বিজ্ঞানের দ্বারা জ্ঞানের এমন একটি শাখাকে বুঝানো হয় যা বস্তুগত দুনিয়া নিয়ে আলোচনা করে। ফিলোসফি অফ সাইন্স বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত এমন দার্শনিক সমস্যার সমাধান করে। এগুলোর মাঝ ২ টি সমস্যা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ –
১/ বস্তুগত দুনিয়া সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কিভাবে বিকশিত হলো ?
২/ বৈজ্ঞানিক গবেষণার চিরন্তন মূলনীতিগুলো কি ?
এইখানে আমরা কুরআনের দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুইটা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবো।
কুরআনের দৃষ্টিতে জ্ঞানতত্ত্বীয় সমস্যা
কুরআনের দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবিক অর্থেই আমাদের অন্তরের বিশাল স্বাধীনতা রয়েছে।
وَ فِی الْاَرْضِ اٰیٰتٌ لِّلْمُوْقِنِیْنَۙ
দৃঢ় প্রত্যয় পোষণকারীদের জন্য পৃথিবীতে বহু নিদর্শন রয়েছে।
وَ فِیْۤ اَنْفُسِكُمْؕ اَفَلَا تُبْصِرُوْنَ
এবং তোমাদের সত্তার মধ্যেও। তোমরা কি দেখ না? (৫১:২০-২১)
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ وَ جَعَلَ الظُّلُمٰتِ وَ النُّوْرَ۬ؕ ثُمَّ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا بِرَبِّهِمْ یَعْدِلُوْنَ
প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং অন্ধকার ও আলোর উৎপত্তি ঘটিয়েছেন। (৬:১)
اَوَ لَمْ یَنْظُرُوْا فِیْ مَلَكُوْتِ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ مَا خَلَقَ اللّٰهُ مِنْ شَیْءٍۙ-وَّ اَنْ عَسٰۤى اَنْ یَّكُوْنَ قَدِ اقْتَرَبَ اَجَلُهُمْۚ-فَبِاَیِّ حَدِیْثٍۭ بَعْدَهٗ یُؤْمِنُوْنَ
তারা কি কখনো আকাশ ও পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তা করেনি এবং আল্লাহর সৃষ্ট কোন জিনিসের দিকে চোখ মেলে তাকায়নি? (৭:১৮৫)
আমরা বস্তুগত দুনিয়া নিয়ে গবেষণা করার জন্য, আল্লাহর সৃষ্ট প্রাকৃতিক নির্দশনগুলোর মাধ্যমে তাঁর আরো নিকটবর্তী হওয়ার জন্য এবং যে কাঁচা মালগুলো তিনি আমাদের জন্য সৃষ্টি করে রেখেছেন সেগুলো ব্যবহারের জন্য আদেশ প্রাপ্ত।
قُلِ انْظُرُوْا مَا ذَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِؕ وَ مَا تُغْنِی الْاٰیٰتُ وَ النُّذُرُ عَنْ قَوْمٍ لَّا یُؤْمِنُوْنَ
তাদেরকে বলো, “পৃথিবী ও আকাশে যা কিছু আছে চোখ মেলে দেখো।” আর যারা ঈমান আনতেই চায় না তাদের জন্য নির্দশন ও উপদেশ তিরস্কার কীইবা উপকারে আসতে পারে। (১০:১০১)
اَللّٰهُ الَّذِیْ رَفَعَ السَّمٰوٰتِ بِغَیْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِ وَ سَخَّرَ الشَّمْسَ وَ الْقَمَرَؕ كُلٌّ یَّجْرِیْ لِاَجَلٍ مُّسَمًّىؕ یُدَبِّرُ الْاَمْرَ یُفَصِّلُ الْاٰیٰتِ لَعَلَّكُمْ بِلِقَآءِ رَبِّكُمْ تُوْقِنُوْنَ
আল্লাহই আকাশসমূহ স্থাপন করেছেন এমন কোন স্তম্ভ ছাড়াই যা তোমরা দেখতে পাও। তারপর তিনি নিজের শাসন কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হয়েছেন। আর তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে একটি আইনের অধীন করেছেন। এ সমগ্র ব্যবস্থার প্রত্যেকটি জিনিস একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলে। আল্লাহই এ সমস্ত কাজের ব্যবস্থাপনা করছেন। তিনি নিদর্শনাবলী খুলে খুলে বর্ণনা করেন, সম্ভবত তোমরা নিজেদের রবের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারটি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করবে। (১৩:২)
وَ سَخَّرَ لَكُمُ الَّیْلَ وَ النَّهَارَۙ وَ الشَّمْسَ وَ الْقَمَرَؕ وَ النُّجُوْمُ مُسَخَّرٰتٌۢ بِاَمْرِهٖؕ اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوْمٍ یَّعْقِلُوْنَۙ وَ مَا ذَرَاَ لَكُمْ فِی الْاَرْضِ مُخْتَلِفًا اَلْوَانُهٗؕ اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیَةً لِّقَوْمٍ یَّذَّكَّرُوْنَ وَ هُوَ الَّذِیْ سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَاْكُلُوْا مِنْهُ لَحْمًا طَرِیًّا وَّ تَسْتَخْرِجُوْا مِنْهُ حِلْیَةً تَلْبَسُوْنَهَاۚ وَ تَرَى الْفُلْكَ مَوَاخِرَ فِیْهِ وَ لِتَبْتَغُوْا مِنْ فَضْلِهٖ وَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ
তিনি তোমাদের কল্যাণের জন্য রাত ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে বশীভূত করে রেখেছেন এবং সমস্ত তারকাও তাঁরই হুকুমে বশীভূত রয়েছে। যারা বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগায় তাদের জন্য রয়েছে এর মধ্যে প্রচুর নিদর্শন। আর এই যে বহু রং বেরংয়ের জিনিস তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীতে সৃষ্টি করে রেখেছেন এগুলোর মধ্যেও অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা শিক্ষাগ্রহণ করে। তিনিই তোমাদের জন্য সাগরকে করায়ত্ত করে রেখেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তরতাজা গোশত নিয়ে খাও এবং তা থেকে এমন সব সৌন্দর্য সামগ্রী আহরণ করো যা তোমরা অংগের ভূষণরূপে পরিধান করে থাকো। তোমরা দেখছো, সমুদ্রের বুক চিরে নৌযান চলাচল করে। এসব এজন্য, যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পারো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকো। (১৬:১২-১৪)
যদি প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করা অসম্ভব হত তাহলে কুরআন আমাদেরকে মৌলিক বিষয় এবং বিভিন্ন জীব ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সমূহ নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করতে উৎসাহিত করতো না। অধিকন্তু কুরআনের কিছু আয়াত সুস্পষ্টরূপে এইদিকে নির্দেশ করেঃ
سَنُرِیْهِمْ اٰیٰتِنَا فِی الْاٰفَاقِ وَ فِیْۤ اَنْفُسِهِمْ حَتّٰى یَتَبَیَّنَ لَهُمْ اَنَّهُ الْحَقُّؕ اَوَ لَمْ یَكْفِ بِرَبِّكَ اَنَّهٗ عَلٰى كُلِّ شَیْءٍ شَهِیْدٌ
অচিরেই আমি এদেরকে সর্বত্র আমার নিদর্শনসমূহ দেখাবো এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও। যাতে এদের কাছে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এ কুরআন যথার্থ সত্য এটাই কি যথেষ্ঠ নয় যে, তোমার রব প্রতিটি জিনিস দেখছেন? (৪১:৫৩)
অন্যদিকে কুরআন হচ্ছে সমগ্র মানব জাতির জন্য পথ নির্দেশনা । আর তাই কুরআনে মানুষের সাথে সম্পর্কিত এমন কোন কিছুই উপেক্ষা করা হয়নি:
وَ نَزَّلْنَا عَلَیْكَ الْكِتٰبَ تِبْیَانًا لِّكُلِّ شَیْءٍ وَّ هُدًى وَّ رَحْمَةً وَّ بُشْرٰى لِلْمُسْلِمِیْنَ۠
আমি এ কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যা সব জিনিস পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে এবং যা সঠিক পথনির্দেশনা, রহমত ও সুসংবাদ বহন করে তাদের জন্য যারা আনুগত্যের শির নত করে দিয়েছে। (১৬:৮৯)
مَا فَرَّطْنَا فِی الْكِتٰبِ مِنْ شَیْءٍ ثُمَّ اِلٰى رَبِّهِمْ یُحْشَرُوْنَ
এই কিতাবে কোন কিছু লিখতে আমি বাদ দেইনি। (৬:৩৮)
অতএব আশা করি যে কেউ গভীর অধ্যয়নের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হবে যে, কুরআন হচ্ছে প্রকৃতিকে নিয়ে গবেষণা করার পথ উন্মোচনকারী নতুন নতুন পথের সন্ধান দানকারী গ্রন্থ ।
প্রকৃতিকে নিয়ে গবেষণা করার চেতনা জাগ্রতকারী উপাদান
কুরআনের মতে, প্রকৃতিকে নিয়ে গবেষণা করার সাধারণ উপায় হচ্ছে আমাদের আক্বল এবং পঞ্চইন্দ্রিয়:
وَ اللّٰهُ اَخْرَجَكُمْ مِّنْۢ بُطُوْنِ اُمَّهٰتِكُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ شَیْــٴًـاۙ وَّ جَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَ الْاَبْصَارَ وَ الْاَفْـٕدَةَۙ
আল্লাহ তোমাদের মায়ের পেট থেকে তোমাদের বের করেছেন এমন অবস্থায় যখন তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের কান দিয়েছেন, চোখ দিয়েছেন, চিন্তা-ভাবনা করার মতো হৃদয় দিয়েছেন।(১৬:৭৮)
আমরা কোন ঘটনার বারবার পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যম শিখি :
قُلْ سِیْرُوْا فِی الْاَرْضِ فَانْظُرُوْا كَیْفَ بَدَاَ الْخَلْقَ
এদেরকে বলো, পৃথিবীর বুকে চলাফেরা করো এবং দেখো তিনি কিভাবে সৃষ্টির সূচনা করেন। (২৯:২০)
اَفَلَمْ یَسِیْرُوْا فِی الْاَرْضِ فَتَكُوْنَ لَهُمْ قُلُوْبٌ یَّعْقِلُوْنَ
তারা কি পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করেনি, যার ফলে তারা উপলব্ধিকারী হৃদয়ের অধিকারী হতো? (২২:৪৬)
এই আয়াতগুলোর প্রথমাংশ পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষণের দিকে নির্দেশ করে এবং দ্বিতীয়াংশ যুক্তিবিদ্যার দিকে নির্দেশ করে। তাই প্রকৃতিকে বুঝার অপরিহার্য মাধ্যম হচ্ছে পরীক্ষামূলক কার্য সম্পাদন করা। কিন্তু পক্ষান্তরে কিছু ধারার দাবি হচ্ছে প্রকৃতির সকল তথ্য শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব নয়। আমরা যদি আমাদেরকে শুধুমাত্র পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ করে ফেলি এবং আমদের আক্বলকে যদি ব্যবহার না করি তবে আমাদের এবং পশুদের মাঝে কি পার্থক্য রইল:
وَ لَقَدْ ذَرَاْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِیْرًا مِّنَ الْجِنِّ وَ الْاِنْسِ ﳲ لَهُمْ قُلُوْبٌ لَّا یَفْقَهُوْنَ بِهَا٘-وَ لَهُمْ اَعْیُنٌ لَّا یُبْصِرُوْنَ بِهَا٘-وَ لَهُمْ اٰذَانٌ لَّا یَسْمَعُوْنَ بِهَاؕ-أُولَٰئِكَ كَالْاَنْعَامِ بَلْ هُمْ اَضَلُّؕ-أُولَٰئِكَ هُمُ الْغٰفِلُوْنَ
আর এটি একটি অকাট্য সত্য যে, বহু জ্বীন ও মানুষ এমন আছে যাদেরকে আমি জাহান্নামের জন্যই সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না। তাদের কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না। তারা পশুর মত, বরং তাদের চাইতেও অধম। তারা চরম গাফলতির মধ্যে হারিয়ে গেছে। (৭:১৭৯)
উপরন্তু সৃষ্টি জগতে বিদ্যমান নিদর্শনসমূহ বুঝতে প্রয়োজন আক্বল ও গভীর উপলব্ধির । আল – কুরআনে বারবার এমন লোকদের কথা বলা হয়েছে:
اِنَّ فِیْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ اخْتِلَافِ الَّیْلِ وَ النَّهَارِ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی الْاَلْبَابِۚۙ الَّذِیْنَ یَذْكُرُوْنَ اللّٰهَ قِیٰمًا وَّ قُعُوْدًا وَّ عَلٰى جُنُوْبِهِمْ وَ یَتَفَكَّرُوْنَ فِیْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِۚ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هٰذَا بَاطِلًاۚ سُبْحٰنَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
পৃথিবী ও আকাশের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের পালাক্রমে যাওয়া আসার মধ্যে, যে সমস্ত বুদ্ধিমান লোক উঠতে, বসতে ও শয়নে সব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর গঠনাকৃতি নিয়ে চিন্তা- ভাবনা করে, তাদের জন্য রয়েছে বহুতর নিদর্শন। (তারা আপনা আপনি বলে ওঠেঃ) “হে আমাদের প্রভু! এসব তুমি অনর্থক ও উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে সৃষ্টি করো নি। বাজে ও নিরর্থক কাজ করা থেকে তুমি পাক-পবিত্র ও মুক্ত। কাজেই হে প্রভু! জাহান্নামের আযাব থেকে আমাদের রক্ষা করো। (৩:১৯০-১৯১)
কুরআন আমাদেরকে এটাও শিখায় যে বস্তুগত দুনিয়ায় এমন অনেক কিছু আছে যা আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করতে সক্ষম নই:
فَلَاۤ اُقْسِمُ بِمَا تُبْصِرُوْنَۙ وَ مَا لَا تُبْصِرُوْنَۙ
অতএব তা নয়। আমি শপথ করছি ঐ সব জিনিসেরও যা তোমরা দেখতে পাও এবং ঐসব জিনিসের যা তোমরা দেখতে পাওনা। (৬৯:৩৮-৩৯)
خَلَقَ السَّمٰوٰتِ بِغَیْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا
তিনি আকাশসমূহ সৃষ্টি করেছেন স্তম্ভ ছাড়াই, যা তোমরা দেখতে পাও। (৩১:১০)
সর্বশেষ কুরআন এমন লোকদের সমালোচনা করে যারা ভাবে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ই বস্তুগত দুনিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার একমাত্র পন্থা:
یَسْــٴَـلُكَ اَهْلُ الْكِتٰبِ اَنْ تُنَزِّلَ عَلَیْهِمْ كِتٰبًا مِّنَ السَّمَآءِ فَقَدْ سَاَلُوْا مُوْسٰۤى اَكْبَرَ مِنْ ذٰلِكَ فَقَالُوْۤا اَرِنَا اللّٰهَ جَهْرَةً فَاَخَذَتْهُمُ الصّٰعِقَةُ بِظُلْمِهِمْۚ
এই আহ্লে কিতাবরা যদি আজ তোমার কাছে আকাশ থেকে তাদের জন্য কোন লিখন অবতীর্ণ করার দাবী করে থাকে, তাহলে ইতিপূর্বে তারা এর চাইতেও বড় ধৃষ্ঠতাপূর্ণ দাবী মূসার কাছে করেছিল। তারা তো তাঁকে বলেছিল, আল্লাহকে প্রকাশ্যে আমাদের দেখিয়ে দাও। তাদের এই সীমালঙ্ঘনের কারণে অকস্মাৎ তাদের ওপর বিদ্যুৎ আপতিত হয়েছিল। (৪:১৫৩)
কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক ভাবে গত শতাব্দীর শুরুর দিকে পজিটিভিজমের হাওয়ায় অনেক মুসলিম স্কলার আক্রান্ত হন এবং অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীও ভাবতে শুরু করেন বস্তুগত দুনিয়া সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ততটুকুই যতটুকু আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়। এই ধরণের চিন্তাকে সামনে রেখে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো :
১। আমরা কখনোই কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করি না । আর তাই পরম পরীক্ষামূলক তথ্য বা নিশ্চিত ভাবে সঠিক কোন তথ্য বলতেও কিছু নেই। পরীক্ষামূলক তথ্যের ব্যখ্যা এমনকি এই তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতাও নির্ভর করে পর্যবেক্ষকের পূর্ব ধারণার উপর ভিত্তি। এই বিষয়টাকে প্ল্যাঙ্ক খুব সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেনে এইভাবে:
প্রথমত প্রতিটি মাপ-জোপ ততটুকুই অর্থ বহন করে যতটুকু তাৎপর্য জড় বিজ্ঞানের থিওরি তাকে দেয়। সত্যিকারের প্রায়োগিক গবেষণার সাথে পরিচিত এমন যেকেউ এই বিষয়ে একমত হবেন যে সবচেয়ে সুন্দর এবং সরাসরি মাপন যোগ্য যেমন ভর এবং বিদ্যুতের পরিমাপও ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তিত হতে থাকবে যতক্ষণ না বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে। এটা সত্য যে এই সংশোধনগুলো পরিমাপের পদ্ধতি নিজ থেকে বের হবে না। বরং যে থিওরির উপর এই পরিমাপটা করা হচ্ছে কিংবা এই পরিমাপের সাথে সম্পর্কিত কোন একটা থিওরির মাধ্যমেই সংশোধিত হবে। অর্থ্যাৎ এটা একটা হাইপোথিসিসের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে। (১)
২। আইনস্টাইন যথার্থই বলেছেন বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা ও স্বীকার্যগুলোকে কখনো আরোহ পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। বরং এগুলো হচ্ছে মানুষের মুক্ত চিন্তার ফলাফল। (২)
পদার্থবিজ্ঞান এমন এক যুক্তিনির্ভর সিস্টেম গঠন করেছে যা একেবারে নিখাদ নয়। সময়ের সাথে সাথে যা পরিবর্তিত হচ্ছে। এটাকে বিবর্তনের রাজ্যও বলা যায় । পদার্থ বিজ্ঞানের এই ধারাপূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আরোহ পদ্ধতিতে চলতে থাকে। এখানে নতুন কোন কিছু আসার উপায় হচ্ছে মুক্ত চিন্তা। পদার্থ বিজ্ঞান যে ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে তার যথার্থতা নির্ভর করে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাকে সে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি প্রতিপাদন করছে তার উপর; যেখানে পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীর বিষয়ের মাঝে সম্পর্ক শুধুমাত্র সংজ্ঞায়নের ভিত্তিতে বোঝা সম্ভব। এখানে বিবর্তন এমন একটি প্রক্রিয়া যা যুক্তির মাধ্যমে ক্রমাগত সরল বিষয়ের দিকে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আমাদেরকে একটু করে বাস্তবতায় ফিরে আসতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে থিওরির সাথে বাস্তবতার দূরত্ব অনেক। অনুরূপভাবে মৌলিক ভিত্তিগুলোকে শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার আলোকেই ব্যাখ্যা করার যে পথ আমরা গ্রহণ করেছি তাও দিন দিন কঠিন এবং দীর্ঘতর হয়ে পড়ছে। (৩)
এই জন্য এই ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি থিওরি হচ্ছে এক্সপেরিমেন্টের সরাসরি ফলাফল যদি না এই এক্সপিরিমেন্টের অন্য কোন ব্যাখ্যা না থাকে। কিন্তু এক্সপেরিমেন্টের অন্য কোন ব্যাখ্যা থাকবে না এই দাবিও আমরা করতে পারিনা । এই ভুল না করার ব্যাপারে অতীত অভিজ্ঞতা আমাদেরকে বারবার সর্তক করে। থিওরি এবং এক্সপিরেমেন্টের মধ্যকার এই সম্পর্কের দ্বারা এটা বোঝার প্রয়োজন নেই যে এটাই একমাত্র সঠিক পদ্ধতি। যুক্তির বিচারে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একটা বিষয়ের উপসংহার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই থেকেই টানা সম্ভব। এই জন্য আমরা এটা বলতে পারি না যে, পরীক্ষামূলক তথ্যের সরাসরি ফলাফলই হচ্ছে থিওরি। বরঞ্চ অনেক থিওরিই দাঁড় করানো হয়েছে এক্সপেরিমেন্টকে ব্যাখ্যা করার জন্য। এজন্য প্রকৃত বিষয়কে জানতে আপনাকে নতুন নতুন অনুমান অথবা তথ্যকে সামনে আনতে হবে। যেমন কেপলার যখন নক্ষত্রগুলোর অবস্থানকে স্থির ধরে মঙ্গলের আপেক্ষিক অবস্থান সম্পর্কিত তথ্যগুলো নিয়ে পড়ছিলেন তখন এই তথ্যগুলো থেকে সুন্দর একট সূত্র (Good looking law) আবিষ্কারের চেষ্ট করে ব্যর্থ হলো। অতঃপর ভিন্ন একটা কারণে তিনি উপবৃত্ত সম্পর্কিত থিওরি নিয়ে কাজ করছিলেন আর এই সময়ে তিনি ধারণা করেন গ্রহের কক্ষপথও উপবৃত্তাকার হতে পারে। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে তিনি কিছু এক্সেপেরিমেন্ট চালিয়ে সফল হলেন । এ থেকে বুঝা যায় মঙ্গলের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার হওয়াটা একটা ধারণা ফলাফলা । সরাসরি মঙ্গলের কক্ষপথ দেখে এই সিদ্ধান্তে আসা হয়নি।
অতএব এটা বলা যায় বিজ্ঞানের অগ্রগতি তাত্ত্বিক কল্পনা (Theoretical speculation)এবং পরীক্ষামূলক কাজ (Experimental work) উভয়ের মাধ্যমেই হয়েছে।
৩। এমন অনেক কনসেপ্ট আছে যেগুলো ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যেমন দৈব ঘটনার ধারণা ইন্দ্রায়ানুভূতি দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যেসকল বিষয়ে আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্য গ্রহণ করি সেগুলোর উদাহরণ হচ্ছে ‘খ’ এর মত যা ‘ক’এর পরে আসে। আর এটাই হচ্ছে ‘ক’এবং ‘খ’এর মাঝের দৈব সম্পর্ক যা আমরা আমাদের আক্বলের সাহায্যে নিরূপণ করি। এমনকি পদার্থ বিজ্ঞানের সকল ধারণা বাস্তবিক অভিজ্ঞতার ফলাফল নয় বরং এর বেশির ভাগই বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টকে ব্যাখ্যার তাগিদে উদ্ভব হয়েছে। যেমন আমরা এটমের ধারণাকে হাজারো এক্সপেরিমেন্টের ব্যাখ্যায় ব্যবহার করি কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউই কিন্তু এই এটমকে দেখেনি (এমনকি ইন্দ্রিয় প্রসারিত করে এমন উপকরণ যেমন ইলেকট্রনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও না।) আমরা এটমকে চিনি অনুমানের উপর নির্ভর করে। অনুরূপভাবে মহাশূন্যের বিস্তৃতি ও সময় নিয়েও আমাদের কাছে কোন সরাসরি তথ্য নেই।
উপসংহারে এই আলোচনা থেকে আমরা এইটা ব্যাখ্যা করতে পারি যে তাত্ত্বিক ভিত্তি ছাড়া শুধুমাত্র এক্সপিরিমেন্ট আমাদেরকে কখনো প্রকৃতি সমন্ধে সঠিক তথ্য দিতে পারে না। এমনকি পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষণের মাধ্যমে বস্তুগত দুনিয়া সম্পর্কে যে ছবি আমাদের মানসপটে তৈরি হয়, যতটুকু জ্ঞান আমরা লাভ করি তার সবটুকুও আমরা ইন্দ্রয়ানুভূতির অভিজ্ঞতা দ্বারা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নই।
বস্তুগত দুনিয়া সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ছবি অংকন করার এই প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ । আর এই প্রক্রিয়া যথাযথ ভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব শুধুমাত্র তাত্ত্বিক গবেষণা এবং পরীক্ষামূলক কাজের মাধ্যমে।
সঠিক পন্থা অবলম্বনের পথে বাঁধা সমূহঃ
যেমনটা আমরা পূর্বেই বলেছিলাম কুরআন আমাদেরকে প্রকৃতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার এবং এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করার নির্দেশ দেয়। এই গভীর চিন্তা এর সাথে সম্পর্কিত বিদ্যমান তথ্য উপাত্ত আমাদেরকে বিশুদ্ধ জ্ঞানের দিকে নিয়ে যাবে। যাই হোক এই বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে যদি সঠিক মূলনীতি এবং পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়। এইভাবে আমরা যুক্তির কাছে ফিরে আসি যা মূলনীতি নিয়ে অধ্যায়ন করার সঠিক পন্থা। যাই হোক শুধুমাত্র যুক্তিবিদ্যার নীতি সঠিক ফলাফল নাও দিতে পারে যদি না যেসকল বিষয়ের উপর এই যুক্তি দাঁড় করানো হচ্ছে সেগুলো নির্ভুল হয়। এই কারণে কুরআন আমাদেরকে এমনসব বিষয়ে সর্তক করেছে যা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে সঠিক ভাবে এগিয়ে যেতে বাধাগ্রস্ত করে। এই পর্যায়ে আমরা প্রকৃতিকে সঠিকভাবে চেনার ক্ষেত্রে বাঁধা প্রদানকারী প্রধান প্রধান বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবো:
১। ঈমানের অভাব
কুরআন অনুসারে ঈমানহীন জ্ঞান দিয়ে কেউ প্রকৃতি সম্বন্ধে সঠিক বুঝা পড়া লাভ করে না।
قُلِ انْظُرُوْا مَا ذَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِؕ وَ مَا تُغْنِی الْاٰیٰتُ وَ النُّذُرُ عَنْ قَوْمٍ لَّا یُؤْمِنُوْنَ
তাদেরকে বলো, “পৃথিবী ও আকাশে যা কিছু আছে চোখ মেলে দেখো।” আর যারা ঈমান আনতেই চায় না তাদের জন্য নির্দশন ও উপদেশ তিরস্কার কীইবা উপকারে আসতে পারে। (১০:১০১)
ঈমানের প্রধান ভূমিকাই হচ্ছে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্ত রাখা।
২। পক্ষপাতিত্বমূলক বিচার বিশ্লেষণ
কারো খেয়াল খুশির অনুসরণ সেটা হতে পারে কারো প্রতি ভালোবাসা কিংবা ঘৃণার কারণে সে যাই হোক এধরণের পূর্বানুমানের ভিত্তিতে চলা ইনসাফের নীতি নয় এবং এই নিদারুণ আত্নম্ভরিতাই হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পক্ষপাতহীন এবং নিরপেক্ষক বিচার বিশ্লষণের পথে বাঁধা প্রদানকারী কারণগুলোর অন্যতম।
وَ لَنْ تَرْضٰى عَنْكَ الْیَهُوْدُ وَ لَا النَّصٰرٰى حَتّٰى تَتَّبِـعَ مِلَّتَهُمْؕ قُلْ اِنَّ هُدَى اللّٰهِ هُوَ الْهُدٰىؕ وَ لَئِنِ اتَّبَعْتَ اَهْوَآءَهُمْ بَعْدَ الَّذِیْ جَآءَكَ مِنَ الْعِلْمِۙ مَا لَكَ مِنَ اللّٰهِ مِنْ وَّلِیٍّ وَّ لَا نَصِیْرٍؔ
ইহুদি ও খ্রিস্টানরা তোমার প্রতি কখনোই সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের পথে চলতে থাকো। পরিষ্কার বলে দাও, পথ মাত্র একটিই, যা আল্লাহ বাতলে দিয়েছেন। অন্যথায় তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে তারপরও যদি তুমি তাদের ইচ্ছা ও বাসনা অনুযায়ী চলতে থাকো, তাহলে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষাকারী তোমার কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী থাকবে না। (২:১২০)
لَقَدْ جِئْنٰكُمْ بِالْحَقِّ وَ لٰكِنَّ اَكْثَرَكُمْ لِلْحَقِّ كٰرِهُوْنَ
“আমরা তোমাদের কাছে ন্যায় ও সত্য নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোমাদের অধিকাংশের কাছে ন্যায় ও সত্য ছিল অপছন্দনীয়।” (৪৩:৭৮)
فَلَمَّا جَآءَتْهُمْ اٰیٰتُنَا مُبْصِرَةً قَالُوْا هٰذَا سِحْرٌ مُّبِیْنٌۚ جَحَدُوْا بِهَا وَ اسْتَیْقَنَتْهَاۤ اَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَّ عُلُوًّاؕ فَانْظُرْ كَیْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِیْنَ۠
“কিন্তু যখন আমার সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ তাদের সামনে এসে গেলো তখন তারা বলল, এতো সুস্পষ্ট যাদু। তারা একেবারেই অন্যায়ভাবে ঔদ্ধত্যের সাথে সেই নিদর্শনগুলো অস্বীকার করলো অথচ তাদের মন মগজ সেগুলোর সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল। এখন এ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কি হয়েছিল দেখে নাও।” (২৭:১৩-১৪)
৩। পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ:
وَ قَالُوْا رَبَّنَاۤ اِنَّاۤ اَطَعْنَا سَادَتَنَا وَ كُبَرَآءَنَا فَاَضَلُّوْنَا السَّبِیْلَا
আরো বলবে, “হে আমাদের রব! আমরা আমাদের সরদারদের ও বড়দের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করেছে।” (৩৩:৬৭)
وَ اِذَا قِیْلَ لَهُمُ اتَّبِعُوْا مَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ قَالُوْا بَلْ نَتَّبِـعُ مَاۤ اَلْفَیْنَا عَلَیْهِ اٰبَآءَنَاؕ اَوَ لَوْ كَانَ اٰبَآؤُهُمْ لَا یَعْقِلُوْنَ شَیْــٴًـا وَّ لَا یَهْتَدُوْنَ
“তাদের যখন বলা হয়, আল্লাহ যে বিধান নাযিল করেছেন তা মেনে চলো, জবাবে তারা বলে, আমাদের বাপ-দাদাদের যে পথের অনুসারী পেয়েছি আমরা তো সে পথে চলবো। আচ্ছা, তাদের বাপ-দাদারা যদি একটুও বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ না করে থেকে থাকে এবং সত্য-সঠিক পথের সন্ধান না পেয়ে থাকে তাহলেও কি তারা তাদের অনুসরণ করে যেতে থাকবে?” (২:১৭০)
৪। অপ্রসাঙ্গিক আলোচনা এবং অন্ধ সমর্থন:
وَ مَا لَهُمْ بِهٖ مِنْ عِلْمٍؕ اِنْ یَّتَّبِعُوْنَ اِلَّا الظَّنَّۚ وَ اِنَّ الظَّنَّ لَا یُغْنِیْ مِنَ الْحَقِّ شَیْــٴًـاۚ
অথচ এ ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞানই নেই। তারা কেবলই বদ্ধমূল ধারণার অনুসরণ করছে। আর ধারণা কখনো জ্ঞানের প্রয়োজন পূরণে কোন কাজে আসতে পারে না। (৫৩:২৮)
সঠিক বিচার বিশ্লেষণের পথে সবেচেয় বড় ভুলগুলোর অন্যতম হচ্ছে জ্ঞানকে আন্দাজ – অনুমানের ভিত্তিতে প্রতিস্থাপন করা :
وَ لَا تَقْفُ مَا لَیْسَ لَكَ بِهٖ عِلْمٌؕ اِنَّ السَّمْعَ وَ الْبَصَرَ وَ الْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْـٴُـوْلًا
এমন কোন জিনিসের পেছনে লেগে যেয়ো না যা সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই। নিশ্চিতভাবেই চোখ, কান ও রুহ সম্পর্কে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার পূর্বশর্ত:
আমরা পর্বেই উল্লেখ করেছি বৈজ্ঞানিক গবেষণা হচ্ছে একই সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং পরীক্ষামূলক কাজের সংমিশ্রণ। এই কাজকে অর্থবহ করতে এবং যথাযথ ফলাফল নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে যেকোন বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের পূর্বে একটা মূলনীতিকে অনুমান করে এগিয়ে যেতে হয়। এই সকল মূলনীতির অসংখ্য ব্যাখা বিশ্লেষণ আছে। কুরআনকে নির্দেশিকা হিসেবে ব্যবহার করার চিন্তা করলে আমরা এখান থেকে কিছু মৌলিক যুক্তি ( যেমনঃ দ্বন্দহীনতার মূলনীতি) পাই যেই মূলনীতি যেকোন ধরণের বৈজ্ঞানিক গবেষণা কার্যক্রমের পূর্বানুমান হিসেবে কাজ করে।
১। অদ্বিত্ববাদের মূলনীতি ( আত – তাওহীদ)
কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কারো ব্যক্তিগত কৌতূহল মেটানোর জন্য প্রকৃতিকে নিয়ে গবেষণা করা উচিত নয়। বরং এটা হওয়া উচিত সমগ্র বিশ্বের সর্বজ্ঞানী স্রষ্টাকে জানার চেনার জন্য। প্রকৃতির সকল জীবজন্তু হচ্ছে সৃষ্টির নির্দশন আর এগুলো নিয়ে অধ্যয়ন আমাদেরকে তাঁর দিকেই নিয়ে যায়।
অধিকন্তু বস্তুগত দুনিয়ার এই শৃঙ্খলা ,ঐকতান এবং সৃষ্টির উদ্দ্যেশের সমর্থনে কুরআনের আয়াত রয়েছে:
وَ خَلَقَ كُلَّ شَیْءٍ فَقَدَّرَهٗ تَقْدِیْرًا
যিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন তারপর তার একটি তাকদীর নির্ধারিত করে দিয়েছেন। (২৫:২)
الَّذِیْ خَلَقَ سَبْعَ سَمٰوٰتٍ طِبَاقًاؕ مَا تَرٰى فِیْ خَلْقِ الرَّحْمٰنِ مِنْ تَفٰوُتٍؕ فَارْجِعِ الْبَصَرَۙ هَلْ تَرٰى مِنْ فُطُوْرٍ
তিনিই স্তরে স্তরে সাজিয়ে সাতটি আসমান তৈরী করেছেন। তুমি রহমানের সৃষ্টকর্মে কোন প্রকার অসঙ্গতি দেখতে পাবে না। আবার চোখ ফিরিয়ে দেখ, কোন ত্রুটি দেখতে পাচ্ছ কি? (৬৭:৩)
وَ مَا خَلَقْنَا السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ وَ مَا بَیْنَهُمَا لٰعِبِیْنَ مَا خَلَقْنٰهُمَاۤ اِلَّا بِالْحَقِّ وَ لٰكِنَّ اَكْثَرَهُمْ لَا یَعْلَمُوْنَ
আমি এ আসমান ও যমীন এবং এর কাছের সমস্ত জিনিস খেলাচ্ছলে তৈরি করিনি। এসবই আমি যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানে না। (৪৪:৩৮-৩৯)
তিনি এই মহাজগতের সকল কিছুর মাঝে সমন্বয় ও শৃঙ্খলাবিধানকারী এবং এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও পরিচালক :
لَوْ كَانَ فِیْهِمَاۤ اٰلِهَةٌ اِلَّا اللّٰهُ لَفَسَدَتَاۚ
যদি আকাশে ও পৃথিবীতে এক আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কোন ইলাহ থাকতো তাহলে (পৃথিবী ও আকাশ) উভয়ের ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যেতো। (২১:২২)
صُنْعَ اللّٰهِ الَّذِیْۤ اَتْقَنَ كُلَّ شَیْءٍؕ
এ হচ্ছে আল্লাহর কুদরতের মূর্ত প্রকাশ, যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে বিজ্ঞতা সহকারে সুসংঙ্গবদ্ধ করেছেন।(২৭:৮৮)
اَفَلَا یَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْاٰنَؕ وَ لَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَیْرِ اللّٰهِ لَوَجَدُوْا فِیْهِ اخْتِلَافًا كَثِیْرًا
তারা কি কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না? যদি এটি আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষ থেকে হতো, তাহলে তারা এর মধ্যে বহু বর্ণনাগত অসঙ্গতি খুঁজে পেতো। (৪:৮২)
هُوَ الَّذِیْ جَعَلَ الشَّمْسَ ضِیَآءً وَّ الْقَمَرَ نُوْرًا وَّ قَدَّرَهٗ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوْا عَدَدَ السِّنِیْنَ وَ الْحِسَابَؕ مَا خَلَقَ اللّٰهُ ذٰلِكَ اِلَّا بِالْحَقِّۚ یُفَصِّلُ الْاٰیٰتِ لِقَوْمٍ یَّعْلَمُوْنَ
তিনিই সূর্যকে করেছেন দীপ্তিময় ও চন্দ্রকে আলোকময় এবং তার মঞ্জিলও ঠিকমত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যাতে তোমরা তার সাহায্যে বছর গণনা ও তারিখ হিসেব করতে পারো। আল্লাহ এসব কিছু (খেলাচ্ছলে নয় বরং) উদ্দেশ্যমূলকভাবেই সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিজের নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে পেশ করেছেন যারা জ্ঞানবান তাদের জন্য। (১০:৫)
তাওহীদের উপর দৃঢ় বিশ্বাস একজন গবেষককে প্রকৃতিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে নয় বরং সামগ্রিকভাবে দেখতে শিখায়। এই সামগ্রিক দর্শনের মাধ্যমে গবেষকরা প্রকৃতির একটি বিষয়ের সাথে আরেকটি বিষয়ের যে নিবিড় সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হন ।
অন্যদিকে প্রকৃতির এই সুশৃঙ্খল বিন্যাসের উপর যদি দৃঢ় বিশ্বাস না থাকে তাহলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা সার্বজনীন তাৎপর্য বহন করবে না সর্বোচ্চ সাময়িক গুরুত্ব লাভ করতে পারে। তবে কিছু বিজ্ঞানী এমনও আছেন যারা প্রকৃতির মাঝে বিদ্যমান আইন, সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার উপস্থিতির উপর বিশ্বাস করলেও তাওহীদে বিশ্বাসী নন। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে তাওহীদে বিশ্বাস ব্যতীত মহাজগতিক ব্যবস্থাপনার কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
বহিঃজগতের বাস্তবতা
যেমনটা আমরা পূর্বেই বলেছি, কুরআন অনুসারে অনুধাবনকারী বিষয় থেকে স্বতন্ত্র একটি বহিঃজগত রয়েছে:
وَ اللّٰهُ اَخْرَجَكُمْ مِّنْۢ بُطُوْنِ اُمَّهٰتِكُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ شَیْــٴًـاۙ وَّ جَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَ الْاَبْصَارَ وَ الْاَفْـٕدَةَۙ
আল্লাহ তোমাদের মায়ের পেট থেকে তোমাদের বের করেছেন এমন অবস্থায় যখন তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের কান দিয়েছেন, চোখ দিয়েছেন, চিন্তা-ভাবনা করার মতো হৃদয় দিয়েছেন। (১৬:৭৮)
الَّذِیْ جَعَلَ لَكُمُ الْاَرْضَ مَهْدًا وَّ جَعَلَ لَكُمْ فِیْهَا سُبُلًا لَّعَلَّكُمْ تَهْتَدُوْنَۚ وَ الَّذِیْ نَزَّلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءًۢ بِقَدَرٍۚ فَاَنْشَرْنَا بِهٖ بَلْدَةً مَّیْتًاۚ كَذٰلِكَ تُخْرَجُوْنَ وَ الَّذِیْ خَلَقَ الْاَزْوَاجَ كُلَّهَا وَ جَعَلَ لَكُمْ مِّنَ الْفُلْكِ وَ الْاَنْعَامِ مَا تَرْكَبُوْنَۙ
তিনিই তো সৃষ্টি করেছেন যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য দোলনা বানিয়েছেন এবং সেখানে তোমাদের জন্য রাস্তা তৈরী করে দিয়েছেন। যাতে তোমাদের গন্তব্যস্থলের পথ খুঁজে পাও। যিনি আসমান থেকে একটি বিশেষ পরিমাণে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে মৃত ভূমিকে জীবিত করে তুলেছেন। তোমাদের এভাবেই একদিন মাটির ভেতর থেকে বের করে আনা হবে। তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি সমস্ত জোড়া সৃষ্টি করেছেন। যিনি তোমাদের জন্য নৌকা-জাহাজ এবং জীব-জন্তুকে সওয়ারি বানিয়েছেন যাতে তোমরা তার পিঠে আরোহণ করো। (৪৩:১০-১২)
বাহ্যিক জগতের উপর বিশ্বাসই হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞান এবং প্রকৃতিবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি। এই বিশ্বাসই যদি না থাকে তবে বৈজ্ঞানিক চেষ্টা-প্রচেষ্টা বাচ্চাদের অহেতুক কর্মকান্ড বা খেলাধুলার চেয়ে বেশি কিছু না। বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডের জন্য প্রেরণা জোগায় এমন বিষয়গুলোর মাঝে এই বিশ্বাস অন্যতম। প্ল্যাঙ্ক এই বিষয়টিকে খুব সুন্দরভাবে এই ভাবে ব্যক্ত করেন:
“সবচেয়ে বাস্তব এবং অসাধারণ মননের অধিকারী ব্যক্তি যেমন কেপলার, নিউটন, লিবনিজ এবং ফেরাডেরা বহিঃজগতের উপস্থিতি এবং এর পিছনে উচ্চতর শাসন বিদ্যমান রয়েছে এমন বিশ্বাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।”
মানব জ্ঞানের সীমবদ্ধতা
আমরা কুরআন থেকে জানতে পারি মানুষের জ্ঞান সীমাবদ্ধ:
وَ مَاۤ اُوْتِیْتُمْ مِّنَ الْعِلْمِ اِلَّا قَلِیْلًا
কিন্তু তোমরা সামান্য জ্ঞানই লাভ করেছো। (১৭:৮৫)
এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলো আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয় উপলব্ধি করতে পারে না:
فَلَاۤ اُقْسِمُ بِمَا تُبْصِرُوْنَۙ وَ مَا لَا تُبْصِرُوْنَۙ
অতএব তা নয়। আমি শপথ করছি ঐ সব জিনিসেরও যা তোমরা দেখতে পাও এবং ঐসব জিনিসের যা তোমরা দেখতে পাওনা। (৬৯:৩৮-৩৯)
اَللّٰهُ الَّذِیْ رَفَعَ السَّمٰوٰتِ بِغَیْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا
আল্লাহই আকাশসমূহ স্থাপন করেছেন এমন কোন স্তম্ভ ছাড়াই যা তোমরা দেখতে পাও। (১৩:২)
سُبْحٰنَ الَّذِیْ خَلَقَ الْاَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنْۢبِتُ الْاَرْضُ وَ مِنْ اَنْفُسِهِمْ وَ مِمَّا لَا یَعْلَمُوْنَ
পাক-পবিত্র সে সত্ত্বা যিনি সব রকমের জোড়া সৃষ্টি করেছেন, তা ভূমিজাত উদ্ভিদের মধ্য থেকে হোক অথবা স্বয়ং এদের নিজেদের প্রজাতির (অর্থাৎ মানব জাতি) মধ্য থেকে হোক কিংবা এমন জিনিসের মধ্য থেকে হোক যাদেরকে এরা জানেও না।(৩৬:৩৬)
এবং এজন্য আমাদেরকে অদেখার উপর বিশ্বাস অর্থ্যাৎ অতিপ্রাকৃতিক সত্যের উপর বিশ্বাস করতে হয়:
ذٰلِكَ الْكِتٰبُ لَا رَیْبَ فِیْهِ ۚۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِیْنَۙ الَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِالْغَیْبِ وَ یُقِیْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَ مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَۙ
এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। এটি হিদায়াত সেই ‘মুত্তাকী’দের জন্য। যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামায কায়েম করে এবং যে রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। (২:২-৩)
মানব জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার এবং অদৃশ্যের উপর বিশ্বাস আমাদের চিন্তাশীলতাকে শুধুমাত্র পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির মাঝে সীমাবদ্ধ না করে ফেলার ব্যাপরে উৎসাহিত করে। একই সাথে আমরা দুনিয়ার সবকিছু জেনে ফেলেছি এমন চিন্তা করার ব্যাপারেও নিরুৎসাহিত করে।
কর্ম ও কারণের মূলনীতি:
এই মূলনীতির বিবৃতি হচ্ছে প্রতি ঘটনার পিছনে একটি কারণ রয়েছে। এই মূলনীতির দুটি অনুসিদ্ধান্ত রয়েছে:
১। পরিণতিবাদের মূলনীতি: যেকোন ঘটনারই ফলাফল আছে; কারণ ছাড়া কোন ফলাফল নেই এবং কারণ ছাড়া ফলাফল হতেই পারে না।
২। প্রকৃতির অভিন্নতার মূলনীতি: অনুরূপ ঘটনার অনুরূপ ফলাফল বিদ্যমান।
আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত এযাবৎকালে যত বিজ্ঞানী আছেন তাদের অনেকের দীর্ঘদিনের ধারণা হচ্ছে “বস্তুগত দুনিয়া কিছু নির্দিষ্ট আইন-কানুন দ্বারা পরিচালিত হয়”। কর্ম ও কারণের মূলনীতি হচ্ছে এমন এক স্বীকার্য যা প্রাকৃতিক শক্তির ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত যেকোন সূত্রকে অর্থবহ করে তোলে।
কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় এই নীতির উল্লেখ রয়েছে। বিভিন্ন আয়াতে এই বিশ্বজগতে আল্লাহর অপরিবর্তনীয় আইনসমূহের কথা বলা হয়েছে:
فَهَلْ یَنْظُرُوْنَ اِلَّا سُنَّتَ الْاَوَّلِیْنَۚ فَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّتِ اللّٰهِ تَبْدِیْلًا ﳛ وَ لَنْ تَجِدَ لِسُنَّتِ اللّٰهِ تَحْوِیْلًا
এখন তারা কি পূর্বের জাতিদের সাথে আল্লাহ যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তাদের সাথে অনুরূপ পদ্ধতিরই অপেক্ষা করছে? যদি একথাই হয়ে থাকে তাহলে তুমি আল্লাহর পদ্ধতিতে কখনো কোন পরিবর্তন পাবে না এবং কখনো আল্লাহর বিধানকে তার নির্ধারিত পথ থেকে হটে যেতেও তুমি দেখবে না। (৩৫:৪৩)
فِطْرَتَ اللّٰهِ الَّتِیْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَیْهَاؕ لَا تَبْدِیْلَ لِخَلْقِ اللّٰهِؕ
আল্লাহ মানুষকে যে প্রকৃতির ওপর সৃষ্টি করেছেন তার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও। (৩০:৩০)
এমন অনেক আয়াত আছে যেখানে কিছু ঘটনার জন্য ব্যবহৃত নির্দিষ্ট কিছু কর্মকৌশল ব্যক্ত করা হয়েছে:
وَ لَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ مِنْ سُلٰلَةٍ مِّنْ طِیْنٍۚ
আমি মানুষকে তৈরী করেছি মাটির উপাদান থেকে। (২৩:১২)
وَّ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخْرَ جَ بِهٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزْقًا لَّكُمْۚ
তিনিই ওপর থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে সব রকমের ফসলাদি উৎপন্ন করে তোমাদের আহার যুগিয়েছেন। (২:২২)
কুরআনের কিছু আয়াত আছে এমন যেগুলো কিছু ঘটনাকে অন্যকিছু ঘটনার মধ্যবর্তী ধাপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে:
وَّ اَرْسَلَ عَلَیْهِمْ طَیْرًا اَبَابِیْلَۙ تَرْمِیْهِمْ بِحِجَارَةٍ مِّنْ سِجِّیْلٍ
আর তাদের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি পাঠান,যারা তাদের ওপর নিক্ষেপ করছিল পোড়া মাটির পাথর। (১০৫: ৩-৪)
قَاتِلُوْهُمْ یُعَذِّبْهُمُ اللّٰهُ بِاَیْدِیْكُمْ
তাদের সাথে লড়াই করো, আল্লাহ তোমাদের হাতে তাদের শাস্তি দেবেন। (৯:১৪)
অন্যদিকে কুরআনের কিছু আয়াত আছে যেখানে বলা হচ্ছে আল্লাহই দুনিয়ার সৃষ্টিকারী এবং এর পরিচালকও তিনিই:
قُلِ اللّٰهُ خَالِقُ كُلِّ شَیْءٍ
বলো, প্রত্যেকটি জিনিসের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ। (১৩:১৬)।
اَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَ الْاَمْرُؕ-
জেনে রাখো, সৃষ্টি তারই এবং নির্দেশও তাঁরই। (৭:৫৪)
এই দুই প্রকারের আয়াতকে সামনে রাখলে যে কেউ শেষ পর্যন্ত এটাই অনুভব করবে যে , সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছার অধীন তবে এগুলো বিশেষ মাধ্যমে সংগঠিত হয়। উল্লেখিত আয়াতগুলো একথারই স্বীকৃতি দেয়:
وَ الْبَلَدُ الطَّیِّبُ یَخْرُ جُ نَبَاتُهٗ بِاِذْنِ رَبِّهٖۚ-وَ الَّذِیْ خَبُثَ لَا یَخْرُ جُ اِلَّا نَكِدًاؕ
উৎকৃষ্ট ভুমি নিজের রবের নির্দেশে প্রচুর ফসল উৎপন্ন করে এবং নিকৃষ্ট ভুমি থেকে নিকৃষ্ট ধরনের ফসল ছাড়া আর কিছুই ফলে না। (৭:৫৮)
এই আয়াত যেদিকে নির্দেশ করে তা হচ্ছে, গাছের বৃদ্ধির জন্য জমিনের উর্বরতা জরুরি যদিও আল্লাহর ইচ্ছাও জরুরি। যাই হোক আল্লাহ চাইলে যেকোন গাছ যেকোন ভূমিতে জন্মাতে পারে।
কিছু বিখ্যাত আশয়ারী মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদ (যেমন ইমাম গাজালী এবং ইমাম রাজী) বস্তুগত দুনিয়ার ক্ষেত্রে পরিণতিবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন । এক্ষেত্রে তাদের মতামত হচ্ছে, প্রাকৃতিক ঘটনা উপলব্ধিতে শারীরিক উপায়গুলির কোন ভূমিকা নেই। যেকোন ঘটনা ঘটে আল্লাহর ইচ্ছায়। বস্তুত এটা আল্লাহর সুন্নাত যে, তিনি আমরা যেটাকে কারণ বলি তা সৃষ্টি করার পর আমরা যেটাকে ফলাফল বলি তা সৃষ্টি করেন, এদের মাঝে এমন কোন সম্পর্ক নেই যা কর্মকে কারণের অনুগামী হতে বাধ্য করে। যদি আল্লাহ না চাইতেন তাহলে এই তথাকথিত “কর্ম” তথাকথিত “কারণের” অনুগামী হতো না। (৪)
যেকারণে এসকল ধর্মতত্ত্ববিদেরা পরিণতিবাদকে অস্বীকার করেছেন তা হচ্ছে কর্মের জন্য কারণ প্রয়োজনীয় এই ধারণা আল্লাহর অসীম ক্ষমতাকে অস্বীকার করে এবং এখানে মিরাকলের কোন জায়গা থাকে না। যাই হোক এই উপসংহারে আসা সঠিক নয়। কেননা আমরা যেটাকে কারণ বলি তা আসলে প্রকৃত কারণ নয় বরং তা একটি মধ্যবর্তী কিংবা ধরে নেওয়া কারণ। মধ্যস্থতাকারী জিনিগুলোর ভূমিকা হল সমস্ত কিছু তৈরির জন্য ভিত্তি প্রস্তুত করা কিন্তু তিনি নির্দিষ্ট মধ্যবর্তী এবং তৈরির কারণ সৃষ্টি করেছেন যদিও এগুলো সবই আল্লাহ নিজেই সৃষ্টি করেছেন। এই মধ্যবর্তী বিষয়বস্তুর উপস্থিতির কারণ স্রষ্টা কে তা নিয়ে মতভেদ ঘটানো নয় বরং এটি আল্লাহকে চেনার ক্ষেত্রে বান্দাদের ভাব উচ্ছাসে ভিন্নতা আনয়নের সাথে সম্পর্কিত। (৭)
পদার্থবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম তত্ত্বের আগমনের এবং হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি প্রদর্শনের পর এই নীতির কিছু প্রতিষ্ঠাতা পরিণতিবাদ এবং এটমিক জগতে প্রকৃতির অভিন্নতা মতবাদকে অস্বীকার করেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে মাইক্রো ফিজিক্সের একটা পরিসংখ্যানমূলক অবস্থা আছে যা অঙ্কিত হয়েছে অসংখ্য একই রকমের পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে এবং একক ঘটনাগুলোকে ব্যতিক্রম হিসেবে ধরার মধ্য দিয়ে।
আইনস্টাইন ও প্ল্যাংকের মত ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ পদার্থবিজ্ঞানী এই নতুন তত্ত্ব ও এর প্রচলিত ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছেন। এই অবস্থা এখনো বিদ্যমান যদিও সময়ের ব্যবধানে বিরোধীদের সংখ্যাও বেড়েছে।
সম্ভবনার সূত্র মহাবিশ্বকে পরিচালনা করছে এইটা আইনস্টাইন, প্ল্যাক এবং আরো প্রমুখ বিজ্ঞানীরা মেনে নিতে পারেননি। তাদের মতে প্রকৃতিতে ঘটমান ঘটনাসমূহ চূড়ান্ত ভাবে পরম সূত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে হবে এবং আপাতত পরিসংখ্যানমূলক আচরণের ক্ষেত্রে পরিণামবাদী ভিত্তিস্থাপন করা প্রয়োজন। যে কেউ সম্ভাবনার সূত্র ব্যবহার করেন মূলত কোন ঘটনার পিছনের কারণ সুনির্দিষ্টভাবে না জানা থাকা কারণে অথবা বড় বড় সংখ্যার ঝামেলা এড়াতে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে আইনস্টাইন নিন্মোক্ত মন্তব্য করেন :
আমি বাধ্যগতভাবে স্বীকার করি যে, আমি এই ব্যাখ্যায় শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী গুরুত্ব যোগ করেছি। আমি এখনো বাস্তবতার মডেলের সম্ভাবনায় বিশ্বাস করি এবং এটা এমন এক তত্ত্ব যা কেবল ঘটনার সম্ভাবনা প্রকাশ করে না বরং বিষয়গুলি যা তাই প্রকাশ করে । (৮)
১৯২৬ সালে ম্যাক্স বর্নকে পাঠানো তার চিঠিতে আইনস্টাইন লিখেন:
কোয়ান্টাম মেকানিক্স চিত্তাকর্ষক বটে। কিন্তু আমার ভিতরের মন বলছে এটা আসলে সত্যিকারের কিছু নয়। এই থিওরি অনেক কিছুই বলে কিন্তু সত্যিকারার্থে আমাদেরকে সেই গোপন রহ্যসের নিকট নিয়ে যায় না। আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি ইশ্বর জুয়া খেলছেন না। (৯)
কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিগত কিছু বছর যাবৎ আমরা লক্ষ্য করছি কিছু মুসলিম স্কলার আশয়ারীদের ফেলে আসা থিওরি গ্রহণ করছেন এবং এর স্বপক্ষে কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে দাঁড় করাচ্ছেন। আমরা এই ধরণের দৃষ্টিভিঙ্গিকে প্রত্যাখান করছি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে:
ক. আমরা যদি কর্ম ও কারণ সম্পর্কিত মূলনীতির গুরুত্বকে এটমিক ও সাব-এটমিক পর্যায়ে অস্বীকার করি তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় আমরা সমগ্র দুনিয়ার সাথে এই মূলনীতির যে সম্পর্ক তাই মুছে ফেললাম। কেননা কর্ম ও কারণ একই সাথে দুনিয়ার অনেক কিছুর সাথে সম্পৃক্ত।
খ. কর্ম ও কারণের মূলনীতি কি সত্য থেকে অসত্য হওয়া প্রয়োজন, আর যদি তাই হয় তাহলে তাহলে পূর্বানুমান এবং উপসংহারের মাঝে কোন সম্পর্ক থাকবে না। কারণ পূর্বানুমানগুলোই একটা উপসংহার বের করে আনে। কর্ম ও কারণের মূলনীতি ব্যাতিরেকে কোন আর্গুমেন্টেরই উপসংহারে পৌঁছানো সম্ভব নয় এবং কেউই যেকোন প্রকারের পূর্বানুমান ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে উপসংহারে পৌঁছাতে পারবে না। আর যদি তাই হয় তাহলে কোন কিছু প্রমাণ করা আর না করার মাঝে কোন পার্থক্য থাকবে না।
এই কারণে যারা কর্ম ও কারণের এই মূলনীতিকে অস্বীকার করছেন তারাও পরোক্ষভাবে এই মূলনীতিই ব্যবহার করছেন । কেননা তারা যদি এটা বিশ্বাস না করতেন যে তাদের আর্গুমেন্টের ফলে আমাদের বিশ্বাস পরিবর্তিত হয়ে যাবে তাহলে তারা কখনোই আমাদের সাথে যুক্তি তর্কে লিপ্ত হতেন না। (১০)
গ. যেমনটা শহীদ অধ্যাপক মর্তুজা মোতাহিরি (১১) এবং শহীদ আয়াতুল্লাহ সাদরি (১২) বলেছেন, এটমিক পর্যায়ে গণনা করার অসম্ভবতার কারণ আমাদের পরিণতিবাদের অভাব নয় বরং এটমিক ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণকারী পরিণতিবাদী জ্ঞানের অভাব এবং এটাও হতে পারে আমাদের অসম্পূর্ণ ব্যবহারিক এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানের ফলে কিংবা গণনার উপর পর্যবেক্ষকের কি প্রভাব পড়ে তা সঠিকভাবে পরিমাপ করতে না পারার ফলে।
যেকোন ক্ষেত্রে প্রত্যেককে এই ব্যাপারে সচেতন হতে হবে যে এটমিক পর্যায়ে পরিণতিবাদের আবিষ্কার করতে না পারা আমাদের ব্যর্থতা এবং এর মাধ্যমে যেন এটা না বুঝি যে এটমিক পর্যায়ে কর্ম ও কারণের প্রয়োজনীয় সম্পর্ক নেই। এটমিক জগত সম্পর্কে আমরা সবকিছু জেনে ফেলেছি এমনটা দাবি করার কোন অধিকার আমাদের নেই।
১৯৭৯ সালে ডিরেক যা লিখেছিলেন তা উদ্ধৃতি করার এটাই যথাযথ জায়গা:
এই মুহুর্তে এটা পরিষ্কার যে বর্তমান কোয়ান্টাম মেকানিক্স এখনো তার চূড়ান্ত পর্যায়ে আসীন হয়নি । সামনের দিকে আরো কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন বোরের কক্ষপথ ক্রমেই পরিবর্তিত হতে হতে চূড়ান্ত পর্যায়ে আজকের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের রূপ লাভ করেছে। কিছুদিন পর হয়ত একটা নতুন আপেক্ষিক কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আবিষ্কার হবে যেখানে আজকের এই সকল অসম্পূর্ণতা থাকবে না। যতটুকু বোঝা যায় নতুন কোয়ান্টাম মেকানিক্সে পরিণতিবাদ থাকতে পারে যেমনটা আইনস্টাইন চেয়েছিলেন। এই পরিণতিবাদের সাথে পরিচিত হওয়া সম্ভব শুধুমাত্র আজকের পদার্থবিজ্ঞানদের কিছু প্রাক-ধারণা বর্জন করার মধ্য দিয়ে এবং এটি এখনই পাওয়া চেষ্টা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
সুতরাং এই শর্তে আমার মতে এটা খুব স্বাভাবিক অথবা যে কারোই হোক নিশ্চিতরূপে শেষ পর্যন্ত আইনস্টাইনই সঠিক বলে প্রমাণিত হবেন, যদিও আপাতত পদার্থবিদেরকে বোরের সম্ভাবনার তত্ত্বকেই মেনে নিতে হবে বিশেষ করে এই মুহূর্তে যদি তাদের সামনে পরীক্ষা থাকে। (১৩)
সংক্ষেপে বললে কর্ম ও কারণের মূলনীতিকে অস্বীকারের মাধ্যমে একটা বিষয় অন্য বিষয়ের জন্য আর প্রয়োজনীয় হবে না এবং যেকোন কিছু থেকেই যেকোন কিছুর ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে। ফলে এখানে বিজ্ঞানের কোন উপস্থিতিই থাকবে না। সুতরাং বিজ্ঞান কর্ম ও কারণের মূলনীতিকে অনুসিদ্ধান্তসহ গ্রহণ করতে বাধ্য যাতে তার অর্থবহ অস্তিত্ব বজায় থাকে।
অনুবাদক : সায়েম মুহাইমিন
১/ Max Planck,The New Science, Greenwich edition(1959);p.51
২/ Einstein,A Centenary Volume, A.P. French ed.,Heinemann(1979). p.312
৩/ Albert Einstein, Idea and Opinions, trans Bergman. New York, Crown Publishers (1954), pp 322-323
৪/ Max Planck, The New Science (1959), p. 250
৭/Sadar al-Din Shirazi, Asfar, vol.6 p.371
৮/Ideas and Opinion by Albert Einstein, p.276
৯/ Enstine, A Centenary Volume, p. 310
১০/ Averroes, Tahafut al Tahafut(The in coherence of the Incoherence) trans.S.Van den Bergh, London & Co., 1954, pp.316-319.
১১/ M.H Tabtabai, Usul Falsafah. vol. 3,p.217(Mutahharis footnote)
১২/M.B Sadr, Falsafatuna, Dar al Taaruf. Beirut, 1980, pp 305-309
১৩/ Some Strangers in the proportion, Woolf ed, Addison-Wesley, p.65.


