আব্দুল হামিদ আবু সুলায়মান; উম্মাহর জাগরণের অক্লান্ত কারিগর 

এক.

ইসলামী সভ্যতার পতনপরবর্তী সময়ে পাশ্চাত্যের উত্থান ও ক্ষমতায়ন মুসলিম উম্মাহকে ভেতর থেকে ভঙ্গুর করে দেয়। ঔপনিবেশিক সূত্রে পশ্চিমা একচ্ছত্র ক্ষমতার বিস্তার, ও চিন্তাগত আধিপত্য মুসলিম সমাজকে অভ্যন্তরীণভাবে ওলটপালট করে দেয়। ঔপনিবেশিক ক্ষমতাসূত্র পশ্চিমা সভ্যতা কর্তৃক মুসলিম উম্মার উপর চাপিয়ে দেয়া আধুনিকতার প্রতিক্রিয়া কিন্তু এককভাবে হয়নি। এর ধরণ ছিলো বিচিত্র। কেউ কেউ পশ্চিমা সমাজের অনুকরণ করে একটা আপোষ রফা করতে চেয়েছিলেন। অপরদিকে আরেকটি শ্রেণী আধুনিকতার বাস্তবতাকে অস্বীকার করে পুরনোকে আকড়ে ধরে সমাধানের রাস্তা খুজছিলেন। এর মাঝামাঝি তৃতীয় বিকল্পবিন্দু হিসেবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি প্রখ্যাত দার্শনিক, মুজতাহিদ আল্লামা ইকবালকে, যিনি কিনা একইসাথে ইসলামী ঐতিহ্যিক জ্ঞান ও পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডে প্রগাঢ় অধিকার রাখতেন এবং এ অনন্য অধিকার তাকে দুটি স্থানেই শ্রেষ্ঠত্বের আসন সমর্পণ করেছিলো।

আল্লামা ইকবাল পাশ্চাত্য সভ্যতার চ্যালেঞ্জকে অস্বীকার না করে, ইসলামের সুমহান ঐতিহাসিক চেতনাকে উচ্চকিত করে তোলেন। একইসাথে পাশ্চাত্য অনুকরণই সমাধানের পথ এ ধারণাকে শক্তিশালীভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। ইকবালের এ প্রত্যাখ্যান নিস্পৃহতায় পরিবর্তিত হয়নি। বরং আল্লামা ইকবালের প্রভাবে মুসলিম ভাবজগত পুনর্জাগরণী চেতনায় অসাধারণভাবে আলোড়িত হয়ে ওঠে।

ইমাম হাসানুল বান্না, সাইয়্যেদ আবুল আ’লা, নাজমুদ্দিন এরবাকানরা সামগ্রিকভাবে একটি মুভমেন্টের ধারণা হাজির করেন। অপরদিকে প্রফেসর ডঃ ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর মতো মহান তাত্ত্বিক ও দার্শনিকেরা এর ক্ষেত্র তৈরী ও নিজেদের আভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালী হওয়ার উপর জোর দেন। এ দুটি ধারাকে ভিন্ন মনে করার খুব একটা সুযোগ নেই আসলে। কারণ দিনশেষে দুটি ক্ষেত্র একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। দ্বিবিধ ক্ষেত্রেই এ মহান ব্যক্তিত্বগণ ইসলামী পুনর্জাগরণের ধারাকে তুলে ধরেন, বিকল্প হিসেবে হাজির করেন।

প্রফেসর ডঃ আব্দুল হামিদ আবু সুলায়মান এ ধারারই এক মহান ঝাণ্ডাবাহী। একালে মুসলিম চিন্তাজগতের পুনর্গঠনে তার অবর্ণনীয় অবদান কোনভাবেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

 

 

দুই.

প্রফেসর ডঃ আব্দুল হামিদ আবু সুলায়মানের জন্ম ১৯৩৬ সালে, মক্কায়। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অনার্স, ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে পেনেসিলভানিয়া বিশ্ববদ্যালয় থেকে “আন্তর্জাতিক সম্পর্কের” উপর পিএইচডি অর্জন করেন।

আব্দুল হামিদ আবু সুলায়মান একজন বহুপ্রজ ব্যক্তিত্ব। বিচিত্র বিষয়ের উপর তার অধিকার ও আলাপ তাকে একালে মুসলিম ভাবজগতের নেতৃত্বস্থানীয় আসনে সমাসীন করেছে। সৌদি আরবের স্টেট প্লানিং কমিটি, কিং সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান, The Association of Muslim Social Scientists এর সাবেক প্রেসিডেন্ট সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালন করেছেন।

ডঃ আবু সুলায়মানের অন্যতম অসাধারণ কর্মক্ষেত্রে ছিলো গত শতকের মুজাহিদ আলেম, দার্শনিক, চিন্তক প্রফেসর ডঃ ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর মিরাস International Institute of Islamic Thought, এখানে দায়িত্ব পালনকালে প্রফেসর ডঃ আবু সুলায়মান তার অসাধারণ কাজগুলো করেছেন।

ডঃ আবু সুলায়মানের বহুমুখী জীবনে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন প্রফেসর ডঃ ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী। ডঃ ফারুকীর দার্শনিক উপলব্ধিজাত চিন্তা ও বিশিষ্ট ভাবনা তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এজন্য পরবর্তীকালে তার লেখায় ফারুকীর চিন্তার সুস্পষ্ট ছাপ দেখা যায়।

ডঃ আবু সুলায়মান International Islamic University Malaysia (IIUM) এর রেক্টরের দায়িত্বও পালন করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস, ও কারিকুলাম তৈরীতে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তার কিতাব “The Islamization and Revitalization of Theory and Higher Education; IIUM as a Model” এ তিনি এ নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছেন।

 

 

তিন.

ডঃ আব্দুল হামিদ আবু সুলায়মানের আগ্রহ বহুক্ষেত্রে ব্যাপৃত। বহু বিষয়ে তার আগ্রহ ও তার বিশিষ্ট চিন্তাভাবনা তিনি তার গুরুত্বপূর্ণ লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এ বিষয়টি তার রচিত গ্রন্থগুলোর তালিকা দেখলেই বুঝা যায়-

১. Towards an Islamic Theory of International Relations: New Directions for Islamic Methodology and Thought:

প্রফেসর আবু সুলায়মানের সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। “ইসলাম ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক” শিরোনামে বইটি বাংলায় অনূদিত হয়েছে। গ্রন্থটির ভূমিকা লেখেছেন মুজাহিদ আলেম ও দার্শনিক প্রফেসর ডঃ ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী। এ কিতাবে ডঃ আবু সুলায়মান বলতে চেয়ছেন, ইসলামী বিশ্বব্যবস্থার যৌক্তিকতা ও পশ্চিমা আদর্শিক দুর্বলতার প্রেক্ষিতে ইসলামের অনন্যতা।

বর্তমান পৃথিবীর জন্য এমন এক ব্যবস্থা প্রয়োজন যাতে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিকভাবে বসবাস করতে পারে।

ডঃ আবু সুলায়মান তুলে ধরেছেন- এমন একটি ব্যবস্থার সন্ধানে ব্রতী হলে ইসলামের দিকে দৃষ্টিপাত করা অনিবার্য। এরকম একটি ব্যবস্থা শুধুমাত্র ইসলামের কালজয়ী আদর্শ থেকে উৎসারিত হওয়া সম্ভবপর। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো মুসলিম উম্মাহর বহুকালব্যাপী চিন্তাগত স্থবিরতা ও যুগোপযোগী পদ্ধতিবিজ্ঞান ও ফিকহকে যুগের প্রেক্ষিতে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা।

একইসাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে তত্ত্বীয় আলোচনা, ইসলামের ক্ল্যাসিক উৎসসমূহ হতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইসলামী নীতির ব্যাখ্যা ও বিভিন্ন পরিভাষার যুগোপযোগী ব্যাখ্যা হাজির করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন।

 

একইসাথে উম্মাহর চলমান সংকট হতে উত্তরণের ক্ষেত্রে তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন।

প্রথমত, পদ্ধতিবিজ্ঞানের সংস্কার (ইসলাহুল মানহাজ)। এক্ষেত্রে ইসলামের উসূলসমূহের আলোকে কর্মপন্থা নির্ধারণের দিকে তিনি জোর দেন।

দ্বিতীয়ত, ইসলামের মৌলিক নীতিসমূহের দিকে প্রত্যাবর্তন এবং এর আলোকে অন্যান্য দেশসমূহের সাথে সম্পর্ক এবং ইসলামী বিশ্বব্যবস্থার মৌলনীতি তুলে ধরার নীতি প্রণয়ন।

 

২. Crisis in the Muslim Mind

প্রফেসর ডঃ আবু সুলায়মানের এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি “মুসলিম মানসে সংকট” শিরোনামে বাংলায় অনূদিত হয়েছে।

এ গ্রন্থে প্রধানত ডঃ আবু সুলায়মান মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ ও ইসলামের মৌলিক নীতির আলোকে তার উত্তরণ ও সমাধানের পথ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ কিতাব প্রফেসর ডঃ আবু সুলায়মানের সারাজীবনের জ্ঞানসাধনার একটি সারমর্ম। তার জীবনব্যাপী অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণের ফলশ্রুতিতে এ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি তিনি প্রণয়ন করেন। ডঃ আবু সুলায়মান এ গ্রন্থে বলতে চেয়েছেন, মুসলিম উম্মাহর সমাধান পাশ্চাত্যের অনুকরণধর্মী পদ্ধতিতেও নয়, কিংবা নিজেদের ঐতিহাসিক জ্ঞান উৎসসমূহের  ক্রমাগত পুনরাবৃত্তির মাঝেও নয়। পুনর্জাগরণের অর্থবহ যাত্রা কেবল যুগের প্রেক্ষিত ও ইসলামের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে উপজীব্য করে অগ্রসর হওয়ার মাঝেই নিহিত।

 

৩. The Qur’anic Worldview: A Springboard for Cultural Reform

“আল কুরআনে বিশ্বদর্শনের রূপরেখা” শিরোনামে এ গুরুত্বপূর্ণ কিতাব অনূদিত হয়েছে। এ গ্রন্থে ডঃ আবু সুলায়মান কুরআনের নীতির আলোকে একটি বিশ্বদর্শন তৈরির রূপরেখা তুলে ধরতে চেয়েছেন। একইসাথে পশ্চিমা বিশ্বদর্শনের বিকল্প হিসেবে তিনি একে তুলে ধরেছেন। একইসাথে কুরআনী ওয়ার্ল্ডভিউ এর মূলনীতি এবং তুলনামূলক আলাপ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

 

৪.  Islamization: Reforming Contemporary Knowledge

এ বইটি মূলৎ ইসলামের প্রাণশক্তি ও তার শক্তিশালী আখলাকী ধারণাকে উপস্থাপন করার একটি পরিকাঠামোর নকশা। এ গ্রন্থে ডঃ আবু সুলায়মান আধুনিক জীবনযাত্রায় ইসলামের প্রভাবশালী ভূমিকা রাখার সম্ভাব্যতা নিয়ে শক্তিশালী আলোচনা করেছেন।

 

৫. Parent-Child Relations: A Guide to Raising Children

এ বইটি ডঃ আব্দুল হামিদ আবু সুলায়মানের বহুমাত্রিকতার একটি দৃষ্টান্ত। একজন শক্তিশালী একাডেমিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ হয়ে গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য বিষয় তিনি লিখেছেন। এর সাথে প্যারেন্টিং- সন্তান প্রতিপালন বিষয়টিও তার কলমের সীমা এড়াতে পারেনি। অভিভাবক এবং সন্তানের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, এটাই এ বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য।

এছাড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার আছে উনার। অর্থনীতি-রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে একাডেমিক লেভেলে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ও প্রবন্ধ লিখেন। তার এ বহুমাত্রিক জ্ঞানসাধনা একালে মুসলিম ভাবজগতের নির্মাণে যে ভূমিকা রেখেছে তাকে কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

 

চার. 

মুসলিম উম্মাহর সংকট উত্তরণ, ইসলামী সভ্যতার পুনর্জাগরণ, ইসলামী চিন্তার যুগের প্রেক্ষিত সংস্কার ডঃ আবু সুলায়মানের লেখালেখিতে কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হিসেবে ঘুরেফিরে আবর্তিত হয়েছে। একালে মুসলিম উম্মাহর দুর্দশার কারণ ও প্রতিকার সম্বন্ধে তিনি বিস্তর ভেবেছেন ও প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তার বিভিন্ন গ্রন্থ মূলত তার এ গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাগুলোর ফলশ্রুতি।

 

ডঃ আবু সুলায়মানের মতে উম্মাহর পুনর্জাগরণের সূচনা উম্মাহর মধ্যে থেকেই হতে হবে। তার ভাষায়-

“মুসলিম উম্মাহর মূল্যবোধ, এর মানবীয় ও বৈষয়িক সম্পদ সম্বন্ধে ধারণা থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি উম্মাহর সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান না রাখেন তাহলে তার পক্ষে উম্মাহর চলমান সাংস্কৃতিক অধঃগতি, রাজনৈতিক বিচ্যুতি ও মানবিক দুর্ভোগ ও দুর্দশা সম্বন্ধে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা কঠিন। আর এটিই উম্মাহর মূল সংকট। এটি অবশ্যসম্ভাবী যে, এ ধরণের পশ্চাৎপদতা এবং দিক নির্দেশনাহীন অবস্থা মুসলিম উম্মাহর চেতনার জগতে প্রধান বিষয় হিসেবে বরাবরই প্রধান বিষয় হিসেবে গণ্য ছিলো, যা মুসলিম উম্মাহর পূর্ববর্তী ও চিন্তাশীল মনীষীগণ বরাবর চর্চা করে এসেছেন। সুতরাং এটাই স্বাভাবিক যে, উম্মাহকেই পুনর্গঠন, নবায়ন ও পুনর্জাগরণ করতে হবে”।

 

ডঃ আবু সুলায়মান মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের প্রভাব, নিজস্ব অনৈক্য, বিভিন্ন চিন্তাগত ধারার প্রভাব ইত্যাদি কার্যকারণ তুলে ধরেছেন। ডঃ সুলায়মানের পর্যবেক্ষণে তিনি সমাধানের পথে অগ্রসর তিনটি ধারাকে চিহ্নিত করেছেন-

 

১. বিদেশী সমাধানের অনুকরণ। যার মূল নিহিত পশ্চিমা সভ্যতার সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার ভেতরে।

২. ঐতিহাসিক সমাধানের অনুকরণ। ইসলামের ঐতিহাসিক সমাধানের হুবহু পুনরাবৃত্তি, যা স্থান-কাল-পাত্রের সংশ্লিষ্টতাকে উপেক্ষা করে।

৩. ইসলাম প্রদত্ত আসালা ভিত্তিক মৌলিক সমাধান। ইসলামের মৌলিক সূত্রসমূহের নীতির আলোকে উম্মাহর বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক সমাধানের প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি।

 

এক্ষেত্রে ডঃ আবু সুলায়মান প্রথমোক্ত দুটি পন্থারই সমালোচনা করেন। কেননা বৈদেশিক সমাধান স্থান-কাল-প্রেক্ষিত না বুঝে নিজস্ব ক্ষেত্রে হুবহু প্রয়োগ করতে গেলে একটা ভারসাম্যহীন বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই হয়না। কেননা নিজস্ব শেকড়ের বিরুদ্ধ কিছুই সমাধান দিতে সমর্থ নয়। অপরদিকে ইসলামের ঐতিহাসিক সমাধান যারা হাজির করতে চেয়েছেন, তারা মূলত পূর্ববর্তী আলেমগণের একধরণের অন্ধ অনুকরণ করেছেন যার ফলে উম্মাহর মাঝে ইজতিহাদ ও জাগরিত জ্ঞানের ধারার রুদ্ধ হয়ে গেছে।

এ দুটি চিন্তার কার্যকরী বিকল্প হিসেবে ডঃ আব্দুল হামিদ আবু সুলায়মান ইসলামের আসালা ভিত্তিক মৌলিক সমাধানকে ভারসাম্যপূর্ণ, যুগোপযোগী ইসলামের মূলনীতিসমূহের সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ পন্থা হিসেবে তুলে ধরেন। তার ভাষায়-

“সমসাময়িক ইসলামী আসালা ভিত্তিক সমাধান হচ্ছে উম্মাহর প্রয়োজন ও চাহিদার একটি ঘোষণা। ইসলামের সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, ইসলামের মূল্যবোধ, লক্ষ্য ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে এটি তার জবাব। (আসালা বলতে মূলত তিনি একেই বুঝিয়েছেন।) এ পথেই উম্মাহ ও তার সম্ভাবনাময় শক্তিগুলো নেতৃত্বের আসনে থাকতে পারে, এবং তার মূল্যবোধ, লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মাধ্যমে সমগ্র মানবতার ভবিষ্যতকে সর্বোত্তমরূপে পরিচালনা করতে পারে”।

তিনি আরো তুলে ধরেন-

“এ সমাধান হচ্ছে স্থান ও কালের মাত্রা এবং পরিধিসহ ইসলামের প্রাথমিক যুগের বিভিন্ন তত্ত্ব ও তার প্রয়োগ সম্বন্ধে প্রায়োগিক উপলব্ধি। এ জন্য ইসলামের লক্ষ্য ও তার মহান উদ্দেশ্য এবং এর মধ্যকার সঠিক সম্পর্ককেও পুরোপরি বুঝতে হবে। অন্যান্য সভ্যতার মোকাবিলায় উম্মাহ যাতে নেতৃত্বের অবস্থানে পৌছতে পারে সে লক্ষ্যে এটি জীবন ও সমাজে তার সকল ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে”।

ডঃ আবু সুলায়মান দেখিয়েছেন উম্মাহর মূল সংকট ‘বিশ্বাসের’ নয় বরং ‘চিন্তার’। একইসাথে তিনি তুলে ধরেছেন সামগ্রিকভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য ইসলামের অপরিবর্তনীয় উসূলসমূহের আলোকে আমাদের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

 

ডঃ আবু সুলায়মান পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে অন্যতম যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন তা হলো মেথডোলজির সংস্কার (ইসলাহুল মানহাজ)। তার ভাষ্যনুযায়ী-

“ইসলামী চিন্তাধারার কাঠামো জগৎ জীবন সম্বন্ধে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে। এর উপলব্ধির পর ইসলামী চিন্তাধারা এবং তাকে নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন সম্পর্ক, ধারণা এবং নীতিসমূহ বুঝার সূচনা করা যায়। সুতরাং আমরা যদি ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞান ও চিন্তাধারার প্রকৃতি ভালোভাবে বুঝতে চাই, ইসলাম যেসকল লক্ষ্য অর্জন করতে চায় তা বুঝার আশা রাখি তাহলে প্রথমেই ইসলামের দৃশ্য (শাহীদ) ও অদৃশ্য (গায়েব) সম্পর্কিত ধারণা উপলব্ধি করা আবশ্যক। এ ধারণা জীবনের উদ্দেশ্যকে সংজ্ঞায়িত করে বস্তুজগতের বাহিরের জগতের সাথে তাকে সম্পৃক্ত করে”।

 

তিনি বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেন-

ইসলামী মেথডোলজির তিনটি মৌল উৎস হচ্ছে-

  • ১. ওহী
  • ২. আকল
  • ৩. মহাবিশ্ব

 

ইসলামী চিন্তাধারার মৌল উপাদানগুলো হলো-

  • ১. তাওহীদ
  • ২. খেলাফত
  • ৩. নৈতিক দায়িত্ব

আর এক্ষেত্রে ইসলামী মেথডোলজির মৌলিক ধারণাগুলো হলো-

  • সৃষ্টি ও অস্তিত্বের উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রকৃতি
  • সত্যের বস্তুনিষ্ঠতা এবং পরিস্থির আপেক্ষিকতা
  • সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা ও স্বাধীন ইচ্ছা
  • তাওয়াক্কুলের ব্যাপকতা বা সর্বাত্মকতা
  • কর্মের কার্যকারণ

ডঃ আবু সুলায়মান এগুলোর সার্বিক মূল্যায়ন ও পর্যালোচনার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তার মতে ইসলামী মেথডোলজি ও উসূলসমূহের আলোকে যুগোপযোগী কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। নইলে অতীতের চর্বিতচর্বণ ও বিজাতীয় অনুকরণ ব্যতীত সৃজনশীল কোন উদ্যোগ সম্ভব হবেনা।

 

পাঁচ.

প্রফেসর ডঃ আব্দুল হামিদ আবু সুলায়মান গত অর্ধশতাব্দী যাবত অনবরত লেখালেখি করেছেন মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণের পথ তৈরির জন্য। উম্মাহর মাঝে বিদ্যমান নানা সমস্যা নিয়ে ভেবে তিনি বহু বিনিদ্র রজনী যাপন করেছেন এবং একইসাথে ইসলামী সভ্যতার মৌলিক উৎসসমূহের পঠন-পাঠনের মাধ্যমে তাকে বর্তমান যুগের উপযুক্ত ভাষায় তুলে ধরার জন্য বিস্তর গবেষণা করেছেন।

ইসলামী সভ্যতার পতনের পেছনে সক্রিয় কার্যকরণ সম্বন্ধে তিনি যা বলেছেন তার সারমর্ম হলো-

  • . বিভিন্ন সভ্যতার প্রভাবে ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে ক্ষতিকারক চিন্তার সংমিশ্রণ। যার ফলে ইসলামের স্পিরিট বা প্রাণশক্তি দুর্বল হয়ে পরে।
  • . ইজতিহাদের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাওয়া
  • . তাকলীদ তথা অন্ধ অনুকরণ
  • . হিকমাহকে হারিয়ে ফেলা।
  • . নিজস্ব ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে উপজীব্য করে সামনে অগ্রসর হওয়ার পথ তৈরির বিপরীতে বিভিন্ন সভ্যতার অনুসরণ।

 

এসকল কার্যকারণকে মুসলিম উম্মাহর মাঝ থেকে দূর করতে না পারলে পুনরুত্থানের আশা করা বৃথা।

বিশ্লেষণী পর্যালোচনার মাধ্যমে ডঃ আবু সুলায়মান ইসলামী সভ্যতার পুনর্জাগরণের সম্ভবনা ও শক্তিমত্তা তুলে ধরেন। পশ্চিমা সভ্যতার বিকল্প বয়ান হিসেবে ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে তিনি লেখেন-

“ইসলাম মানবজাতিকে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য ও কারণ উপহার দিয়েছে তথা জীবনকে অর্থবহ করেছে। মানবজাতি কিভাবে জীবনযাপন করবে তার জন্য আখলাকী মূলনীতি দিয়েছে। ইসলাম মানুষকে তার ফিতরাত সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে এবং দৃশ্য (শাহীদ) ও অদৃশ্যের (গায়েব) ব্যক্তি, সমাজ ও সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে বিশ্বজনীন সম্পর্কের একটি মাত্রা দিয়েছে। ইসলাম সমগ্র মানবতাকে একটি স্থিতিশীল সমাজ, অগ্রগতি, নিরাপত্তা ও বিশ্ব শান্তির ভিত্তি দিয়েছে”।

 

পশ্চিমা সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করে ডঃ সুলায়মান লেখেন-

“আধুনিক সমাজের নৈতিক দেউলিয়াত্ব এখন কারো কাছেই গোপন নয়। বস্তুবাদের ছায়ায় এখন বিশ্ব উত্তর-দক্ষিণ, সাদা-কালো, ধনী-গরিব, উপনেবিশ স্থাপনকারী- উপনিবেশ দ্বারা শাসিত, প্রভু-দাসে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আজ মানুষের কাছে শান্তির অর্থ আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এক জাতি বা অন্য জাতি, এক শ্রেণি বা অপর শ্রেণি এক শিবির বা অপর শিবির থেকে গণবিধ্বংসী বাহিনীকে হামলার জন্য ছেড়ে দেওয়ার আতঙ্ককে দমন করা ছাড়া আর কিছু নয়”।

ইসলামকে মুক্তির একমাত্র মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করে ডঃ সুলায়মান লেখেন-

“এসকল ক্ষেত্রে বিরাজিত মারাত্মক ত্রুটির কারণে তাদের এবং সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্য আজ ইসলামের প্রয়োজন অনেক বেশি। কারণ একমাত্র ইসলাম উপস্থাপিত নীতির মাধ্যমেই এর সমাধান ও সংশোধন সম্ভব। পূর্ণাঙ্গ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমেই আধুনিক বস্তুবাদী সমাজের অকল্যাণ ও উদ্ভূত হুমকি মোকাবিলা করা সম্ভব”।

ডঃ আব্দুল হামিদ আবু সুলায়মান তার সমগ্র জীবনকালব্যাপী সাধনায় মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। বহু বিনিদ্র রজনী তিনি এ নিয়ে ভেবেছেন, লেখালেখি করেছেন। স্বার্থকভাবেই তিনি ছিলেন উম্মাহর জাগরণের বিনিদ্র কারিগর, জ্ঞানের রাস্তার এক মহান সংগ্রামী। আজ মুসলিম উম্মাহর এই ক্রান্তিকালে তার চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা মোটেই হ্রাস হয়নি। বরং দিন যত অতিবাহিত হচ্ছে আমরা তার জরুরত টের পাচ্ছি, পাবো।

 

তথ্যসূত্রঃ

১, মুসলিম মানসে সংকট, প্রফেসর ডঃ আব্দুল হামিদ আহমদ আবু সুলাইমান, অনুবাদঃ মোঃ মাহবুবুল হক, বিআইআইটি’২০১৯,

২, ইসলাম ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, প্রফেসর ডঃ আব্দুল হামিদ আহমদ আবু সুলাইমান, অনুবাদঃ জয়নুল আবেদীন মজুমদার, বিআইআইটি’২০০২

৩, জ্ঞানের ইসলামায়নঃ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্বিবিদ্যালয় মালয়েশিয়া মডেল, বিআইআইটি’২০০৭

৪, http://www.iosminaret.org/vol-7/issue15/Islamic_Values.php

৬২ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top