেই দেশে।
মহাসত্ত্ব মোছলমান ছিদ্দিকের বংশে।
নানাগুণ পারগ মহত কুলশীল।
তাহাকে আনিয়া রাজা কন্যা সমৰ্পিল ।
বৃদ্ধ নরপতি যদি গেল স্বর্গপুরী।
সেই কন্যাবর হইল মুখ্য পাটেশ্বরী।
শৈশবের পাত্র দেখি বহুস্নেহে ভাবি।
মুখ্য আমাত্য করি রাখিলা মহাদেবী।”
(পদ্মাবতী)
অর্থাৎ বৃদ্ধ নির্ণ অধিকারী (রাজা নরবদিগ্যি)। নিজ শিশুকন্যাকে অতি আদর যত্নে লালনপালন করেন। তাহাকে বহু ধনরত্ন, বহু কিঙ্কর, বহু অলঙ্কার দিয়াছিলেন। এ সব ধনরত্ন আর শিশুকন্যাকে মৃত্যুকালে কাহার হাতে সমর্পণ করিয়া যাইবেন, তজ্জন্য রাজা বড় চিন্তান্বিত ছিলেন। সেই দেশে মাগন নামে ছিদ্দিক বংশ-জাত এক মহা গুণশালী মুসলমান ছিলেন। রাজা তাঁহাকে আনিয়া তাঁহার হস্তে কন্যাকে সমর্পণ করিলেন। রাজার মৃত্যুর পর সেই কন্যা মুখ্য পাটেশ্বরী হইলেন। মুখ্য পাটরাণী হইয়া তিনি মাগনকে প্রধান আমাত্য পদে বরণ করিলেন।
ডক্টর-ঔপাধিক সুকুমার বাবু কেমন সত্য সন্ধানী ঐতিহাসিক ও গবেষণাকারী, পাঠকগণকে দেখাইলাম। আলাওলের ‘পদ্মাবতী খানি একটু খুলিয়া দেখিলে তিনি মাগনকে ‘রাজকুমার’ বলিয়া লিখিয়া গবেষণার ও বিজ্ঞতার চূড়ান্ত প্রদর্শন করিতেন না। তিনি বোধহয় আলাওলের ভাষার মর্ম্মও বুঝেন না, তাই মাগনকে ভগিনীর পালিত পুত্র বলিয়াছেন।
বড়ই দুঃখের কথা যে, এত বড় জ্ঞানী ও পণ্ডিত লোক হইয়া তিনি অর্থলোভে এরূপ অনৃতবাদ-কলঙ্কিত গ্রন্থ লিখিয়া লোকের মনে কুসংস্কার সৃষ্টি করিতেছেন ইসলামের চক্ষে অত্যন্ত দোষাবহ ও সর্ববস্থা বৰ্জ্জনীয়।
দিলরুবা
মাঘ ১৩৫৯