আবু যায়েদ আল বালখী ছিলেন একজন এনসাইক্লোপিডিক প্রতিভার অধিকারী, যিনি জ্ঞানের এমনসব শাখায় গভীরভাবে অবদান রাখেন, যা আজকের সময়ে একে অপরের থেকে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন মনে হতে পারে। তিনি ইতিহাসের সর্বপ্রথম মনোবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত। তার সময়ের আবিষ্কৃত মনোবিদ্যা চিকিৎসার বিভিন্ন পন্থা আজও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী, বহুপ্রজ এবং বিশিষ্ট লেখক আল বালখী একাধারে ভূগোল, মেডিসিন, ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি, দর্শন, কবিতা, সাহিত্য, আরবী ব্যাকরণ, জ্যোতিষশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, বায়োগ্রাফি, আখলাক, সমাজবিজ্ঞান সহ আরও অন্যান্য বিষয়ে তিনি ৬০ এর অধিক বই এবং রিসালা রচনা করেছেন। একজন পলিম্যাথ হওয়ার পরও তিনি ভূগোলবিদ হিসেবেই অধিক খ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি জরিপ ও মানচিত্র প্রনয়ণের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা ‘মাদরাসায়ে বালখী’ হিসেবে পরিচিতি পায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, হস্তলিখিত পান্ডুলিপি হয়তো হারিয়ে গেছে, নয়তো জাদুঘরে স্থান পেয়েছে।
আল বালখী সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানতে পারি, তার সবটুকুই প্রখ্যাত জীবনীকার, ইয়াকুত আল হামাবীর মাধ্যমে। তার মতে, বালখীর পুরো নাম হচ্ছে আবু যায়েদ আহমদ সাহল ইবনুল বালখী। তিনি ২৩৫ হিজরীতে (৮৪৯ খ্রী.) শামিস্তিয়ান নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যা পারস্যের বালখ প্রদেশের অধীনে ছিল, বর্তমান সময়ে যা আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। তার প্রাথমিক শিক্ষা তার বাবার তত্ত্বাবধানেই হয়েছিল। তার বাল্যকাল সম্বন্ধে এর বেশি কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তার পরবর্তী জীবন এবং জ্ঞানের সংগ্রাম সম্পর্কে হামাবী বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
হামাবীর বর্ণনায়, আবু যায়েদ আল বালখীর ছাত্র মুহাম্মদ আল হাসান আল ওয়াজিরির মতে, বালখী ছিলেম সুঠাম দেহ, মধ্যম উচ্চতা, উজ্জ্বল বর্ণ এবং বড় বড় চোখের অধিকারী। তিনি ছিলেন চুপচাপ, চিন্তাশীল এবং লাজুক স্বভাবের। ইতিহাসের পাতায় তার স্বভাবের সূক্ষ্ম বর্ণনা থাকার কারণে আমরা জানতে পারি, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ইন্ট্রোভার্ট একজন মানুষ ছিলেন। এটিও পরিষ্কার হয় যে, তিনি নির্জনতা পছন্দ করতেন এবং সামাজিকতা অথবা বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান এড়িয়ে যেতেন এবং একাকী জ্ঞানার্জনে সময় ব্যয় করতে পছন্দ করতেন।
যদি তিনি ইসলামী সভ্যতার মহান আলেম ও চিকিৎসক আবুল ফারাজ এবং আবু বকর আল রাজীর মত সামাজিকভাবে আচার অনুষ্ঠানে যেতেন, তাহলে হয়তো তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমরা আরও অবগত হতে পারতাম, তার হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন অবদান সম্পর্কে আরও জানতে পারতাম। উদাহরণস্বরূপ আবুল ফারাজের অন্যতম মাস্টারপিস, “মিফতাহ আত তিব্ব ওয়া মানহাজ আত তুল্লাব” মেডিসিন সংক্রান্ত গ্রন্থ, যা তার বন্ধুদের অনুরোধে লিখিত। এই অনবদ্য গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লেখেন,
“আমার কিছু জ্ঞানী বন্ধু আমার বইটি দেখেছেন, ‘A Treatise Encouraging the Study of Philosophy’। এর সহজে বোধগম্যতা ও ভাষাশৈলীর জন্য তারা আমাকে অনুরোধ করেন মেডিসিন শাস্ত্রের উপর অনুরূপ গ্রন্থ রচনা করতে। তাই আমি তাদের অনুরোধে এই ধরনের একটি গ্রন্থ রচনা করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম, এটিকে সহজে বোধগম্য করার চেষ্টা করেছিলাম এবং এটির নাম রাখলাম ‘মিফতাহুত তিব্ব’।
আবুল ফারাজের সামাজিকতা এবং বন্ধুদের অনুরোধের কারণেই ইতিহাসে অনবদ্য অসাধারণ এই গ্রন্থটি আমরা উপহার পাই।
অনুরূপভাবে ইতিহাস খ্যাত আবু বকর আল রাজী চিকিৎসক হওয়ার পাশাপাশি মিউজিকের গুণগ্রাহী ছিলেন, মিউজিকের প্রতি অদম্য আগ্রহ এবং ভালোবাসা ছিল। তিনি প্রায়ই তার বাসায় মিউজিকের আসরের আয়োজন করতেন। একরাতে তার আমন্ত্রিত মিউজিশিয়ানরা তাদের ইন্সট্রুমেন্ট তার বাসায় রেখে যায়। তার গবেষণার অধীনে রাখা একটি বানর, একটি ইন্সট্রুমেন্টের তার খেয়ে ফেলে৷ তিনি বানরটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখেন এবং আবিষ্কার করেন বানরটি তারটি হজম করে ফেলেছে। এই থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি চিকিৎসার ইতিহাসের যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন, যা বর্তমানে dissolving catguts (দ্রবণীয় সুতা) হিসেবে পরিচিত।
মাঝেমধ্যে বিজ্ঞান তার আবিষ্কারের উৎসাহ কিংবা ধারণা পায় প্রকৃতি থেকে, সৃজনশীলতা থেকে, আকস্মিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে। শুধুমাত্র সামাজিকতার কারণে, অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আবুল ফারাজ এবং আবু বকর আল রাজীর যুগান্তকারী আবিষ্কারসমূহ আমাদের সামনে এসেছে।
অবশ্য আল বালখীর অন্তর্মুখী বৈশিষ্ট্য তার স্বভাবকে করে তুলছে ধৈর্য্যশীল এবং ফোকাসড, যার কারণে আজ থেকে ১২ শতাব্দী আগেও তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে “মাসালিহ আল আবদান ওয়াল আনফুস” এর মত নিখুঁত একটি গ্রন্থ রচনা করতে পেরেছেন। এই অন্তর্মুখী বৈশিষ্ট্য, বিশ্লেষণাত্মক মনোভাব এবং নিখুঁত ক্লিনিক্যাল উপলব্ধি ব্যতীত আল বালখী নবম শতাব্দীতে বসে মনো-দৈহিক রোগ, psychoses এবং psychoneuroses এর মধ্যে পার্থক্য অথবা বিভিন্ন জটিল মনোরোগের চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হতেন না। তার লিখিত গ্রন্থের আগে এসব সমস্যার সমাধান নিয়ে কেউ চিন্তাও করতে পারেনি।
আল বালখী শুধু একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানীই ছিলেন না, বরং যুগান্তকারী একজন ভূগোলবিদ এবং ধর্মতত্ত্ববিদও ছিলেন। আরবী গদ্যের উপর ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য। বালখীর ছাত্র আল ওয়াজিরির মতে, “বালখী যখন কোন কিছু বলতেন, তখন মনে হতো যেন মুক্তা ঝরে পড়ছে। তার অভিব্যক্তি ছিল অতুলনীয়”। আল ওয়াজিরি আল-বালখীর সময়কালের প্রখ্যাত দুজন আলেম ‘আল জাহয’ এবং ‘আবু উবায়দা আল রায়হিনী’ এর সাথে তুলনা করে বলেন, “আল বালখী উভয়জন থেকেই আরও বেশি স্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট করে কথা বলতেন, উভয়জন থেকেই তিনি ছিলেন বাগ্মী। যেকোন বিষয় তিনি সহজেই অল্প কথায় আলঙ্কারিকভাবে গুছিয়ে বলতেন। অপরদিকে আল জাহয এর কথা থাকতো শব্দবহুল এবং আল রায়হিনী এর কথা ছিল খুবই স্বল্প”।
আল বালখীর ভাষাশৈলীর বর্ণনায় হামাবী বলেন, ক্ল্যাসিক এবং মডার্ন বিজ্ঞানের গভীর জ্ঞান থাকার কারণে আল বালখীর লেখা ছিল দার্শনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত। তার অনেক লেখাই প্রাজ্ঞ উক্তি এবং প্রবাদে পরিণত হয়েছিল।
যেমন:
“যদি কেউ তোমার এমন বিষয় নিয়ে প্রশংসা করে যা তোমার মধ্যে নেই; তাহলে তুমি নিশ্চিত নও যে, সে তোমার এমন বিষয় নিয়ে নিন্দা করবে না, যা তোমার মধ্যে নেই।”
“দ্বীনের চেয়ে বড় দর্শন আর নেই। তাই কেউ ভালো দার্শনিক হতে পারে না, যতক্ষণ না সে দ্বীনদার হয়।”
“সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ঔষধ হলো জ্ঞান”।
আল বালখী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসামান্য অবদানের পিছনে ছিল তার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সংগ্রাম। আল হামাবী বর্ণনা করেন, তিনি তার শহর বলখ থেকে বাগদাদে সফর করেন এবং জ্ঞানার্জনের জন্য সেখানে ৮ বছর অবস্থান করেন। তার শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইসলামী সভ্যতার আরেক মহান আলেম, ‘আবু ইউসুফ আল কিন্দি’।
হামাওয়ি এর মতে, আল বালখী বাগদাদে থাকা অবস্থায়ই ইসলামের বিভিন্ন ধারার সাথে যুক্ত হন, যা পরবর্তীকালে তিনি নিজের ভুল হিসেবে অনুধাবন করেন। আজন্ম সুন্নি মতধারা অনুসরণকারী আল বালখী বাগদাদে এসে শিয়া এবং যায়েদিয়্যা ধারায় প্রভাবিত হয়ে পড়েন। একইসাথে চিন্তাগত দিক থেকে তিনি মুতাযিলা ধারায় প্রভাবিত হয়ে পড়েন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, বাগদাদে অবস্থানের প্রাথমিক সময়ে তার আধ্যাত্মিক কোন সহায় ছিল না।
সেই সময়টিতে এমনিতেই অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমান ছিল৷ আব্বাসীয় খিলাফত দুর্বল হয়ে পড়ছিল। জ্ঞানগত বিশৃঙ্খলা এবং পতন সবদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। সবশেষে বিভিন্ন বিদ্রোহ এবং ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ৮৬৮ খ্রী. সনে আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটে।
আল বালখীর কৈশোরকালীন চিন্তার অস্থিতিশীলতা, মতদ্বৈততা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বাগদাদের পতনের পর আল বালখী বিভিন্ন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে, মানসিক দ্বন্দ্বের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার জ্ঞানার্জন করে তিনি সুন্নি ধারায় ফিরে আসেন এবং রচনা করেন, “কিতাব নাজম আল কুরআন”। যা এই ক্ষেত্রটিতে লেখা সমস্ত কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে।
বাগদাদে তার পড়াশোনা সমাপ্ত করে তিনি বলখে ফেরত আসেন এবং স্থানীয় শাসক আহমদ ইবনে সাহল ইবনে হাশিম আল মারওয়াজির কাতিব (researcher) হিসেবে নিযুক্ত হন। আহমদ ইবনে সাহল তাকে মন্ত্রীত্ব এবং একই সাথে কাতিবের প্রস্তাবনা দিলে মন্ত্রীত্ব প্রত্যাখান করে কাতিব হওয়াকেই পছন্দ করেন। আহমদ ইবনে সাহল তার ইচ্ছাকে সম্মান করেন এবং তাকে কাতিব হিসেবেই নিযুক্ত করেন।
আল-বালখীর এই ত্যাগের বিষয়টি আমরা ইসলামী সভ্যতার মহান আলেমগণের মাঝে দেখতে পাই, যারা জ্ঞানকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগকে প্রত্যাখ্যান করে জ্ঞানের জগতে পদচারণা করাকেই প্রাধান্য দিতেন। আল-বালখীও সেই আলেমগণের ধারা অনুসরণ করে অধিক ক্ষমতা এবং উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন এড়িয়ে আশি বছর বয়স পর্যন্ত গবেষণা ও লেখালেখি চালিয়ে যান।
আল হামাবী একই সাথে উল্লেখ করেন, আল বালখীর নিকট খোরাসানের সম্রাট থেকে তাকে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তাবনা আসে এবং তিনি নাকচ করে দেন। পরবর্তীতে তিনি দ্বিতীয়বার বাগদাদ আসেন এবং খুব দ্রুত সময়ে বলখ ফিরে যান এবং মৃত্যু (৯৩৪ খ্রী.) পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন।
অনুবাদঃ সাব্বির হাসান সিফাত।