ইসলামী সভ্যতায় কৃষি ও খাদ্য :
ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি রচিত হওয়ার পর তৎকালীন দুনিয়ায় যে শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, আল্লাহর রাসূল (স.) তার বিপরীতে নতুন এক ব্যবস্থার প্রস্তাবনা পেশ করেন। অর্থনৈতির মূলনীতিকে গোটা জাতির সামনে তুলে ধরেন এবং তা বাস্তবায়নে যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় একাধিক মূলনীতি বাস্তবায়ন করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর সাহাবিগণ এ ধারা অব্যাহত রাখেন। ফলস্বরূপ তৎকালীন সমাজের দারিদ্র্যতা, অর্থনৈতিক সংকট দূরীভূত হয়ে এমন একটি সভ্যতার সূচনা হয়, যেখানে দারিদ্র্যতা, খাদ্য সংকট, বেকারত্বের মত সমস্যাগুলো ছিল অনুপস্থিত। যার দৃষ্টান্ত আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই। রাসূল (স.) এবং আবু বকর (রা.) এর যামানা পার হয়ে উমর (রা.) এর শাসনামলের শেষ দিকে আরবের সাড়ে ৩৮ লক্ষ বর্গমাইল অঞ্চলে যাকাত নেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না!
ইসলামী সভ্যতার সময়কালে অর্থনীতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এ বিষয়ে মুফাসসিরগণ, ইতিহাসবিদ এবং বিজ্ঞানীগণ স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। কারণ, কোরআন-হাদীসসহ ইসলামী শাস্ত্রগুলোতে আলেমগণ এ বিষয়ে বেশ গুরুত্বারোপ করেছেন। ইমাম কুরতুবী বলেনঃ
“সমৃদ্ধির জন্য কৃষিকাজ আবশ্যক। ইসলামী রাষ্ট্রে খাদ্যের পর্যাপ্ততা অর্জনের আগ পর্যন্ত চাষাবাদ, রোপণ, ও জমি আবাদের কাজ অবিরাম চালিয়ে যেতে হবে।”
খাদ্যের সমৃদ্ধি যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা উপোরোক্ত উক্তিতেই বুঝা যায়। ইমাম কুরতুবী একে রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করেছেন। কারণ, জনগণের সমৃদ্ধি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সত্যিকারের স্থায়ী উন্নয়ন, সুস্থ সবল জাতি, সর্বোপরি আখলাকসম্পন্ন শক্তিশালী উম্মাহ গঠনে কৃষি ও খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
খোলাফায়ে রাশেদার আমল থেকে শুরু করে প্রত্যেক যুগেই কৃষিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমনঃ হযরত উমর (রা.) অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। অর্থনীতির ভিত্তি নির্মাণের জন্য তিনি যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল কৃষি। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর পরই কৃষকদের সাথে বৈঠক করেন। কৃষি সংশ্লিষ্ট যাবতীয় সমস্যা, খাদ্য উৎপাদনের দিকে জোর দেয়া, খাদ্য সংকট মোকাবিলা প্রভৃতি কাজের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। উমর (রা.) এক্ষেত্রে ভূমিব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। তিনি ভূমির ৩টি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন-
- ১. ভূমি মানবজাতির জন্য সর্বাধিক প্রয়োজনীয় এবং মানুষের সকল চাহিদা পূরণ করে।
- ২. ভূমির পরিমাণ সীমিত।
- ৩. ভূমি স্থায়ী।
উমর (রা.) নেতত্বের আসনে সমাসীন হওয়ার পরপরই মুসলিমদের সামনে কৃষি সংক্রান্ত দুটি মৌলিক সমস্যা এসে হাজির হয়।
এক. ক্রমবর্ধমান ইসলামী অঞ্চলগুলোর খাদ্যচাহিদা মেটানো।
দুই. ভূমিব্যবস্থাকে এমনভাবে সুবিন্যাস করা যাতে মধ্যস্বত্বভোগী কোনো শ্রেণির উদ্ভব না ঘটে।
এই দুটি লক্ষকে সামনে রেখে উমর (রা.) যুগান্তরী সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিজিত ভূমি নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে না দিয়ে কৃষকদের মাঝে সমভাবে বন্টন করেন। যার ফলে রাষ্ট্রীয় উৎপাদন বহুগুণে বেড়ে যায়। রোমান এবং পারস্যের সামন্ততান্ত্রিক কিংবা রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে উমর (রা.) নতুন ধারা তৈরি করেন। অনুপস্থিত ভূমি মালিকানার বিলোপ সাধন করে বিশ্ববসীর জন্য একটি মডেল উপস্থাপন করেন। তিনি অনাবাদি জমিকে চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ভূমিহীনদেরকে ভূমির মালিকানা প্রদান করেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষকদের বিশেষ পুঁজি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং ঘোষণা দেন, রাষ্ট্র কতৃক প্রদেয় এ পুঁজি রাষ্ট্রকে আর ফেরত দিতে হবে না। উৎপাদিত ফসলের ৫০% কৃষকরা নিজের জন্য রাখবে বাকি ৫০% রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিবে। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের কল্যাাণে নিয়োজিত কৃষকদের জন্য এটি ছিল বড় একটি পাওয়া। যুগান্তকারী এই পদক্ষেপের ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে রাষ্ট্রের আওতাধীন সব অনাবাদি জমি আবাদি জমিতে পরিণত হয়। উন্নয়নের চালিকাশক্তি কৃষকদের নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখা, রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা সাহায্য-সহযোগিতাসহ নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। গনিমতের মাল আসার পর তিনি তার সবটুকু যোদ্ধাদের মধ্যে বন্টন না করে সে সময়ের সবচেয়ে বড় চাহিদা কৃষির উন্নয়নের জন্য ব্যয় করেন। এক্ষেত্রে নানাবিধ চিন্তাগত ও সিদ্ধান্তগত জটিলতা তৈরি হলেও তিনি তার ইজতেহাদি সিদ্ধান্তের আলোকে কৃষির উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে এর অনুকূল সিদ্ধান্ত প্রদান করেন এবং তা বাস্তবায়ন করেন। পরবর্তী সময়ে দেখা যায় তাঁর এ পদক্ষেপ ছিল সময়ের সেরা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত।
কৃষিব্যবস্থার সামগ্রীক উন্নয়নের লক্ষ্যে এগ্রিকালাচারাল টেকনোলজি অর্থাৎ, তৎকালীন সময়ের সবথেকে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দেন। সেচ প্রকল্প, ড্রেনেজ সিস্টেম প্রবর্তনসহ নানাবিধ উদ্যোগ করে বিদ্যমান কৃষির ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। উন্নয়ন চালিকা শক্তির মূল উপাদান কৃষক ও কৃষির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফরমান জারি করেন।
ইমাম আবু ইউসুফের কিতাবুল খারাজ-এর একটি ঘটনা এখানে প্রাণিধানযোগ্য। ‘একবার মুসলিম সেনাবাহিনী ভুলক্রমে এক ব্যক্তির ফসলী ক্ষেত মাড়ালে উমর (রা.) ক্ষতির শিকার কৃষককে তাৎক্ষণিকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করেন।’ দুর্ভিক্ষ কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য নিশ্চিত করেন। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ফলে রাষ্ট্রীয় উৎপাদন তার লক্ষমাত্রা অতিক্রম করে।
উৎপাদন বাড়াতে স্বতন্ত্র সেচ প্রকল্প চালু করা হয়। আল্লামা শিবলী নোমানী তাঁর আল ফারুক গ্রন্থে লিখেছেনঃ
“সমগ্র দেশে খাল খনন, বাঁধ নির্মান পুকুর খনন, প্রয়োজনীয় স্থানে পানির ব্যবস্থা করার জন্য হযরত ওমর পৃথক এক বিভাগ (Department) প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লামা মাকরিযী লিখেছেন শুধুমাত্র মিসরেই এ কাজের জন্য দীর্ঘ কয়েক বছর ব্যাপী এক লক্ষ বিশ হাজার শ্রমিক এই কাজে নিযুক্ত ছিল। এর যাবতীয় খরচ বাইতুলমাল তহবিল থেকে বহন করা হতো। খেযিস্তান এবং আহওয়াজ এলাকায় জাযর ইবন মুয়াবিয়া হযরত উমরের অনুমতিক্রমে অনেক খাল খনন করে বহু পতিত জমি আবাদ উপযোগী করেছিলেন। এভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অনেক খাল খনন করা হয়েছিল বলে বড় বড় ইতিহাসবিদ্গণ উল্লেখ করেছেন।” (আল ফারুক, পৃ-১৪২)
উসমান (রা.) খিলাফতে অধিষ্টিত হয়ে পূর্ববর্তী কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। হযরত আলীও (রা.) এই ধারাকে অব্যাহত রাখেন। তিনি সব অঞ্চলে কৃষি এবং খাদ্যনীতির গুরুত্ব বজায় রাখতে শাহী ফরমান জারি করেন। মিশরের গভর্নর মুসা আল-আশআরীর কাছে পাঠানো এক চিঠির শুরুটা তিনি এভাবে করেছিলেন, “হে মুসা আল-আশআর! উৎপাদন বৃদ্ধি কর এবং উৎপাদিত ফসলর সুষম বন্টন নিশ্চিত কর।” স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, খোলাফায়ে রাশেদার আমলে কৃষিকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির ভিত কীভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল।
কৃষিকে মুসলিমরা উন্নতির কোন শিখরে নিয়ে গিয়ে ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রখ্যাত এক সভ্যতার ইতিহাস বিশেষজ্ঞের নিম্নোক্ত উক্তিতে- “আমি কখনোই শুনিনি, মুসলিমরা তাদের স্থায়ী আবাসস্থলে অন্যান্য অঞ্চল থেকে খাদ্য আমদানি করেছে। এর পরিবর্তে তারা নিজেরা কীভাবে সার প্রস্তুত করতে হয়, মাটির গঠন, চাষ পদ্ধতি, রোপণ, সেচ ব্যবস্থা ইত্যাদির উপর তারা স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করে।” (The Back of Islam, ২য় খন্ড, ড. মোহাম্মদ আমীন)
যেসব অঞ্চল কৃষিকে কেন্দ্র করে উন্নয়নের ভিত রচনা করেছিল তার মধ্যে অন্যতম আন্দালুসিয়ার মুসলিম সালতানাত বা ইসলামী খেলাফত। তৎকালীন সময়ে মুসলিম বিজ্ঞানীরাই সর্বপ্রথম কৃষির এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করে। আজকে আমরা যে লেবু, মালটা, কমলা, বাদামসহ গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিদায়ক ফল দেখতে পাই, সেসবের বীজ মুসলমানদের হাত ধরেই বাণিজ্যিক রোপন শুরু হয়। তারা নতুন নতুন বীজের আবিষ্কার করে। পৃথিবীর ইতিহাসে আজও আন্দালুসিয়ার কৃষি বিশ্ব কৃষিব্যবস্থার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। খলীফা আব্দুর রহমান প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার কৃষকদের সাথে মতবিনিময় করতেন। ইসলামী সভ্যতার সময়কালে স্পেনের কৃষি কোন অবস্থায় ছিল জানতে উইল ডুরান্টের নিম্নোক্ত উক্তিটিই যথেষ্ট। তিনি লিখেছেনঃ
“কয়েকশত কৃষিজাত পণ্য যেমনঃ শস্য, সবজি, ফলমূল, বাদাম ও ফুলের চাষ করা হয়। কমলা গাছ এবং কমলার বীজ নিয়ে দশম শতাব্দীর কিছু আগে আরবরা সিরিয়া, এশিয়া মাইনর, প্যালেস্টাইন, মিশর এবং স্পেনে প্রবেশ করে। এসব দেশ থেকে কমলা দক্ষিণ ইউরোপে প্রবেশ করে। আখের আবাদ এবং চিনির পরিশোধনও আরবদের (মুসলিমদের) থেকে ক্রুসেডাদের মাধ্যমে ইউরোপীয় অঞ্চলে প্রবেশ করে। আরবদের মাধ্যমেই ইউরোপ তুলার সাথে পরিচিত হয়। রাষ্ট্র সেচব্যবস্থা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। জলাবদ্ধতা, পানি নিষ্কাশন এবং পতিত জমি আবাদ করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ সাহায্য করে। যার ফলে সেসময়ে বুখারা এবং সমরকন্দের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে পৃথিবীতে স্থাপিত স্বর্গ বলে আখ্যায়িত করা হতো।”
একইভাবে স্কটের মন্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। তিনি স্পেনে মুসলিম সালতানাতের কৃষিপদ্ধতি সম্বন্ধে বলেনঃ“…the most complex, the most perfect, the most scientific, even devised by the ingenuity of man.
মুসলিমরা বিজিত হয়ে যেসব অঞ্চলে ন্যায়ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতো এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাতো সেখানে তারা উন্নত খাদ্যনীতি এবং কৃষিকে বিশেষ গুরুত্ব দিত। যেমনঃ আন্দালুসিয়াতে যখন মুসলিমরা দেখতে পেল স্বাস্থ্যহীনতা এবং বিনা চিকিৎসায় অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন মুসলমানরা এ অঞ্চলের জলবায়ু, ভূমিসহ সামগ্রীক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে নতুন বীজ উদ্ভাবন করে এবং অঞ্চলোপযোগী খাদ্যনীতি প্রনয়ণ করে। এ ধরনের পদক্ষেপ কেবল আন্দালুসিয়াতে নয়, অন্যান্য অঞ্চলেও নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সালতানাতের উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। বাংলা অঞ্চলে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর মুসলমানরা এ অঞ্চলের খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসার সুষ্ঠু বন্দোবস্ত করতে অঞ্চল উপযোগী নানা জাতের বীজ, কলা, আমলকিসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর খাবার সর্বত্র সহজলব্য করেন। এ জাতীয় উদ্যোগের ফলে কৃষি ও খাদ্যনীতিতে বিপ্লব সাধিত হয়। উন্নত কৃষি এবং সঠিক খাদ্যনীতির অভাবে আজ আমরা ভয়ংকর যুদ্ধের সম্মুখীন। যা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় সংকট।
বাদশা আলমগীরের সময় বাংলার কৃষি সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে। মীর জুমলা (১৫৯১-১৬৬৩) এবং শায়েস্তা খাঁর (১৬৬৪-১৬৭৮, ১৬৮০-১৬৮৮) আমলে উৎপাদন ছিল সর্বোচ্চ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছিল সর্বাধিক সস্তা। টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। এ সময় বাংলা অঞ্চল অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে। ড. মোহাম্মদ মোহর আলী তাঁর History of the Muslims of Bangal (2 Vol. 5) এ নিয়ে তথ্যবহুল আলোচনা করেছেন।
সীমান্ত দিয়ে কোনো ভাবেই যেন ভেজাল মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য প্রবেশ করতে না পারে এ ব্যাপারে উমর (রা.) এর সময়কাল থেকেই কঠিন আইন প্রণয়ন করা হয় এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রতিটি অঞ্চলেই চেক পোস্ট বসানো হয়। আজকের যে শুল্ক সিস্টেম তার আবিষ্কারকও মুসলিমরাই। অর্থাৎ এ ব্যাপারে মুসলিমরা কতো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করেছে তা আমরা ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি।
বর্তমান পৃথিবীর কৃষিব্যবস্থা পুরোপুরিই জায়নবাদী-সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠির নিয়ন্ত্রনে। তারা একে কেন্দ্র করে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ বীজ, খাদ্য এবং কৃষির যুদ্ধ যা পারমাণবিক বোমার থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী। ইসলামী সভ্যতার সূচনাকালীন সময়েই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা বাকারার ২০৫ নং আয়াতে আমাদেরকে সতর্ক করে বলে দিয়েছেন,
“যখন সে শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে, পৃথিবীতে তার সমস্ত প্রচেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করে বিপর্যয় সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত ও মানব বংশ ধ্বংস করার কাজে। অথচ আল্লাহ বিপর্যয় মোটেই পছন্দ করেন না।”
এ আয়াত দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে যা বুঝাতে চাচ্ছেন তা হলো, তারা আমাদের শস্যক্ষেত্র এবং বংশ বৃদ্ধিকে থামিয়ে দিবে। আজকে সেই বিষয়টি আমরা ব্যাপক হারে লক্ষ্য করছি এবং এর ভয়াবহ ফলাফলও উপলব্ধি করছি। সূরা নিসার ১১৯ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,
“তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব, তাদেরকে আশ্বাস দিব, তাদেরকে পশুদের কর্ণ ছেদন করতে বলব, এবং তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্টির আকৃতি পরিবর্তন করার আদেশ দিব। যে কেউ আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হবে।”
এ দুটি আয়াত থেকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে, তারা আমাদের বীজ ব্যবস্থা, আমাদের বংশবৃদ্ধিকে থামিয়ে দিবে। আমাদের সৃষ্টির আকৃতিকে পরিবর্তন করে দিবে।
সুষ্ঠুভাবে বর্তমান বিশ্ব খাদ্যনীতিকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জায়নবাদীগোষ্ঠী কতৃক পরিচালিত মনোসান্তো, কারগিলের মতো কোম্পানিগুলো আমদানীকৃত বীজের মধ্যে ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে, যা ভয়াবহ রোগের সৃষ্টি করছে। তারা জেনেটিক্যালি মোডিফাই করে ঝুঁকিপূর্ণ এসব বীজ আমাদের নিকট প্রেরণ করছে। তারা নয়া কীটনাশক, সার সিস্টেম তৈরি করে কৃষি সেক্টরকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে এসেছে যে, সার এবং কীটনাশক ছাড়া খাদ্য উৎপাদন কল্পনাও করা যায় না। জমিতে সার এবং কীটনাশক প্রয়োগের ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। উৎপাদিত খাবার খেয়ে মানবদেহে নানা রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত ঔষধের কাঁচামালও তারা সরবরাহ করছে। এবং তাদের নিয়ন্ত্রনাধীন বড় বড় ঔষধ কোম্পানি গড়ে ওঠেছে। নিজেরা কৃত্রিম রোগ সৃষ্টি করে আবার নিজেরই সে রোগের ঔষধ সরবরাহ করে। মানবরূপী নিকৃষ্ট এ পশুগুলো মানবজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ সেক্টর ‘কৃষিব্যবস্থা’কে নিরব গণহত্যার মোক্ষম হাতিয়রে পরিনত হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদীদের হীন এ কাজের বিপরীতে ইসলাম খাদ্যনীতি এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়কে কতটা আদালত এবং ইনসাফের দৃষ্টিতে বিবেচনা করেছে তা নিচের ছোট একটি উদাহরণেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। আমাদের নবী রহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মোহাম্মদ (স.) এক বেদুইনকে একটি গর্ভবতী উটনীর লালন-পালনের দায়িত্ব প্রদানকালে বলেন, “নিজ হাতের নখ ছোট করে রাখবে, যেন উটের দুধ দোহনকালে নখ বড় থাকার কারণে উটনী কষ্ট না পায়।” অত্যন্ত দুখ এবং পরিতাপের বিষয় হলো আজকালকার ডেইরি ফার্মগুলো ইনজেকশনের মাধ্যমে গর্ভধারণ এবং গর্ভপাত করছে। স্তনে মেশিন লাগিয়ে বল প্রয়োগে দুধ দোহন করছে। এ জাতীয় কাজগুলো কি আদৌ মানবতার জন্য, কৃষির জন্য কিংবা খাদ্যনীতির জন্য কল্যণ বয়ে আনতে পারে?
ইসলাম সব বিষয়ে আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা উপলব্ধি করতে না পারার কারণে সত্য ও সঠিক পথ হারিয়ে ভয়াবহ এক পরিণতির দিকে প্রতিনিয়ত ধাবিত হচ্ছি। এ থেকে উত্তরণের জন্য ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। পাশাপাশি বর্তমান সময়ে আমাদের যে সার্বিক অবস্থা সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। কেননা, অন্যান্য দেশের তুলনায় মুসলিম দেশগুলো এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্য দেশগুলো আরও অনেক বেশি পিছিয়ে। এ জন্য আমাদের সবার আগে পর্যালোচনা করা দরকার, পূর্বে বাংলা অঞ্চলে কি ছিল। কি ছিল তার প্রাচীন ইতিহাস। এই বাংলা অঞ্চলে প্রকৃত কৃষি বিপ্লব, উন্নত খাদ্যনীতি সম্ভব কিনা, সম্ভব কিনা একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে সমাধানের দিকে অগ্রসর হতে হবে। এক্ষেত্রে হারিয়ে যাওয়া সভ্যতাকে কেন এবং কীভাবে হারালাম তারও তত্ত¡ তালাশ করতে হবে।
বাংলা অঞ্চলে ইসলামী সভ্যতার কৃষি এবং খাদ্য :
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. আব্দুর রহিমের ভাষায়, বাংলা অঞ্চলে মুসলমানদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তা এমন একটি পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়, যে পর্যায়ে বাংলা অঞ্চলের মানুষদের শুধু রাজনৈতিক মঞ্চকে কিংবা শুধু সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনকেই উন্নত, গঠনমূলক করে না। একইসাথে অর্থনীতি ও কৃষির উন্নতি এবং সমৃদ্ধির পথকে প্রশস্ত করে তোলে। বাংলা অঞ্চলের ভ‚মিকে বলা হতো প্রাচুর্যে ভরা উর্বর ভূমি। এর অধিকাংশ নারী- পুরুষ সকলেই ছিলেন অনেক বেশি পরিশ্রমী। ফলশ্রুতিতে মুসলিম শাসকগণ ইসলামী সভ্যতার রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতির আলোকে এমন সব মূলনীতি প্রনয়ণ করেন যার ফলে কৃষি এবং বাণিজ্যে অভ‚তপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। গোটা অঞ্চলের মাটির উর্বরতা, কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্য, বৈদেশিক বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্র এমন একটি পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয় যা গোটা অঞ্চলকে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং শক্তিশালী একটি অর্থনৈতিক ভিত্তিতে রূপান্তরিত করে।
নীহাররঞ্জন রায় বাংলার ইতিহাস লিখতে গিয়ে বলেন, “মুসলমানদের ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রণয়নের ফলে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা হলো গোটা উপমহাদেশের অর্থনৈতিতে অভ‚তপূর্ব এক পরিবর্তন সাধিত হয় যার অন্যতম ভিত্তি ছিল কৃষি। মুসলমানদের অর্থনৈতিক কৌশল, প্রজ্ঞাপূর্ণ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গোটা বাংলাকেই অর্থনৈতিক উন্নতির স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দেয়।”
মীনহাজ-ই-সিরাজ তাঁর ‘তাবাকাতে নাসিরীতে’ লিখেন- মুসলমানদের এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং নৈতিক মূল্যবোধের (আখলাক) ফলে শুধুমাত্র শাসকদের মূলনীতিই নয় প্রজাদের মধ্যেও এক সহমর্মী এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠে। সকলেই তাদের খাজনা দেয়া-সহ রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেয়ার জন্য পুরোদমে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এর ফলে সব দিক মিলিয়ে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আয় সেসময়ে উন্নতির শিখরে পৌঁছে।
সকল ঐতিহাসিক এ বিষয়ে একমত যে, চারটি বিষয়ের মাধ্যমে এ অঞ্চলের অর্থনীতি এতো বেশি শক্তিশালী হয়,
এক. কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের উন্নতি সাধন।
দুই. প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা।
তিন. বৈদেশিক বাণিজ্য ও রপ্তানিতে জোর প্রদান।
চার. খনিজ সম্পদ এবং মূল্যবান পদার্থের প্রাচুর্যতা এবং তার সঠিক ব্যবহার।
ঐতিহাসিকগণ এবং তৎকালীন বিশেষজ্ঞগণ এ অঞ্চলের মাটিকে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট উর্বর মাটি বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের অঞ্চলে অসংখ্য নদী-নালা, সবথেকে বেশি ঋতু, প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং প্রাকৃতিক সেচ ব্যবস্থা বিদ্যমান। সঠিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করলে এই অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে সর্বশ্রেষ্ঠ উন্নত কৃষি অঞ্চল। মুসলমানরা এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে প্রয়েজনীয় সব উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইবনে বতুতা এ অঞ্চলে ভ্রমণে এসে কৃষির অবস্থান, শষ্যের প্রাচুর্য ফুল-ফলের সমারোহ দেখে এতটা বিস্মিত হন যার প্রকাশ আমরা তার লেখনীতে দেখতে পাই। তিনি লিখেছেন, “নদী পথে মিশরের নীল নদের মতো ডানে-বামে ছিল অসংখ্য চাকা, উদ্যানরাজী এবং গ্রামের পর গ্রাম। আমরা গ্রাম ও উদ্যানরাজীর মধ্য দিয়ে ১৫ দিনের মতো চলেছি। আমাদের মনে হয়েছে আমরা একটি সাজানো উদ্যানের মধ্যে দিয়ে চলেছি।” ইবনে বতুতার সমস্ত ভ্রমণ কাহিনী ও তার পর্যালোচনাকে যদি আমরা ভালোভাবে উপলব্ধি করি তাহলে দেখব, এ অঞ্চলের রাষ্ট্রনীতি এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন এতোটাই সূক্ষ্ম এবং গোছালো ছিল, এ অঞ্চলের কৃষিকে অনেকটা স্বপ্নীল বাগান হিসাবে ঐতিহাসিকগণই আখ্যায়িত করেছেন।
আবার বিশ্বভারতী এনালসের ঐতিহাসিকগণ এ অঞ্চলকে সপ্তস্বর্গ, পৃথিবীর স্বর্ণভান্ডার হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। এবং এ অঞ্চলের সম্পদ, মানুষের চারিত্রিক সততা এবং পরিকল্পিত কৃষি, নদী এবং প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনাকে স্বর্গের সাথে তুলনা করেছেন। একজন চৈনীক দূত বাংলা সম্পর্কে বলেন, “এর অঞ্চলে ভূমি এতটাই উর্বর এবং এর উৎপাদন এতই বেশি যে, একই জমিতে প্রতি বছর দুই থেকে তিন ধরণের ফসল তারা পায়। কোনো রকম যত্ন না করেও এ অঞ্চলের ভূমি থেকে কৃষকরা তাদের চাহিদার থেকেও বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারে।”
প্রখ্যাত গবেষক ও ঐতিহাসিক, আবুল ফজল বলেন, “বাংলার মাটি এতো বেশি উর্বর ছিল যে একই জমিতে বছরে তিনটি ফসল উৎপন্ন হতো।” মুঘল সালতানাতের বিখ্যাত ঐতিহাসিক লেখকগণ সেকালের পলিমাটির অসাধারণ উর্বরতার উল্লেখ করেছেন। বাংলার সমগ্র মুসলিম শাসনামলে ভূমির উর্বরতা এবং কৃষির প্রশংসা এত বেশি লক্ষ্য করা যায় যে, সুলতান আওরঙ্গজেবের শাসনামলে নদী-নালা, খাল-বিল, কৃষির সুন্দর পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন, সারিবদ্ধ গ্রাম এবং শহরের পরিচ্ছন্নতা, মাঠভর্তি শস্য এবং নানাবিধ ফুল- ফলের প্রশংসা করে গবেষণা পত্রও রচিত হয়। পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত গবেষক বার্ণিয়ারও এই কথাগুলোর স্বীকৃতি দিয়েছেন। তারা মুসলিম বিদ্বেষী হওয়েও এ বিষয়গুলোর সত্যতা তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছেন।
অঞ্চলের সবয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদিত ফসল ছিল চাল। সরু, মোটা নানা ধরণের চাল এদেশে উৎপাদিত হতো। চালের নানা প্রকারের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবুল ফজল বলেন,
“যদি প্রত্যেক প্রকার থেকে একটি করে শস্যকণা সংগ্রহ করা হতো তাহলে একটি বড় কলস ভরে উঠতো।” কৃষিবিদ ফরিদ আখতারের মতে এ অঞ্চলে প্রায় পাঁচশত’র বেশি বীজ সংরক্ষিত হত এবং সেগুলোর চাষ হত। এই নানা ধরনের বীজ এবং বিভিন্ন ধরণের শস্যকণা এবং উর্বর জমি এ দুয়ের সমন্বয়ে উৎপাদিত চালের পরিমাণ এতো বেশি ছিল যে, জনসাধারণের চাহিদা মেটানোর পর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ৭০টি জায়গায় রপ্তানি হতো। চালের মতো যে সব শস্য উৎপাদিত হতো তার মধ্যে অন্যতম ছিল তুলা, মরিচ, সরিষা। এ ফসলগুলোর উৎপাদন এতো বেশি হতো যে, পৃথিবীর ৫০ টির মতো অঞ্চলে তুলা এবং তুলা থেকে উৎপাদিত সুতা, মরিচ, সরিষা ইত্যাদি রপ্তানি হতো।
গত কয়েক দশক পূর্বেও পাটকে বাংলা অঞ্চলের সোনালী আঁশ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হতো। ৭-৮ শত বছর যাবৎ সব ধরণের সাহিত্যে, কবিতায়, গ্রন্থে পাটের কথা উল্লেখ থাকতো। নানাবিধ মাধ্যমে পাট, পাট থেকে তৈরিকৃত বস্ত্র এবং বিভিন্ন পণ্যকে সাহিত্যে তুলে ধরা হতো। পাট শুধুমাত্র একটি ফসল হিসেবে উৎপাদনই হত না বরং পাটের দ্বারা তৈরি বিভিন্ন ধরণের পণ্য ও বস্ত্রসামগ্রীও তৈরি হতো। এগুলো ছিল উপমহাদেশ তথা বাংলা অঞ্চলের আয়ের অন্যতম ক্ষেত্র।
‘ইকোনমিক এনালস অব বেঙ্গল’ বইতে জে সি সিনহা বলেন, “বাংলায় মুসলিম শাসনামলে পাট এবং পাটজাত দ্রব্য এতো বেশি পরিমাণে উৎপাদন হতো যে, পাট এবং পাট থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন দ্রব্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি করা হতো।” এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাই, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ অঞ্চলে এসে তারা পাটবস্ত্র এবং তৎসংশ্লিষ্ট শিল্পেরে সাথেই সম্পৃক্ত হয়। ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ আগস্টের একটি পত্র এখনও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে, সেখানেও পাট নিয়ে বিস্তর আলোচনা লক্ষ্য করা যায়। জে সি সিংহ বলেন, সে সময়ের ঐ চিঠিতে যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো ইস্ট ইন্ডিয়া কর্তৃক বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার চটের থলে এবং ১২ শ চালের বস্তা পাঠানোর একটি দলিল। অর্থাৎ একটি চিঠি থেকেই যদি এ ধরণের তথ্য ফুটে উঠে বুঝাই যাচ্ছে যে, পাটকে কেন্দ্র করে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তি ও পর্তুগীজদের বিশাল একটি পরিকল্পনা ছিল এবং পরবর্তীতে তারা তা বাস্তবায়ন করে। দুঃখজনক বিষয় হল সেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়নকারী সেই সোনালী আঁশ এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় আজ আমাদের অর্থনীতি থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে
বাংলাদেশে একসময় তুঁতগাছ এবং গুটি পোকার চাষ হতো। পঞ্চদশ শতকে এ অঞ্চলে যেসকল ঐতিহাসিকগণ আসেন বা এ অঞ্চলের কথা তুলে ধরেন তাদের বর্ণনাতে দেখা যায়, গুটি পোকা মূলত মুসলিমদের পূর্ব আমলে ছিল না বললেই চলে। মুসলমানরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর গুটি পোকা আমদানি করে। সঠিক পরিচর্যা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের ফলে উৎপাদন এতো বেশি বরকতপূর্ণ হয় যে, বার্ণিয়ার ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে কাশিম বাজার পরিদর্শনকালে দেখতে পান, কাশিম বাজারে রেশমের কাঁচামালের উৎপাদন বছরে প্রায় ২৫ লক্ষ পাউন্ডের সমপরিমাণ। অর্থাৎ ২২ হাজার বেল। প্রত্যেক বেলের ওজন ১০০ লিভার। উৎপাদিত এ কাঁচামালের থেকে সাড়ে সাতশত পাউন্ড গুজরাট ও ভারতের অন্যান্য অংশে পাঠানো হতো। উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও রেশমের এই কাচামাল উৎপাদন হতো এবং তা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি হতো। রপ্তানি কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিল গোটা এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীগণ এবং এর কেন্দ্রবিন্দু ছিল এ অঞ্চলের ইসলামী সভ্যতা। (তথ্যসূত্র লাগবে) জে সি সিনহা ইকোনমিক এনালস অফ বেঙ্গলে লিখতে বাধ্য হয়েছেন যে, প্রতি বছর কাশিম বাজার থেকে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ পাউন্ড কাঁচা রেশম জাপান হলেন্ড অঞ্চলে রপ্তানি হতো এবং বাংলায় দশ লক্ষ পাউন্ড রেশমের সুতা তৈরী হতো।
বাংলা অঞ্চলে রেশমের কাঁচামাল এতো বেশি সস্তা ছিল যে এর ব্যবসা বিভিন্ন অঞ্চলে খুব দ্রæত সম্প্রসারিত হয়। যার ফলে খুব সহজেই এ অঞ্চল থেকে অন্যান্য অঞ্চলের বণিকগণ রেশম ক্রয় করে বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে তাদের ব্যবসায় উন্নতি সাধন করে। বাংলা অঞ্চলের উন্নত কৃষি, উর্বর জমি এবং যুগান্তকারী উদ্যোগের ফলে এ অঞ্চল হয়ে ওঠে কৃষির স্বর্গরাজ্য।
বিশ্বভারতী এনালস প্রথম খন্ডের চাইনিজ একাউন্টস এ যেসব তথ্য রয়েছে এবং এর পাশাপাশি অন্যান্য ঐতিহাসিকগণের দেয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলা অঞ্চলে তার উন্নত কৃষি ও নানাবিধ উৎপাদনের ফলে এমন এক কৃষি বিপ্লব এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয় যার মধ্য দিয়ে ভুট্টা, সরিষা, তেল, তিসি, কালাই এতো বেশি উৎপাদিত হতো যে, নিজ অঞ্চলের প্রয়োজন মিটিয়ে পৃথিবীর প্রায় ৫০-৬০টি অঞ্চলে তা রপ্তানি হতো। এছাড়াও শাক-সবজি, পেঁয়াজ, রসুন, শসা ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হতো এবং বিভিন্ন অঞ্চলে তা পৌঁছানো হতো। পান, সুপারি, নারিকেল এসবের প্রাচুর্য এতো বেশি ছিল যে, এগুলোও প্রায় ৪০-৫০ টি অঞ্চলে রপ্তানি করা হতো।
কলা, আম, কাঁঠাল, ডালিম, লেবু, খেজুর ইত্যাদি ছিল বাংলা অঞ্চলের সুপরিচিত ফলের মধ্যে কয়েকটি। এসব ফলের প্রতি অন্যান্য অঞ্চলের বণিকদের চাহিদা এতো বেশি ছিল যে, তারা এসব ফসল নিজ অঞ্চলে আমদানি করতেন। এ অঞ্চলের কৃষি রপ্তানিমুখী হয়ে ওঠায় অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
ইবনে বতুতা ও বার্ণিয়ারের বর্ণনার পাশাপাশি ফরাসি, ব্রিটিশ এবং ভারতীয়দের বর্ণনা এক করলে দেখা যায় তারা বাংলা অঞ্চলের গৃহপালিত পশু যেমনঃ ঘোড়া, খচ্চর, মহিষ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির কথা বেশ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছে। গৃহপালিত এ পশুগুলোর প্রাচুর্যতার কারণে খুবই অল্প দরে বিক্রি হতো। দাম কম হলেও কৃষকদের কোনো ক্ষতি হয়নি বরং খরচের তুলনায় তারা লাভবান হতো। গৃহপালিত এ পশুগুলো বিভিন্ন অঞ্চলের খাদ্য হিসেবেও রপ্তানি হতো। এটিও বাংলা অঞ্চলের অর্থনীতি ও কৃষিকে ব্যাপকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজলের বর্ণনায় বাংলা অঞ্চলে বিভিন্ন খনিজ সম্পদের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেগুলো আজও পর্যন্ত বর্তমান। তিনি বলেন- মাহান্দা সরকারের হারবাহ নামক স্থানে মুক্তার একটি খনি ছিল। এখানে অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথর উৎপাদিত হতো। বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ৫০ এরও অধিক খনিজ সম্পদ বিদ্যমান রয়েছে। আমাদের অঞ্চলে এখনও ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা কেউ ই জানি না এটি আসলে কারা নিয়ন্ত্রণ করছে বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কীভাবে এই খনিজ সম্পদগুলোকে তাদের শোষণের হাতিয়ারে পরিণত করছে।
ঐতিহাসিকগণ বাংলার সুতি শিল্পের অনেক প্রশংসা করেছেন। এ ব্যাপারে বিখ্যাত পন্ডিত বার্বুসা বলেন, এ অঞ্চলে পর্যাপ্ত সুতা রয়েছে। তারা সূতি ও মিহি অনেক প্রকারের বস্ত্র তৈরি করে। নিজেদের ব্যবহারের জন্য রঙিন এবং ব্যবসার জন্য সাদা রাখে। এগুলো খুবই মূল্যবান কাপড় এবং এগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে মৌর, আরব, ইরান, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ অনেক পছন্দ করতো যার দরুন বাংলা অঞ্চল থেকে এসকল অঞ্চলে এই কাপড়গুলো জাহাজ করে রপ্তানি হতো। কে, এম আশরাফ তার “লাইফ এন্ড কন্ডিশন অব দি পিপল অব হিন্দুস্তান” বইয়ে লিখেন, পন্ডিত বার্থেনা এ অঞ্চলের বস্ত্রের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরণের সুতি বস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলার মতো এতো বেশি সুতি বস্ত্রের প্রাচুর্যতা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখেননি বলে বার্থেনা মন্তব্য করেন। ঠিক একইভাবে আবুল ফজল উল্লেখ করেন, সোনারগাঁয়ে এক প্রকার মিহি মসলিন তৈরি হতো। মসলিনগুলো এতো বেশি উন্নত মানের ও দামী ছিল যে বাহরিস্থান গ্রন্থের প্রথম খন্ডে মির্যা নাথান বলেন, তিনি মালদ্বাহ থেকে তৎকালীন সময়ের চার হাজার টাকা মূল্যে এক খন্ড মসলিন বস্ত্র ক্রয় করেন। জে সি সিনহা ইকোনমিক এনালস অব বেঙ্গলেও উল্লেখ করেন, এ অঞ্চলে এতো বেশি কাঁচা সুতা উৎপন্ন হতো এবং সুতা থেকে মসলিন কাপড় উৎপন্ন হতো যা বার্বুসা তার ভ্রমণকালে ব্যাপক হারে দেখতে পান। আর এটা ছিল জগৎ জুড়ে বিখ্যাত একটি সুতা শিল্প যা এ অঞ্চলের অর্থনীতি ও কৃষিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
এ অঞ্চলে আখের উৎপাদন ছিল অনেক বেশি। বার্বুসা তার ভ্রমণকালে দেখা আখ চাষের কথা ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছেন। হ্যাকলুয়েথ সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ইতিহাসের ২য় খন্ডে আমরা দেখতে পাই এ অঞ্চলের আখ থেকে শুধু চিনি নয় আরও নানা ধরণের খাদ্য দ্রব্য উৎপাদিত হতো। উৎপাদিত এ খাদ্য দ্রব্যগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি হতো। তবে সব থেকে বড় আয়ের এবং রপ্তানিকারক পণ্য ছিল চিনি। এই চিনিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। বাংলা সালতানাতের ঐ সময় পূর্ব-পশ্চিম উপক‚লের দেশসমূহ এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে চিনিকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
চিনির মূল আবিষ্কারক ছিলেন মুসলিমগণ। কিন্তু উপনিবেশিক শক্তি যখন এ অঞ্চলে হানা দেয় এবং তাদের নিকৃষ্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করে তখন আমাদের অঞ্চলের চিনির অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকে আর তা আজকের বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। আমরা কিছুকাল পূর্বেও লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চিনির কলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশের প্রায় ৯০ ভাগ চিনি বিদেশী কোম্পানিগুলো থেকে আমদানি করতে হয়। এই চিনিকে অবশ্যই মুসলিমদের হাতে রাখতে হবে। কারণ চিনিকে কেন্দ্র করে খাদ্যের বড় একটি অংশ তৈরি হয়। আর চিনি যদি মুসলমানদের হাতে না থাকে তাহলে সেটি সাম্রাজ্যবাদীদের জুলুমের একটি হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হবে। এবং আজকের বিশ্ব তাই-ই হচ্ছে। এ চিনিকে কেন্দ্র করে নানাবিধ রোগ, ভাইরাস এবং অর্থনৈতিক শোষণ চালান হচ্ছে। বিদেশী কোম্পানি থেকে চিনি আমদানি করার ফলে নানা রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ মুসলিম সভ্যতায় এক হাজারেরও বেশি সময় ধরে গোটা মানবজাতি চিনি খেয়েছে। চিনি থেকে তৈরিকৃত বিভিন্ন খাবার খেয়েছে। কখনো এতো রোগে নিপতিত হয়নি। কিন্তু যখন থেকেই উপনিবেশিক শক্তির হাতে তথা বর্তমান যায়নবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতার ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে চিনি এবং চিনি থেকে তৈররিকৃত খাদ্যদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে তখন থেকে চিনি একটি বিষতুল্য খাদ্যদ্রব্য হিসেবে আমাদের কাছে আসছে এবং আমরা উপায়ন্তর না পেয়ে তা খেতে বাধ্য হচ্ছি। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকট যেমন সৃষ্টি হচ্ছে একইভাবে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যগত সংকট ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ অঞ্চলের তৈরিকৃত বিভিন্ন শিল্প পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলেই ব্যাপক সমাদৃত হয়। যেমন এখানকার তৈরি তামা, কাঁসা, কাঠ, পাথর হস্তনির্মিত জিনিসপত্র প্রভৃতি কারুকার্য এবং কারিগরি বিভিন্ন জিনিসপত্র প্রায় ৩০-৪০ টি অঞ্চলে ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং এগুলোও বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি হতে থাকে।
এখনও পর্যন্ত সব থেকে বেশি মসলা উৎপাদিত হয় ভারতীয় উপমহাদেশের এ অঞ্চলে। অন্যান্য দেশ মসলা শিল্পে এ অঞ্চলের উপরেই নির্ভর করে। মুসলিম সালতানাতের সময়ও প্রায় ৭০ টি অঞ্চলে মশলা এবং মশলা জাতীয় দ্রব্য রপ্তানি করা হতো। এমনকি উপমহাদেশে ইসলামী সভ্যতার শেষ কেন্দ্র মহীশূরে ব্রিটিশ-হায়দারাবাদ-মারাঠা ত্রিশক্তির বিরুদ্ধে অসম লড়াইয়ে শেরে মহীশূর টিপু সুলতান শুধুমাত্র এই মসলার উপর নির্ভর করে বছরের পর বছর সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।
এরপর আসে বাংলার মৎস সম্পদের কথা। সামুদ্রিক মাছ এবং লবণাক্ত পানি থেকে উৎপাদিত লবণ ছিল মুসলিম বাংলার অন্যতম একটি শিল্প। তখন নদীগুলোতে অনেক মাছ পাওয়া যেত। এমনিকি এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত আয়ের ৪৫ ভাগ আসে মাছ থেকে। আমাদের অঞ্চলের মাছ অনেক বেশি সুস্বাদু এবং পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষদের খাওয়ার উপযোগী। ফলশ্রুতিতে আমাদের নদী এবং সামুদ্রিক মাছ দিয়ে এখনো বিশাল একটি অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব
বাংলার মুসলিম সালতানাতের অর্থনৈতিক আয়ের অন্যতম একটি উৎস ছিল এ মৎস্যশিল্প। সামুদ্রিক মাছের সাথে যুক্ত ছিল লবণাক্ত পানি থেকে উৎপাদিত লবণ। যা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি হতো। বিশেষ করে এ মৎস্যশিল্প পৃথিবীর প্রায় ৬০ টি অঞ্চলে রপ্তানি করে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এজন্য মৎসশিল্পের এই দিকটি বর্তমান সময়েও খুব সম্ভবনাময়ী একটি দিক। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা এখনো যথেষ্ট উদাসীন।
এক্ষেত্রে একটি বিষয় বলে রাখা জরুরী আমাদের এসকল দ্রব্যাদি রপ্তানি করার অন্যতম মাধ্যম ছিল বন্দর। বন্দরগুলোর বর্ণনা দিতে বিভিন্ন জন যেসব বিষয় তুলে ধরেছেন তন্মধ্যে কয়েকটি তথ্য তুলে ধরছি। যেমনÑ বণিক মাস্টার সিজার ফেডরিক ১৫৬৭ সালে একটি বন্দর পরিদর্শন করে লিখেছেন, প্রতি বছর এ অঞ্চল থেকে সোনারগাঁও বন্দর দিয়ে ছোট বড় ৩০-৩৫টি জাহাজে চাল, কাপড়, সংরক্ষিত হরতকি, বিভিন্ন ধরনের পণ্যদ্রব্য বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে। ১৫৮৫ সালে রেলওইচ সোনারগাঁও বন্দর পরিদর্শন শেষে লিখেন- এখানে দেখতে পেলাম, প্রচুর পরিমাণে সুতি বস্ত্র অন্যান্য অঞ্চলে রপ্তানি হচ্ছে। চালসহ বিভিন্ন ধরণের ফসল ভারত, সিংহল, মালাক্কাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরিত হচ্ছে।
বার্থেমা ও বার্বুসা ১৬ শতকের দিকে যখন ভ্রমণ করেন তখন তারা এ ব্যাপারটিকে খুব জোরের সাথেই বর্ণনা করেন। তারা বলেন, বাংলা অঞ্চল তার প্রতিটি শহরকে একেকটি শক্তিশালী বন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিটি বন্দর থেকে মুসলমানগণ সুতি বস্ত্র, চিনিসহ অন্যান্য দ্রব্য যেগুলো তারা উৎপাদন পূর্বক বৈদেশিক বাণিজ্যের লক্ষ্যে বড় বড় জাহাজে ভর্তি করে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে থাকে। যা মুসলমানদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সর্বোচ্চ শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়।
বাংলা অঞ্চলে মুসলিম শাসনামলে বাকলা তথা বরিশাল, পটুয়াখালী অঞ্চলে ব্যবসায়িক দিক থেকে প্রভাবশালী একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে। এ অঞ্চল সম্পর্কে রেলঅফইচ বলেন, এখানে সুতা, সুতিবস্ত্রসহ কৃষিজাত দ্রব্যের বিপুল সমাবেশের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় একটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এর সব থেকে বড় প্রমাণ হচ্ছে আমরা দেখতে পেতাম জাহাজ করে এসব দ্রব্যাদি রপ্তানি করা হচ্ছে। রেলঅফইচ একই সাথে সোনারগাঁও অঞ্চলের রপ্তানির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, বিপুল পরিমাণে সুতি বস্ত্র,পাট,চাল বিভিন্ন মসলা এমনভাবে জাহাজ বোঝাই করে বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি করা হতো যা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে খুবই বিরল।
ইবনে বতুতা যখন জলপথে বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন তখন প্রতিটি অঞ্চলের বন্দরগুলো এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা দেখে তিনিও বিস্মিত হন। বিশ্বভারতী এনালসের দ্বিতীয় খন্ডে আমরা এ বিষয়টি লক্ষ করি যে, চীন, বার্মা, ইউরোপ, মালদ্বীপ, সিংহলসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর এর অন্যতম ভিত্তি ছিলো এসকল বন্দরকে কেন্দ্র করে জাহাজের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের ফসলের রপ্তানি।
বাংলা অঞ্চলের সাথে চীনের স্বর্ণ, রৌপ্য, রেশম, নীল ও সাদা চিনামাটির বাসন, তাম্র, লৌহ, কাস্তুরি, সিন্দুর, পারদ এবং মাদুর ইত্যাদির ব্যবসা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যা দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক শক্তিকে অনেক বেশি তরান্বিত করে। পাশাপাশি তেল, মাখন, শুঁটকি মাছ, ফলমূল, কালাই, পান- সুপারী, পিঁয়াজ, রসুন, ঘৃতকুমারীসহ নানাবিধ ঔষধি গাছ বা ফল ব্যাপক হারে উৎপাদিত হতে থাকে। এই বিষয়টি বিভিন্ন অঞ্চলের চিকিৎসকদের কাছে এবং গবেষকদের কাছে ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে। ফলশ্রুতিতে ব্যবসায়িকরা বিভিন্ন অঞ্চলে এসকল পণ্যসমূহ পৌঁছে দিত এবং একে কেন্দ্র করে বাংলা সালতানাতে একটি শক্তিশালী কৃষি ও খাদ্যনীতির ভিত রচিত হয়। ঐতিহাসিক বার্ণিয়ারের বর্ণনায় আমরা দেখি, এ অঞ্চলের মোম, গন্ধগোগল, লম্বা মরিচ বিভিন্ন প্রকারের ঔষধ ইউরোপসহ বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ গুলোতেও ব্যাপকভাবে রপ্তানি হতো। বার্ণিয়ার বলেন, বেশ কিছু মিষ্টান্ন ফলমূল আম, আনারস, হরতকি, লেবু, আদা এগুলোও পচুর পরিমানে রপ্তানি হতো। কেননা এগুলো সব অঞ্চলেই সুস্বাদু ও সুমিষ্ট ফল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলা। বর্তমান সময়ে ইউরোপের কমলা, আপেল যেমন সারা দুনিয়ায় পরিচিতি লাভ করেছে।
এরপর যদি আমরা দ্রব্যমূল্যের ক্রয় ক্ষমতার দিকে লক্ষ করি তাহলে দেখব যে সকল কিছু বিদেশে রপ্তানি হওয়া এবং বৈদেশিক অর্থ উপার্জনের ফলে ও রাষ্ট্রীয় নানাবিধ আখলাকী উদ্যোগের ফলে প্রতিটি পণ্যই অত্যন্ত সস্তা দরে পাওয়া যেত। বিষয়গুলো নিয়ে ইউরোপীয় লেখকগণ বিকৃতভাবে উল্লেখ করলেও দেখা যায়, দ্রব্য মূল্য ক্রয়ক্ষমতা মধ্যে ছিল। যার ফলে সবাই নিজ চাহিদা মতো খাবার ক্রয় করতে পারতেন। এমনকি ক্রয় করার পরেও তাদের কাছে অর্থ উদ্ধৃত থেকে যেত। এজন্যই ইবনে বতুতা মন্তব্য করেন পৃথিবীর কোথাও তিনি এমন একটি দেশ দেখেননি যেখানে জিনিসপত্র বাংলা অঞ্চলের মতো এতো সস্তায় বিক্রি হয়। তিনি দেখেন যে এ দেশ চালে পরিপূর্ণ ও ভালো এবং পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্যে ভরপুর।
এ বিখ্যাত পর্যটক আফ্রিকা, মিশর ভারত এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তিনি যেসকল মন্তব্য করেছেন তা থেকে বোঝা যায়, এ অঞ্চলের ক্রয়ক্ষমতা কতটা সাধ্যের মধ্যে ছিল। ১৬৪০ সালে বাংলাদেশের এ অঞ্চলে ভ্রমণ করে সিবাস্তিয়ান মাররিক বলেন, প্রত্যেক বাজারে বা শহরে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও শিল্পজাত দ্রব্য, সুতির বস্ত্র প্রভৃতির প্রাচুর্য এতো বেশি ও সস্তা ছিল যে মাত্র একটি বাজার থেকে এসকল জিনিসপত্র অল্প দামে ক্রয়পূর্বক জাহাজ বোঝাই করে নেওয়া যেতো। যার ফলে ব্যবসায়ীগণ এ অঞ্চলের সাথেই ব্যবসা করতে সর্বদা প্রচেষ্টা চালাতো। এ অঞ্চলের মানুষ ব্যপক হারে উৎপাদন করে তাদের অর্থনৈতিক সাবলম্বিতা অর্জন করতো। এছাড়াও তিনি মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের শহরগুলিতে বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে মূল্য এতটাই সাধ্যের মধ্যে ছিল যে তিনি দিনে কয়েকবার আহার করতে প্রলুব্ধ হতেন। তিনি অনেকগুলো দ্রব্যের বর্ণনা দেন। যেমনঃ মাত্র ৮ দিরহামে ৮০ রাতল ধান পাওয়া যেত। ১ রৌপ্য দিনারে ২৫ রাতল চাল পাওয়া যেত। ১ আনা ৯ পাইয়ে বর্তমান ওজনের ১ মণ চাল পাওয়া যেত। এভাবে প্রতিটি পণ্যই এ অঞ্চলের মানুষদের কাছে অনেক সস্তা ছিল। যার ফলে এ অঞ্চলের মানুষ যতটুকু আয় করতেন ততটুকু দিয়ে তারা তাদের খাদ্য, বস্ত্র কেনার পরেও তাদের আয়ের একটি বড় অংশ উদ্বৃত্ত থকত।
সে সময় জনসংখ্যার তুলনায় কর্মসংস্থান অনেক বেশি ছিল। পাশাপাশি মুসলমানদের রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক বলয়ের কারণে মানুষ অনেক বেশি পরিশ্রমী হয়ে উঠে। নারী-পুরুষ সকলেই তাদের স্ব-স্ব জায়গা থেকে সাধ্যমতো পরিশ্রম করে। যার ফলে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থান, কৃষির ভিত্তি, বস্ত্র বা সব ক্ষেত্রে বিশাল এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। এর মধ্য দিয়ে মুসলমানদের আখলাকী এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সুনির্দিষ্ট একটি শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর শ্রমনীতির দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো, একজন শ্রমিক যে পরিমাণ পারিশ্রমিক পেতেন তার তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে তার বাৎসরিক অন্ন-বস্ত্রের চাহিদা মিটে যেত। যেমনঃ মুঘল সালতানাতের সময়কালে শ্রমিকদের যে মজুরি নির্ধারিত ছিল সেটি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দৈনিক মজুরি হিসেবে তৎকালীন সময়ে একজন শ্রমিক দুই দম আয় করতেন। তাহলে তার মাসে আয় হতো ৬০ দম অর্থাৎ বছরে তার আয় হতো আঠারো টাকার সমান। জীবন ধারণের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এতোটাই ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ছিল যে, ইবনে বতুতা বলেন তার জনৈক বন্ধু আল মাসুদী বাংলা অঞ্চলের একজন নাগরিক যিনি বছরে আয় করেন ১৮ টাকা। কিন্তু তার বছরে খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র ক্রয় করতে ব্যয় হয় ৮ দিরহাম বা ১ টাকা। পারিবারিক অন্যান্য সদস্যের চাহিদা এবং খাদ্য-বস্ত্র সব মিলিয়ে তার আয়ের তিন ভাগের দুইভাগ খরচ হতো। আর এক ভাগ থেকে যেত। কারও কারও ক্ষেত্রে ১ ভাগ ব্যয় হতো আর বাকি দুই ভাগই উদ্বৃত্ত হিসেবে থেকে যেতো। আবার তিনি বলেন, অনেকের সারা বছর ২ বা ৩ টাকার বেশি প্রয়োজন পড়তো না। ফলে ১৫ টাকার মতো উদ্বৃত্ত থেকে যেতো। এসব উদ্বৃত্ত টাকা সেই সময়ের মুসলমানদেরকে ওয়াকফ, দান, সাদাকাহ, যাকাতের দিকে ব্যপকভাবে ধাবিত করে।
মুসলিমরা তাদের এই বাৎসরিক উদ্বৃত্ত সম্পদের একটি অংশ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে প্রেরণ করতো। বিভিন্ন দরিদ্র অঞ্চল, দুর্ভিক্ষকবলিত অঞ্চল, যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে এমন অঞ্চলে মুসলমানরা তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। রাষ্ট্র্র, শিক্ষা, চিকিৎসা সব ক্ষেত্রে অনেক বেশি বাজেট দিতে পারতো। যার কারণে বলা হয় ইসলামী সভ্যতার ১২শত বছরের শাসনামল ছিল পুরো পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত একটি ন্যায়ভিত্তিক শাসনামল। গোটা দুনিয়াতে হত দরিদ্র খুঁজে পাওয়া, অনাহারী মানুষ খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। আমাদের উপমহাদেশের মুসলিম সালতানাত তথা ইসলামী সভ্যতা যে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তার একটি উদাহরণ হচ্ছে ৭ শত বছরে আমাদের অর্থনৈতিক জিডিপি ছিলো ২৯%। অর্থাৎ যাকাত নেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। ইসলামী সভ্যতার এ অঞ্চলে সেই বিশাল অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা কেমন? সে ব্যাপারে আমরা কতটুকুই বা অবগত?
মানববিধ্বংসী ব্রিটিশ শাসনামলে কৃষি খাদ্য :
উপরোক্ত বিষয়গুলোকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে এ কথা স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী সভ্যতা বা মুসলিম শাসনামলে বাংলা অঞ্চলের অর্থনৈতিক ভিত্তি, কৃষি ও খাদ্যনীতি উন্নতির চরম শিঁখরে পৌঁছে যায় যা মানবতার ইতিহাসে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণে পরিণত হয়। কিন্তু এর পর পরই এ অঞ্চলে যে ব্যাপকভাবে চলমান শোষণ ও নিকৃষ্টতম গণহত্যা এবং মহাপ্রলয় নেমে আসে তার তীব্রতা ও ভয়াবহতা কয়েক খন্ড বই লিখেও হয়ত উপলব্ধি করানো সম্ভব হবে না। এই মহান সভ্যতার পতন ও নিকৃষ্ট জায়নবাদীদের উত্থানের বিষয়ে মুসলিমদের ও সত্যনিষ্ঠ গবেষকদের তুলনামূলক কাজ নেই বললেই চলে।
১৭৭২ সালের গভর্নর জেনারেল ওয়ারিন হেসটিন্সের ইংল্যান্ডের কোম্পানির ডাইরেক্টরদের কাছে পাঠানো এক পত্রে লিখেন- প্রদেশের তথা বাংলার সমগ্র লোক সংখ্যার এক তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়েছে এবং তার ফলস্বরূপ চাষাবাদের অবস্থা চরম অবনতির দিকে চলে গেছে। সেখানে তিনি রাজস্ব আয়ের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরণের পরামর্শ দেন ও চরম হতাশা প্রকাশ করেন।
তাহলে চিন্তাশীল ও উৎসুক মনে প্রশ্নের সঞ্চার হতে পারে যে, এই আকাশচুম্বী অবস্থানে থাকা একটি অর্থনীতি ও কৃষি অঞ্চলে এমন কি ঘটল যার দরুন একটি দুর্ভিক্ষেই গোটা জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মৃত্যুবরণ করল?
ব্রিটিশদের শোষণের ভয়াবহতা শুধু এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং সঠিক ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, দুর্ভিক্ষের পূর্বে বাংলাদেশের রাজস্ব (১৭৬৮ সালে) ছিল ১ কোটি ৫২ লক্ষ ৪ হাজার ৮ শত ৫৬ টাকা। কিন্তু এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে এ অঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করার পরও ১৭৭১ সালে রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৫৭ লক্ষ ২৫ হাজার ৫ শত ৭৬ টাকায়। একটু চিন্তা করলেই আমরা এই আগ্রাসনের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারব। তাদের শাসনের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় জনগণ এ ধরণের দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে।
এ দুর্ভিক্ষ সাধারণ কোনো দুর্ভিক্ষ নয়। প্রথমত, এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যুর হিসাবটা সঠিক কিনা সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। কেননা হিসাবটি ব্রিটিশদের উপস্থাপিত হিসাব। দ্বিতীয়ত, তাদের রাজস্ব আয় কমে গিয়ে শূন্যের কোটায় নামার কথা থাকলেও তাদের রাজস্ব আয় উল্টো বৃদ্ধি পেয়েছে! শোষণের মাত্রা তো কমেইনি বরং দুর্ভিক্ষের মত এতটা কঠিন পরিস্থিতিতেও তারা নির্যাতন আরও বাড়িয়েছে। চিঠিগুলো দেখলে বুঝা যায়, দুর্ভিক্ষ নিয়ে তারা মোটেও চিন্তিত নয়। মূলত তারা তাদের রাজস্ব আয়, তাদের শোষণ এবং অর্থনৈতিক লুন্ঠন যাতে কমে না যায় সেদিকেই অধিক মনোযোগী ছিল।
চারিদিকে যখন অর্থনীতি, কৃষি ও খাদ্যের চরম ধস নামে, মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং অন্যান্য সকল অধিকার থেকে গোটা অঞ্চলের সকল মানুষ বঞ্চিত হতে শুরু করে, মৃত্যুর পর মৃত্যু, গণহত্যার পর গণহত্যা চলে সেসবের ভিতরে তারা তাদের শাসন এবং লণ্ঠনকে পাকাপোক্ত করতে নতুন আইন প্রনয়ণ করে। যা ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নামে পরিচিত। এদিকে নানাবিধ সমস্যা ধারাবাহিকভাবেই চলছিল। পূর্বের যে ব্যবস্থান্যুায়ী জমিদাররা ছিল সরকার এবং কোম্পানিগুলোর রাজস্ব আদায়ের এজেন্ট। কিন্তু এই নতুন আইন অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে তাদেরকে জমির মালিক হিসেবে স্বত্বাধিকার দেয়া হয়। এজেন্ট হিসেবে পূর্বে তারা স্বাধীন কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করত। কিন্তু নতুন এ আইনে পূর্বে যেভাবে রাজস্ব আদায় করতো সেক্ষেত্রে তারা নতুন মাত্রা যোগ করে। তারপর থেকে স্বাধীনভাবে এই সকল জমিদাররা যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই প্রজাদের উপর নানাবিধ কর প্রয়োগ করতে শুরু করে।
“বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা” নামক গ্রন্থে হেমাচন্দ্র কান্নগো বলেন, “এই জমিদাররা প্রতি একর এ এতো বেশি খাজনা এবং জুলুমপূর্ণ কর আরোপ করা শুরু করে যা ছিল সম্পূর্ণ বে-আইনী। কৃষকদের কাছ থেকে আদায়কৃত খাজনার পরিমাণ, সরকারকে প্রদান করা অর্থের চেয়ে ৫ গুণ বেশি ছিল। অর্থাৎ সরকারকে দেওয়ার মধ্যে দিয়েই যেধরণের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে ও অর্থনীতির ধস নেমে আসে, জুলুমের শিকার হতে থাকে তার থেকে ৫ গুণ বেশি খাজনা এ সকল জমিদাররা আদায় করতে শুরু করে। এদিকে ব্রিটিশরা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে তাদের ভ‚মির রাজস্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। নির্ধারিত যে রাজস্ব ছিল তার থেকে আরও বৃদ্ধি করে ১ কোটি ৫৭ লক্ষ থেকে ২ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা অর্থাৎ ৩৩ লক্ষ পাউন্ড রাজস্ব আয় বাড়িয়ে দেয়। ফলে নতুন এক ভয়াবহ আগ্রাসনের দ্বার উন্মোচিত হয়।”
জমিদাররা তাদের প্রভুতুল্য ব্রিটিশদের মন খুশি করতে এবং ব্রিটিশ লুণ্ঠনকারীরা আরও বেশি লুণ্ঠনকে বৃদ্ধি করতে জমিদারদের যেসকল পরামর্শ দিতো তার ভিত্তিতে জমিদাররা শুধুমাত্র খাজনা আদায় বা নির্দিষ্ট কর আদায় করেই ক্ষান্ত হত না। সাথে নিত্যনতুন নানা ধরণের দাবি নিয়ে উপস্থিত হতো। এই ধরণের বে-আইনী পাওনা মেটাতে গিয়ে কৃষকরা ক্রমেই দরিদ্র হতে থাকে। কিন্তু এ থেকে উত্তরণের বিকল্প কোনো পন্থা বা ব্যবস্থা ছিল না। যারা পরিপূর্ণভাবে এ দাবি মেটাতে অক্ষম হত, তাদের উপর নেমে আসত ভয়াবহ নির্যাতন। এভাবে যখন ধারাবাহিক শোষণ চলতে থাকে তখন কৃষক এবং সাধারণ পেশার জনগণ যেন পঙ্গুতে পরিণত হয় যার ভয়াবহতা বিশ্বমানবতা আগে কখনো কখনো প্রত্যক্ষ করেনি।
১৮৮০ সালের দিকের একটি রিপোর্টে দেখা যায়, ব্রিটিশ যায়নবাদী পরিচালিত তীব্র শোষণের পাশাপাশি তাদের চাহিদা, তাদের আয়ের মাত্রা বাড়ানোর নেশায় উন্মত্ত হয়ে যায়। তারা শুধু লুণ্ঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং জমিদারদের ব্যবহার করে নির্যাতন, গণহত্যা ও ভয়াবহ জুলুমের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়ার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এ সম্পর্কে অধ্যাপক রাধাকোমল মুখার্জী ভারতে ভূমি সমস্যা সম্পর্কে লেখা একটি পুস্তকে বলেন, আধুনিক বা তৎকালীন এ জমিদারী প্রথার মাধ্যমে ব্রিটিশরা সমাজের অধিকার এবং সবকিছুকে লুণ্ঠন করে তাদের শক্তিকে নতুনভাবে ব্যয় করেছিল কৃষক এবং সাধারণ মানুষদের দমন করার কাজে। অর্থাৎ এসকল বিষয় থেকে উপলব্ধি করা যায়, শুধুমাত্র দুর্ভিক্ষের কারণেই মানুষ মারা যায়নি। অন্যান্য নানা জুলুমের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণত্যাগ করে। এরপর ১৭৫৩ সালের পর থেকে বা পূর্ব থেকেই যে ইজারা ব্যবস্থা চালু হয়, সেই ইজারা ব্যবস্থায় বিভিন্ন মাঠ, খাল, বিল পর্যন্ত ইজারা দিতে শুরু করে। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে কৃষকরা একেবারেই ভ‚মিহীন হয়ে পড়ে এবং তাদের মৌলিক অধিকার বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এসব ইজারা, কর নানাবিধ জুলুমের মধ্যে দিয়ে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যে ইজারার নাম শুনলেই প্রজাদের মনে কম্পন শুরু হয়ে যেতো।
ওইসকল জমিদাররা যখন কৃষক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের উপর তাদের কর ধার্য করতো আর প্রজারা যদি তা দিতে ব্যর্থ হতো তখন তাদের উপর নেমে আসতো নানাবিধ নির্যাতনের কালো ছায়া। উদাহরণ হিসেবে আমরা যদি সেকালের কয়েকটি পত্রিকার দিকে খেয়াল করলে (যেমন, তত্ত¡বোধিনীর ৮৪ তম সংখ্যায়, সাময়িক পত্রে, বাংলার সমাজ চিত্র পত্রিকার ২য় খন্ডে) দেখা যায় তখন বেত্রাঘাত, দন্ডাঘাত, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে বক্ষস্থান দলন, খাপড়া দিয়ে নাসিকা কর্ণ মর্দন, মাটিতে নাসিকা ঘর্ষণ, পিঠে হাত পানিগুঢ় বদ্ধকরণ, কান ধরে দৌঁড় করানোম, ফাটা দুইখানা বাধা বাগারী দিয়ে হাত ধলন করা, গ্রীষ্মকালের প্রখর রৌদ্রে পা ফাঁক করে পিঠ বাকিয়ে পিঠের উপর ও হাতের উপর ইট চাপিয়ে দেয়া, বৃক্ষ বা অন্যত্রে বেধে লম্বা করা, ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ধানের গোলায় পুতে রাখা, গৃহবন্দি করে লঙ্কা মরিচের ধোঁয়া দেয়া, কারাবদ্ধ করে উপবাস রাখা প্রভৃতি শাস্তি প্রতিনিয়তই তারা কৃষকদের উপর এবং সাধারণ পেশাজীবী মানুষদের উপর প্রয়োগ করতে থাকে। কোনো দাবী আদায় না হলে হাত কেটে ফেলা, পিতার সামনে সন্তানকে হত্যা করা এবং সন্তানের সামনে পিতামাতাকে হত্যা করা। এইসকল জঘন্যতম উপায়ে তারা গণহত্যা চালাতে থাকে। এই কাজগুলো তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। এই নিকৃষ্টতর কাজ তারা আমেরিকার ইনকা সভ্যতা ও মায়া সভ্যতার সাথেও করেছে। আফ্রিকায় তারা যে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছে, এদেশেও সেই ধারাবাহিকতা তারা অব্যাহত রাখে।
তত্ত্বোধিনী পত্রিকায় ১৮৫০ সালে কৃষির অবস্থা বলতে গিয়ে বিনয় ঘোষ বলেছিলেন, তত্ত্বোধিনী পত্রিকা শহরের পত্রিকা আর শহরের মধ্যবর্তীরাই এর পরিচালক। যার কারণে শহরের অর্থনীতি এবং কিছু সামাজিক বিচারের বিষয় উঠে এসেছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চল বা বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের কি ভয়াবহ অবস্থা বা তাদের সামাজিক বাস্তবতাকে কতোটুকুই বা তুলে ধরতে পেরেছে। আদৌ এর কোনো সঠিক সমীক্ষা আছে কিনা তাও অজানা। তৎকালীন কোনো কোনো লেখক বলেন, পল্লী গ্রামের মধ্যে অসংখ্য ব্যক্তি উপযুক্ত অন্নের অভাবে হাজারো যন্ত্রণা ভোগ করছে। অর্থ কষ্টে, খাদ্যের অভাবে, পানির সংকটে জলাশয়ে বিভিন্ন প্রাণী যেভাবে পঁচে মারা যায় ঠিক একইভাবে মানুষগুলো মারা যাচ্ছিল। অর্থাৎ লক্ষ্য করলে দেখতে পাব যে, ব্রিটিশরা ক্ষমতায় আসার কিছু কাল পরেই তাদের আগ্রাসন ও লুণ্ঠনের মাত্রা আকাশচুম্বী অবস্থানে পৌঁছে যায়। যা ছিল আমাদের ধারণারও অতীত।
মেমোরেন্টাম অন দি পার্লামেন্ট সেটেলমেন্টের ৪০ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ, তাদেরই এজেন্ট সেন্সেস কমিশনার স্যার টমাস মন্ড্রোর মতে, ১৮৪২ সালে উপমহাদেশে ভ‚মিহীন কৃষকের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু ১৮৭২ সালে অর্থাৎ ৩০ বছরের ব্যবধানে আমাদের ভ‚মিহীন কৃষকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫ লক্ষে। এই সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি লাভ করতে করতে ১৯৩১ সালে দেখা যায়, সেন্সেস অনুসারে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের এবং বাংলা অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে ৭০ ভাগ জনগণই ভ‚মিহীন কৃষকে পরিণত হয়েছে। বাকী যে ৩০% এর ভ‚মির মালিকানা ছিল, খোঁজ করলে দেখা যাবে, তাদের মধ্যে সত্যিকারের মালিকানা ছিল নিতান্তই হাতে গোনা কয়েকজনেরই। অধিকাংশই ছিল জমিদার কিংবা ব্রিটিশদের তৈরিকৃত এজেন্ট। এরা মূলত লুণ্ঠনের কাজেই ব্যবহৃত হতো। ১৯২১ সাল থেকে শুরু করে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত এই এক দশকে জমিদার এবং খাজনাভোগী শ্রেণির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ তারা জুলুমকে আরও বেশি ত্বরান্বিত করতে, তাদের শোষণের মাত্রা আরও বেশি বাড়িয়ে দিতে তাদের এজেন্টদের সংখ্যা আরও বেশি বৃদ্ধি করতে থাকে যা দশ বছরের ব্যবধানে ৬২ গুণ বৃদ্ধি পায়।
এরপর যদি আমিরা দুর্ভিক্ষের দিকে আলোকপাত করে দুর্ভিক্ষের কারণের দিকে তাকাই তাহলে দেখি, দুর্ভিক্ষের মূল কারণ ছিল তাদের শোষণ এবং তাদের গ্রহণকৃত নানাবিধ উদ্যোগ যা উপমহাদেশের কৃষি ও অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ লক্ষ্য করি, সুপ্রকাশ রায় ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ’ বইয়ে বলেন, ব্রিটিশরা নিজেদের শোষণের ফল সহজপন্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ভারতে রেলপথ নির্মাণ করে। ফলে তারা ৪ কোটি অধিবাসীর প্রায় ৬ মাসের খাদ্য এবং সকল শিল্পের কাঁচামালের চাহিদা পূরণের জন্য গ্রাম শহর সব কিছু তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সাজিয়ে নেয় তথা রেলপথ নির্মাণ করে।
রেলপথের দ্বারা ভারতের বন্দরগুলির সহিত গ্রাম ও শহরের কেন্দ্রসমূহের সাথে সংযুক্ত হওয়ায় ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন শস্য ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বন্দরগুলোতে অধিক পরিমাণে জাহাজ যোগে প্রেরিত হতো। এভাবে তারা এই মাত্রা দিনকে দিন বৃদ্ধি করে খাদ্যশস্যের পাচার বাড়িয়ে দেয়। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের ও বাংলা অঞ্চলের খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়ে তা কৃষক এবং সাধারণ জনগণের সাধ্যের বাহিরে চলে যায়। জনসাধারণের পক্ষে তা ক্রয় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অথচ কৃষকরাই ছিল এ খাদ্যশস্যের মূল কারিগর।
এস. কে চ্যাটার্জীর ‘দি মিলিয়নস’ বইয়ের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতবর্ষের এই রেলপথ স্থাপনের পূর্বে ও পরে দুর্ভিক্ষের সংখ্যা ও প্রাণহানির তুলনা করলে এ বিষয়ে অনেকখানি স্পষ্ট হওয়া যায় যে, ১৮০২ সাল থেকে ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত ৫৩ বছরে মোট দুর্ভিক্ষের সংখ্যা ছিল ১৩ এবং এইসকল দুর্ভিক্ষের মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫০ লক্ষেরও অধিক। কিন্তু রেলপথের স্থাপত্য নির্মাণ শুরু হওয়ার পর ১৮৬০ থেকে ১৮৭৯ পর্যন্ত এই ২০ বছরে দুর্ভিক্ষের সংখ্যা ১৬ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় দুই কোটি। উপমহাদেশের কৃষকদের সেচ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে জমিজমা, বিভিন্ন সম্পদ, মাঠ, ঘর-বাড়ি নষ্ট করে তার উপর দিয়ে রেলপথ বসায় এবং দেখানো হয় তারা অনেক পরিকল্পিত, উন্নত ও সংরক্ষিত উপায়ে উন্নয়ন করছে। অথচ এই স্থাপনার ক্ষেত্রে তারা মোটেও জনগণ এবং কৃষকদের বাস্তবিক অবস্থার দিকে নজর দেয়নি। তারা নজর দিয়েছিল তাদের লুণ্ঠনের দিকেই, লুণ্ঠন তরান্বিত হওয়ার পন্থার দিকেই। এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক, তাদের তৈরিকৃত রিপোর্ট অনুযায়ী যদি অফিসিয়ালি মৃত্যু ও দুর্ভিক্ষের সংখ্যা এটা হয়, তাহলে বুঝাই যাচ্ছে তা নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের। প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলির অবস্থা তাহলে কি হয়েছিলো? ২০ বছরের ব্যবধানে যদি কোটি কোটি লোক মারা যায় তাহলে সত্যিকার বাস্তবিক অবস্থা কি হয়েছিল? উপমহাদেশে যার ফল আমরা আজও ভোগ করছি।
বার্ণিয়ার যে মন্তব্য করেছিলেন- বাংলাদেশ বা বাংলা অঞ্চল পৃথিবীর অন্যান্য যেসকল প্রভাবশালী সভ্যতা রয়েছে তার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। আমাদের নদীগুলো, সেচব্যবস্থার প্রশংসা তিনি করেছিলেন। উপমহাদেশের ইসলামী সভ্যতা তথা মুঘল সালতানাতের সময় গোটা ভারতবর্ষব্যাপী সেচ ব্যাবস্থা ব্যপক উন্নতি সাধন করে। আর এটি মূলত মুসলিমদের ধারাবাহিক একটি ঐতিহ্য। কেননা আমরা জানি উমর (রা.) এর পর থেকেই এই সেচ ব্যবস্থা, কৃষির উন্নয়ন এবং কৃষির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রযুক্তির প্রয়োগ করা মুসলিমদের একটা সাধারণ ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল। সেই বিশাল ঐতিহ্যের উপমহাদেশের মুসলমানদের গড়া কৃষি ব্যবস্থাকে যারা এমনভাবে ধ্বংস করেছিলো তাদেরই একজন গবেষক বিখ্যাত নদী বিশেষজ্ঞ স্যার ইউলিয়াম ইউলক বলেছিলেন, বাংলা অঞ্চলের যে সমৃদ্ধি ছিল তা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে লুণ্ঠনকারী ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে যা এই সম্বৃদ্ধিতে ভয়াবহ আকারে ধস নামিয়ে দেয়। অথচ ব্রিটিশদের এই উন্নয়নের পিছনে মূলভিত্তি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষি জমি এবং খালবিল।
সুপ্রকাশ রায়ও তার বইতে বলেন, ভারতের এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ মূলত ব্রিটিশদেরই দান। এটি খুব স্বাভাবিক। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, এই প্রত্যেকটি ব্যক্তি ছিল ব্রিটিশদের হয়ে কাজ করা এবং তাদের পক্ষে থাকা লোক অর্থাৎ সুবিধাবাদী ও ব্রিটিশদের গোলাম। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো ব্যক্তিদের উত্তরসূরী যারা ব্রিটিশ শাসনের মঙ্গল কামনা করতো এবং নানা ধরণের পরামর্শ দিতো তাদের বর্ণনা অনুযায়ী-ই যদি ভয়াবহ অবস্থার চিত্রাঙ্কন এমন হয় তাহলে বাস্তবিক অবস্থা আসলে কি ছিল? ১৯১৮ থেকে ১৯২১ সালের দুর্ভিক্ষের পর ১৯৩৪ সালে বাংলা অঞ্চলে বিশেষ খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষের দিকেও যদি তাকাই তাহলে দেখবো, এই দুর্ভিক্ষেও প্রায় এক তৃতীয়াংশের মতো মানুষ মারা যায়। যারা জীবিত ছিল তারাও এতটা কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছিল যে, এই ব্যাপারে মেমোরেন্টামের ৫৯ নং পেইজে বলা আছে, অনেক কৃষকেরা গাছের পাতা খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে ছিল। ১৯৩৬ সালে এ দুর্ভিক্ষ আরও বিস্তার লাভ করে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
যেসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে সেসব অঞ্চলে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ নিহত হয় এবং বিভিন্নভাবে পীড়িত হলে সরকার মাত্র ১১ লক্ষ টাকা সাহায্য করে। কোনো কোনো বর্ণনা মতে ৩৬ লক্ষ টাকার ঋণ প্রদান করে। কিন্তু সত্যিকারার্থে এই দুর্ভিক্ষ থেকে মানুষের মুক্তির জন্য যে কোনো কার্যক্রম থেকে তারা বিরত থাকে।
ভবানী সেনের লেখা ‘ভাঙ্গনের মুখে বাংলা’তেও তিনি বলেন, সেই সময়গুলোতে অর্থাৎ দুর্ভিক্ষের আগে পরের বাংলায় সাধারণ মানুষের ৬-৮ মাস কোনো কোনো অঞ্চলে দশ মাসের খাদ্যের ঘাটতি ছিল। কিন্তু যা উৎপাদিত হতো তা দিয়ে ১ বছরের উৎপাদন দিয়ে কয়েক বছর চলা সম্ভব ছিল। এর থেকেই বুঝা যাচ্ছে সকল উৎপাদিত পণ্য, ফসল লুণ্ঠিত হয়ে চলে যেতো ব্রিটিশদের কোষাগারে। একই বইয়ে লক্ষ করলে দেখা যায় সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলো থেকেও এমনভাবে লুণ্ঠন করা হতো যে মাসে কয়েক লক্ষ মণ চাল তারা সরিয়ে নিতো। ফলশ্রæতিতে খাদ্য সংকটের কারণে মানুষ অনাহারেই মারা যেত। কৃষকদের স্বাস্থ্যহীনতা, মানসিক কষ্ট ও অধিক মৃত্যুর ফলে উৎপাদন কমতে থাকে। কিন্তু এ উৎপাদনের পরেও তারা তাদের লুণ্ঠন হ্রাস পায়নি। প্রতিনিয়ত কৃষকদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। না দিতে পারলে উপহার হিসেবে শাস্তি প্রয়োগ করতো!
ভবানী সেন তার বইয়ে উল্লেখ করেন, ১৯৪০ সালের পরে যে দুর্ভিক্ষগুলো একের পর এক দেখা দেয়, গ্রাম কি শহর সকল জায়গাতেই নিরন্ন, নিঃস্ব কৃষকেরা দুমুঠো ভাতের জন্য ঘর থেকে ঘর ভিক্ষা করতে থাকে। কিন্তু ভিক্ষা দেওয়ার মানুষ-ই তখন ছিল না। গোটা জনগণের শতকরা ৭৫ জনের ঘরেই চাল ছিল না। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণেই মজুদ ছিল যুদ্দার, আড়তদার চোরাকারবারি ব্রিটিশদের এজেন্টদের কাছে, মিল মালিকদের কাছে। এই দস্যুরা মুনাফা আদায় বন্ধ তো করেইনি বরং ব্রিটিশদের কাছে যে ধরণের বার্তা পাঠাচ্ছিল তাতে বোঝা যাচ্ছিল আরও বেশি আয় করা সম্ভব। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে শুধু বাংলা অঞ্চলেই ১৫ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিলো। অথচ এই দুর্ভিক্ষ চলাকালীন অবস্থাতেই ব্রিটিশ এজেন্ট ব্যাপারীরা লাভ করে ১৫০ কোটি টাকা। ভবানী সেন এ নিয়ে আরও বলেন, সরকারি নীতির সংখ্যা অনুযায়ী ৭৫ লক্ষ হলেও অন্যান্য বেসরকারি সূত্রের হিসাব মতে দুর্ভিক্ষের বছরে অনাহারে ৩৫ লক্ষ নর-নারী মারা যায় এবং ১২-১৫ লক্ষ নর- নারী এমনভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে যে তাদের অবস্থা পথের ভিখারির থেকেও করুণ হয়ে যায়। প্রায় কোটির কাছাকাছি সংখ্যক মানুষ নতুন করে ভিখারি হয়। খাদ্যের জন্য মানুষ স্ত্রী, পুত্র সন্তানদেরকেও বিক্রি করতে দ্বিধাবোধ করে না। নর্দমার মধ্যে কুকুরের সাথে উচ্ছিষ্ট নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে থাকে অনাহারে ভুগতে থাকা মানুষগুলো। তিনি একই বইয়ে আরও বলেছেন, দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিটির সরকারি বিবরণ অনুসারে বাংলাদেশের ৬ কোটি মানুষের মধ্যে ২ কোটি মানুষের জীবন দুর্ভিক্ষ দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাংলার ৯০টি মহকুমার মধ্যে ২৯ টি মহকুমায় ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়ে দুর্ভিক্ষের ভয়াল থাবা। বাংলাদেশের ৮২ হাজার ৯ শত ৫৫ কিলোমিটার মধ্যে অধিকাংশ অঞ্চলেই দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়।
এভাবে যখন অবস্থা আরও নিম্নগামী হতে থাকে ঠিক এ সময়ই ব্রিটিশরা পরিকল্পনা করতে থাকে এ অঞ্চল থেকে চলে যাওয়ার। তাদের শোষণের, জুলুমের পন্থাকে পরিবর্তন করার। কথিত স্বাধীনতা তথা তাদের ভাষায় পাওয়ার ট্রান্সফার করার চিন্তা। সে সময়ের বগুড়া জেলার একটি গ্রামে তাঁতিদের সম্পর্কে জনযোদ্ধার একটি রিপোর্টে বলা হয়, দশটিকা গ্রামে ২০০ জন তাঁতির বসবাস। তাদের মোট সংখ্যা ১৭৩ এবং ২৫ জনের ৪-৫ বিঘা করে আবাদী জমি ছিল। দুর্ভিক্ষ সময় ৫০ জন লোককে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ভিক্ষা করে বাঁচতে হয়েছে। আর বাকীরা অসুস্থ থেকেই মারা গিয়েছে। যারা বেঁচে আছে তারাই জমি বিক্রি করে দিন মজুর হয়েছে। আর বাকীরা তাদের বাড়ি- ঘর বন্ধক রেখে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছে। এটি শুধু দশটিকা গ্রামে নয় গোটা অঞ্চলের একই অবস্থা। ভবানী সেনের ভাষায় এসময় যাদেরও কিছু কিছু জমি ছিল তারাও সকল জমি হারিয়ে ফেলে। কেউ বিক্রি করে আবার কেউ বন্ধক রাখে। এর মধ্য দিয়ে অধিকাংশ কৃষক এবং সাধারণ মানুষ তাদের অবস্থান থেকে পরিপূর্ণভাবে নিঃশেষ হয়ে যায়। ভবানী সেন উক্ত গ্রন্থে আরও বলেন, দুর্ভিক্ষের সময় একটি হিসাব অনুযায়ী ৩৫ লক্ষ মানুষ মারা গেছে কিন্তু যারা বেঁচে আছে তারাই আজকের দিনে আরও সমস্যায় আছে। কেননা এলাকা গুলিতে শতকরা দশ জন লোক এতো বেশি দুস্থ ও রোগাগ্রস্থ যে তাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। প্রায় ১২ লক্ষ লোক নতুন করে ভিখারি হয়েছে। একেবারে ভিখারী না হলেও রিক্ত হয়েছে এমন লোকের সংখ্যা ৬০ লক্ষ।
এখন প্রশ্ন থেকে যায় যে, এতো বিশাল উন্নত সালতানাত ২৯% জিডিপি নিয়ন্ত্রণকারী ইসলামী সভ্যতা যেখনে মাত্র ২০% মুসলিম ছিল আর বাকী সবাই ছিল অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সেখানে মুসলিমরা এমন একটি অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং কৃষি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলো যেখানে সাধারণ যাকাত নেওয়ার মতো লোক পাওয়া যেতো না। যে অর্থনৈতিক অবস্থা এতো উন্নত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো সেখানে কি এমন হলো যে, তারা তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এভাবে দুর্ভিক্ষের পর দুর্ভিক্ষ, মৃত্যুর পর মৃত্যু, শোষণের পর শোষণ শুরু হলো তা আমাদের উপলব্ধি করার সময় কি এখনো আসেনি?
তারা কথিত স্বাধীনতা দেওয়ার পরেও পুরো উপমহাদেশ জুড়ে এমন এক অবস্থা বিরাজ করছিল যে, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলে একটি পর একটি দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকতো যা চির দুর্ভিক্ষের দেশে পরিণত হয়েছিল। এসময় থেকেই শুরু হলো নতুন করে খাদ্যের অভাব এবং নানাবিধ দুর্ভিক্ষ। ব্যাপকতা, স্থায়ী প্রাণহানির দিক দিয়ে দুর্ভিক্ষ ভারতের ইতিহাসে নতুন আরেক রেকর্ড স্থাপন করল। অর্থাৎ ব্রিটিশরা থাকা অবস্থাতেই যে পরিস্থিতি ছিল তারা চলে যাওয়ার পরও সে অবস্থা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকলো। অর্থাৎ এ শাসন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কোনো সময় হয়েছে কিনা কিংবা এতো নিকৃষ্টতর শাসন পৃথিবীর ইতিহাসে আদৌ সম্ভব কিনা আমার জানা নেই। পাশাপাশি তারা চলে যাওয়ার পর যে নয়া ব্যবস্থা রেখে গেলো তার ভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ আজও বিদ্যমান। তা পরবর্তীতে বা গত ৫০-৬০ বছরের অর্থনৈতিক অবস্থা, কৃষির দুর্ভিক্ষ এবং দারিদ্র্য অবস্থা দেখলেই টের পাওয়া যায়।
ব্রিটিশ পরবর্তী বাংলা অঞ্চলে কৃষি ও খাদ্য :
১৯ শতকের শেষের দিকে দুনিয়ার অবস্থা নানাভাবে পরিবর্তীত হতে থাকে। বিশেষ করে উসমানী খিলাফতের পূর্ণাঙ্গ পতনের পর দুটি বিশ্ব যুদ্ধ এবং ইয়াল্টা কনফারেন্সের মাধ্যমে পরবর্তীতে দুনিয়ায় নতুন এক রূপরেখা তথা নয়া বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর সরাসরি শাসনের পন্থা থেকে সরে এসে যায়নবাদী গোষ্ঠীরা কথিত স্বাধীনতার নাম করে শোষণ এবং নিয়ন্ত্রণের ভিন্ন এক কৌশল প্রতিষ্ঠা করে। ফলে উপমহাদেশ থেকে তারা চলে যাওয়ার পরও শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদীতা এক বিন্দুও কমে যায়নি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কৃষিক্ষেত্রে, খাদ্য ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক ভয়াবহ সংকট বিদ্যমান ছিল স্বাধীনতার পর যেসকল শাসক ক্ষমতায় আসীন হন তারা সেই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে মুকাবিলা করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হন। আর এ পরিস্থিতির উত্তোরণে তারা তাদের নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার কৌশল প্রয়োগ করে। তারা বুঝাতে শুরু করে যেহেতু অর্থনৈতিক অবস্থা বেশি ভালো না সেহেতু নির্দিষ্ট কিছু শর্তের বিনিময়ে তোমরা ঋণ গ্রহণ কর। আর তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্র সে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য ছিল কেননা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারেই ভঙ্গুর ছিল। আর এই ভংগুর অর্থনীতির উত্তোরণ ঘটিয়ে রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। আর এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাশ্চাত্য জায়নবাদীরা গরিব শ্রেণির মানুষদের ঋণ দিতে থাকে, সামাজিক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে। এসকল ত্রাণ এবং সামাজিক সংস্থাও ছিলো নয়া ষড়যন্ত্রের অংশ।
সেসকল সহযোগিতা ও ত্রাণের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল তাদের তৈরিকৃত বীজ এবং প্রদানকৃত খাদ্য। রাষ্ট্র এক্ষেত্রেও বীজ ও খাদ্য গ্রহণে বাধ্য ছিলো। ফলশ্রæতিতে এসকল ঋণ গ্রহণের শর্ত, ত্রাণ প্রদান, নানা সহযোগিতাসহ সব মিলিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় নয়া এক কৃষি ও খাদ্যনীতি। মূলত তারা কৃষি বিল্পবের নাম করে নতুন এক কৃষি ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করে। ২০০ বছরের জুলুম ও নয়া কৌশলের মধ্যে দিয়ে হারিয়ে যায় উপমহাদেশের নানা জাতের ফসল। অথচ এক সময়ে কয়েক প্রকারের ফসল এ অঞ্চলে বিদ্যমান ছিল, কয়েক ধরণের বীজ এখানে উৎপন্ন হতো। তা অল্প বিস্তর শুরুতেই বলা হয়েছে। কিন্তু সেই অঞ্চলেই তারা সকল বীজ এবং ফসল কে নষ্ট করে দিয়ে স্বাদবিহীন ফার্মের ফসল তথা হাইব্রিড ফসলের দিকে নিয়ে যায় গোটা জাতিকে। এই বীজ এবং হাইব্রিড ফসলের মধ্য দিয়ে আমদানি হয় নানা ধরণের রোগব্যাধির। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি আমেরিকা, আফ্রিকা ও উপমহাদেশে তাদের শাস্তি এবং গণহত্যার অন্যতম ভিত্তি ছিল নানা ধরণের রোগ সৃষ্টি করে হত্যা করা, নিয়ন্ত্রণ করা। আবার পরিস্থিতিও এমন একটি জায়গায় চলে যায় যেখান থেকে চাইলেও বের হতে পারছিলো না রাষ্ট্র তথা কৃষিব্যবস্থা।
এরই পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলন অভ্যন্তরীণভাবে এমন এক কোন্দলপূর্ণ অবস্থায় গিয়ে পৌঁছায় যে জন্য এসকল বিষয়ের প্রতি কারোর দৃষ্টিপাত করার সময় হয়নি বা আজও পর্যন্ত হচ্ছে না। এভাবেই পাশ্চাত্য তার জায়নবাদ নীতি দিয়ে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কৃষি প্রযুক্তিতে বীজের ধারণা ও খাদ্যনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। এটিও আন্তর্জাতিক শোষণের একটি অংশ এবং জায়ানবাদী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ ও শোষণের একটি হাতিয়ার। তাদের সরাসরি শাসন পরবর্তী কথিত স্বাধীন অঞ্চল গুলোতে দুর্ভিক্ষ, খাদ্য সংকট এমনভাবে বিদ্যমান ছিলো যার থেকে উত্তোরণ ঘটানো আমাদের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। আর এই সুযোগটিই তারা বিভিন্নভাবে কাজে লাগায়। তারা নতুন নতুন পন্থা, কৌশল রাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরতে থাকে। ফলশ্রæতিতে ৬০ এর দশকে কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কোনো ধরণের সত্যিকার পলিসি নির্ধারিত হয়নি। কিন্তু সেসময়ের সরকারি ব্যবস্থাপনায়, খাদ্যনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। তখন সব জায়গায় রকফেলার ফাউন্ডেশনের নীতি ও কৌশল বাস্তবায়ন করা হয়। কারণ দরিদ্র দেশ শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশসহ আফ্রিকার প্রত্যেকটি উপনিবেশিক শাসন পরবর্তী অঞ্চলে উন্নত টেকনোলজির ব্যবস্থা ছিলো না, ছিল অশিক্ষিত শ্রেণী বা শিক্ষার হার ছিল না, গৃহযুদ্ধে ভরে গিয়েছিলো অঞ্চলগুলো। দুর্ভিক্ষ প্রতি বছর জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফলশ্রুতিতে এই দরিদ্র দেশগুলো বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ নিতে বাধ্য হতো। আর এই ঋণ দেওয়ার সময়ই তারা এ সকল নীতি পরিবর্তনের শর্ত দেয়।
তখনই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সব জায়গাতেই খাদ্যের সংজ্ঞায়নে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। ইসলামী সভ্যতার খাদ্যনীতি হচ্ছে,
- স্বাস্থ্যকর ও উপকারী,
- পুষ্টিকর,
- হালাল।
কিন্তু তারা খাবারের সংজ্ঞায়নে তুলে ধরে,
- পুষ্টি নয় পরিমাণে বিশ্বাসী।
- উপকারে নয় বরং চাকচিক্য ও স্বাদে বিশ্বাসী।
তারা শুধু মাত্র শিক্ষা দিয়ে নয় মিডিয়ার মাধ্যমে এমনভাবে প্রচার করতে থাকে যার ফলে তাদের খাদ্যগুলো একেকটি ফ্যাশনে পরিনত হয় এবং প্রত্যেক জনগণের মাথায় চিন্তাগতভাবে এ খাদ্যের সংজ্ঞাকে, মডেলকে পুশ করা হয়। ফলশ্রুতিতে মানুষ নিপতিত নতুন এক আগ্রাসনের সমুদ্রে।
কিন্তু লক্ষ্য করুন, তারা ঋণ দিয়েছে বিপরীতে কিন্তু তারা শিক্ষাকে উন্নত, প্রযুক্তিকে উন্নত, গবেষণাগারকে উন্নত করার ব্যাপারে কোনো ধরনের জোর দেয়নি। ৮০’র দশকে ৯০’র দশকে এই নীতি চলমান অবস্থায় তারা কথিত দুর্ভিক্ষ দমনের নাম করে হাইব্রিড ধান নিয়ে আসে এবং হাইব্রিড ধান দ্রুত উৎপন্ন হওয়ার ফলে মনে করে কৃষির ক্ষেত্রে সত্যিই বিপ্লব হচ্ছে। অথচ আমাদের সত্যিকারের বীজ, আমাদের উর্বর জমিতে যদি বাংলা সালতানাতের মতো করে চাষাবাদ করা যেত তাহলে সাধারণ ভাবেই অনেক বেশি ফসল উৎপন্ন হতো যার দ্বারা খাদ্য সংকট মোকাবিলা করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সেই ধরণের যোগ্যতা, কৌশল এবং চিন্তাধারা না থাকায় যায়নবাদীদের ফসল নিতে আমরা বাধ্য হচ্ছি।
এ ফসল একইসাথে প্রভাব ফেলছে আমাদের মানসিক অবস্থায়, আমাদের মনস্তত্ত্বে। মাওলানা মওদূদী তর্জমানুল কোরআনে এক প্রবন্ধে লিখেন-
“ইসলাম শূকর এবং মদ শুধুমাত্র এ কারণে নিষিদ্ধ করেনি যে তা শরীরের জন্য অপকারী। বরং তা একইসাথে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। খাদ্য শুধু মানুষের শরীরেই নয় বরং তাঁর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে।”
ইসলাম খাবারের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে হালালকে, তাঁর পেছনের দর্শন মূলত এটি। কারণ খাবার শুধু বাহ্যিক প্রভাবই রাখে না একইসাথে আভ্যন্তরীণ ও নৈতিক প্রভাবও বিস্তার করে। অঞ্চলোপযোগী, উপকারী, পবিত্র ও হালাল খাবারের বিপরীতে এমন খাদ্যের মডেল যায়নবাদীরা হাজির করেছে যা মানুষকে অস্থিরমতি করে ফেলে, তাঁর নৈতিক জায়গাকে প্রভাবিত করে। সমকামিতার ন্যায় মানবপ্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজগুলো প্রসার লাভের পেছনেও খাদ্যের প্রভাব বিদ্যমান। খাদ্যের সাথে কৃষি এবং ভ‚মিব্যবস্থা আঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু আমরা এগুলাকে কবীরা গুনাহ বলে ফতোয়া দিয়ে ধর্মতাত্ত্বিক সমাধান খোঁজায় রত থাকি। প্রশ্ন হলো- আন্তর্জাতিক বীজনীতি, আমাদের অঞ্চলে তাদের শোষণ ও ভূমিব্যবস্থা পরিবর্তন, খাদ্যের নৈতিক প্রভাব, খাদ্য রাজনীতি সর্বোপরি কৃষিব্যবস্থার ভয়াবহ সংকট এবং সমাধানের ক্ষেত্র অনুসন্ধানে রাজনৈতিক এবং সামগ্রিক সমাধান না খুজে ধর্মতাত্তি¡ক সমাধান হাজির করলেই কি সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব?
এই হাইব্রিড ফসল যখন দেয়া হলো আর তাদের বীজের মধ্যেই যেহেতু সমস্যা সুতরাং এই সমস্যা দূরীকরণের জন্য তারা নতুন করে প্রদান করল সার আর কীটনাশক সিস্টেম। অর্থাৎ একজন সুস্থ মানুষকে ইনজেকশন দিয়ে অসুস্থ করে দেয়া শুরু হলো। আমাদের জমি ছিল উর্বর। সে জমিতে সার এবং কীটনাশকগুলোকে ইনজেকশনের মতো পুশ করা শুরু হলো। সেখানে উৎপাদিত হওয়া শুরু হল হাইব্রিড ধান। ফলাফল হিসেবে সাময়িক উৎপাদন হলেও মাটি তার উর্বরতা হারাতে শুরু করলো, পানি দূষিত হতে হতে লাগল। গত ৪০ বছর যাবৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি এই জমির ফলন ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। ২০০ বছর পরে কি হতে পারে তা নিয়ে কি আমরা একবারও ভেবে দেখেছি? ৫০ বছরের ব্যবধানে উৎপাদন খরচ কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০০ বছর পর এই অবস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, তা কি আমরা একবারও ভেবেছি? কৃষকেরা তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য তো পাচ্ছেই না উপরন্তু নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
গবেষকদের মতে, “খাদ্যের সংজ্ঞাতে পরিবর্তন ঘটনো হয়েছে। খাদ্যের সংজ্ঞা নির্ণয়ে দানাদার খাদ্যকে প্রধান খাদ্যের (Staple Food) মর্যাদা দেওয়া হয়েছে; খাদ্যের পুষ্টিগুণের চেয়ে পরিমানের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। মেক্সিকো সরকার ও রকফেলার ফাউন্ডেশান ১৯৪৩ সালের দিকে ‘সবুজ বিপ্লব’-কে একটি কৃৎকৌশলগত প্যাকেজ হিসেবে দেখানোর জন্য ‘বিশেষ গবেষণা’র উদ্যোগ নিয়েছে। সেই উদ্যোগ ১৯৬০ দশকে পুনর্গঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (International Rice Research Institute) হিসেবে। স্থানীয় পরিবেশ, প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র্য এবং চাষের জমির বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ধানের জাতকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
তথাকথিত অনুন্নত দেশগুলোকে রকফেলার ফাউন্ডেশনের নীতি ও কৃৎকৌশল চাপিয়ে দেওয়া সহজ ছিল না। সেটা তারা করেছে বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাবার শর্ত হিসেবে। ষাটের দশকে বিশ্ব ব্যাংকের শর্ত মেনে তৎকালীন পাকিস্তানের আইয়ুব খান সরকার উফশি বীজ প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি পদ্ধতি চালু করেছিলেন, যার মূলে শুধু উফশী বীজ নয়,একই সঙ্গে ছিল রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার। এবং তা এসেছিল সুদূর আমেরিকার ফোর্ড এবং রকফেলার ফাউন্ডেশানের আর্থিক কল্যাণে। এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোই সহযোগিতা করেছিল প্রাণ ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ দেশগুলোতে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে কৃষিকে ‘উন্নত’ করতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই সকল রাসায়নিক পদার্থের বা বিষাক্ত দ্রব্যের জন্য বাজার তৈরির দরকার ছিল। ‘সবুজ বিপ্লব’ বা এৎববহ জবাড়ষঁঃরড়হ আসলে নিছকই বৈজ্ঞানিক ব্যাপার ছিল না। এটি ছিল একটি কৃৎকৌশলগত প্যাকেজ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি আর আধুনিক বিজ্ঞানের কৌশলগত ব্যবহার। যুদ্ধে ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিক উদ্বৃত্তের বাজার তৈরির জন্য এমন ধানের জাত উদ্ভাবিত হল যেসব জাত চাষের জন্য বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ও কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। সর্বোপরি এটা বাস্তবায়িত করতে কৃষক নয়, কৃষি ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা, ল্যাবরেটরির গবেষকদের হাতে তুলে দেওয়া ইত্যাদি সব কিছুরই মিলিত প্রকল্প ছিল গ্রিন রেভুলিউশান (সবুজ বিপ্লব)। অধিক উৎপাদন করে মানুষকে ক্ষুধা থেকে বাঁচাবার কথা বলা হয় বটে, আসলে সবুজ বিপ্লবের মূল কাজ ছিল ল্যাবরেটরিতে উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশিল বীজের সাথে কৃত্রিম সার ও কীটনাশক এবং তার সাথে সেচ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। কর্পোরেট কৃষির বীজ বপন এখান থেকেই শুরু।
গবেষকগণ বলেন, “সেই ষাটের দশক থেকে পৃথিবীতে খাদ্য নিরাপত্তার রাজনীতি চলছে। বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের সরকারি দপ্তর থেকে থেকে বলা হয়, মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা পেতে হলে উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষ করতে হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত এসে দেখা গেল উফশী ধান চাষ করে মানুষ খাদ্যে নিরাপত্তা পায়নি। বিপরীতে মানুষ ব্যাপকভাবে খাদ্য ঝুঁকিতে পড়েছে। উফশী জাতের ধান চাষ করতে গিয়ে যে সার, বীজ, কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে একদিকে মাটির উর্বরতা কমেছে, অপরদিকে অপকারি পোকা মারতে গিয়ে উপকারি পোকাও মারা গেছে। তাই গাছের পরাগায়নে মধুপোকা বা প্রজাপতি এখন আর ফসলের মাঠে দেখা যায় না। তাছাড়া মানুষ একবার জমি চাষ করে তিন চারবার ফসল তুলত। ধান পাকলে মাষকলাই মাঠে থাকত, একইসাথে তিলও চাষ করা হত। এতে জমির উর্বরতা কমত না, মাটির ক্ষয়ও রোধ হত। কিন্তু একই জমিতে পরপর ধান চাষ করায় প্রতিবারের জন্য নতুন করে জমি চাষ করতে হচ্ছে। তাতে যেমন মাটির ক্ষয় হচ্ছে, তেমনি কমে যাচ্ছে উর্বরতা। এছাড়া ফসলের মাঠ এবং বাড়ির আঙ্গিনায় প্রকৃতিকভাবে হওয়া বিভিন্ন লতাগুল্ম পাওয়া যেত। কিন্তু নানা ধরনের কীটনাশক ও আগাছানাশক ওষুধ দেয়ায় আগাছার সাথে প্রকৃতিকভাবে হওয়া পুষ্টিগুণ-সম্পন্ন এসব লতাগুল্মও মরে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল উফশী চাষ করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কথা বলা হলেও তা সম্ভব হয় না।
৯০-এর দশক পরবর্তী সময়ে নতুন ধাচের হাইব্রিড বীজ প্রথমবার সরবরাহের পর দ্বিতীয় ধাপ থেকে বীজ দেয়া শুরু করল সরকারের সাথে সরাসরি চুক্তিতে থাকা প্রাইভেট কোম্পানিগুলো। হাইব্রিড এই বীজ থেকে যে ফসল উৎপাদিত হচ্ছে তাতে সার এবং কীটনাশক দিতে হচ্ছে। কৃষি বিশ্লেষকেরা বলছেন, হাইব্রিড বীজের একচ্ছত্র মালিকানা কোম্পানির সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে এবং গুটি কয়েক কোম্পানির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকছে। যেমন ২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী মনসান্টো ৪,৯৬৪ মিলিয়ন ডলারের বীজ ব্যবসা করে এবং মালিকানাধীন বীজের বাজারের ২৩% নিয়ন্ত্রণ করে। এর পরে রয়েছে ডু-পন্ট (১৫%), সিনজেনটা (৯%) । মাত্র ১০টি কোম্পানি পৃথিবীর মালিকানাধীন বীজের বাজার দখল করে আছে। তার মধ্যে উল্লেখিত তিনটি কোম্পানি ৪৭% বাজার দখল করে আছে। এর অর্থ হচ্ছে বিশ্ব কৃষি ব্যবস্থায় গুটিকয়েক বহুজাতিক কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
এর ফলাফল হচ্ছে চকচকে সুন্দর সবজি উৎপাদন হলেও জমির অবস্থা ক্রমেই নষ্ট হতে শুরু করছে। মানুষ ভয়াবহ দুর্বলতা ও নতুন নতুন রোগের মধ্যে নিপতিত হচ্ছে। GMO (Genetically Modified Organism) হচ্ছে, বীজের মডিফাই করণ। বিশ্বব্যাপী শুরু হওয়া এই প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশে বীজ আসতে শুরু করলো। যা গবেষক ও বিজ্ঞানীদের ভাষায় এখনো পর্যন্ত অস্পষ্ট। কিন্তু ফলাফলস্বরূপ মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সারসহ সব ধরণের ভয়াবহ রোগ যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তা আশংকাজনক। মোট মৃত্যুর ৬১ ভাগই হচ্ছে এইসকল খাদ্য, বীজ ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে। বর্তমানে ৮০ ভাগ খাদ্যে ক্যামিকেল মিশানো হয়। ৬৭ ভাগ জমিতে কীটনাশক ছিটানো হয়। যার ফলে রোগ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তাই নয় কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশের সাথে উপযোগী পোকা গুলিও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যেমন জোনাকী পোকা আজ বিলুপ্তির পথে। বাৎসরিক কৃষি পরিসংখ্যান গ্রন্থে (Yearbook of Agricultural Statistics in Bangladesh, 2009) দেখা যায়, ১৯৯৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কীটনাশক ব্যবহারের পরিমান ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ১৯৯৩ সালে ছিল ৭৬৬০.৩৯ মেট্রিক টন, ২০০৭ সালে তা হয়েছে ৩৭৭১২.২০ মেট্রিক টন, অর্থাৎ ৩৯২% বেড়েছে। উল্লেখ্য ধান ও অন্য ফসলে হাইব্রীড বীজের ব্যবহার ১৯৯৮ সাল থেকে অনেক গুণ বেড়ে গেছে।
সরাসরি হাতের সাহায্যে জমিতে এই কীটনাশক ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশের ক্যান্সার রোগীর ৬০ শতাংশ হচ্ছে কৃষক। কারণ এই কীটনাশক খালি হাতে তারা ব্যবহার করে।
পানিতে বিভিন্ন ধরণের কেমিকেল ও কারখানার ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থের দরুন পানি দূষণের কারণে জমি নষ্ট হচ্ছে এবং কৃষকরা এভাবেই প্রতিদিন দারিদ্রতার কাছে হার মানছে। শুধু কি তাই, জাতিসংঘ কর্তৃক কৃষিতে ব্যবহৃত ১২টি কীটনাশক নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তা বাংলাদেশে অবলিলায় ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এসকল কীটনাশকগুলো ব্যবহারের ফলে লিভার, কিডনী, স্তন ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব, ত্বকের সমস্যাসহ নানা ধরণের সমস্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই সব কিছুর কারণ এই ধরণের সার, কীটনাশক এবং বীজ ব্যবস্থা। এতো কিছু ব্যবহারের পরেও ৮৪% কৃষক গড়ে মাত্র ৩ একর জমিতে চাষ করে। চাষ করার পরও তারা ন্যায্যমুল্য পাচ্ছে না। চড়া সুদ দিতে হচ্ছে। যার কারণে খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে আরও কমদামী হাইব্রিড বীজ, কীটনাশক, সার কিনছে। ফসল বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরণের ক্যামিকেল বা ঔষধ ব্যবহার করছে। কিন্তু তবুও তারা তাদের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না এবং পরিবারকে চালাতে পারছে না। কারণ এসব কিছু নির্দিষ্ট একটি চক্রের হাতে বন্দি।
এই চক্রগুলোর কাছে বন্দি হওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে, যেসব বীজ কোম্পানি গুলো আমাদেরকে বীজ দিয়ে থাকে তারাই প্রত্যেকটি ঔষধ কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ। অর্থাৎ তারা যে রোগের ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে, ঔষধ কোম্পানিগুলো সে রোগের ঔষধ তৈরি করছে। আমরা ভাইরাস খাচ্ছি আবার তাদেরই দেওয়া ঔষধও ভক্ষণ করছি।
আলোচনার শুরুতে উল্লেখিত আয়াত দুটির কথা এবারে যদি চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাচ্ছি ইয়াহুদিরা সারা পৃথিবী নিয়ন্ত্রন করছে। এবং তারা আমাদের দেশে এসে কিভাবে এবং কেন শস্যক্ষেত এবং মানব বংশকে ধ্বংস করছে তার উত্তর পাচ্ছি কি?
এজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭০ সালে বলেছিলেন “Control oil and you control nations; control food and you control the people.” অর্থাৎ, যদি তুমি তেলকে নিয়ন্ত্রন কর তাহলে তুমি একটি জাতিকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে আর যদি তুমি খাদ্যকে (বীজ) নিয়ন্ত্রন কর তাহলে মানুষকে অর্থাৎ সারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
আর এটিই তারা সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করে চলেছে। যেমন, তাদের বীজ ও খাদ্য কোম্পানী সারা দুনিয়ার কৃষি ও খাদ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কৃষিপণ্য এবং কীটনাশক উৎপাদনকারী নিয়ন্ত্রণকারী বৃহৎ কোম্পানিসমূহ :
- 1| Cargill
- 2| Bayer
- 3| DuPont
- 4| Monsanto
- 5| Syngenta
এই কোম্পানিগুলো বীজের পাশাপাশি খাদ্যকেও নিয়ন্ত্রণ করে। গত শতকে এইডস, ডায়াবেটিস, বার্ডফ্লুসহ আরও অনেক রোগের জীবাণু ছড়ানোর পেছনে এরাই দায়ী। যেমন, চিনি, গম, চালের জিনের সাথে তারা ডায়াবেটিস-সহ আরও নানাবিধ রোগ মিশয়ে দিয়ে থাকে। তার অন্যতম একটি উদাহরণ হচ্ছে, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ চকলেট এবং চিনিজাত পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান হল নেসলে (Netsle) আবার ডায়াবেটিকস কিংবা চিনি খাওয়ার ফলে যে সব অসুখ শরীরে দানাবাঁধে তার মেট্যাংস (Metanx) নামক ঔষধও তৈরি করে এই একই কোম্পানি!
ভয়াবহ এই আগ্রাসনকে তুলে ধরার জন্য অনেক গবেষকগণ কাজ করে যাচ্ছেন! তন্মধ্যে F. William Engdahl এর লেখা Seeds of Destruction: The Hidden Agenda of Genetic manipulation নামক বইটি অন্যতম।
এসব সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ফলাফল স্বরূপ আমাদের স্বাস্থ্য খাত, আমাদের শারীরিক অবস্থা, মানসিক অবস্থা, পরিবেশের অবস্থা এতোটাই নিম্নগামী যেখানে আমাদের গড় আয়ু ছিল ৮০-৯০ বছর এখন তা কমতে কমতে ৪০ এর কোঠায় এসে নেমেছে। হঠাৎ মৃত্যু, হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক, নানা ধরণের ক্যান্সার, রোগ বৃদ্ধি, শতভাগ মানুষ আজ দুর্বলতার মধ্যে ভুগছে, গ্যাস্ট্রি, কিডনী ইত্যাদিতে ভুগছে। প্রতিটি ঘরের প্রত্যক ব্যক্তি আজ গণহারে অসুস্থ। সুস্থ হওয়ার কোনো পথ নেই কারণ তাদেরই দেওয়া ঔষধ খেয়ে সুস্থ হওয়া লাগবে!
তাই স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় তাদের দেওয়া স্বাধীনতা, ঋণ, সহযোগিতা, ত্রাণ কোনো কিছুই মানবতার জন্য না। পুরোটাই মূলত শোষণের উদ্দেশ্যে। তাদের হাতে গড়ে ওঠা কিংবা তৈরী হওয়া একটি শ্রেণির বয়ান হাজির করে কথিত উন্নয়নের কৃষি, বিজ্ঞানের বিপ্লবের। কিন্তু বাস্তবিক অবস্থা কি তা তো আমরা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারছি।
এসব বিষয় যে আমরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করে সচেতনতা তৈরি করব, এর থেকে মুক্তির পথ খুঁজব এর জন্য শক্তিশালী কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেই। নেই কোনো কার্যকরি উদ্যোগ। প্রতিটি সেক্টর এখন পুরোপুরিই বিদেশি কোম্পানিগুলোর হাতে বন্দি। সত্যিকারের মুক্তি জন্য নয়, স্বাধীনতার জন্য নয় দুর্ভিক্ষ কিংবা ক্ষুধা থেকে বাঁচাবার জন্য নয় এই সবকিছু একটি দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ভয়াবহ ধাপ।
কৃষকেরা জমিতে সার-কীটনাশক ব্যবহার করছে কৃষির ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য। কিন্তু তারা কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় ঋণ পাচ্ছে না, স্থায়ী পুঁজিও নেই তাদের। তাহলে তারা কীভাবে এই কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে? সমাধানস্বরূপ তারা বিভিন্ন এনজিও, গ্রামের মহাজনদের কাছে ঋণের জন্য হাত পাতছেন। এছাড়া আছে ব্যাংক, ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প। কিন্তু এগুলোর প্রতিটিতেই রয়েছে সুদের মহা কারবার। একজন সবজি চাষীর ভাষ্যমতে তাকে ১০০ টাকায় সুদ দিতে হচ্ছে ২১ টাকা। এতে তার লাভের পরিমাণ ১০০ টাকায় ১০৫-১১০ টাকা। কুটির শিল্প, মৎস শিল্পের সাথে জড়িতদের সুদ দিতে হয় ১৭% যেখানে লাভ হয় ১৫%। বোঝাই যাচ্ছে গ্রামীণ সুদের কী ভয়াবহ অবস্থা!
কৃষিতে ভয়াবহ লোকসান কিংবা লাভ এত কম হওয়ার পিছনের কারণ খুঁজলে দেখবো সমগ্র বিষয়ের পেছনে নির্দিষ্ট সিন্ডিকেট কাজ করে। কৃষিপণ্য উৎপাদনের পর তা বাজারজাত করার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেক দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশের যাতায়াত ব্যবস্থার যে করুণ দশা, তাতে নির্দিষ্ট স্থানে পণ্য নিয়ে যেতে বেশ কাটখড় পোড়াতে হয়। এরপর শুরু হয় চাঁদাবাজি! নানা জাতীয় সিন্ডিকেটের কারণে রংপুরের ২ টাকার টমেটো আমাদের হাতে আসতে আসতে দাম হয়ে যায় ৪০ টাকা। কিন্তু কৃষক তো সেই উৎপাদন মূল্য দুই টাকাই পাচ্ছে! খরচ হচ্ছে ২ টাকা, বিক্রিও করছে ২ টাকায়। আর আমরা যারা ক্রেতা, তারা কিনছি ৪০ টাকায়। এই বড় ধরনের অব্যবস্থাপনা, দূর্নীতি, আখলাকবিহীন অবস্থার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষকসমাজ এবং সাধারণ মানুষ। লাভ হচ্ছে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের।
LLRD-এর মতে বর্তমানে ৫০% পুরুষ এবং ৬০% নারী কৃষক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ, অন্যান্য চাহিদার কারণে তারা নিজেদের উৎপাদিত শাক-সবজি, নিজেদের চাষ করা মাছ নিজেরাই ভোগ করতে পারছে না। তারা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না, বঞ্চিত হচ্ছে তাদের সন্তানেরাও। আর তারা যতটুকু গ্রহণ করতে পারছে, সেটাতেও আছে কীটনাশক, সার আর ভেজালের সমাহার। তাহলে চিন্তা করে দেখুন! এই চাষী, হাওড়-নদীর জেলে, প্রান্তিক ও ভ‚মিহীন কৃষক, নারী কৃষক, কুটির-শিল্পীদের নিয়ে, তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে কি আমরা একটুও ভাবছি? রাষ্ট্রের কোনো সহযোগিতা বা উদ্যোগ কি আছে? আছে কি কোনো পরিকল্পনা, পর্যালোচনা বা প্রস্তাবনা? অর্থাৎ তারা যা-ই করছে সবটাই গ্রামের মহাজনদের কাছ থেকে সুদ নিয়ে। এতে করে তাদের দারিদ্র্য তো কোনো অংশে কমছেই না, বরং দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তাদের স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক অবস্থার করুণ দশা। এমনকি শিক্ষা থেকেও তারা অনেক অনেক দূরে।
কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। অথচ বর্তমানে ধান ব্যতীত যাবতীয় কৃষিদ্রব্য আমদানি করতে হচ্ছে। সক্ষমতার চেয়ে অনেক কম ধান উৎপন্ন হচ্ছে। আর যতটুকুই উৎপাদিত হচ্ছে, তা মজুদ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই! তাহলে বাকি ফসল কোথায় যাচ্ছে? মহাজনেরা, বিভিন্ন কোম্পানি কিংবা সাধারণ ব্যবসায়ীরা কিনে নিচ্ছে। যার ফলে কৃষকরা তাদের কষ্ট, শ্রম, বিনিয়োগের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। এমনকি সরকার রাষ্ট্রীয় গুদামের ধারণক্ষমতাও বৃদ্ধি করছে না।
যারা ধান চাষ করে তাদের ক্ষেত্রে যদি লক্ষ্য করি, ২০০২ সালে বর্গাচাষী অর্থাৎ ভ‚মিহীন চাষীর সংখ্যা ছিল শতকরা ৪৫%, ২০১৬ তে এসে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫% এ। বর্তমানে এ সংখ্যা ৭০% ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে ভেবে দেখার বিষয় এই ৭০% কৃষক যেখানে ভ‚মিহীন এবং তাদের চাষকৃত ফসলের ৫০% মালিককে দিয়ে দিতে হচ্ছে, সেখানে এই কৃষকরা কি আদৌ তাদের পরিশ্রমের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে?
বাংলাদেশে তুলার মোট চাহিদা ৭৩-৭৪ লক্ষ বেল, অথচ দেশে মাত্র ১ লক্ষ ৭১ হাজার বেল তুলা উৎপন্ন হচ্ছে। বাকিটা আমদানি করতে হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন বাহির থেকে তুলা আমদানিতে আমাদের যে পরিমাণ ক্ষতি বা অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার যথাযথ উপযোগ থাকলে তা দিয়ে দেশেই প্রায় কয়েক কোটি বেল তুলা উৎপাদন করা সম্ভব! অথচ আমরা ৯০ হাজার কোটি টাকার বিদেশি কৃষিপণ্য আমদানি করে চলছি! মজার বিষয় হলো, কোনো এক বছরে যদি ১ লাখ ৭১ হাজারের স্থলে ২ লাখ বেল তুলা উৎপন্ন হয়, তাহলে মন্ত্রী থেকে শুরু করে পাতি আমলা পর্যন্ত বলতে শুরু করবে, “আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।” কিন্তু মূল যে ক্ষতির জায়গাটা, তা আমরা কেউ-ই লক্ষ্য করছি না।
দুধ সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য উপাদেয় একটি খাবার। কিন্তু আমরা কি দেশের মানুষের দুধের চাহিদা মেটাতে পারছি? দেশের ডেইরি ফার্মগুলোর দ্বারাও কি এই চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে? অথচ এই দুধকে কেন্দ্র করে ৪০-৫০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রেও কোনো উদ্যোগ নেই!
বাংলাদেশের মৎস শিল্প ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অথচ এ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের দেশে প্রায় হাজারের উপরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত; এখন হাইব্রিড পাঙ্গাস আর তেলাপিয়া ছাড়া তেমন কোনো মাছ সহজলভ্য নয়। নদী দূষিত হওয়া, অব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ না থাকায় আমাদের যে বিশাল রপ্তানি শিল্প তা আজ ধ্বংসের মুখে। হাইব্রিড মুরগী আর ডিমের কথা না হয় বাদই থাকলো!
আমরা লক্ষ্য করছি, পাটশিল্পের সাথে জড়িত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক আজ বেকার। পাটকলগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হল। অথচ এই পাট ছিল আমাদের সোনালি আঁশ। যতটুকু ছিল, সেটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হল। চাইলেই কি এখানে লক্ষ লক্ষ কিংবা কোটির উপরে কর্মসংস্থান করা যেত না?
দেশের অন্যতম একটি বড় শিল্পক্ষেত্র হল চা। চা শ্রমিকদের নিয়ে কোনো আলাপ নেই, নেই কোন উদ্যোগও। তাদেরকে ন্যায্যমূল্য দিয়ে, এখানেও লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান করা সম্ভব ছিল। আমাদের ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, আমাদের মাছ, পাট, চা, তুলা, মসলা প্রতিটি ক্ষেত্রেই যদি আমরা যথাসময়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতাম, তাহলে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হত না। এভাবেই চিনিকল থেকে শুরু করে আমাদের সকল ধরণের ফসল ক্রমেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুধু ধান ছাড়া প্রত্যেকটি ফসল আমদানী করা হচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলের কৃষকরা, নারীরা এবং তাদের সন্তানেরা পাচ্ছে না তাদের সঠিক চিকিৎসা, শিক্ষা এবং সকল ধরণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি গ্রামীণ ক্ষুদ্র শিল্প, কুটির শিল্প আজ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যার ফলে বেকারত্ব বাড়ছে। শহর থেকে গ্রামমুখী হওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষ সেখানে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করছে। যতটুকুই বা খাদ্য পাচ্ছে সেটুকুও ভেজাল মিশ্রিত। এগুলো খেয়ে রোগাগ্রস্থ হওয়ার পরেও পাচ্ছে না সঠিক চিকিৎসা। চিকিৎসা পেলেও যে ঔষধ আমরা ভক্ষণ করি তা সেই একই চক্রের ফসল।
কথিত যে নয়া ব্যবস্থা তারা প্রতিষ্ঠিত করেছে এ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। নতুন বাংলাদেশ গড়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই সঠিক উপলব্ধি, সচেতনতা তৈরি ব্যতীত মুক্তির পথ খোঁজা আকাশকুসুম কল্পনা। শুধু বীজ, খাদ্য ও ওষুধ নয় প্রত্যেকটি সেক্টর-ই আজ পুরোপুরি বিদেশি কোম্পানির হাতে বন্দি। প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকানের ভাষায়, “আমরা সবাই যায়নবাদের কারাগারে বন্দী, সেখানে আমরা কতিপয় অবাধ্য কয়েদি। কিন্তু দিন শেষে সবাই কয়েদী।”
মুক্তি জন্য নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রস্তাবনার আলোকে সামনে অগ্রসর হয়ে নতুন বাংলাদেশ তথা হারানো ঐতিহ্যের বিনির্মাণ করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, পূর্বের সেই সোনালী ঐতিহ্যের আলোকে যদি আমরা কাজ করি তাহলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সম্ভব। কেননা আগের সেই খনিজ সম্পদ, জমি, বনাঞ্চল, কৃষক, মানব সম্পদ, নদী, সমুদ্র এখনও বিদ্যমান।