বস্তুবাদী জীবনধারা বর্তমানে, চরম পর্যায়ের বেকারত্ব, শিক্ষার্থীদের হতাশা, এমনকি জাপানের মতো উচ্চহারের শিক্ষিত দেশেও আত্নহত্যার ভয়ানক হারে বৃদ্ধি, মাদকাসক্ত যুবকশ্রেণী, পারিবারিক বিশৃঙ্খলাসহ অসংখ্য অধঃপতনে জর্জরিত এই বিশ্ব আজ এক ভয়াবহ ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে ! ফলে ক্ষুধা দারিদ্র্য আর মানসিক অশান্তির এক সমাজ কাঠামো গড়ে উঠছে চতুর্দিকে!
এর জন্য অন্যতম দায়ী কে?
কেন শিক্ষিত হয়েও বেকারত্ব, কিংবা জাপানের মত উচ্চশিক্ষিতদের দেশেও আত্নহত্যার হার বেশী?
কেন আমাদের জাতির বিবেকখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হতাশা, বিশৃঙ্খলার কারখানায় পরিণত হল?
মূলত এগুলো ব্যবস্থাগত সংকটের ফলাফল। যার অন্যতম কেন্দ্রস্থল বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা। যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চাইলেই বা শিক্ষকরা চাইলেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। কারণ, চিন্তাশীল কোনো শিক্ষক বা চিন্তা উদ্ভাবনকারী কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বারা বর্তমান এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং এই সেক্টরটা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে রাজনীতি দ্বারা! আর রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কতিপয় পুঁজিবাদী কোম্পানি বা লবির লাভক্ষতির উপর নির্ভর করে! ফলে শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে ওই সকল কোম্পানি বা লবির কর্মচারী তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ ইউরোপ থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল প্রান্তের শিক্ষাব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর হাতে আবদ্ধ! এখন তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, পৃথিবীর ইতিহাসে সবসময়ই কি শিক্ষা ব্যবস্থা তথা পুঁজিবাদী কোম্পানির লাভ-লোকসানের রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলো? ইতিহাসের নজির আমাদেরকে এ ব্যাপারে কী বলে?
জ্ঞান ও শিক্ষাব্যবস্থার ধারণাকে আমরা যদি ১২০০ বছর পৃথিবীকে পরিচালনাকারী বিশ্বব্যবস্থা তথা ইসলামী সভ্যতার আলোকে পর্যালোচনা করি, তাহলে যে বিষয়টি প্রথমেই আমাদের সামনে উঠে আসে, তা হলো, ইসলামী সভ্যতায় জ্ঞানের ধারণা ও শিক্ষাব্যবস্থার অনন্য কাঠামো। ইসলামী সভ্যতায় জ্ঞান বরাবরই একটি স্বাধীন বিষয় ছিলো। আমাদের দেখতে পাই এই শিক্ষা ব্যবস্থা অর্থনৈতিক লাভ-লসের সমীকরণ দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি কাঠামো, যেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সু্যোগ খুব কমই ছিলো। তবে, রাষ্ট্র সেখানে অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা করতো, সামাজিক নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতো। কিন্তু, ক্ষমতার সূত্রে রাষ্ট্রের তেমন একটা হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিলো না। এই হস্তক্ষেপহীন থাকার মূল কারণ ছিল ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি পুঁজিবাদের ন্যায় বস্তুগত উন্নতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং এখানে রাষ্ট্র ব্যক্তির বিকাশে অভিভাবকের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছিল। ইসলামী সভ্যতার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় লেখা থাকতো – “এখানে কোনো মাছকে উড়তে বাধ্য করা হয় না, কোনো পাখিকে সাঁতরাতে বাধ্য করা হয় না ”
কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমান সময়ে সন্তানদেরকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তৈরির হিড়িক ঘরে ঘরে দেখতে পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবজেক্ট চয়েজ হোক কিংবা নবম দশম শ্রেণীর বিভাগ নির্বাচন সকল ক্ষেত্রেই ভালো একটি চাকরি, ভালো বেতনকেই সর্বাগ্রে স্থান পায়। আর এই বিষয়গুলো নির্ধারণ হয় বৈশ্বিক অর্থনীতির চাহিদার উপর ভিত্তি করে। যখন যে বিষয়ের চাহিদা বাড়ে রাষ্ট্রও সেদিকে গুরুত্ব দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থাকে সেই আলোকে সাজিয়ে তোলে। অর্থনীতির কাছে শিক্ষাব্যবস্থার বন্দী-দশার সাধারণ চিত্র আমাদের সকলেরই কমবেশি জানা। শিক্ষাব্যবস্থা কেবল এখানেই বন্দী বললে ভুল হবে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিও তার প্রয়োজনানুসারে শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবহারের ধারাও বর্তমান বণিক সভ্যতায় বেশ জনপ্রিয়তা। প্রায়ই দেখা যায় জাতীয় রাজনীতির পরিবর্তনের সাথে সাথে পাঠ্যপুস্তকে বিরাট পরিবর্তন আসে। আবার বৈশ্বিক রেজিম পরিবর্তনের সাথে সাথেও পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তনের ধারাও সমানতালে চলছে। যেমন বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকার কেন্দ্রে অবস্থানের কারণে আমরা যখন ইকোনমিকস, ফিন্যান্স নিয়ে পড়তে যাই তখন বাংলাদেশ ভারত কিংবা জাপানের একজন ছাত্র থেকে অধ্যাপক সকলকেই আমেরিকার ম্যাক্রইকোনমিকস পড়তে বাধ্য অথচ আমেরিকার অর্থনীতি আর অন্যদের অর্থনীতিতে পার্থক্য রাত এবং দিনের মতো পরিষ্কার। অনুরূপভাবে সারা পৃথিবী ইউরোপের সোশিওলজি পড়তে বাধ্য।
এখন এই পর্যায়ে একটি প্রশ্ন জাগে, পৃথিবীর জ্ঞানের ইতিহাস কি সবসময়ই রাজনীতি অর্থনীতি দ্বারা পরিচালিত ছিল?
সমগ্র পৃথিবীকে ১২০০ বছর পরিচালানাকারী ইসলামী সভ্যতার রাজনৈতিক ইতিহাসকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামী সভ্যতার বিভিন্ন আমলের সুলতান-খলিফা-শাসকগণ বিভিন্ন মতাদর্শের ছিলেন। যেমন ফাতিমিরা শিয়া, কিংবা উসমানীরা হানাফী। কিন্তু, শুধুমাত্র জ্ঞানতাত্ত্বিক ও চিন্তাগত পার্থক্যের দরুণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে শিক্ষাব্যবস্থায় সে চিন্তাকে প্যাট্রোনাইজ করা হয়েছে, এধরণের ইতিহাস থাকলেও তা ইসলামী সভ্যতায় খুব কম ঘটেছে। আর ইসলামের মাজহাব সমূহের মাঝে কিছুক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলেও, সবাই আখলাক ও আদালতকে কেন্দ্রে স্থাপন করতো। ফলশ্রুতিতে, মানবতা ক্ষতিগ্রস্থ হতো না। বরং যে মাজহাবই ক্ষমতায় থাকুক বা যে শিক্ষাব্যবস্থাই প্রভাবশালী থাকুক না কেন, মানবসম্প্রদায় সেটা থেকেই আদিল সমাজ ও ইরফানী সংস্কৃতি উপহার পেতো। ব্যক্তি স্বার্থে কিংবা জাতীয়ভাবে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অথবা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মিথ্যা স্বপ্ন ও বস্তুবাদী আগ্রাসনের স্বীকার হয়েছে, ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া বিরল।
একইভাবে আমরা যদি দেখি, ইসলামী সভ্যতার বিভিন্ন সময়কালে বিভিন্ন শাসকগণ ভিন্ন ভিন্ন ধারার চিন্তা লালন করতেন। যেমন, রাষ্ট্রীয় মাযহাব হানাফী হলেও সুলতান ব্যক্তিগতভাবে শাফেয়ী মাযহাব অনুসরণ করছেন, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় কোনোভাবেই এর প্রভাব বিদ্যমান ছিলো না। আবার, সেলজুকীরা হানাফী হওয়া সত্ত্বেও নিযামিয়া মাদ্রাসার প্রধান ছিলেন ইমাম গাজ্জালী। মাযহাব হিসেবে ইমাম গাজ্জালী হানাফী মাযহাব অনুসরণ করতেন না। তবুও, তৎকালীন সবচেয়ে বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ছিলেন তিনি। এসবক্ষেত্রে সবাই স্বাধীন ছিলো। যেমন, ইসলামী সভ্যতার শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপারে বলা হয়। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইসলামী সভ্যতার অসাধারণ উদারতা ও বহুত্ববাদী মনোভাব থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আখলাকপূর্ণ অবস্থান বিদ্যমান ছিলো।
আবার বিভিন্ন যুগে ইসলামী সভ্যতার মহান আলেমগণ জ্ঞানকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে দূরে রাখতে রাজনৈতিক শক্তির সামনে বুক পেতে দিয়েছেন, তবুও তাঁরা মাথা নত করেননি। যাতে করে, একটি নির্দিষ্ট ক্ষমতাবলয়ের (regime) উৎপাদন হিসেবে ইসলামী সভ্যতার জ্ঞানকে আখ্যায়িত করা না যায়। ইমাম আবু হানিফার রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণ না করার কারণও ছিলো এটাই। একইভাবে, মালেকী মাযহাবকে রাষ্ট্রীয় মাযহাব করার সিদ্ধান্তকে স্বয়ং ইমাম মালেক কর্তৃক প্রত্যাখ্যান করা, বিভিন্ন সময়ের বড় বড় মুজতাহিদ আলেমগণের রাষ্ট্রীয় পরিষদে অংশ না নেয়ার কারণও ছিলো এটাই। কারণ, জ্ঞান ও মূলনীতিকে যেনো স্বাধীন রাখা যায়। পাশাপাশি, শিক্ষাব্যবস্থা ও জ্ঞানপদ্ধতি যেনো কোনো একটা নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণকাঠামো থেকে মুক্ত থাকে।
০২. জ্ঞানের স্বাধীনতা ও পরাধীনতাঃ
এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসে। তা হচ্ছে, “ইসলামী সভ্যতায় জ্ঞান কেন স্বাধীন আর পাশ্চাত্যের বণিক সভ্যতায় জ্ঞান কেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ?”
এর জবাবে বলা যায়, পাশ্চাত্য এবং অন্য যেকোনো সভ্যতা মূলত শক্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে, ইসলামী সভ্যতা হাকীকতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। পাশ্চাত্য বা শক্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা কোনো সভ্যতা জ্ঞানকে যেখানে শক্তি অর্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখে, অন্যদিকে ইসলামী সভ্যতা সেখানে জ্ঞানকে হাকীকতে উপনীত হওয়ার একটা মাধ্যম হিসেবে দেখে থাকে।
অর্থ্যাৎ, মূলত এই দুই ধরনের সভ্যতায় জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্যগত পার্থক্যই জ্ঞানের স্বাধীনতা ও পরাধীনতার মূল কারণ।
কেননা, আমরা দেখতে পাই, জ্ঞান যখন হাকীকতে উপনীত হওয়ার পন্থা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, জ্ঞান তখন কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা প্রতিষ্ঠানের লাভ-ক্ষতি কিংবা স্বার্থের বিবেচনা করে না। সে কেবল যা সত্য, তাই তুলে ধরে। অন্যদিকে, শক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত জ্ঞান কেবলই কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধারে নিমজ্জিত থাকে। ফ্রান্সিস বেকনের Knowledge is power; বিখ্যাত এই উক্তি মূলত এই আলোচনাকেই স্বীকৃতি দেয়।
ইসলামী সভ্যতার শিক্ষাব্যবস্থা মূলত মানুষকে বিকশিত করতে চায়। ইসলামের মূল দৃষ্টিভঙ্গি হলো, মানুষ স্রষ্টার প্রতিনিধি, তাই সে দুনিয়াকে বিনির্মাণ করবে। এজন্য তার সৃজনশীল হতে হবে। আল্লাহ এজন্যই চান, মানুষ যেনো তাঁর রঙ্গে রঙিন হয়। কুরআন এ-কারণেই মানুষকে দ্বীনের শিক্ষা দেয়, আইন ধরিয়ে দেয় না। কারণ, এরপর ব্যক্তি নিজেই দ্বীন অনুযায়ীই আইন তৈরি করতে পারবে।
ইসলামী সভ্যতা তাঁর কার্যক্রমের মূলকেন্দ্রে আখলাককে স্থাপন করে। ফলশ্রুতিতে, এ’ধরণের জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া কিংবা নিয়ন্ত্রণ তৈরি করা; মানুষ পরিচালনা করার জন্য এমন পদ্ধতিকে ইসলাম কখনও গ্রহণ করেনি।
অন্যদিকে, ইসলামী সভ্যতা ব্যতীত আর সবকালেই জ্ঞান ছিলো শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর শক্তি’র চাওয়া-পাওয়া হলো, জ্ঞান যেনো কেবল তার কামনা বাসনাকেই পূরণ করে। ফলে এই জ্ঞান মানুষের বিকাশ তো করেই না, বরং মানুষকে গোলামে পরিণত করে। উদাহারস্বরূপ, হাল আমলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাত্রই হলো কোম্পানির চাকর তৈরির একেকটা কারখানা।
০৩. শিক্ষাক্ষত্রে ইসলামী সভ্যতার দর্শনঃ
এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, জ্ঞানকে ইসলাম কীভাবে দেখা হয়েছে?
দ্বীনে মুবিন ইসলাম যে বিষয়টির প্রতি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ত্ব দিয়েছে, তা হল ‘ইলম’ তথা জ্ঞান। ইসলামে জ্ঞান অর্জনকে ফরজ করা হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কোরআন ও হাদিসে ইলমের গুরুত্ত্ব ও জ্ঞানবানদের মর্যাদা সম্পর্কিত অনেক আয়াত এবং হাদিস আমরা দেখতে পাই।
মহাগ্রন্থ আল কোরআন ও হাদিসের এই মনোভাব মুসলমানদের মনে জ্ঞানের প্রতি গভীর এক শ্রদ্ধাবোধের সৃষ্টি করেছিলো। যার ফলে, জ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখাকে তারা কোরআনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের আলোকে ঢেলে সাজিয়েছিলো। এবং বিজ্ঞানকে এনে দিয়েছিলো এক নতুন মাত্রা। যে যুগে মহান আল্লাহর অনুসন্ধান করতে গিয়ে মানুষ সৃষ্টিকে মূল্যহীন মনে করে বর্জন করেছিলো, মুসলমানগণ সে যুগে প্রকৃতি এবং ইসলামের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলো বিশেষ এক সম্পর্ক।
আল্লাহ এবং বিশ্বের সাথে মানুষের বহুবিদ সম্পর্ক বিরাজমান। এই সম্পর্কের মাধ্যমে মানুষের মনে গভীর চেতনার উন্মেষ করাই হচ্ছে কোরআনের প্রধান উদ্দেশ্য। ইসলামে মানুষ এবং প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক হলো, কৃষির সাথে প্রকৃতির এবং মাটির সাথে কৃষকের সম্পর্কের মতো, ব্যবসায়ী এবং বাজারের মধ্যকার সম্পর্কের মতো। কিন্তু এই সম্পর্ককে ইসলাম চিরস্থায়ী বলে গণ্য করেনি। ইসলাম বলে যে, তুমি সর্বদায় যদি তোমার মায়ের কোলে বসে থাকো, তাহলে তুমি যেমন পরিপূর্ণ একজন মানুষ হতে পারবে না, তেমনিভাবে তুমি যদি সর্বদায় মাটিকে তথা পৃথিবীকে আকড়ে ধরে বসে থাকো, তাহলে তুমি মাটিতে উৎপাদিত অন্যান্য সৃষ্ট বস্তুর মতোই হয়ে থাকবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শ এবং বাস্তব, এই দুটি বিরোধী শক্তি নয় যে, তাদের মিলন অসম্ভব। আদর্শকে বেঁচে থাকতে হলে বাস্তবের সঙ্গে তার পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটানোর কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, বাস্তবকে উপেক্ষা করলে জীবনের সামগ্রিক রূপই বিনষ্ট হয়ে যায়, জীবনের সামনে দেখা দেয় তখন নানাবিধ বেদনাময় বাঁধা-বিরোধ।
মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক সত্ত্বার প্রতিষ্ঠা সকল ধর্মেরই কাম্য। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে পার্থক্য হলো, বাস্তব (পৃথিবী) এবং আদর্শের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এক সামঞ্জস্য তৈরি করে ইসলাম। আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের সংযোগকে স্বীকার করে ইসলাম বস্তুজগতকে স্বাগত জানায়। আর বাস্তবসম্মত উপায়ে জীবন পরিচালনার জন্য একটি পন্থাকে অবলম্বন করে বস্তু-জগতকে আয়ত্ত্ব করার নির্দেশ দেয়।
০৪. ইসলামে ইলমের লক্ষ্যঃ
১। আল্লাহকে চেনা এবং তার প্রতি ঈমান আনা।
ইসলাম ইলমের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কিছুর প্রতি অন্ধভাবে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়নি ইসলামে।
فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مُتَقَلَّبَكُمْ وَمَثْوَاكُمْ
সূরা মুহাম্মাদ- ১৯
এজন্য মুসলিম মনীষীগণ জ্ঞানের একটি আলাদা শাখার উদ্ভাবন করেছেন। আর তা হচ্ছে ‘ইলমুত তাওহীদ’। আল্লাহর পরম একত্বের স্বীকৃতি হিসেবে তাওহীদ হচ্ছে সত্যের উৎস-সমূহের একত্বের স্বীকৃতি। আল্লাহ হচ্ছেন প্রকৃতির স্রষ্টা, যেখান থেকে মানুষ তার জ্ঞান অর্জন করে নেবে। জ্ঞানের বিষয় হচ্ছে, মহান রবের সৃষ্ট এই প্রকৃতির ডিজাইন বা নকশাসমূহ। নিশ্চয় আল্লাহ এগুলোকে জানেন। কারণ তিনিই হচ্ছেন এসবের রচয়িতা। এবং একইরূপে নিশ্চিতভাবে তিনিই হচ্ছেন প্রত্যাদেশের উৎস। তিনি মানুষকে তাঁর জ্ঞান থেকে জ্ঞান দান করেন। তাঁর জ্ঞান হচ্ছে পরম এবং বিশ্বজনীন।
২। তারবিয়া ও তাযকিয়া:
মানুষকে তার নফসের বাসনা এবং শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্ত রাখার জন্য ইসলাম তাযকিয়া ও তারবিয়ার প্রতি অনেক গুরুত্বারোপ করেছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীণ তার নবীগণকেও পাঠিয়েছেন এই লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। মহান আল্লাহ বলেন,
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ (সূরা জুমুয়া-২)
৩। জীবিকা নির্বাহের পন্থা শিক্ষা দেওয়া:
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই পৃথিবীকে মানুষের অধীন করে বানিয়েছেন। জলে-স্থলে যা কিছু আছে, সকলকিছুকে তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তবে, ইসলাম এক্ষেত্রে একটি মূলনীতি পেশ করেছে। তা হলো, এই পৃথিবীটা মানুষের কাছে একটা আমানত এবং এটাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে যাবে না। পরবর্তী বংশধররা যেনো আরও সুন্দর ও বসবাস যোগ্য একটি পৃথিবী পায়, এ’বিষয়ের প্রতি ইসলাম বিশেষ দৃষ্টি আরোপ করেছে। এই পৃথিবীর গোপন রহস্য এবং সৃষ্ট বস্তু নিয়েও ইসলামে গবেষণা করতে বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُنِيرٍ (সূরা লোকমান-২০)
৪। আদালত প্রতিষ্ঠা:
ইসলাম আদালতের প্রতি ব্যাপকভাবে জোর দিয়েছে। ইসলামে তার অনুসারীদেরকে শত্রুর সাথে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রেও ‘আদালত’কে মূলভিত্তি হিসেবে প্রতিস্থাপন করে নিতে বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ৩০ টিরও বেশী স্থানে ‘আদালত’ বা ‘আদল’ এর কথা বলা হয়েছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَىٰ أَنفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ ۚ إِن يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَىٰ بِهِمَا ۖ فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَىٰ أَن تَعْدِلُوا ۚ وَإِن تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
(সূরা নিসা-১৩৫)
৫। আখেরাতের চিন্তা:
ইসলাম সর্বদায় আখেরাতকে দুনিয়ার উপর প্রাধান্য দিয়েছে। মহান আল্লাহর দরবারে কোনো মানুষের সমস্ত প্রচেষ্টা ও কর্ম সফল হওয়া নির্ভর করে দুটি বিষয়ের উপর,
ক. সে প্রচেষ্টা হবে শরিয়তের আওতাধীন।
খ. ইহজাগতিক কর্ম ও প্রচেষ্টার একমাত্র লক্ষ্য হবে আখেরাতের চূড়ান্ত সফলতা।
সমগ্র কোরআনের প্রায় ১০ পারা জুড়ে রয়েছে আখেরাতের আলোচনা।
৬। উপকারী এবং অপকারী জ্ঞান:
জ্ঞানকে দ্বীনী কিংবা দুনিয়াবী বলে বিভাজিত করেনি ইসলাম। জ্ঞানকে মূলত দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। তা হলো, উপকারী জ্ঞান এবং অপকারী জ্ঞান। যে সকল জ্ঞান উপকারী সেই ধরণের সকল জ্ঞানই হল ইসলামী জ্ঞান।
ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, মুসলিম উলামাগণ যত গ্রন্থই রচনা করেছেন, এই বিষয়-সমূহকে সামনে রেখেই গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘ইলম-হিকমত-মা’রেফাত’ এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ে মানুষকে তৈরি করার জন্য পুস্তক রচনা করেছেন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-সমূহকেও গড়ে তুলেছেন সে অনুযায়ী।
এই লক্ষ্যে তিনটি বিষয়কে তারা একত্রিত করে পাঠ করেছেন। বিষয় তিনটি হলো,
১। ইনসান
২। মহাবিশ্ব
৩। কুরআন
ইসলামী সভ্যতার প্রানকেন্দ্র বাগদাদ, কায়রো, ইস্তাম্বুল এবং আন্দালুসিয়ার শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর দিকে তাকালেও আমরা উপরিউক্ত বিষয়-সমূহের বাস্তব উপমা দেখতে পাই। ইসলামে জ্ঞান-গবেষণার মূল উদ্দেশ্যই হলো, “ বিষয় সমূহের হাকীকত সম্পর্কে জানা”।
০৫. শিক্ষাক্ষত্রে পাশ্চাত্য সভ্যতার দর্শন
এখন তাহলে প্রশ্ন হলো, পাশ্চাত্য সভ্যতা জ্ঞানকে কিভাবে দেখছে? দুনিয়াব্যাপী প্রতিষ্ঠিত তাদের এই জ্ঞানদর্শন’র ভিত্তিমূল কি?
আজ থেকে চারশত বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৬ শতাব্দীতে ইলম (জ্ঞান) এবং মানতিকে (যুক্তিবিদ্যায়) বিশাল এক পরিবর্তন আসে। পৃথিবীর বড় বড় দার্শনিকদের মধ্যে বড় দুইজন দার্শনিক হলো ‘ফ্রান্সিস বেকন’ এবং ‘রেনে দেকার্তে’। এই দু’জন আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে নতুন করে গঠন করে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেছে। এই দু’জনের চিন্তার প্রভাবের কারণে, বিশেষ করে বেকনের জ্ঞান-দর্শন এবং জ্ঞানের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গী, জ্ঞান সম্পর্কে অতীতের সকল ধারণাকে পরিবর্তন করে দেয়।
এই পরিবর্তন পাশ্চাত্যের জ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি এনে দেয় এবং প্রকৃতির উপরে তাদের আধিপত্যকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে, প্রকৃতিকে আবাদ করার পরিবর্তে তারা ফাসাদ সৃষ্টি করতে শুরু করে। তার এই মতাদর্শের অনুসরণে মানুষ মানুষের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু, ফ্রান্সিস বেকনের এই দর্শনটাই বা কী তাহলে?
বেকনের পূর্বের দার্শনিক ও জ্ঞানীরা (আলেম-উলামারা), বিশেষ করে ধর্মসমূহ—জ্ঞানকে শক্তির সেবায় নয়, বরং সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে, জ্ঞানকে তারা সত্য বা হাকীকতের অনুসন্ধানে কাজে লাগাতো। মানবিক জ্ঞানের দিকে তারা অগ্রসরমান ছিলো। তাদের ব্যবহৃত বাক্যগুলো এমন ছিলো, ‘হে মানুষ, তোমরা আলেম হও! জাগ্রত হও! কেননা, জ্ঞান তোমাকে সত্যের সন্ধান দিবে।’
সত্যকে খুঁজে পাওয়ার জন্য জ্ঞান মানুষের একটি গবেষণার ওসিলা ছিল। এই কারণে জ্ঞানের তখন পবিত্রতা বজায় ছিলো। ইলম ছিলো তখন একটি মুকাদ্দেস বা পবিত্র বাস্তবতা। জ্ঞানের অবস্থান ছিলো মানুষের ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে এবং জাগতিক বিষয়াবলীর চেয়ে এর গুরুত্ব ছিলো অনেক বেশী। দুনিয়াবী সম্পদের তুলনায় জ্ঞানকে সবসময় উচ্চ একটা স্থানে আসীন করানো হতো। জ্ঞান উত্তম নাকি দুনিয়াবী যশ, খ্যাতি ও সম্পদ উত্তম; এই প্রশ্ন করা হতো সর্বদাই। আমরা এই ধরনের অনেক উপমা ফার্সি এবং আরবী ভাষায় লেখা সাহিত্যের মধ্যে পেয়ে থাকি। এই দুইয়ের মধ্যে যখন তুলনা হতো, জ্ঞানকে তখন সবকিছুর উর্ধ্বে প্রাধান্য দেওয়া হতো।
যেমন কবি বলেন যে,
ইদ্রিসকে দেওয়া হয়েছিলো ইলম, আর স্বর্ণ ও রূপা কারুনকে;
একজন আজ মাটির নীচে, অপরজন আকাশেরও উপরে।
বেকন বলেন, “জ্ঞান মানুষের জন্য একটি খেলনা সমতুল্য। আমাদেরকে বলা হয়ে থাকে যে, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জনের পেছনে ছুটে চলো। কেননা, জ্ঞান তোমাদেরকে সত্য উদ্ভাবনে সাহায্য করবে। আর সত্য উদ্ভাবন মহাপবিত্র একটি কাজ’। আমার কাছে এটি সঠিক মনে হয় না। বরং আমি মনে করি যে, মানুষের উচিত তাদের জ্ঞানকে তাদের ব্যক্তিগত সেবা-মূলক কাজে ব্যবহার করা। মানুষের জীবনের জন্য যে জ্ঞান উত্তম, যে জ্ঞান মানুষকে প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব এনে দেয়, সে জ্ঞানই উত্তম জ্ঞান। যে জ্ঞান মানুষকে ক্ষমতাবান করে, যে জ্ঞান হলো ভালো জ্ঞান”। ফ্রান্সিস বেকনের উক্তি, Knowledge is power; পাঠকসমাজের নিকট বিখ্যাত এই উক্তিটাকে আবারো পর্যালোচনা করার অনুরোধ রইলো।
এভাবে তারা জ্ঞানের গতিপথকে পরিবর্তন করে দেয়। এছাড়াও, প্রকৃতিকে নিজেদের কর্তৃত্বধীন করার জন্যও জ্ঞানের গতিপথকে তারা পরিবর্তন করে নেয়। কিন্তু কেন?
কারণ, মানুষ প্রকৃতির উপর যতো বেশি কর্তৃত্বশালী হবে, তার গোপন রহস্য সমূহ মানুষ ততো বেশি উম্মোচন করতে পারবে।
ইউরোপের অন্যতম একজন বড় দার্শনিক হলো, এই ফ্রেডরিক নিটসে। দুনিয়াব্যাপী ইউরোপের শোষণের মূলে তার চিন্তাদর্শন-ই সবচেয়ে বেশি মানবতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে! তার মতে, “ধর্ম হলো দরিদ্রদের তৈরি একটা বিষয়। দরিদ্ররা শক্তিশালীদের মোকাবেলা করার জন্য এই ধরনের একটি অদ্ভুত জিনিসের আবিষ্কার করেছে। মসীহ এবং খ্রিষ্টানদের আখলাকী দৃষ্টিভঙ্গী হলো- গোলামীর আখলাক। খ্রিষ্টান আখলাক মনিবের আখলাককে ধ্বংস করে দেয়। আজকের যে ভ্রাতৃত্ব, সমতা, শান্তিপ্রিয়তা নামে যা কিছু রয়েছে, এর মূলে আছে খ্রিষ্টান আখলাক। এ’সকল কথা মিথ্যা, আর তৈরিই করা হয়েছে মানুষকে প্রতারনা করার জন্য। এ’সকল কথা হলো, গরিব এবং দরিদ্রদের উদ্ভাবন। এ’জন্য এই সকল আখলাকী ধারণাকে উচ্ছেদ করা প্রয়োজন। এর স্থলে জমিদারী বা ফিউডালিজমকে পুনরায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। দুর্বলদের সৃষ্টি করা হয়েছে মূলত ক্ষমতাবানদের সেবা করার জন্য। সবলদের বেঁচে থাকতে হলে, নতুন নতুন আবিষ্কার করতে হবে। মূলত, দুর্বলদের শোষণ করার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই, বরং এটা সবলদের অধিকার।”
অতএব, এই মতাদর্শের সাথে সহমত পোষণ করতে হলে স্রষ্টা এবং আখেরাতের চিন্তাকে ছুড়ে ফেলতে হবে। কারণ, এটাই এর মৌলিক প্রকৃতি। দয়া বা মমতার মতো ধরণগুলোর চিন্তাকে ছুড়ে ফেলতে হবে। দয়া-মমতা এই সকল জিনিস গরীবদের অস্ত্র। ক্ষমা করা ও নম্রতা হলো দুর্বলতা ও কাপুরুষতা। সাহসী এবং বীর পুরুষ হওয়া প্রয়োজন।
এই ধরনের চিন্তা-মিশ্রিত অসংখ্য স্কুল গড়ে উঠেছে ইউরোপে। আমাদের সমাজে এই ধরনের কোনো চিন্তার উৎপত্তি হয়নি বলে আমাদের শুকরিয়া জ্ঞাপন করা উচিত। ইউরোপের রূহ এবং সত্যিকারের রূপ হলো এটা। এই চিন্তার কারণেই তারা সারা পৃথিবীর মানুষকে শোষণ করে। এই জন্যই তারা বলতে পারে আমাদেরকে কাছে এক ফোটা রক্তের চেয়ে এক ফোটা তেল অনেক বেশী দামী। তাদের এই সকল চিন্তার মুলে রয়েছে নিটসের দর্শন।
০৬. অন্যান্য সভ্যতার সাথে ইসলামী সভ্যতার পার্থক্যঃ
অন্যান্য সভ্যতার সাথে ইসলামী সভ্যতার সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, ইসলামী সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা হচ্ছে মত-ভিন্নতা, ভিন্ন প্রকৃতি ও ভিন্ন চিন্তাকে সম্মান করা, সেগুলোকে সাদরে গ্রহণ করা। ইসলাম কোনোক্ষেত্রেই মানুষের উপর সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ কিংবা কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেয়নি। ‘অপর’ এর অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছে। কেননা, প্রাকৃতিক বা বিভিন্ন প্রেক্ষিতে সৃষ্ট এসকল পার্থক্যকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করে ইসলাম। যার প্রকৃত দৃষ্টান্ত আমরা ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে দেখতে পাই। এ বিশালতার দরুণ ইসলামী সভ্যতার অনেকগুলো মাযহাব, মক্তব, বিভিন্ন ধারা তৈরি হয়। এবং একেকটি ধারা একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও একই সমাজে সহাবস্থান করে টিকে-ছিলো। ইসলামী সভ্যতা এবং সমাজ এজন্য বরাবরই বহুত্ববাদী ছিলো, এবং আখলাকের আলোকে ইসলামী সভ্যতা অসাধারণ একটি পরিবেশ তৈরি করেছিলো।
নিজেদের দাওয়াতকে ছড়িয়ে দিতে মানুষের হৃদয়কে প্রভাবিত করার পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে এই সভ্যতায়, সকলকে সন্তুষ্ট করে ইসলাম ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, ক্ষমতা ব্যবহার করে কারো উপর জোরপূর্বক ইসলামকে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে, আমরা যদি মহান দার্শনিক জ্ঞানসম্রাট আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচের অমর সৃষ্টি ‘ইসলামী ডেক্লারেশন’ খুব ভালোভাবে পড়ি, তাহলে দেখবো যে, সেখানে তিনি বলছেন,
“যেকোনো বিপ্লবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো, সেখানের বুদ্ধিজীবীদের চিন্তার সাথে জনগণের এক ধরনের হৃদয়গত সংযোগ স্থাপন করা। কেননা, এরকম একটি সম্পর্ক তৈরি হওয়া ছাড়া কোনো বিপ্লব সম্ভব নয়”।
আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচের এ কথাটি একইসাথে ইসলামী সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলনীতি। যেকোনো ধরনের ইসলাহ, তাজদীদ, ই’মার, ইহইয়া কিংবা ইনশা’র জন্য ইসলাম কনভিন্স করার পন্থা অবলম্বন করে। সুলতান ফাতিহের ‘আমরা ভূখণ্ড বিজয় করার জন্য নয়, বরং মানুষের হৃদয়কে বিজয় করার জন্য বিজয়াভিযান পরিচালনা করি’ এ অসাধারণ কথাটি মূলত এরই প্রতিনিধিত্ব করে।
ইতিহাসের পাতায় আন্দালুসিয়ার দিকে তাকালে আমরা দেখি, ইসলামী সভ্যতার সুদীর্ঘ ৮০০ বছরের সময়কালে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো খ্রিষ্টানরা। কিন্তু, একজন খ্রিষ্টানকেও অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়নি। বিপরীতে বরং, আন্দালুস দখলের পর খ্রিষ্টানরা যে নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছে, তাঁর বিস্তারিত বিবরণ ইতিহাসের পাতাগুলিতে সংরক্ষিত আছে। একইভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে যখন ব্রাক্ষ্মণরা আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে, তখন ভিনভাষী, ভিনধর্মের সকলের উপর নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছে। কিন্তু উপমহাদেশে ইসলামী সভ্যতার সুদীর্ঘ ৭০০ বছরের ইতিহাসকালে এরকম বিন্দুমাত্র নজিরও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইসলামী সভ্যতার সময়কালে মুসলমানরা যদি এ ধরনের আধিপত্য চালাতো, তাহলে ভিন্ন কোনো ভাষা ও ভিন্ন কোনো ধর্মের খোঁজ পর্যন্ত পাওয়া যেতো না। কিন্তু, প্রতিটি ধর্ম, প্রতিটি ভাষা স্বমহিমায় টিকে ছিলো, এবং আজও রয়েছে। দিল্লি, ইস্তাম্বুলের মতো জায়গা, যা ছিলো ইসলামী সভ্যতার কেন্দ্রস্থল, সেখানেও যথেষ্ট-সংখ্যক ভিন্ন ধর্মের মানুষজন ছিলো, এমনকি এখনও রয়েছে। সেসময়কার কোনো ভাষা মুসলিমদের কারণে বিলুপ্ত হয়েছে, অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে ভিন্ন ভাষা-ধর্ম-জাতির উপর গণহত্যা চালানো হয়েছে, এর সুস্পষ্ট, প্রমাণিত ও গ্রহণযোগ্য কোনো নজির নেই।
মূলত এক্ষেত্রেই পশ্চিমা আধুনিকতার সাথে ইসলামী সভ্যতার পার্থক্য লক্ষ্যণীয়। অর্থাৎ ইসলামী সভ্যতায় সবগুলো অঞ্চলেই ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন ভাষার লোকজন বিদ্যমান ছিলো। মুসলিমরা তাদেরকে ভাই হিসেবে সমস্ত অধিকার দিতো, একত্রে বসবাস করতো। অপরদিক, খ্রিষ্টান-হিন্দুরা মুসলমানদের ধর্ম পালন দেখে নিজেদের ধর্মকে ভালোভাবে পালন করতো এবং ধর্মকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে জীবন্ত করে তুলেছিলো, এক্ষেত্রে কোনো বাঁধা ছিলো না। কারণ, ইসলামী শরীয়তের পূর্ণ বাস্তবায়ন ছিলো।
বিপরীতপক্ষে পাশ্চাত্যের মডার্নিজম বা আধুনিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ হচ্ছে আধুনিকতা। সকল-কিছুকে তার নিজের ছাঁচে গড়ে নিতে চায় সে। একধরণের নিয়ন্ত্রণমূলক কর্তৃত্ববাদ চাপিয়ে দেয় পাশ্চাত্য, যার ফলে বিকল্প কোনো কিছু বা বৈচিত্র্য কোনো কিছুকেই সহ্য করতে পারে না সে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো দুটি বিশ্বযুদ্ধ। একই অঞ্চল, একই ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও এ বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষের জীবন খোয়া গেছে। শুধুমাত্র পার্থক্য ও বৈচিত্র্যকে সহ্য না করতে পারার দরুণ এ যুদ্ধে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। যেখানে তারা নিজেদেরকেই সহ্য করতে পারে না, সেখানে অন্যান্য অঞ্চল, জাতিসত্তা কিংবা অন্যান্য ধর্মের কাউকে গ্রহণ করা অসম্ভব। এটা তাদের মূলনীতিবিরুদ্ধ!
কিন্তু অপরদিকে, পশ্চিমা আধুনিকতা ভিন্ন মতাদর্শের কারো সাথে সহাবস্থানের ধারণাকে গ্রহণ করে না। বরং সবকিছু আধুনিকতার তৈরিকৃত ধাঁচে গ্রহণ করতে হবে বা এমন একটি জীবনাচরণ বহন করতে হবে, এ বিষয়টি আধুনিকতাবাদ তাঁর সকল উপাদান ব্যবহার করে আমাদের অবচেতন মনে গেঁথে দেয়। আর এর সাথে থাকে ক্ষমতার সম্পৃক্ততা, যাকে ইতালির চিন্তাবিদ আন্তোনিও গ্রামসি আখ্যা দিয়েছেন হেজেমনি হিসেবে। (গ্রামসির হেজেমনি তত্ত্বের ব্যাখ্যা অনেক বিশাল, তবে আধিপত্য বিস্তার করে করে মানুষের চিন্তায় প্রবেশ করিয়ে দেয়া, কনভিন্স করা গ্রামসির হেজেমনি তত্ত্বের অন্যতম অনুষঙ্গ।)
আবার ফ্রান্সিস বেকনের ন্যায় বড়বড় দার্শনিকেরা জ্ঞানকে কেবলমাত্র ক্ষমতার আসনে আরোহণের জন্য সিড়ি কিংবা ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছে, ব্যবহার করেছ। এজন্যই, পাশ্চাত্যের পন্থা মানুষকে কনভিন্স করা নয়, বরং কনভার্ট করা। অর্থাৎ মানুষের ভেতরকে প্রভাবিত করা নয়, বরং মানুষকে রূপান্তর করে বদলে দেয়া।
গত শতাব্দীর সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী সাম্রাজ্য হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ সাম্রাজ্য এতো দ্রুত ধ্বসে পড়ার কারণ কী? কারণ, এ সাম্রাজ্য মানুষের শয়নকক্ষ পর্যন্ত তাঁর নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করে রেখেছিলো। আর প্রকৃতির স্বাভাবিক একটা মূলনীতি যে, মানুষ তাঁর ফিতরাত বিরোধী কোনোকিছুকে স্থায়ীভাবে মেনে নেয় না। ফলে এ প্রবল ক্ষমতাশালী সাম্রাজ্য টিকতে পারেনি।
আবার দেখা যায়, কম্যুনিস্টরা ক্ষমতা দখলের সাথে সাথেই লেলিনকে প্রত্যেকটা জায়গায় অপরিহার্য করে গড়ে তোলে। লেলিনের জীবনী ও তাঁর সংগ্রামকে শিক্ষাব্যবস্থায় বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার ফলে, প্রতিটা শিশু তা শিখতে বাধ্য হয়। পাঠ্যবই থেকে শুরু করে প্রতিটা ক্ষেত্রেই লেলিন, স্ট্যালিনকে হাইলাইট করা হয়। শুধু সোভিয়েত নয়, বরং সকল অঞ্চলেই এমনটা করা হয়। উপমহাদেশেও ব্রিটিশ শোষণকালে এভাবেই ব্রিটিশ বন্দনা শুরু হয়।
কিন্তু ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে এরকম কোন দৃষ্টান্ত নেই! উমাইয়া-আব্বাসী থেকে শুরু করে ইসলামী সভ্যতার সমস্ত অঞ্চলেই হাকীকতকে কেন্দ্রে রেখে জ্ঞান আবর্তিত হয়েছে। ফলে আব্বাসী, উমাইয়া কিংবা উসমানীদের আমলের শিক্ষাক্রমে এমনটা কখনও দেখা যায় না যে, ইতিহাস পাঠে বাধ্যতামূলকভাবে তাদের ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিংবা মুঘলদের সময়কালে মুঘলদের পারিবারিক ইতিহাস শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমন কোন নজির নেই!
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সুদীর্ঘকালব্যাপী তিনটি মহাদেশব্যাপী বিস্তৃত উসমানী সালতানাত, কিংবা বিশাল অঞ্চলজুড়ে টিকে থাকা মুঘল সালতানাত, ইরান অঞ্চলে সাফাভী সালতানাত—বিশাল সংখ্যক মানুষকে পরিচালনা করেছে। তাদের পক্ষে কি মানুষের উপর এ ধরণের সর্বময় কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেয়া সম্ভব ছিলো না? শক্তিশালী প্রশাসন, সেনাবাহিনী আর জ্ঞান; সবই তো বিদ্যমান ছিল। তা সত্ত্বেও তারা ভিন্ন ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, বৈচিত্র্যতা নির্মূল করেনি, ধ্বংস করেনি।
০৭. ফলাফলঃ
তাদের এমন শক্তিকেন্দ্রিক জ্ঞানের দৃষ্টিকোণের আলোকে প্রশ্ন আসতেই পারে যে, জ্ঞান যদি প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে, তাহলে এর ফলাফল কী হবে? অর্থাৎ আরও সুন্দর একটি জীবন কি অর্জন করা সম্ভব? মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা কি আরও ভালো হবে? যদি হয়, তাহলে কিভাবে?
প্রকৃতির রহস্যসমূহ উম্মোচন করে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে সেখান থেকে মানুষের কল্যাণের জন্য কোনো কিছুর উদ্ভাবন অবশ্যই ভালো একটি চিন্তা। কিন্তু, আমরা যদি চূড়ান্ত ফলাফলকে বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, অবশেষে জ্ঞান তার উচ্চ মর্যাদা এবং উচ্চ আসনকে হারিয়ে ফেলবে। আবার এ জ্ঞানের ফসল হলো, পাশ্চাত্যের একক চিন্তাগত আগ্রাসন এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্য। যার ফলশ্রুতিতে, পশ্চিমা চিন্তাদর্শন গোটা বিশ্বব্যাপী জ্ঞান ও চিন্তার ক্ষেত্রে একক মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে।
বেকনের মতে, “জ্ঞান কেবলমাত্র এবং একমাত্র ক্ষমতার জন্য”, (knowledge is power) অন্য কিছুর জন্য নয়। তবে, প্রথমদিকের অবস্থাটা এমন ছিলো না। কিন্তু ক্রমান্বয়ে, জ্ঞান-বিজ্ঞান শুধুমাত্র শক্তির অর্থাৎ ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গ ও ক্ষমতার গোলামী করতে শুরু করেছে। সমগ্র দুনিয়া আজ এই ভিত্তির উপরেই পরিচালিত হচ্ছে। অথচ, এর পূর্ব পর্যন্ত জ্ঞানের কোনোদিন এতোটা অধঃপতন হয়নি। জ্ঞান-বিজ্ঞান আজ জালিম ও ক্ষমতাবানদের শোষণের হাতিয়ার। অবস্থাটা আজ এমন পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যে, যিনি যতো বড় জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী, তিনি ততো বেশি পরাধীন। উদাহরণস্বরূপ আইনস্টাইনের কথাই ধরা যাক। তার জ্ঞান, তার চিন্তা আজ কোন কাজে লাগছে? কাদের উপকারে আসছে?
আইনস্টাইন রুজভেল্টের গোলামে পরিণত হয়েছিলো। যদি সে না হতে চাইতো, তবুও সে পারতো না। কারণ, সে নিজে ছিলো পরাধীন, তার নিজস্ব কোনো শক্তি ছিলো না। পূঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদেই হোক আর কমিউনিজমেই হোক, জ্ঞান আজ ক্ষমতার ও ক্ষমতাবানদের গোলাম! কেননা, দুনিয়া আজ পরিচালনা করছে ক্ষমতাবানরা, জ্ঞানীরা নয়।
আজ বলা হয়ে থাকে যে, “আমাদের বর্তমান দুনিয়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের দুনিয়া”, “বর্তমান যুগ জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ”। মুখরোচক এমন কথাগুলো আজ শুধু মুখের বুলিই হয়ে রয়ে গিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে জ্ঞানের এই সেক্টরের রূঢ় বাস্তবতা হলো, আজকের দুনিয়া ক্ষমতাশীনদের দুনিয়া, জ্ঞানের দুনিয়া নয়। আমাদের উচিত, এই কথাগুলোকে, দুনিয়ার এমন বাস্তবতাকে এভাবেই উপস্থাপন করা। আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান আছে, কিন্তু তা স্বাধীন নয়, তা আজ পরাধীন। জ্ঞান আজ শক্তি ও ক্ষমতার কাছে বন্দী এক গোলামের নাম।
পৃথিবীতে যা-কিছু আবিষ্কার হচ্ছে, সেসবকিছু আজ ক্ষমতা ও শক্তিবানদের সেবায় নিয়োজিত। সকল আবিষ্কারের আগে ক্ষমতাবানরা মানব বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করে। এরপর, সে সকল উপাদান থেকে যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, তাহলে সেটা দিয়ে মানব কল্যাণের জন্য কিছু বানানোর চেষ্টা করে। তাও আবার সকল মানুষের জন্য না! দুনিয়ার একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য।
আমরা যদি বিগত চারশত বছরের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, সকল বই-পুস্তক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এই চিন্তার আলোকে গড়ে তোলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলতে চাই, ফরাসী নৃবিজ্ঞান (ফ্রেঞ্চ এন্থ্রোপলজি) নামে কোনো পরিভাষা নাই, কিন্তু আলজেরিয়ান এন্থ্রোপলজি রয়েছে, আফ্রিকান এন্থ্রোপলজি রয়েছে। কিন্তু ফ্রেঞ্চ সোশিওলজি নামে অনেক পরিভাষা ও বই পুস্তক রয়েছে। এর কারণ হলো, তারা নিজেদেরকে একভাবে বিবেচনা করে, আর যাদেরকে শোষণ করে তাদেরকে চিন্তা করে অন্যভাবে। কিভাবে তাদেরকে বেশী বেশী শোষণ করা যাবে, এটা নিয়ে রয়েছে তাদের বিস্তর গবেষণা।
এ প্রেক্ষিতে ইউরোপের অবস্থানকে যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, এসকল যুদ্ধ বা ক্ষমতার মাধ্যমে মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা যায়। কিন্তু, মানুষ এতে তাঁর রূহকেই হারিয়ে ফেলে। মানুষ তাঁর সত্যিকারের শান্তি কখনোই খুঁজে পায় না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ আজকের ইউরোপ। পরবর্তীতে তারা এ নীতি থেকে সরে আসে। কেননা, এরূপ সর্বময় কর্তৃত্বশীল সাম্রাজ্য বা সভ্যতার পতন ঘটা অনিবার্য। ব্রিটেন ও ফ্রান্স একসময় এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলো। পরবর্তীতে, আমেরিকা ভিন্ন নীতি গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে আমেরিকা আগে পরিবেশ তৈরি করে, পরে তাদের চিন্তা ও আইডিওলজি পুশ করে; শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতি, মিডিয়ার মাধ্যমে।
বর্তমান ইউরোপ হেগেলের ডায়েলেক্টিকবাদকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে মুসলমানদের এমন ফিকহ, সমাজতত্ত্বকে আমরা আমাদের উপনিবেশ পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলগুলো থেকে হারিয়ে ফেলেছি, যার ফলে ফিকহের মৌলিক পরিভাষাগুলো অনুপস্থিত। যার কারণে যেকোনো অঞ্চলের আঞ্চলিক প্রথা বা উরফকেই আমরা ইসলাম ভাবতে শুরু করি, ইসলামের মৌলিক কিছু হিসেবে মান্য করা শুরু করি। যেকোনো অঞ্চলের আঞ্চলিক প্রথা বা উরফকেই ইসলামের মানদণ্ড মনে করে পয়গম্বর (স) এর সুন্নত হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করি। এর মাধ্যমে বরং আরো বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব ছিলো, মৌলিক উৎসসমূহ ব্যবহার করে সামাজিক আচরণ তথা স্যোশাল বিহেভিয়ারকে বিশ্লেষণ করা। যেহেতু এই সোশ্যাল বিহেভিয়ার ব্রিটিশ ও হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের আদলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, তাই এর পরিবর্তে সেখানে নতুন প্রস্তাবনা দেয়া আমাদের বড় একটা দায়িত্ব ছিলো। কিন্তু, আমরা সেটা করতে পারিনি। ফলে দুর্খায়েম, অগাস্ট কোঁৎ ও ম্যাক্স ওয়েবারের সমাজ-বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আমাদের উপর এমনভাবে চাপিয়ে রেখেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই আমরা একে মূল সমাজবিজ্ঞান মনে করে থাকি। যার ফলে মুসলিম বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে মুসলিমদের অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত, মুসলিমদের জীবনকে সজ্জিত করবে, কিংবা তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে; এমন কোনো সমাজবিজ্ঞান আমরা দাঁড় করাতে পারি না, দাঁড় করাতে দেয়া হয় না।
মাদ্রাসা শিক্ষা হোক, বা যেকোনো শিক্ষাই হোক, এ কাঠামোগুলিকে সাম্রাজ্যবাদীরা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যে, সেখান থেকে এধরণের সোশিওলজি দাঁড় করানো এককথায় অসম্ভব। ফলশ্রুতিতে আমরা আমাদের মূল উসূলুদ্দীন ও আমাদের ফিকহকে বাদ দিয়ে যখন সমাধান করতে যাই, তখন ঘুরেফিরে পাশ্চাত্যের মূলনীতির মধ্যেই আবদ্ধ হই।
অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা কিংবা আগ্রাসন চালানোর মতো কাজগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে বসে করলেও, কিংবা কমনওয়েলথের নাম দিয়ে করলেও, দিনশেষে এটা একটি উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া হিসেবেই ফাংশন করছে, যে ক্ষমতা দিয়ে মানুষেরে চিন্তা ও জ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আর এর ভয়াবহতা হলো, আমাদের আখলাকী সংকট, অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, রাজনীতির ক্ষেত্রে ভয়াবহ ক্রাইসিস; সর্বোপরি, আমরা আমাদের সোশিওলজি দাঁড় করাতে পারি না।
এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, জ্ঞানকে স্বাধীন রাখতে না পারা। জ্ঞান রাজনীতিকরণের হাতিয়ারে পরিণত হওয়া। পাশাপাশি, আমাদের জ্ঞান ও চিন্তা নিয়ন্ত্রিত হওয়া। ফলশ্রুতিতে, আমরা পশ্চিমাদের তৈরিকৃত চিন্তাকাঠামোর বাহিরে কিছু ভাবতেই পারি না। আমাদের জ্ঞান ও চিন্তার ক্ষেত্রে এটাই মূলধারায় পরিণত হয়েছে। এর বাহিরে আমরা নতুন কিছু চিন্তা করতে পারি না, নতুন কিছু সৃষ্টিও করতে পারি না।
যেমন, ইমানুয়েল কান্ট এক্ষেত্রে প্রশ্ন রেখেছিলেন, আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বলে কোনকিছুর আদৌ অস্তিত্ব আছে কি-না। নাকি সবকিছুই সমাজ নির্ধারিত মানদণ্ডের ছাঁচে গঠন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে, কান্টের কথাকে আমরা বর্তমান সভ্যতার প্রেক্ষিতে এভাবে তুলে ধরতে পারি যে, মানুষের ব্যক্তিগত রুচি, সামাজিক স্ট্যান্ডার্ড, ধর্মতাত্ত্বিক প্রথা, অথবা দেশীর সংস্কৃতি-কে একটি নির্দিষ্ট চিন্তাকাঠামোর আলোকে আমরা পরখ করি। কেননা, আমাদের ব্যক্তিগত রুচি থেকে শুরু করে দেশীয় সংস্কৃতির সবটাই পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক নিগড়ে বন্দী। ফলশ্রুতিতে, পাশ্চাত্যের তৈরিকৃত কোনোকিছুর বাহিরে আমরা স্বকীয় কিছু ভাবতে সক্ষম নই!
জ্ঞানের এই শক্তি ব্যবহার করে তারা তাহলে আমাদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে? তিনটি ক্ষেত্রকে ব্যবহার করে পাশ্চাত্য মূলত জ্ঞানের ক্ষেত্রে এরকম রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তৈরি করে।
ক) মিডিয়া
খ) একাডেমিয়া
গ) সংস্কৃতি
এক্ষেত্রে একাডেমিয়াতে ‘জ্ঞান’ উৎপাদন হয়, মিডিয়ার মাধ্যমে তা ছড়ানো হয় এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে তা সকল মানুষকে প্রভাবিত করে। জ্ঞানের লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া কিংবা জ্ঞানদর্শন বা জ্ঞানতত্ত্বের কাঠামো আগাগোড়া বদলে যাওয়ার ঘটনা হুট করে ঘটেনি। এক্ষেত্রে এবিষয়টিকে একইসাথে অনেক বড় একটি ঐতিহাসিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
আজকেও আমরা তাকিয়ে দেখি যে, যারা আগের পদ্ধতিতে জ্ঞান অর্জন করছে, তাদের মধ্য থেকে জ্ঞানের এই মর্যাদা এখনো সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায়নি। আমরা যদি অতীতের মাদরাসা-সমূহ কিংবা শিক্ষাকেন্দ্র-সমূহের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকের আলাদা একটি মর্যাদা রয়েছে। এই সকল শিক্ষাকেন্দ্রে কেউ একথা বলে না বা লজ্জার কারণে বলতে পারে না যে, আমি অর্থ আয়ের জন্য জ্ঞান অর্জন করছি।
কিন্তু আজ বেকনের জ্ঞান দর্শনের আলোকে যে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেই ব্যবস্থা এই চিন্তাধারাকে অনেক আগেই বিদায় জানিয়েছে। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলা হয়েছে পুঁজিবাদের উপর ভিত্তি করে, জ্ঞান যেখানে পুঁজির উপর প্রতিষ্ঠিত। আলী শরীয়তীর ভাষায় বলতে গেলে, “জ্ঞান ও অর্থ আজ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, যেখানে অর্থ হচ্ছে স্বামী আর জ্ঞান যেনো তার স্ত্রী।”
আজ যারা শিক্ষা অর্জনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে, তাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো, সুখী একটি জীবন যাপন করা এবং ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। আজকের শিক্ষাব্যবস্থাকে তুলনা করা যায় বাজার আর ব্যবসায়ীর মধ্যকার সম্পর্কের মতো করে। কারণ, উভয়ের লক্ষ্যই হলো- অর্থ উপার্জন। শিক্ষকদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। তারা জ্ঞান বিতরণের বদলে অর্থ উপার্জনকেই প্রাধান্য দেয়। যার ফলে শিক্ষার্থীদের মনে তাদের প্রতি না আছে কোনো ভালোবাসা, না আছে কোনো শ্রদ্ধাবোধ।
এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কি? আমাদের সবচেয়ে বড় করণীয় হলো, ইসলামী সভ্যতার মূলনীতির আলোকে হাকীকতমুখী জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালানো। এবং শিক্ষাকাঠামো ও বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান জ্ঞানদর্শনের বিপরীতে হাকীকত, মাআরেফতের আলোকে নতুনভাবে একটি জ্ঞানের আন্দোলনের সূচনা করা।
মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফ, ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী, ড. হামীদুল্লাহ এবং সাইয়্যেদ নকীব আল আত্তাসদের পথ ধরে পুনরায় একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক আন্দোলনের জন্য সংগ্রাম করে যাওয়া ছাড়া জ্ঞানকে স্বাধীন ও হাকীকতমুখী করার আর অন্য কোনো পন্থা নেই।
তথ্যসূত্রঃ
আলী শরীয়তির আধুনিকতা সংক্রান্ত আলোচনা
The Political use of knowledge in the policy process, Falk Davitar