‘A Separation’ তেহরান থেকে লস এঞ্জেলস; ইরানি সিনেমার শ্রেষ্ঠত্বের আখ্যান

চলচ্চিত্র একটি সৃষ্টিশীল গণমাধ্যম। এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ। যে দেশে তা নির্মিত হয় সে দেশের জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে চলচ্চিত্রটি। বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্রের হালচাল নিয়ে আলাপ করতে গেলে বলতে হয় রূপকথার জন্য বিখ্যাত পারস্যের কথা- যার বর্তমান নাম ইরান। বৃহৎ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডারসমৃদ্ধ ইরানে আনুমানিক ১৯০০ সালে আমদানিকৃত কিছু চলচ্চিত্র দিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হয়। ১৯০০ সালের ১৮ আগস্ট প্রথম একজন ইরানি ক্যামেরায় চিত্র ধারণ করেছিলেন। তবে সেদেশে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৩০ সালে-যার নাম ‘আবি ভা রাবি’ (আবি ও রাবি), যা পরিচালনা করেন আভানেস ওহানিয়ান।

হলিউড-বলিউড এর বৈচিত্র্যময় চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমান সময়ে ইরানি চলচ্চিত্র নিজেদের সমাজবাস্তবতা, ঐতিহ্য ও জীবনবোধের উপস্থাপনে তৈরি করে নিয়েছে স্বকীয় গ্রহণযোগ্যতা। এর সবচেয়ে উজ্জ্বলতম উদাহারণ ‘অ্যা সেপারেশন’।

‘অ্যা সেপারেশন’ মুভিটি ২০১২ সালে অস্কারের ৮৪তম আসরে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার জিতে নেয়। অস্কারের ৮৪ বছরের ইতিহাসে ওটাই ছিলো কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান কোনো ক্যাটাগরিতে অস্কার বিজয় ছবিটির নির্মাতা ‘আসগর ফরহাদী’। যিনি মঞ্চ নাটকের পটভূমি থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে এসে ইরানকে এনে দিয়েছেন সর্বাধিক অস্কার।

সিনেমায় দেখা যায়, সিমিন আর নাদের ইরানের উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিনিধিত্বকারী এক দম্পতি, যাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় চৌদ্দ বছর। তাদের এগারো বছরের এক মেয়েও আছে, নাম তেরমাহ। আর আছে আশি বছরের বৃদ্ধ বাবা, যিনি আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত। সিমিন আমেরিকায় যাবার সুযোগ পেয়েছে, সে তার স্বামী এবং মেয়েকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে-মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। কিন্তু স্বামী নাদের তার অসুস্থ, বৃদ্ধ বাবাকে ফেলে কোথাও যেতে চাইছে না। তাই উন্নত জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখা সিমিন এক পর্যায়ে আদালতে ডিভোর্সের আবেদন করে। যথার্থ কারণ নেই বলে পারিবারিক আদালত ডিভোর্সের আবেদন নাকোচ করে দেয়। হতাশ হয়ে সিমিন তার বাবার বাড়িতে চলে যায় আর তার মেয়ে তেরমাহ থাকে নাদেরের কাছে। মেয়ে তেরমাহ বাবা নাদেরের সাথে থেকে যায় এই আশায় যে, সিমিন ফিরে আসবে।

নাদের বৃদ্ধ বাবাকে দেখা-শোনা করার জন্য এক ধার্মিক, নিম্ন বিত্ত পরিবারের নারী রাজিয়াকে নিয়োগ দেয়। রাজিয়া তার স্বামীর অর্থনৈতিক চাপ সামলানোর জন্য স্বামীকে না জানিয়েই কাজ করা শুরু করে। ঘটনাবহুল গল্পটি শেষ সিনে আবার ফিরে আসে শুরুর সেই কোর্টরুমেই এবং তখন পরিলক্ষিত হয় নাদের এবং সিমিনের বিবাহ বিচ্ছেদ অবশেষে সম্পন্ন হয়েছে। বিচারক তাদের সন্তান তেরমাহকে বলেবাবা অথবা মা কার কাছে সে থাকবেসেই সিদ্ধান্ত জানাতে তেরমাহ সিদ্ধান্ত জানানোর আগেই শেষ হয় সিনেমা আর প্রশ্নটি রয়ে যায় দর্শক এর মনে

 

‘আসগর ফরহাদী’ তার চলচ্চিত্রে পরিবার এবং সমাজের জটিল সম্পর্কগুলো তুলে ধরেন, কিন্তু তিনি কোনো সমাধান দেন না সেটা তিনি দর্শকদের বিচারের উপরেই ছেড়ে দেন যেমন সিনেমার শুরুর সিনে দেখা যায় সিমিন-কে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘কেন সে দেশ ছাড়তে চায়?’-এই প্রশ্নের জবাবে সিমিন শুধু বলে ‘মেয়েকে এই পরিবেশে বড় করতে চায় না’। কেমন পরিবেশ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি সিমিন। ফরহাদী ততক্ষণে গল্প নিয়ে যায় অন্য কোথাও, কিন্তু দর্শক এর কাছে রেখে যায় সিমিন এর জবাব না দেওয়া প্রশ্নটি। কেমন পরিবেশে বাস করে ইরানের মেয়েরা?

দর্শকদেরকে পরিষ্কারভাবে ভালোমন্দ চিনিয়ে না দেওয়া, অথবা কোনো একটি চরিত্রের পক্ষে দর্শকদের সমর্থন তৈরির চেষ্টা না করা প্রসঙ্গে ফরহাদী বলেন, আমি দর্শকদের উপর আমার বিচারবোধ চাপিয়ে দিতে পছন্দ করি না তার মতে, বর্তমান বিশ্বে উত্তরের চেয়ে প্রশ্নের প্রয়োজন অনেক বেশি। সব কিছুর উত্তর দিয়ে দেওয়া হলে মানুষ প্রশ্ন করার, চিন্তা করার অগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। সিনেমা হলেই যদি মানুষকে সমস্যার সমাধান দেখিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সিনেমাটা হলের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় কিন্তু যদি দর্শকদের মনের মধ্যে প্রশ্নগুলো জাগ্রত রাখা যায়, তাহলে সিনেমাটা মূলত শুরুই হয় সেটা দেখার পর থেকে। মানুষের মনে সিনেমার কাহিনী, চরিত্রগুলোর বক্তব্য, তাদের সমস্যাগুলো আলোড়ন সৃষ্টি করতে থাকে।

এত ঘটনাবহুল একটা সিনেমায় কোনো নেগেটিভ চরিত্র বা ভিলেন বলা যায় এমন কাউকে দেখা যায়নি কারণ প্রতিটি চরিত্রের কাজের পিছনেই ছিলো যুক্তিসঙ্গত কারণ। তাই পাওয়া যায়নি কাউকে অপরাধী বানানোর সুযোগ। এই ছবির চরিত্রগুলোর মধ্যে দেখা যায় সবাই নিজের অবস্থান, বাস্তবতা, অনুভূতি-জীবনবোধ ও সীমাবদ্ধতাকে সঙ্গে নিয়ে ভালো এবং খারাপের মাঝখানের দাঁড়িয়ে আছে। ফরহাদী তার চলচ্চিত্রে কাউকে হিরো হিসেবে উপস্থাপন করে বাহবা দেওয়ার চেষ্টা করেননি, আবার কাউকে ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে ঘৃণার পাত্র বানাতে চাননি। তিনি যেটা চান সেটা হচ্ছে, চরিত্রগুলোর প্রতি সহানুভূতি তৈরি করা। এই সহানুভূতি থিমটির প্রতি ফরহাদী অতিরিক্ত মাত্রায় দুর্বল তার প্রায় সবগুলো চলচ্চিত্রের মূলভাবই হলো সহানুভূতি

ফরহাদীর ট্রেডমার্ক হলো অসাধারণ শট মেকিং। তিনি মানুষের সঙ্কটকে দেখানোর জন্য ক্যামেরাকে নেড়েচেড়ে অস্থিরভাবে ছোটাছুটি করিয়ে একটি শটকে অনেকগুলো খণ্ড খণ্ড শটে ভেঙে গল্প বলার প্রচেষ্টা করেন। তার স্বাতন্ত্র্যের পুরস্কারই হয়তো দু’বার অস্কার জয়।

এই মুভিতে অধিকাংশ দৃশ্যই হ্যান্ড ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে যা তার কাজে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অভিনেতারা করেছেন অসাধারণ অভিনয়। নাদেরের ভূমিকায় পেয়ম্যান মোয়াদি, সিমিন চরিত্রে লায়লা হাতামি, রাজিয়া ভূমিকায় সারেহ বায়াত, নাদের আর সিমিনের মেয়ের চরিত্রে পরিচালকের নিজের মেয়ে সারিনা ফরহাদীসহ সবার অভিনয়ই ছিলো প্রাণবন্ত এবং বাস্তবিক। যে কারণে প্রথম কোনো ইরানি ছবি হিসেবে বার্লিন ফেস্টিভ্যালের অভিনয় ক্যাটাগরি’র সবগুলো পুরস্কারই এই ছবির শিল্পীরা পেয়েছিলেন।

সিমিনের চরিত্রটা দিয়ে পাশ্চাত্যের জীবনের দিকে উন্মুখ তাকিয়ে থাকা ইরানি মধ্যবিত্তদের মানসিকতা নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে বলে কেউ কেউ ফরহাদীকে বাহবা দিয়েছে, আবার আধুনিক যান্ত্রিক জীবনের সামনে রাজিয়ার মতো ধার্মিকদের অসহায়তাকে সঙ্কট রূপে ব্যাখ্যা দেওয়ায় ইরানের সাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী ফরহাদীকে শুনিয়েছেন নিন্দার বাণী।

শুধুমাত্র দর্শক এর দৃষ্টিতে তাকালে আমাদের চোখে ভাসে নাদেরের কান্নার দৃশ্যটা, গৃহকর্মীর সাথে রূঢ় ব্যবহার করার পর নিজেই ভুগছেন অনুশোচনায়। এই দৃশ্যের পাশাপাশি দর্শক বোধ করে কি অসহনীয় আর বিপরীতমুখী সব অনুভূতির মাঝ দিয়ে আমাদের হেঁটে যেতে হয় প্রতিদিনের জীবনে।

মানুষের ঔচিত্যবোধের অনুভূতিকে এমন আশ্চর্য বৈপরীত্যে দোলাতে পারার ক্ষমতা দেখিয়েছেন আসগর ফরহাদী। ইরানি সিনেমার ইতিহাস শতবছরের। কিন্তু এখনও ব্যাপক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় নির্মাতাদের কারণ তারা কাজ করে যাচ্ছেন সমাজের রুক্ষ ও দুঃখদায়ক বাস্তবতাকে নিয়ে। তাদের মূল বিষয় থাকে ‘মানুষ’। প্রভাবশালীদের অপকর্মের প্রভাবে সাধারণ মানুষের করুণ জীবনকে সিনেমায় দেখানোর কারণে জাফর পানাহির মতো চলচ্চিত্রকাররা গ্রেফতার হয় বারবার। কিয়ারোস্তমি, মাজিদি কিংবা মাখমালবেফ যারা ইরানি চলচ্চিত্রের সুদৃঢ় ভিত গড়ে দিয়েছেন, তারা নির্মাণভঙ্গি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কাব্যময়তাকে কিন্তু ফরহাদী হাঁটলেন না সে পথে। তিনি রুক্ষতাকে দেখাচ্ছেন রুক্ষভাবেই। ‘অ্যা সেপারেশন’ তেমনই একটি ছবি যেখানে সম্পর্কের ভাঙন ও পারিবারিক টানাপোড়েন এর সাথে তুলে এনেছেন ইরানের সমাজে শ্রেণি বিভাজনে নারীদের অবস্থান।

১৮৭ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of আইনুদ্দিন সাফওয়ান

আইনুদ্দিন সাফওয়ান

পড়াশোনা ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এ, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগে। দীর্ঘদিন যাবৎ সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা ও লেখালেখি করছেন। সিনেমা, শিল্প এবং রাজনীতির প্রতি আগ্রহের জায়গা থেকে ডিজিটাল ফর্মে ফিল্ম নিয়ে গবেষণা এবং বাংলাদেশে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের বাস্তবতাকে গণমানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্য কাজ করছেন।
Picture of আইনুদ্দিন সাফওয়ান

আইনুদ্দিন সাফওয়ান

পড়াশোনা ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এ, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগে। দীর্ঘদিন যাবৎ সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা ও লেখালেখি করছেন। সিনেমা, শিল্প এবং রাজনীতির প্রতি আগ্রহের জায়গা থেকে ডিজিটাল ফর্মে ফিল্ম নিয়ে গবেষণা এবং বাংলাদেশে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের বাস্তবতাকে গণমানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্য কাজ করছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top