একজন কবি কি করে তার আত্মার একান্ত বিশ্বাসের উচ্চারক হয়েও; শিল্প সফল, সর্বমানবের কবি হতে পারেন, পৃথিবীর সকল মৃত্যুঞ্জয়ী মহৎ কবির ভিতরেই আমরা কম-বেশী তার পরিচয় পাই, আমাদের দেশ, আমাদের সমকালে আমাদের সৌভাগ্য আমাদের সতীর্থ একজনের মধ্যে সে মহাত্যের মানিক আভাটা আমরা দেখেছি। তাঁর উজ্জ্বল নাম- ফররুখ আহমদ’। ফররুখ আহমদের কোন সাহিত্য সচেতন পাঠকের কাছেই তাঁর এই আশ্চর্য পরিচয় ব্যাখ্যার প্রয়োজন করে না। তবু বলি, যারা শুধু এপাশ থেকে বা ওপাশ থেকে তাঁকে দেখেছে, অথবা নিজ নিজ ভাবনার দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর অসম্পূর্ণ পরিচয় নিয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন, আমার বিশ্বাস, ফররুখ আহমদের রচনাবলীর বিচিত্র দিকের সু-দৰ্শন তাদের দেখা ও জানাকে অনেকখানি সত্য ও পূর্ণ পরিধিতে উত্তীর্ণ করতে সাহায্য করবে।
কাব্য সাধনার অন্তকর্মী ফররুখ আহমদের প্রতিভার সঙ্গে যোগ হয়েছিল দিবারাত্রির পরিশ্রম। একজন আদর্শবাদীর আদর্শ চেতনার তাগিদ যখন একবার তাঁর প্রকাশের সত্যিকার বাহন এবং বিচরণের প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র খুঁজে পায়, নিরলস কর্ম সাধনাই তখন হয়ে পড়ে তাঁর ব্রত। ফররুখ আহমদ তাঁর ব্রত খুঁজে পেয়েছিলেন কাব্য সাধনার অঙ্গনে। এই ব্রত পালনে তিনি নিজেকে নিঃশেষে দান করেছেন- প্রথমত বাংলা সাহিত্যের কাছে, দ্বিতীয় সৌন্দর্যবোধের ও মানবতার মুক্তি সাধনের কাছে, এবং তৃতীয়ত তাঁর একান্ত ধর্ম বিশ্বাস ইসলামের কাছে।
আমার বিবেচনায়, বাংলা সাহিত্য তাঁর সমকালে এবং আজ পর্যন্ত তাঁর কাছে যা পেয়েছে, একক আর কোন সাহিত্য কর্মীর কাছে তা পায়নি। কাব্যের কুঞ্জে ফুল ফোটাবার বেলায় সৌন্দর্য ও মানবতা এক আপন ঐকান্তিক আদর্শ নিষ্ঠা অঙ্গাঙ্গী হয়ে তাঁর কলমে প্রেরণা, শক্তি ও সাফল্য জুগিয়েছে। তাঁর কবিতার যেসব পদ্ধতিতে এবং যেসব স্তবকে হাঁরামানিক জ্বল জ্বল করে উঠেছে, তা অনিবার্য আকর্ষণে আকৃষ্ট করে কাব্য পাঠক মাত্রাই।
কাব্যের উপজীব্য সন্ধানে ফররুখ আহমদ নতুন কোন মেরুর যাত্রী হননি বা নতুন কোন দ্বীপ দেশও আবিষ্কার করেননি। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল- বিশেষ করে এই তিন উজ্জ্বল পূর্বসূরী মনোগঠনে, ভাষা নির্মাণে এবং বিষয় ব্যবহারে প্রভাবিত করেছেন; অনুপ্রাণিত করেছেন মিলটন, শেলী, কাটস, টি.এস. এলিয়ট, হুইটম্যান, রুমী, ইকবাল প্রমুখ এবং আভাসিত করেছেন তার কোন কোন সমসাময়িকও। কিন্তু তাঁর সাফল্য এখানে এবং এখানেই তাঁর স্বকীয়তা যে, তিনি তাঁদের কারো প্রভাব বলয়েই আটকা পড়ে থাকেননি, বরং নিজের এক স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট কাব্য-পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছেন। একে বলা যায় অনেক বাগান দেখে এসে নিজের এক বাগান তৈরী করা, যা ঠিক আর কোনটার মতো নয়, এবং যে-বাগানের ফুল নতুন শোভা ও নতুন সুরভির দাবি করে। বাংলা কাব্যকর্মণার ক্ষেত্রে মহাসফল কৃষক রবীন্দ্রনাথ কোনখানে বলেছেন, “ভাবের বস্তু চির-পুরাতন, নতুনত্ব হচ্ছে তার প্রকাশের স্বকীয়তার মধ্যে। এই স্বকীয়তা সবার করায়ত্ত হয় না। যাঁর হয়, তিনিই নতুন কবি। কাব্য-ক্ষেত্রে তিনিই রাখেন নতুন অবদান।”
মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণের আগে ফররুখ আহমদের দিনগুলি রঙিন মখমল বিলাসে কাটেনি। তবু আমি জানি, শেষ নিঃশ্বাসের আগ পর্যন্ত অন্তরের অন্তস্থলে জাতির জন্য তিনি নতুন সফরের স্বপ্নকেই পালন করে গেছেন; পারলে বন্দী জীবনকে শুনিয়ে গেছেন ‘নোনা দরিয়ার ডাক‘। সে ডাকে যেমন মহৎ জীবনের অবিনাশী, উচ্ছ্বল সুর ধ্বনিত তেমন অনস্বর, অপরূপ চিত্রকলা প্রতীকায়িত। বাংলা সাহিত্যে ফররুখের অবদানের যখন সত্যিকার মূল্যায়ন হবে তখন এ সত্যকেই আমরা উদ্ভাসিত দেখতে পাব।
রেশমী চুড়ির রিনিঠিমি এবং আত্মরতির কলট দার্শনিকতা-সাহিত্য-কর্মের এই দুই অঞ্চলকে আমরা জানি এবং জানি এর আরেকটি অঞ্চলও রয়েছে। সে অঞ্চলের কর্মী সাহিত্যে ইতিহাসের কোন সময়ই দল বেঁধে আসেন না। সময়ের দূর ব্যবধানে আসেন এবং এক একটা যুগে একক অবদান রেখে সাহিত্যের ভাণ্ডারকে নতুন সম্ভারে সমৃদ্ধ করে যান। ফররুখ আহমদ তাঁদেরই একজন। এই তৃতীয় অঞ্চলটি অতল গভীর সৌন্দর্যের। সে সৌন্দর্য ক্ষণপ্রভার দিপ্তিতে-ক্ষণিক বিভ্রম সৃষ্টির বেসাতিতে ব্যস্ত নয় বলে সমকালে তার সত্যিকার মূল্যায়ন হয় না। তার ন্যূনতা এইখানে যে, উপস্থিতে ইতর রস-পিপাসা বা সাহিত্যিক ভোজবাজীর হুজুগে চাহিদাকে তা তপ্ত করতে পারে না। সাহিত্য সেখানে বিনোদন মাত্র নয়, ধ্যানীর অভিজ্ঞান, ত্রিকালদর্শী উপলব্ধি ও অন্তর্লীন অনুভূতির বাজনাই তার চরিত্র সমৃদ্ধ করে। রস এবং সৌন্দর্যের কারবার সেখানেও আছে, তবে তাই সে সাহিত্যকর্মের মূল উপজীব্য নয়, বরং তা মূল উপজীব্যের অবয়ব নির্মাণের সহগামী উপকরণ। ফুলের সৌন্দর্য কারো কাছে শুধুই বিনোদন-রূপ আর সুরভি। বহিরিন্দ্রিয়ের তাৎক্ষণিক আস্বাদন সাধনেই তার পরিতৃপ্তি। কিন্তু সেই ফুলই কারো কাছে বয়ে আনে বিমূর্ত আবাঙমানসগোচর অনির্বচনীয়ের অপরূপ রসারস। তাতে সমগ্র সৃষ্টির বিকাশ বেদনা এবং অনন্ত জীবনের অন্তর্লীন বাসীমূর্ত। এই সার্বিক দৃষ্টিতে ফুলের সঙ্গে কাঁটা ও কীটের উপসঙ্গ অস্বীকৃত নয়। অস্তিত্বের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সে দৃষ্টিতে ফোটে একই বিকশিত বা বিকাশমান গোলাপের সকল রূপ- ব্যাহত ও অনাহত সুরভি নিয়ে। ফররুখ আহমদ তাঁর সৃষ্টিতে করেছেন সেই ফুল ফোটানোরই সাধনা।
শিল্পী একজন মানুষ, যে মানুষের থাকে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা এবং লক্ষ্য ও আদর্শ। তা থেকে শিল্পের আধারে তিনি মানুষকে স্থায়ী কিছু বক্তব্য দিয়ে যান। মহৎ শিল্পী তাঁর ভাবনা এবং আদর্শ-চিন্তার চিনত্ব এবং মহত্ত্বের জন্যই মহৎ। সৃষ্টির বহিরভুকে সুষমা-মণ্ডিত করেই তার কাজ ফুরায় না। তার অন্তরকে জ্যোতিমান করে তোলাও তার চাই- যা থেকে একাধারে সুন্দরের, সত্যের কল্যাণের আলো বিচ্ছুরিত হবে। ফররুখ আহমদ সেই শিল্প-সাধনাকেই অবলম্বন করেছিলেন। সকল অর্থে সার্থক শিল্প সৃষ্টির বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও অনেক নির্জন আলাপে তিনি আমাকে বলেছেন- মহৎ জীবন-শিল্পীর মতই বলেছেন, কবিতার জন্য কবিতা লিখে খ্যাতি পাওয়া আমার লক্ষ্য নয়, আমার লক্ষ্য- আমার জীবন-দর্শনের শিল্প রূপায়ন। সমকালীন কবি-সত্ত্বা যদি তাতে আমাকে ছোট আসন দেয়, তাতে আমি পরোয়া করি না।
কোন কবিই তাঁর সকল পদ্ধতিই শিল্পের অনিন্দ্য পাখায় উড্ডীন করতে পেরেছেন, এমন নজির নেই। ফররুখ আহমদের তাঁর জীবন দর্শনের উপস্থাপনার অতি আগ্রহ হয়তোবা কখনো কখনো শিল্প নির্মাণকে ব্যাহত করেছে। তেমন ক্ষেত্রে তাঁর কোন কোন সৃষ্টি যদি সাধারণ ও সার্বজনীন শিল্প-রুচির অভ্যর্থনা না পায়, তাতে তার কোন আক্ষেপ নেই। সে-সব পদ্ধতি তার আদর্শ-সাধনার সমকালীন প্রয়োজনে লেগেছে, এই বোধ নিয়েই তিনি খুশী। এতে যদি কারো আনন্দ ক্লিষ্ট হয়ে থাকে সে সব হলে তেমন পাঠকের দৃষ্টি হয়তো কবির নিজেরও প্রার্থনীয় ছিল না। আমরাও বলি, তাঁর মূল্যায়ন করুন। সঙ্গে পাওয়া অন্যান্য ধাতু সম্পদ অন্য কোন দৃষ্টিতেই বাহুল্য বা মূল্যহীন না-ও হতে পারে, তাদের মূল্য সেই ভিন্ন দৃষ্টিতেই বিচারের জন্য তাঁরা ছেড়ে দিন। এটুকু সহৃদয়তা অজস্র সৃষ্টি সম্ভারের মালিক যে কোন বড় শিল্পী সঙ্গতভাবেই আশা করতে পারেন।
কিন্তু ফররুখ আহমদের বেলায় দেখা যাচ্ছে, কোন কোন মহল কাব্যের সামগ্রিক বিচারে এই সামান্য কনসেশনও তাঁকে দিতে রাজী নন। তাঁরা তাঁর সৃষ্টি শিল্প-গরিমাকে খাটো করে দেখাবার জন্য তাঁর শিল্প মূল্যে দুর্বলতার রচনাকে অবলম্বন করেন। সম্ভবত এর কারণ কেবল শিল্প মূল্য বিচারের মধ্যেই নয়, বরং অন্যত্র নিহিত। কিন্তু যে কারণেই হোক, যাঁরা তার সৃষ্টির অবমূল্যায়নের প্রয়াস পান তাঁরা ভুলে যান যে এতে কোন উদ্দেশ্যই সাধিত হবে না। কারণ অনাত্মীয় কাল ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রহারে কোন মহৎ শিল্পীরই মৃত্যু হয় না। ফররুখ আহমদের মৃত্যু নাই। আমার বিশ্বাস, আমাদের কালের বাংলা সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের পরে আর যাকে বেশী মনে রাখবে তাঁর নাম- ফররুখ আহমদ
বিবর্তন, ফররুখ স্মরণ সংখ্যা, প্রকাশকাল ১৯৮৬ সম্পাদক মোহাম্মদ বদরুল ইসলাম মুনীর!