বাংলাদেশী জাতির সিন্দবাদ কবি ফররুখ আহমদ। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের কবি ফররুখ আহমদ। আমাদের জাতীয় রেনেসাঁর কবি, সাত সাগরের মাঝি, সিরাজাম মুনীরার অমর কবি ফররুখ আহমদ। বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ লিখেছেন, সে সময়ে আমাদের সাহিত্যে ফররুখ আহমদকে কোণঠাসা করার, তাঁকে ‘ইসলামী রেনেসাঁ‘ আর ‘পাকিস্তানবাদের’ কবি বলে বাতিল করে দেবার অশুভ প্রচেষ্টা চলছিল। তাঁর কবিত্ব শক্তি, সৃজনী ক্ষমতা আর অনবদ্য সৃষ্টিকে বাদ দিয়ে আদর্শ আর মতবাদকে বড় করে তুলে তাঁকে খারিজ করে দেয়ার প্রচেষ্টারও অন্ত ছিল না। মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ্ ‘সে সময় বলতে হয়ত বুঝিয়েছেন দু’এক দশক আগেকার কথা। কিন্তু কথাটা কোন একটা ক্ষুদ্র চক্র সম্পর্কে আজও কি সত্য কথা। মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত যে, ফররুখকে বাতিল ও খারিজ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে একটি বিশেষ বিদগ্ধমহল উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই। কোন কোন সম্প্রসারণবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির সাংস্কৃতিক প্রভাব এদেশে বিস্তারে যারা মনে-প্রাণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন বা করেছেন, তারাই ফররুখ আহমদকে প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক, ইসলামপন্থী ও তমদ্দুনী কবি বলে খারিজ ও বাতিল করতে সবচেয়ে বেশী উৎসাহী। কারণ রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ তাঁদের পথের কাঁটা। সিরাজাম মুনীরার কবি ফররুখ আহমদ আল্লাহর হাবিব রসূলে মকবুল (সা:) কে লক্ষ করে লিখেছেন: ‘কে আসে, কে আসে সাড়া পড়ে যায় / কে আসে, কে আসে নতুন সাড়া জাগে সুপ্ত মৃত জনপদ, জাগো শতাব্দী ঘুমের পাড়া। হারা সম্বিত ফিরে দিতে বুকে/তুমি আনো প্রিয় আবেহায়াত/জানি সিরাজাম মুনীরা। তোমার রশ্মিতে জাগে কোটি প্রভাত। তবু বিদ্যুৎ কণা-স্ফুলিঙ্গে লুকানো রয়েছে লক্ষ দিন / তোমার আলোয় জাগে। সিদ্দিক, জিন্নুরাইন, আলী নবীন / ঘুম ভেঙে যায় আল-ফারুকের হেরি ও প্রভাত জ্যোতিষ্মান/মুক্ত উদার আলোকে তোমার অগণন শিখা পায় যে প্রাণ।
ফররুখ আহমদ হযরত আবু বকর সিদ্দিক, উমর দারাজ দিল, ওসমান গনি, আলী হায়দার প্রভৃতি কবিতা লিখেছেন।
অতএব বিদেশী ভাবাদর্শী এক শ্রেণীর বিদণ্ডের চোখে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল। ‘আলী হায়দার’ কবিতায় ফররুখ লিখেছেন :
“মুসলিম কভু নাহি মানে পরাজয় কুল মধনুকে তার জয় অক্ষয়
যত খায়বার করেছে দুয়ার, সেনানী তোমার
হাতে ভেঙেছে বালুর মিনার যেমন ভেঙে পড়ে ঝঞ্ঝাতে। …………
তার তকবির শোনা যায়, পিছে ওঠে জনতার স্বর
আলী হায়দার। আলী হায়দার। আসে আলী হায়দার।”
উমর দারাজ দিল’-এ ফররুখ লিখেছেন :
আজকে উমর-পন্থী পথিকের দিকে দিকে প্রয়োজন
পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রাপ্তর প্রাণ-পণ
ঊষর রাতের অনাবাদী মাঠে ফলাবে ফসল যারা
দিক-দিগন্তে তাদেরে খুঁজিয়া ফিরিছে সর্বহারা।
আজকে এখানে মৃত মরুভূমি অচল এ মরুপোত
বহে অসংখ্য বালুর তুফানে দিন-রাত্রির স্রোত
লু হাওয়ায় লেখা তীব্র পিপাসা, মৃত্যুর হাহাকার
আজকে এখানে নিশীথ প্রহরী উমর জাগে না আর।
তবু অতীতের প্রশ্বাসে আজো তরে নিচ্ছিল সরণী উমর।
বন্ধু উমর। দারাজ দিল।
ফররুখ আহমদ অন্য কোন পন্থী হননি। তিনি উমর-পন্থী। তাই সেই বিদগ্ধদের বিবেচনায় তিনি রিভাইডেলিয় পশ্চাদমুখী, প্রতিক্রিয়াশীল, তমুদ্দীন’ কবি। তারা ফররুখকে তাদের বিদগ্ধ সমাজ থেকে খারিজ ও বাতিল করে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন পন্থী বিদগ্ধদের সর্বস্বত্বত্যাগী সত্যিকার সর্বহারা বন্ধু কি তাঁরা সারা ইতিহাসে দেখাতে পারবেন? যদি না পারেন তবে ফররুখের উমর-পন্থী হওয়া তাদের চোখে দোষণীয় কেন? উমরের চেয়ে বিপ্লবী উমরের চেয়ে প্রগতিশীল, উমরের চেয়ে সর্বহারা দরদী আর কে এখানে ফররুখের সেই ‘নেতা’ নামক ব্যঙ্গ কবিতাটি স্মরণযোগ্য যাতে তিনি স্যাটায়ারের চাবুকে চাবুকে জর্জরিত করেছেন এভাবে
৬০, বিপ্লবীদের পিঠ : মানুষের লাগি কাঁদি ভিজায়েছি আমার আছিল। কমরেড! বেরাদর ….
যাই বলি জেনে আমি নেতা সেই সাথে মোর ট্যাক হবে জানি সম্পূর্ণ রঙিন।
আদর্শ ভাঙ্গায়ে খাই মুক্ত দিল উদার প্রনেতা জনতার মাথা বেচি আনিব মুক্তির লাল দিন।
মরুক পঞ্চাশ লাখ, মারিব পঞ্চাশ লাখ নিজে – ‘তোমাদের দুখে মোর প্রতিদিন বুক ওঠে ভিজে।
অহর্নিশি বয়ে যাই জনতার দুঃখের সংগিন।”
অতএব ফররুখ আহমদ তমুদ্দনী কবি, প্রতিক্রিয়াশীল কবি, পশ্চাদমুখী কবি। তাঁকে খারিজ ও বাতিল করবার জন্য নানানপন্থী বিপ্লবী বিদক্ষদের কতই না দক্ষ হয়েছে। ১০০০ এর মরে লেখা ‘লাশ’ এর কবি ফররুখ যখন অভাবে দারিদ্রে আক্ষরিক অর্থেই অন্যহারে, বিনা চিকিৎসায় সত্যিই একদিন নিজেই লাশ হয়ে গেলেন সেদিনই সেই বিদ্যদের প্রাণের জ্বালা ছড়ালো। কারণ তরুণ কবি জড় সভ্যতাকে ধিকার নিয়ে বলেছেনঃ
“হে জড় সভ্যতা।
মৃত সভ্যতার দাস স্ফীতমেদ শোষক সমাজ। মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ,
তারপর আসিলে সময়
তোমার শৃঙ্খলগত মাংসপিণ্ডে পদাঘাত হানি নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বারপ্রান্তে টানি।
আজ এই উৎপীড়ত মৃত্যু-দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বত্ত
ধ্বংস হও
তুমি ধ্বংস হও।“
[লাশ: সাত সাগরের মাঝি]
অথচ তারাও বিলক্ষণ জানেন মানবতার কবি ফররুখ, সাম্যের কবি ফররুখ অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজীবন মুজাহিদ এবং আপসহীন সংগ্রামী। ‘এই সংগ্রাম’ শীর্ষক কবিতায় তিনি লিখেছেন :
এই সংগ্রাম দিন রাত্রির তীরে
চলে অবিরাম সারা মন ঘিরে।
প্রতি মুহূর্তে শ্বাপদ তুলিছে ফণা
হানি পরাজয়ী বিষাক্ত যন্ত্রণা:
জুনা হীনতার পিছল পথে সে
বিষাইছে রাত্রিরে।
ফররুখ আহমদ ইসলামী রেনেসাঁর কবি- এর মধ্যে তাঁর লুকাছাপার কিছুই নাই। তৌহিদের বুলন্দ আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাঁর কণ্ঠে। তিনি যা ভেবেছেন সমগ্র অন্তর দিয়ে ভেবেছেন, সমস্ত চেতনা দিয়েই উপলব্ধি করেছেন: কণ্ঠের সর্বশক্তি দিয়ে তা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর সাত সাগরের মাঝি কবিতায় তিনি বলেছেন
কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে তোর হল জানি না তা।
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
দুয়ারে তোমার সাত-সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলো না? তবু তুমি জাগলে না?
আজকে তোমাকে পাল ওঠাতেই হবে।
ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে আলি, তবুও জাহাজ আজ ছোটাতেই হবে।
তবে পাল খোলো, তবে নোঙ্গর তোলো
এবার অনেক পথ শেষে সন্ধানী । হেরার তোরণ নিবে সম্মুখে জানি।।
তবে নোঙর তোলা।
তবে তুমি পাল খোলো।
সিন্দবাদকে ডেকে কবি বলেছেন
ভেঙ্গে ফেলো আজ থাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ, দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ,
ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েসী রাতের মখমল অবসাদ,
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও হে মাঝি সিন্দবাদ ।
এছাড়াও পাঞ্জেরী কবিতায় কবি বলছেন :
রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
ও-কি দরিয়ার গর্জন, -একি বেদনা মজলুমের। ও-কি ক্ষুধাতুর পাঁজরায় বাজে
মৃত্যুর জয়ভেরী।
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরী কত দেরী।।
ফররুখের এই আহ্বান কি পেছনে চলার আহ্বান? না সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ জয় করে কওমের হাজারো বছরের ঐতিহ্যবাহী মাঝিমাল্লাদের এগিয়ে চলার আহ্বান সমুদ্রের গর্জনে যিনি মজলুমের বেদনার আর্তনাদ শোনেন, তিনি কি প্রতিক্রিয়াশীল?
করো ঈমানের আগুনে তপ্ত গোলাপী খুন: বাজেনা সমুখে চটকের ভয় ভাঙিয়ে দাও বলা ফররুখকে আমি বলেছি বাংলার ইকবাল। ইকবালের বালে জিব্রীলের ভাবানুবাদ করেছেন নিম্নরূপ :
ওঠো দুনিয়ার শরীর তুমি জাগিয়ে দাও
ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও
ঐ দেখ আসে দুর্গত-হীন-দুঃখীর রাজ
পাশের চিহ্ন মুছে যাও, ধরা রাঙিয়ে দাও!!
কিষাণ মজুর পায় না যে মাঠে শ্রমের ফল ধরে সে-মাঠের সব শস্যে আগুন লাগিয়ে দাও ।
ফররুখ জীবন-ভর ছন্দ বেঁধেছেন কওমকে জাগাবার জন্য আমাদের ঘুম ভাঙাবার জন্য। ছন্দের মধ্য দিয়ে তিনি দিয়েছেন মর্দে মুজাহিদের ডাক। কিন্তু নিজের জীবনের ছন্দ তিনি মেলাতে পারেননি। বারবার ছন্দ-পতন হয়েছে সংসার জীবনে। আদর্শের পথে যারা আত্ম নিবেদিত তাদের বোধ করি, এমনিই হয়ে থাকে। জমা-খরচের হিসাব তাদের মেলে না। তারা শির দেয় সায় দেয় না। তাই বুঝি ‘গদ্য পৃথিবী’ কবিতায় ফররুখ নিজের কথাই বলেছেন :
ছন্দহীন, মিলনহীন প্রান্তর
সুমা মেঘের কোমল ছা
জেগে আছে এক দুঃস্বপ্নের মত…..
যেখানে তুমি খুঁজে পাবে না মেহদির সবুজ পাতা ছন্দ আর মিলের কোন কবিতা নিতান্ত গদ্যের, নিছক অমিলের এই পৃথিবী।
কোন কাহিনী …………
কিন্তু আমাদের জাগরণের কবি ফররুখ, আমাদের কওমী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ এতটুকু হেরে যাননি। তার আদর্শের বিরাট জয় হয়েছে এবং বৃহত্তর জয় আসন্ন। বিভ্রান্তি ও পদচ্যুতির যে কালো মেঘ আসমান ছেয়ে ফেলেছিল, সুরুজ-চান-সেতারাদের ঢেকে ফেলেছিল সে মেঘ কেটে গেছে। আবার সূর্যলোক জেগে উঠেছে। চন্দ-তারারা ভেসে উঠেছে। যে তারারা সিন্দবাদকে নির্ভুল পথে চালিয়ে নিয়ে যায়, সেই তারকা আমরা আবার খুঁজে পেয়েছি। সিন্দবাদের নৌকার নোঙর তোলা হয়েছে। সাগর তরঙ্গ তুচ্ছ করে নৌকা মনজিলে মকসুদের লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে। ইনশাআল্লাহ, ফররুখ আহমদের সিন্দবাদ মাঝির নৌকা মনজিলে মকসুদে পৌঁছবেই।
আল্লাহপাক বলেছেন: “ওয়াল জায়ান হারু ও জাহাকাল বাতেলু, ইন্নাল বাতেলা কানা জাহুকা” – বল হে রাসূল সত্য এসেছে মিথ্যা লোপ পেয়েছে, নিশ্চয় মিথ্যার বিনাশ অনিবার্য। কিন্তু এই আবার সূর্য উঠেছে, চাঁদ সেতারারা আবার জেগেছে- এটা দেখবার জন্য বন্ধু ফররুখ, ভাই ফররুখ তুমি আর কটা দিন থাকলে না। তুমি থাকলে না। তুমি বলেছিলে, রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী। অন্ধকার রাত কেটে গেছে, জেগেছে সুবেহ সাদেক। কিন্তু বাংলার ইকবাল, হে নাবিক শ্রেষ্ঠ সিন্দবাদ। তুমি কোথায়? তুমি কোথায়? পরলোক থেকে তুমি কি দেখছো কওমের এই নবযাত্রা!
[বিবর্তন, ফররুখ স্মরণ সংখ্যা, প্রকাশকাল ১৯৮৬ সম্পাদক মোহাম্মদ বদরুল ইসলাম মুনীর।।