প্রাক কথা
হযরত নূহ (আ)-এর সময়ের মহাপ্লাবনের পর তাঁর অন্যতম পুত্র হাম পৃথিবীর দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। হামের এক পুত্র হিন্দ যে অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন সে অঞ্চল হিন্দুস্তান বা হিন্দুস্থান। হিন্দের দ্বিতীয় পুত্র বড় উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। বঙ’র বংশধরদের আবাসস্থলই ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিত। বঙের সন্তান সন্ততিরা এ অঞ্চলে কতকাল বসবাস করেন তা জানা যায় না। প্রাচীনকালে নানা পরিবর্তনের ফলে ‘বঙ’ জনগোষ্ঠীর পরে ক্রমে নেগ্রিটো, অস্ট্রোলয়েড বা অস্ট্রো-এশিয়াটিক, মঙ্গোলয়েড বা ভোটচীনীয় ও দ্রাবিড় গোষ্ঠী এদেশে আসেন। তাদের অনেক পরে এ অঞ্চলে আর্যদের আগমন ঘটে। বঙ্ জাতির পর বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণেই বর্তমান ‘বঙ্গ’ জাতির আদি মানবগোষ্ঠী। আর্যরা হিন্দুস্থানে আসেন খৃষ্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। আর তারা হিন্দুস্থানের পূর্বাঞ্চলে আসেন এরও প্রায় দুই হাজার বছর পরে।
বাংলা ভাষার সৃষ্টি ও সমৃদ্ধিতে এসকল প্রাচীন জাতি ও গোষ্ঠীর অবদান প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে। এ দেশবাসীর জীবনে দ্রাবিড়দের প্রভাব সবচাইতে বেশি। মুন্ডা, কোল ইত্যাদির বঙ্গের অধিবাসীদের কাছে সংস্কৃত তথা বৈদিক ভাষার আবাসন অনেক পরের কথা। তাই বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সংস্কৃত ভাষাকে বাংলাভাষার ‘দূরবর্তী আত্মীয়’ হিসেবে এতে তার প্রভাব নগণ্য নয় বলে উল্লেখ করেছেন।
বৌদ্ধ ধর্মাশ্রিত চর্যাপদগুলোতে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন পাওয়া যায়। এগুলো বাংলায় পালদের শাসনামলে রচিত হয়। কাজেই বলা যায়, বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ লাভ ঘটে বৌদ্ধ আমলে, বিশেষ করে পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। কিন্তু পরবর্তীতে পাল রাজত্বের অবসানে আর্য সেন আমলে সাহিত্য ও রাষ্ট্রভাষায় সংস্কৃত আমদানি করে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা রহিত করা হয়। রাজাদের অনুসরণ করে শাস্ত্রবিদ পণ্ডিতগণও ‘দেবভাষ’ সংস্কৃত ছাড়া লোক ভাষায় শাস্ত্রালোচনা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। তারা ফতোয়া দেন: অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানিচ। ভাষায়াং মানব শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজের অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ ও রামচরিত ইত্যাদি ধর্ম শাস্ত্র ‘লোক ভাষায় শ্রবণ ও আলোচনা করলে রৌরব নরকে যেতে হবে। তাই দেখি খ্রিস্টীয় নবম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়।
এরপর প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলা ভাষা চর্চা শুরু হয় ত্রয়োদশ শতকে বঙ্গে মুসলিম বিজয়ের পর থেকে । বস্তুত মুসলমান সালতানাতের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রচেষ্টায়ই বাংলা ভাষা লালিত ও পরিপুষ্ট হয়। মুসলিম আমলেই বাংলার সত্যিকার বিকাশ ও স্ফূর্ত্তি ঘটে। বাংলায় মুসলিম আগমন না ঘটলে এবং মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কোনোদিন বর্তমান অবস্থায় পৌঁছতে পারত কিনা সন্দেহ। এ কথা ঐতিহাসিক সত্য যে, বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন বাংলাদেশ ও বাংলার জনগণের জন্য বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির রত্নভাণ্ডার খুলে দিয়েছে। মধ্যযুগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য মুসলিম আগমনের ফলেই সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করে। অনেকেই তাই মধ্যযুগকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলা ভাষায় কথা বলা এবং শাস্ত্রাদি আলোচনা ও কাব্য চর্চা যারা নিষিদ্ধ করেছেন, তাদের লক্ষ্য করেই আমাদের মধ্য যুগের কবি আবদুল হাকিম উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন: যে জন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে জন কাহার জন্ম নির্ণয়ন জানি । এ দেশে জন্মেও এদেশী ভাষার চর্চায় যাদের অনীহা, তারা এ দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায় না কেন, বলে তিনি তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। অনেকের ধারণা, আঠার-উনিশ শতকে যেসব বিদেশাগত মুসলমান ঘরে ও বাইরে ঊর্দু ভাষা ব্যবহার করা আভিজাত্যের লক্ষণ বলে মনে করতেন এবং এ দেশের নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলিম সমাজের ভাষা বলে বাংলাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতেন, আর সে কারণে বাংলায় কথা বলা ও সাহিত্য চর্চায় অনীহা প্রকাশ করতেন, তাদের সম্পর্কে কবি আবদুল হাকিম এ উক্তির মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ ধারণা ঠিক নয়। তিনি যে যুগে তার কাব্য রচনা করেছেন, সে যুগে উর্দু বাংলার তর্ক যুদ্ধ সৃষ্টি হয়নি। এ তর্ক যুদ্ধ সৃষ্টি হয়েছে ইংরেজ আমলে। এ সময় আধুনিক বাংলা সাহিত্য পদ্যে-গদ্যে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলেছে। পরে বিশ শতকে এসে সে বিতর্কও মিটে যায়। বঙ্গে বাংলা ভাষা চর্চার হিন্দু-মুসলিম অধিকার স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষা সম্পর্কে আলোচনায় এ কথাগুলি স্মরণ রাখতে হবে। বাংলা ভাষার নিজস্ব উপাদান ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আলোচনা দিয়েই আমাদের ভাষা আমাদের সংস্কৃতি’ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করতে চাই।
বাংলা ভাষার উপাদান
রূপের (Form) দিক থেকে বিবেচনা করে বাংলা ভাষার শব্দ সম্ভারকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১.দেশেজ বা খাঁটি বাংলা শব্দ
২. তৎসম
৩. অর্ধ তৎসম
৪. তদ্ভব ও
৫. অন্যান্য ভাষার শব্দ।
আমাদের সাহিত্যে ব্যবহৃত সাধু রীতির ভাষার প্রতি একশ শব্দের মধ্যে দুটি দেশজ, চুয়াল্লিশটি তৎসম, পঞ্চাশটি অর্ধতৎসম ও তদ্ভব এবং চারটি অন্যান্য ভাষার শব্দ। আদর্শ বা মান চলিত রীতির (Standard Collaquial Style ) ভাষার শব্দ সম্ভারের শতকরা পাঁচটি খাঁটি বাংলা বা দেশজ, দশটি তৎসম, পাঁচটি অর্ধ-তৎসম, সত্তরটি তদ্ভব, আটটি অন্যান্য ভাষার এবং দু’টি অজ্ঞাত মূল ভাষার।
১. দেশজ বা খাঁটি বাংলা শব্দ
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে কিংবা তার সামান্য কিছু আগে বাংলাদেশে আর্য সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্যদের আসার আগে এদেশে কোল ও তিব্বতী বর্মী এবং অল্প সংখ্যক দ্রাবিড় মালতো জাতির লোক বাস করত। তাদের নিজস্ব ভাষায় কোনো পুস্তকাদি লেখা হয়েছিল কিনা, আমাদের জানা নেই। আর্যরা এদের সংস্পর্শে এলে এদের ভাষার কিছু কিছু উপাদান ভারতীয় আর্য ভাষার সঙ্গে তথা সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশের সঙ্গে মিশে যায়। এসব শব্দ অত্যন্ত সাধারণ ও সুপরিচিত এবং সংখ্যায়ও প্রচুর। অনেক সময়ে এসব শব্দের মূল নির্ধারণ দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এ শব্দগুলো বাইরের কোনো ভাষা থেকে আসেনি। এগুলো এসেছে দেশের প্রাচীনতর অধিবাসীদের ভাষা অস্ট্রিক বা অন্য কোনো ভাষাবংশ থেকে। আর্যদের সঙ্গে আর্য ভাষা আসার আগে বাংলায় আর্যের ভাষার যেসব উপাদান পাওয়া যায় এবং যেসব উপাদান আর্যভাষা আসার পরেও হুবহু বা কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে রয়ে গেছে যেগুলোই দেশজ বা খাঁটি বাংলা।
এ কথা ঐতিহাসিক সত্য যে, কোল বা মুন্ডা ভাষাভাষী লোকই আর্যদের আসার অব্যবহিত আগে এদেশে বসবাস করত। আর সে কারণেই কোল বা মুন্ডা ভাষার সঙ্গেই বাংলা ভাষার বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। বাহ্যত মনে হতে পারে যে, বাংলা ভাষায় কোল ভাষার প্রভাব পড়েছে। বস্তুত একে প্রভাব না বলে সগোত্রীয়তা বা মিল বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। কোল ভাষার সঙ্গে যে মিল দেখা যায় সেটি যেমন কোল ভাষার তেমনি বাংলা ভাষারও নিজস্ব উপাদান । এ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আর্য ভাষা থেকে আগত গৌড় অপভ্রংশ মিলে গিয়ে উভয়ে মিলিতভাবে বাংলা ভাষার উদ্ভব, বিকাশ ও সমৃদ্ধির দ্বার খুলে দিয়েছে। পরে এর সঙ্গে অন্যান্য উপাদান যুক্ত হয়েছে। আমরা বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারি।
শব্দ সম্ভার (Vocabulary )
বাংলা ভাষায় বস্তু, ভাব ও ক্রিয়াবাচক বহু শব্দ রয়েছে, যেগুলো কোনো বিদেশী ভাষা থেকে আসেনি অথচ সংস্কৃত বা আর্য-ভাষার শব্দ বিভক্তি বা ধাতু প্রত্যয়ে নিষ্পন্ন বলেও ব্যাখ্যা করা যায় না। এগুলো দেশজ শব্দ। যেমন,
বস্তু ও ভাব বাচক বা বিশেষ্য বাচক শব্দ
আকাল, আখড়া, আড্ডা, আমড়া, কাড়া, কামড়, কালা, কুড়ি, কলা, কোন্দা, খচ্চর, খুঁটি, খোঁড়া, খোপা, গন্ডা, গাড়ি, গোড়া, ধুড়ি, ঘেঁচি, ঘোমটা, চাইচি, চটি, চাউল, চাঙ্গারী, চুলা, চোঙ্গা, চোপা, ছাল, ঝাঁটা, ঝাড়, ঝাণ্ডা, ঝানু, ঝিঙা, ঝিঞা, ঝোল, টপক, চৌপার, ঠেঙ্গা, ঠোঙ্গা, ডাগর, ডাব, ডাসা, ডাহা, ডিঙ্গা, ডিঙ্গি, ডিঙ্গানো, ডেকরা, ডেসা, ডোকনা, ডোঙ্গা, ডোমা, ঢাল, ঢিল, ঢেউ, ঢেঁকি, ঢেপসা, ঢোল, তেনা, তেলাপোকা, তোতলা, থেতলা, দেওর, নেঙ্গা, পাড়া, নেট, পেতনা, মন্ডি ইত্যাদি।
ক্রিয়া বাচক শব্দ
এডু, চাট, নড়, ইত্যাদি ধাতু থেকে গঠিত ক্রিয়া বাচক শব্দ। এ শ্রেণীর অনুরূপ কিছু শব্দ সংস্কৃতেও পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলো যে সংস্কৃত বা আর্য ভাষা জাত নয়, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা নয়। এগুলো সংস্কৃতে রূপ পরিবর্তিত কৃতঋণ শব্দ। যেমন-লাড়ু লা-ডুক, খাড়খাড়ুক, তেতুল- তেওলী-তিন্তিড়ী, হাড়ি-হার্ডিক ইত্যাদি। আবার প্রাকৃত স্তরেও অনুরূপ কিছু শব্দ পাওয়া যায়। যেমন চাঙ্গা-চাঙ্গ, পেট-পোর্ট, ছটফট-চড়পড়, চাদা-চটি ইত্যাদি। দেশজ এসব শব্দ বিভিন্ন সময়ে আর্য ভাষায় প্রবেশ লাভ করেছে। তাই সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ ও বাংলা-সবস্তরেই এগুলোর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষার কিছু শব্দ সংস্কৃতে গৃহীত হয়ে ধীরে ধীরে প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষার স্তর পর্যন্ত এসেছে। সেগুলো খাঁটি বাংলার রূপ রক্ষা করতে পারেনি। তাই এগুলোকে খাঁটি বাংলা না বলে আর্য ভাষার মাধ্যমে আগত দেশী ভাষার অপভ্রংশ বা তদ্ভব রূপ হিসেবে গ্রহণ করাই বেশি যুক্তিসঙ্গত। যেমন, কলা <কদলী, ডিম< ডিম্ব, টোড়া< ডুতুভ, তামলী< তাহলিক ইত্যাদি। আবার কতকগুলো শব্দ বাংলা ও কোল ভাষা থেকে সংস্কৃত ভাষায় অবিকৃত অবস্থায় গৃহীত হয়েছে। যেমন অলাবু, তাম্বুল, ময়ূর ইত্যাদি। বাংলা ভাষার উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো কোল বা মুন্ডা ভাষায়ও বিদ্যমান বিধায় অনেকেই এগুলোকে বাংলা ভাষার কোল বা মুন্ডা ভাষার প্রভাব বলে উল্লেখ করেছেন। বস্তুত এগুলো বাংলায় কোল ভাষার প্রভাব নয়, বরং দুই ভাষার সগোত্রীয়তা প্রমাণ করে। এই দুই ভাষাভাষী লোক যে একদা একত্রে বসবাস করতো এবং একই ভাষায় কথা বলতো, একথা ঐতিহাসিক সত্য ।
২. তৎসম শব্দ
আধুনিক বাংলায় যে সব শব্দ সংস্কৃত থেকে অপরিবর্তিত রূপে গৃহীত হয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় তৎসম শব্দ (‘তৎ’ অর্থাৎ সংস্কৃত, ‘সম’ অর্থাৎ অভিন্ন)। যেমন, অন্ন, আকাশ, কাৰ্য, গৃহ, প্রভাত, মস্তক, হস্ত ইত্যাদি। সংস্কৃত সাহিত্যে যেসব শব্দের প্রয়োগ নেই, যেসব শব্দ সংস্কৃত অভিধানে গৃহীত হয়নি এবং যেসব শব্দ সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মে সিদ্ধ নয়, এমন কিছু শব্দ সাধারণ্যে ব্যবহৃত কথ্য সংস্কৃতে প্রচলিত ছিল। আবার এ ধরনের কিছু নতুন শব্দ তৈরিও হয়েছে। এভাবে অনেক শব্দ বাংলায় নিজস্ব স্থান করে নিয়েছে। এগুলোও তৎসম শব্দ। যেমন অন্ধল (অন্ধ ব্যক্তি), আকুলি (আকুল) কৃষাণ, ঘর, চাল, টঙ্গ, ডাল (শাখা), নবল, নওল (নতুন) ইত্যাদি।
৩. অর্ধ তৎসম শব্দ
যেসব শব্দ একদা সংস্কৃত থেকে বাংলায় অবিকৃত রূপে গ্রহীত হয়েছিল, কিন্তু কালের বিবর্তনে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হয়েছে, সেগুলো অর্ধ-তৎসম শব্দ। যেমন কেষ্ট-কৃষ্ণ, কুচ্ছিত <কৃৎসিত, গিন্নী< গৃহিনী, চিত্তির< চিত্র, ছেদ্দা< শ্রদ্ধা, জোছনা<জ্যোৎস্না, বোষ্টম< বৈষ্ণব, রাত্তি< রাত্রি ইত্যাদি।
৪. তদ্ভব শব্দ
যেসব শব্দ প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা কিংবা সংস্কৃত ভাষা থেকে মধ্য-ভারতীয় আর্য ভাষা অর্থাৎ প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মাধ্যমে ধারাবাহিক বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে, সেসব শব্দকে বলা হয় তদ্ভব শব্দ (‘তৎ’- সংস্কৃত+’ভব’-উৎপন্ন, অর্থাৎ সংস্কৃত জাত) ইন্দো ইয়োরোপীয়-অন্যান্য ভাষার শব্দ এবং অস্ট্রিক, তিব্বতী বর্মী, দ্রাবিড়, চীনা ইত্যাদি ভাষাগোষ্ঠী থেকে আগত শব্দ এ শ্রেণীতে রয়েছে। এসব প্রাচীন আগন্তুক শব্দ আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। এগুলো প্রথমে সংস্কৃতে কিংবা প্রাকৃতে গৃহীত হয়ে পরে বিবর্তনের ধারা বেয়ে বাংলায় এসেছে।
প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা বা সংস্কৃত ভাষা থেকে প্রাপ্ত তদ্ভব শব্দ আড়াই<প্রা° অডঢতইঅ<স অর্ধ তৃতীয়; আইশে প্রা° আবিসই সে আবিশতি; ইঁদারা<প্রা” ইন্দাআর সে ইন্দ্রাগার; উনান< প্রা” উনহারণ<স উষ্ণাপন; এগার প্রো এ্যাগারহসে° একাদশ; ওঝা প্রা° উজঝাঅ স° উপাধ্যায়; কনুই<প্রা° কহোনিআসে ত কফোনিকা; খাজাপ্রা° খজর্জ< স° আদ্য; গায়< প্রা° গাঅই< স° গায়তি; নাপিত প্রো।
অন্ত্রিক ভাষাগোষ্ঠী থেকে গৃহীত তদ্ভব শব্দ নগ্নিঅ <স° নক; রানী< প্রা° রন্নিআ< স° রাজিজ্ঞকা; ষোল প্রো° সোলহ <স° ষোড়শ। ঢাকা<প্রা° ঢক্কসে ঢক্ক; ঢোকে<প্রা° ঢুক্কই সে° ঢৌকয়তি; প্রাচীন বাংলা দুলে প্রাত দুলি <সে দুলি; টঙ্গ <স টঙ্গ সে টঙ্ক, প্রাচীন বাংলা তা বোলা সে তাম্বুল ইত্যাদি। এ ধরনের অনেক প্রতি শব্দের মূল সংস্কৃতে পাওয়া যায় না। সেগুলো অজ্ঞাতমূল শব্দ। যেমন, উচ্ছে, ঝিঙা, খোকা, খুকি, ডেঙ্গর (উকুন), ডেলা, ঢেঙ্গা, পুঁজাল, লিক, ইত্যাদি।
ইন্দো ইয়োরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকে গৃহীত তদ্ভব শব্দ। দাম প্রো° দক্ষ সে° দ্রমা< গ্রীক প্রাথমে Drakhme (মুদ্রাবিশেষ); সুড়ঙ্গ<প্রা: সুরঙ্গ সে সুরঙ্গ <গ্রিক সু রিস Surinks; সিমুই সিমাই সেমাই <প্রা° সমিতা সে সমিতা <গ্রিক সেমি দালিশ Semidalis (ময়দা); মুদ্রা প্রা° মুদ্দ সে মুদ্র (মিশরী সিলমোহর) < পাহলবী মুদ্রায় (অর্থাৎ মিশর); কাহণ <প্রা° কহব স° কর্যাপন (মুদ্রাবিশেষ) < পাহলবী কর্ম (বস্তমান বিশেষ)+পণ ইত্যাদি।
মোঙ্গল গোষ্ঠী থেকে ইরাপীয় মাখার মারফত গৃহীত তদ্ধৰ শব্দ ঠাকুর< প্রা° ঠকুকুরসে ঠকুর< তুর্কী তেগর; তুরুক (সওয়ার) <প্রা’ তুরুক< স° তুর্কী, তুর্ক ইত্যাদি।
দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠী থেকে গৃহীত তদ্ভব শব্দ ইচলা (মাছ)<প্রা° ইঞ্চঅ< স° ইঞ্চক (<তামিল ইরভু), উলু (খড়)< প্রা” উলুম <স’ উলুপ(<তামিল উলুটব-ঝোপ), কুড় (বিঘা) <প্রা° কুডব< স কুটপ (<তামিল কুলকম কঠিন ও তরল পদার্থের মান), খাল প্রো’ খ ” খল্প (<তামিল কাল); ঘড়া প্রো ঘড় স ঘট (<তামিল-মলয়ালী-কুটম; কানাড়ী কোড); পিলে (ছেলেপিলে) <প্রা° পিল্লিআ; পিলু সে° পিল্লিক (<তামিল পিল্লৈ-শাবক); মোট (বোঝা) < প্রা°-মুডঅ (সত মুকট (<তামিল মুটে) ইত্যাদি।
লেখায় তৎসম কিন্তু উচ্চারণ তদ্ভব এমন অনেক শব্দ আছে যেগুলোকে বাংলায় তৎসম ও তদ্ভব দুই-ই বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে শব্দগুলো উচ্চারণে ‘তদ্ভব’ হয়ে গেছে, লেখায় কোথাও কোথাও তৎসমের ছাপ বিদ্যমান যেমন, জল। অন্তে অকারসহ দুই অক্ষর বিশিষ্ট উচ্চারণে সংস্কৃত বা তৎসম এবং অন্তে স্বর উচ্চারণ না করে একাক্ষরবিশিষ্ট উচ্চারণে ‘জল’ তদ্ভব। এরূপ করণ, চলন, দশ, ধন, বন, ভর, রস ইত্যাদি।
একই শব্দের অর্ধতৎসম ও তদ্ভব রূপ অনেক সময় একই শব্দের অর্থ তৎসম ও তদ্ভব দুই রূপে কিংবা তদ্ভব শব্দের দুই রূপান্তর যমজ হিসেবে বিভিন্ন অর্থে প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন, শ্রদ্ধা? >সাধ, ছেদ্দা; ক্ষার> খার, ছার; ক্ষুদ্র> খুন, ঘুড়া; কক্ষ> কাঁখ, কাছ ইত্যাদি। কুচিৎ সগোত্র ভিন্ন ভাষার শব্দও পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়। যেমন, গোলাপ-জোলাপ, চরকা- চাকা, দেব-দেও, চিত্র-চেহারা, বাধা-বস্তা, বাহু- বাজু, মিশ্র-মিহির, মুদো (মুদ্রা)- মোহর, সন- সাল, সপ্তাহ- হপ্তা ইত্যাদি।
৫. অন্যান্য ভাষার শব্দ
রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, ধর্মীয় ও সংস্কৃতিগত কারণে বাংলাদেশে আগত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বহু শব্দ ও ব্যাকরণ গত উপাদান বাংলায় এসে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাভাষা অন্যান্য যে সমস্ত ভাষার কমবেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে এসে সেসব ভাষার শব্দ সঞ্চয় করেছে, সেগুলোর মধ্যে প্রধান হল :
১. ফারসি,
২. আরবি
৩. পর্তুগীজ,
৪. ওলন্দাজ ও
৫. ইংরেজি।
এছাড়া তুর্কী, ফরাসি এবং গ্রিক ভাষার কিছু শব্দ এবং এদিকের ভারত, ব্রহ্মদেশ, মালয়, চীন, জাপান, এসব দেশের ভাষারও কিছু শব্দ এসে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। খ্রিস্টীয় তের শতকের শুরুতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী তুর্কীরা পশ্চিমবঙ্গ অধিকার করেন সমগ্র বাংলাদেশে মুসলিম অধিকার বিস্তৃত হতে আরো প্রায় শতেক বছর লেগে যায়। এ সময় থেকে গৌড়ের পাঠান সুলতান ও তাদের অমাত্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। সম্রাট আকবরের সময়ে (১৫৪২-১৬০৫) বাংলাদেশ মুঘল সালতানাতভুক্ত হয়। এ সময়ে রাজ সরকারের ভাষা ছিল ফারসি। ইংরেজ আমলে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকাল পর্যন্ত এদেশে রাজকার্যে ফারসি ভাষার প্রভাব ছিল। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে যখন ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি রাজ ভাষা রূপে গৃহীত হয়, তখন থেকে বাংলা ভাষায় ফারসি ভাষার প্রভাবের অবসান ঘটে। এ দীর্ঘ ৬০০ বছরের মুসলিম প্রভাবের ফলে বাংলা ভাষায় কয়েক হাজার ফারসি শব্দ এবং ফারসির মাধ্যমে প্রচুর আরবি আর কিছু তুর্কী ও পোশতু শব্দ প্রবেশ লাভ করে। বাংলায় সেসব শব্দের উচ্চারণও অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ফারসির প্রভাবে আরবি শব্দের এবং পরে বাংলার প্রভাবে ফারসির মারফতে আগত আরবি শব্দের ধ্বনিরও বেশ পরিবর্তন ঘটেছে।
১। ফারসি প্রভাব
ফারসি থেকে গৃহীত শব্দগুলোকে প্রধানত সাত ভাগে বিভক্ত করা যায় :
১. রাজ্য ও যুদ্ধবিগ্রহ সম্বন্ধীয় শব্দ
কামান, খাযানা, খাস, খেতাব, খেলাত, জখম, জমি, জমিদার, জাহাজ, তখত, তহশীল, তহশীলদার, তালুক, তালুকদার, তীর, তোপ, নবাব, ফৌজ, বাদশাহ, বাহাদুর, বেগম, রশদ, শহর, সেপাই ইত্যাদি।
২.আইন আদালত সংক্রান্ত শব্দ
আইন, আসামী, কয়েদ, কানুন, জরিমানা, জেরা, তামাদি, দারোগা, নাযির, নালিশ, পেয়াদা, পেশকার, ফয়সালা, ফরিয়াদ, মিয়াদ, মোকদ্দমা, মোয়াক্কেল, মোক্তার, রায়, সালিশ ইত্যাদি।
৩. ধর্ম সম্বন্ধীয় শব্দ
ওযু, খোদা, গুনাহ, জায়নামায, দরবেশ, দোযখ, পেশ ইমাম, ফিরিশতা, বেহেশত, মোল্লা, মৌলবী, মরদ, মুসলমান, রোযা ইত্যাদি।
৪. শিক্ষা সম্বন্ধীয় শব্দ
আদব, আদাব, আরয, আলেম, কাগজ, কেচ্ছা, খবরদার, গযল, পীর, বুযুর্গ, সরফরাজ ইত্যাদি।
৫. সভ্যতার উপকরণ সংক্রান্ত শব্দ
আচকান, আতর, আয়না, কালিয়া, কোপ্তা, কোরমা, গুলিস্তা, গোলাপ, চশমা, জামা, দালান, পোলাও, বরফ, বাগিচা, বাদাম, মখমল, মিছরী, রুমাল, শিরনী, হালুয়া ইত্যাদি।
৬. জাতি ও ব্যবসায় সংক্রান্ত শব্দ
ইহুদী, কলাইকর, কসাই কারিগর, খানসামা, খানা, খিদমত, খিদমতগার, চাকর, জাদুকর, দরজী, দোকানদার, নফর, ফিরিঙি, বাজিকর, ভিত্তি, মেথর, সহিস, হিন্দু ইত্যাদি।
৭. সাধারণ দ্রব্য, ভাব, বিষয় ইত্যাদি সম্বন্ধীয় শব্দ
আওয়ায, আখরোট, আব, আতশ, আফসোস, কম, কিসমিস, কোমর, গরম, তাজা, দরবার, নরম, নাম, পছন্দ, পেশা, বদল, বাহবা, বেশি, মযবুত, লাল, সবুজ, সফেদা, সেপায়া, সেতার, হযম, হরদম, হাওয়া, হুশিয়ার ইত্যাদি।
এমন কি বাংলা ব্যাকরণেও ফারসি প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নর পায়রা মাদী পায়রা, মর্দা বা মদ্দা কুকুর, মাদীকুকুর ইত্যাদি রূপে শব্দের লিঙ্গ নির্দেশনা ফারসি প্রভাবের ফল। ফারসিতে ‘নর’ ও মাদা অর্থজ্ঞাপক শব্দ বিশেষ্যের পরে ব্যবহৃত হয়। যথা, গাও নৱ (ষাঁড়, গাও মাদা (গাভী)। বাংলায় স্ত্রী বা পুরুষ বাচক শব্দ বিশেষ্যের আগে প্রযুক্ত হয়। এ প্রয়োগ বাংলায় নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। সমগোত্রীয় কোল বা মুন্ডা ভাষায়ও এ লক্ষণ বিদ্যমান। ফারসিতে ‘মুরগ’ মানে পাখি। এর সাথে স্ত্রীবাচক প্রত্যয় ‘ যোগ করে বাংলায় মুরগী শব্দটি তৈরি হয়েছে। বাংলায় মোরগ মানে পুরুষ মোরগ আর মুরগী মানে স্ত্রী মোরগ। ফারসিতে মুরগী নেই। কতগুলি ফারসি তদ্ধিত প্রত্যয় ও উপসর্গ বাংলায় বেমালুম মিশে গিয়েছে।
ফারসি থেকে গৃহীত তদ্ধিত প্রত্যয় ঈ : ইরানী, দেশী, বিলাতী ইত্যাদি।
কর : যাদুকর, ধুনাইকর, করাইকর ইত্যাদি।
ঘোর : আফিমখোর, গাঁজাখোর, গুলিখোর, চমশখোর, হারামখোর ইত্যাদি।
গিরি : কেরানীগিরি, বাবুগিরি, বাবুটিগিরি, বান্দীগিরি ইত্যাদি দান : পানদান, পিকদান ইত্যাদি।
দানী : আতরদানী, নিমকদানী, ফুলদানী, সুরমাদানী ইত্যাদি।
দার : তহসিলদার, দোকানদার, পোদ্দার, শিকদার ইত্যাদি। দারী: আয়মাদারী, তহসিলদারী, ফৌজদারী, মনসবদারী ইত্যাদি।
বাজ : ধড়িবাজ, ফন্দিবাজ, মামলাবাজ ইত্যাদি।
ফারসি থেকে গৃহীত উপসর্গ
কম (স্বল্প অর্থে) : কম আক্কেল, কমজোর, কমপোখত, কমবখত ইত্যাদি। কার (কাজ অর্থে) : কারখানা, কারচুপী, কারবার, কারসার্জ ইত্যাদি।
দর (অধীন, মধ্যস্থ অর্থে) : দরকার, দরখাস্ত, দরদালান, দরপত্তন, দরপাট্টা ইত্যাদি।
না (না-অর্থে) : না-কাম, নাখোশ, নাচার, নামঞ্জুর, নামরদ, নারায, নালায়েক ইত্যাদি।
নিম (আধা অর্থে) : নিমখুন, নিমমোল্লা, নিমরাজি ইত্যাদি ।
ফি (প্রতি অর্থে) : ফি-বছর, ফি-মাহিনা, ফিরোজ, ফি-সন, ফি- হপ্তা ইত্যাদি।
ব (সহিত অর্থে) : বকলম বনাম, বমাল ইত্যাদি।
বদ (মন্দ অর্থে) : বজ্জাত, বদবখত, বদমেজাজ, বদমাশ, বর (বাইরে, মধ্যে) বরখাস্ত, বরখেলাপ, বরদাস্ত ইত্যাদি। বদরাগী, বদহাল ইত্যাদি।
বে (না অর্থে) : বেআক্কেল, বেআদব, বেকসুর, বেকায়দা, বেকার, বেখবর, বেগতিক, বেতার, বেনজীর, বেমওকা, বেমালুম, বেলেহাজ, বেশরম, বেহাত, বেহায়া, এমনকি বে-হেড ইত্যাদি।
সে (তিন অর্থে) : সেতার, সেপায়া ইত্যাদি।
এসব শব্দ ও ব্যাকরণ সংক্রান্ত উপাদান বাংলা ভাষার অস্থিমজ্জার সঙ্গে মিশে গিয়েছে। অনেক সময় এগুলোকে অন্য ভাষার শব্দ বলেই মনে হয় না।
২। আরবি প্রভাব
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি শব্দের বেশির ভাগই ফারসির মাধ্যমে বাংলায় এসেছে। তাই এগুলোর উচ্চারণ প্রায় সর্বত্রই বিকৃত হয়ে গেছে। বাংলায় আগত আরবি শব্দগুলোকে প্রধানত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১. প্রশাসনিক ও আইন আদালত সম্পৰ্কীয় শব্দ
আদালত, আরবি, আলামত, উকিল, এজলাস, ওজর, কসম, কানুন, খারিজ, মহকুমা, মুন্সিফ, রায়, হাজত ইত্যাদি।
২. ধর্ম সম্বন্ধীয় শব্দ
আল্লাহ, ইসলাম, ঈদ, ঈমান, কুরআন, কোরবানী, কিয়ামাত, জান্নাত, জাহান্নাম, তওবা, তাসবীহ, তেলাওয়াত, যাকাত, রাসুল, হাদিস, হারাম, হালাল ইত্যাদি।
৩. শিক্ষা সংক্রান্ত শব্দ
ওস্তাদ, কলম, কাবিল, কিতাব, কিচ্ছা, কুরসী, খাতা, গায়েব, জামায়াত, তাওহিদ, তাফসীর, তরজমা, দাখেল, দোয়াত, নগদ, ফাজিল, বাকী, বিদায়, মুর্শিদ, মুসলিম, হাযির ইত্যাদি ।
৪. সংস্কৃতি ও বিবিধ বিষয়ক শব্দ
আক্কেল, আখেরাত, আদম, আদমী, আদাব, আতর, আর, কবর, কিসমাত, খাস, তফিক, তসলীম, তাজ্জব, তামাদ্দুন, তালিম, তাহযীব, দফা, দুনিয়া, বিদায়, মজলিস, মনজিল, মাকসুদ, মাহফিল, মিলাদ, হাশর ইত্যাদি।
এছাড়া কিছু আরবি শব্দ উপসর্গরূপে বাংলায় প্রবেশ লাভ করেছে। এগুলো ফারসি থেকে আগত উপসর্গের মতই বাংলা শব্দের সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে।
৫. আরবি থেকে গৃহীত উপসর্গ
আম (সাধারণ অর্থে) : আম দরবার, আমমোখতার ইত্যাদি।
খয়ের (ভালো অর্থে) : খয়ের খা ইত্যাদি।
খাস (বিশেষ অর্থে) : খাসকামরা, খাসদখল, খাসদরবার, খাসনবীশ, খাসমহল ইত্যাদি।
গর, গায়র (অভাব অর্থে) : গরমিল, গরমওসুম, গররাজি, গর হাজির ইত্যাদি।
বাজে (বিবিধ অর্থে) : বাজে কথা, বাজে খবর, বাজে নাম, বাজে লোক ইত্যাদি।
লা (না অর্থে) : লা-ওয়ারিশ, লাখেরাজ, লা-জওয়াব, লাপাত্তা, লা-মাযহাব।
৩। তুর্কী শব্দ
আলখাল্লা, উজবুক, উর্দু কাঁচি, কুলী খাতুন, খাঁ, খানম, গালিচা, চাকর, চাকু, চিক, তাক, তুর্ক, তোপ, দারোগা, বাবুর্চি, বাহাদুর, বেগম, বিবি, বোচকা, মুচলেকা, লাশ, সওগাত ইত্যাদি।
৪। পোশতু শব্দ
পাখতুন, পোশত, পোস্তান (বইয়ের), শেরওয়ানী, সরাই-খাম ইত্যাদি।
৫। পর্তুগীজ শব্দ
পনের শতকের শেষের দিকে কিংবা ষোল শতকের শুরুর দিকে পর্তুগীজরা প্রথমে ভারতের পশ্চিম উপকূলে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে থাকে। পরে পর্তুগীজ শাসক ননু দ্য কুনহা (Nonu da Cunha ১৫২৮-১৫৩৮) সর্বপ্রথম বাংলাদেশে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি বাংলার সুলতান মাহমুদ শাহকে শেরশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য (১৫৩৪ খ্রিঃ) চারশ পর্তুগীজ সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন। এদের অনেকেই পরে ব্যবসা বাণিজ্যে মনোযোগী হয় এবং কেউ কেউ এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। চট্টগ্রামের দেয়াং এলাকায় এবং পশ্চিমবঙ্গের ব্যান্ডেলে তাদের উপনিবেশ ও ব্যবসা বাণিজ্য ছিল। ইংরেজদের আসার আগে পর্তুগীজদের প্রভাব এত বেশি ছিল যে, অনেক বাঙালি পর্তুগীজ ভাষায় কথা বলতে পারতেন। দৈনন্দিন ব্যবহার্য কতকগুলো প্রচলিত শব্দ পর্তুগীজ ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় মিশে গেছে। এখনো পর্তুগীজ ভাষার শতাধিক শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়। যেমন, আনারস, আলকাতরা, আলপিন, ইস্পাত, কপিকল, কামরা, কাবাব, গামলা, গুদাম, গরাদে চাবি, জানালা, জালা, চোকা, তোলা, নিলাম, নোনা, পাঁউ, পেরেক, ফিতা, বালতি, বেশালী, মার্কা মাতুল, মিস্ত্রী, ফূর্তি ইত্যাদি ।
৬। ওলন্দাজ শব্দ
ওলন্দাজ ভাষা থেকে তাসখেলার কিছু শব্দ এবং অন্যান্য শব্দ বাংলায় গৃহীত হয়েছে। যেমন, ইস্কাপন, চিড়িতন, রুইতন, হরতন, তুরুপ, ইসক্রুপ, গাড়ির বোম, পিসপাস, ওলন্দাজ দিনেমার, আলেমান, ইংরেজ ইত্যাদি।
৭। ফরাসি শব্দ
কার্তুজ, কুপন, গ্যারাজ, ডিপো, বনবন, বিস্কুট, বরুল, রেস্তোরা ইত্যাদি।
৮। ইংরেজি শব্দ
আঠার শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশ ইংরেজ শাসনে আসে। কিন্তু বাংলা ভাষায় ইংরেজির ব্যাপক প্রভাব শুরু হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। এ প্রভাব ক্রমমান হারে বাংলা শব্দকোষ ও প্রয়োগ রীতির ওপর পড়েছে। প্রচুর পরিমাণে ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং এখানো হচ্ছে। ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি পৃথিবীর নানা স্থানের নানা ভাষার শব্দ প্রথম ইংরেজিতে গৃহীত হয়ে পরে ইংরেজি শব্দ রূপেই বাংলায় এসেছে। বাংলায় কৃতঋণ ইংরেজি শব্দগুলোকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায় :
১. অনেকটা খাঁটি ইংরেজি উচ্চারণের অনেক শব্দ বাংলায় এসেছে।
যেমনঃ ইউনিভার্সিটি, ইউনিয়ন, কলেজ, টিন, নভেল, নোট, পাউডার, পেন্সিল, ফুটবল, ব্যাগ, ব্যাংক, মাস্টার, মানি অর্ডার, লাইব্রেরি, হকার ইত্যাদি।
২. অনেক ইংরেজি শব্দের রূপ ও ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় গৃহীত হয়েছে।
যেমনঃ আফিম, আপিস, ইস্কুল, ইস্টিশন, বাক্স, বোতল, হাসপাতাল ইত্যাদি।
৩. কতকগুলো ইংরেজি শব্দ বাংলায় সমাসযুক্ত পদে উপসর্গের মত ব্যবহৃত হয়।
যেমনঃ ফুল: ফুলজামা, ফুলপ্যান্ট, ফুলমোজা, ফুলহাতা ইত্যাদি।
হাফ : হাফ ছুটি, হাফ নেতা, হাফ প্যান্ট, হাফ মোজা, হাফ হাতা ইত্যাদি।
হেড: পণ্ডিত, হেড মাস্টার, হেড মিস্ত্রী, হেড মৌলভী ইত্যাদি।
সাব : সাব-অফিস, সাব ইনস্পেকটর; সাব জজ ইত্যাদি।
৯। বর্মী শব্দ : ফুঙ্গী, লুঙ্গি ইত্যাদি।
১০। চীনা শব্দ : গুলচি, চা, চিনি, লিচু, লুচি, সাকুরা, সার্টিন ইত্যাদি।
১১। জাপানী শব্দ : রিক্সা, হারিকিরি, হারিকেন ইত্যাদি।
১২। তিব্বতী শব্দ : লামা, শেরপা ইত্যাদি।
১৩। রুশ শব্দ: বলশেভিক, মস্কোভিচ, সোভিয়েত ইত্যাদি।
১৪। দক্ষিণ আফ্রিকী শব্দ : গন্ডোলা, জেব্রা ইত্যাদি।
১৫। অস্ট্রেলীয় শব্দ : ক্যাঙ্গারু, বুমেরাং ইত্যাদি।
১৬। পেরুর শব্দ : কুইনিন ইত্যাদি ।
১৭। মালয় শব্দ : গুদাম, সাগু ইত্যাদি।
১৮। হিব্রু শব্দ : শয়তান ইত্যাদি।
১৯। ইতালীয় শব্দ : ম্যাজেন্টা ইত্যাদি।
২০। গ্রিক শব্দ : কেন্দ্র, কোণ, দাম, সুড়ঙ্গ ইত্যাদি।
২১। প্রাচীন পারসিক শব্দ : পুথি, মুচি, মোজা ইত্যাদি।
২২। গুজরাতী শব্দ : খদ্দর, হরতাল ইত্যাদি।
২৩। পাঞ্জাবী শব্দ : চাহিদা, শিখ ইত্যাদি।
২৪। উর্দু-হিন্দী শব্দ : আচ্ছা, ইমলি, কুত্তা, চরখা, বাচ্চা, মিলানা ইত্যাদি।
উর্দু-হিন্দী উপসর্গ ‘হর’ (প্রত্যেক) যুক্ত হয়ে নতুন শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, হর+এক হরেক, হরেক আদমী, হরেক মাল, হরেক রকম। হর+কিসিম = হরকিসিম; এরূপ হর ওয়াক্ত, হরদম, হরফন (হরফন মাওলা), হররোজ ইত্যাদি।
২৫। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত মিশ্র শব্দ :
বাংলা ভাষায় প্রায় সমার্থক দুটো শব্দের মিশ্রণ জাত এক ধরনের নতুন শব্দ তৈরি হয় এবং সমাসবদ্ধ শব্দের মত নতুন অর্থের সৃষ্টি করে। কখনো কখনো ‘দেশী’ ও ‘বিদেশী’ অর্থাৎ দেশজ খাঁটি বাংলা ও অন্য ভাষার শব্দের মিলনেও এরূপ শব্দদ্বৈত সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন, আরবি+আরবি-গরহাযির; আরবি+ফারসি- মুসলমান; ফারসি + ফারসি- রোযাদার; ফারসি+আরবি- বেমালুম, চৌহুদ্দী; ইংরেজি+ ইংরেজি-ফুলশার্ট, হাফশার্ট; ইংরেজি+বাংলা – পকেটমার, হাফহাতা; ইংরেজি + সংস্কৃত- হেড পণ্ডিত; খ্রিস্টাব্দ; ইংরেজি+ফারসি-ডাক্তার খানা; টন্নি-মুখতার (Attorney); ইংরেজি + আরবি- হেড মাওলানা, সেকেন্ড মৌলভী; বাংলা + ফারসি রাজা বাদশাহ্, হাটবাজার ইত্যাদি।
বাংলা ভাষার শব্দসম্ভার দেশজ কিংবা অন্য যে কোনো ভাষা থেকে আসুক না কেন, এখন তা বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে। এগুলো বাংলা ভাষার সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে, বাংলা থেকে আলাদা করে এদের কথা চিন্তা করা যায় না।
উপসংহার
সমগ্র পৃথিবী আজ বিশ্বপল্লীতে রূপায়নের প্রক্রিয়া চলছে। এতে ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি ইত্যাদি নানা উপলক্ষে উন্নততর মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষাভাষীর পরস্পর সংলাপ-আলোচনা ও লেন-দেনের সুযোগে ভাষার উপাদান বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলা ভাষা নিঃসন্দেহে আরো সমৃদ্ধ হবে। এই আমাদের ভাষা-বাংলা ভাষা। আমাদের ভাষা আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের গৌরব। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, আমাদের প্রাণের ভাষা। আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসিকান্না এ ভাষায়ই প্রকাশ করি, প্রাণ জুড়াই। এর চাইতে আপন ভাষা, এর চাইতে মধুর ভাষা আর কোথাও নেই। মাতৃভাষার তুলনা নেই ।
শত নদী-খাল-বিল থাকা সত্ত্বেও যেমন বারিধারা-বৃষ্টির পানি না হলে চাতকীর পিপাসা মিটে না, তেমনি আমাদেরও মাতৃভাষা ছাড়া মন ভরে না। কবি বলেছেন:
নানান দেশের নানান ভাষা,
বিনা স্বদেশী ভাষায় পুরে কি আশা?
খাল বিল চাতকীর
ধারা জল বিলে কভু মিটে কি তৃষা?
মাতৃভাষার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি। আমরা শহীদ হয়েছি। প্রতিষ্ঠা করেছি আমাদের মায়ের ভাষাকে আপন মহিমায়। অত্যাচারীরা আমাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে আমরা ফরিয়াদ করেছি : ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিত চায়,’ বলে। কোটি অন্তরের আহাজারী কবুল হয়েছে। আমাদের ত্যাগ তিতিক্ষা সার্থক হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে জাতিসংঘে। আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় মাতৃভাষা দিবস- একুশে ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার গৌরব ও আমাদের সংস্কৃতির গৌরব এ বিশ্বে আর কোনো জাতির ভাগ্যে জোটেনি। তাই আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি বিশ্বে একক বৈশিষ্টে বিদ্যমান। মানবতার সেবায় আমাদের নিঃস্বার্থ ত্যাগে মুগ্ধ হয়ে আফ্রিকার একটি দেশ- সিয়ারালিওন আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে তাদের অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা রূপে গ্রহণ করে আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করেছে। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও নৃসমাজের এ বিরল গৌরবে মানব ইতিহাসে অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
মাতৃভাষা আন্দোলন আমাদের উৎসাহিত করছে স্বাধীনতা বিপ্লবে, উজ্জীবিত করেছে জিহাদে । এ আন্দোলন সংহত করেছে আজাদী সংগ্রামের এবং সে সংগ্রাম ছিনিয়ে এসেছে কেবল বাক স্বাধীনতা নয়, বরং স্বাধীন সার্বভৌম জাতিসত্তা এনে দিয়েছে একটি স্বাধীন পতাকা, একটি স্বাধীন জনগোষ্ঠী। বিশ্বের ইতিহাসে এ ধরনের আন্দোলন নজীরবিহীন। একদা পেয়েছিলাম : স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়রে, কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায়রে, কে পরিবে পায়?
আন্তরিক ও ঐক্যবদ্ধ জিহাদ সফল হয়েছে। আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়েছি নির্মল আজাদীর। প্রাণ ভরে আবার গেয়ে উঠেছি :
মোদের গরব মোদের আশা
আ মরি বাংলা ভাষা
এই আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের সংস্কৃতি। এ ভাষাতেই বিদায় নিব সাঙ্গ করি কানা হাস।
#তথ্য নির্দেশ
১. কেউ কেউ বাংলা ভাষার শব্দ সম্ভারকে প্রধানত ‘মৌলিক’ ও ‘আগন্তুক’- এ দুভাগে ভাগ করার পক্ষপাতী। তাঁদের মতে ভারতীয় আর্য ভাষা জাত তৎসম, অর্ধতৎসম ও তদ্ভব শব্দগুলি প্রথম শ্রেণীর আর অন্ত্রিক, দ্রাবিড়, সেমীয় ইত্যাদি অসম্পৃক্ত গোষ্ঠীর ভাষা অথবা ইন্দো ইয়োরোপীয় গোষ্ঠীর শাখাত্তর থেকে গৃহীত শব্দাবলী দ্বিতীয় শ্রেণীর। দ্রষ্টব্য সুকুমার সেন, ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’, পৃ:-১৯৩। এ ধরনের বিভাগ বিজ্ঞানসম্মত নয়। ‘মৌলিক’ বলে যদি কোনো শাখার নাম করতে হয়, তবে তা হবে ‘দেশজ’ বা খাঁটি বাংলা শব্দ।
২. সকল ভাষাতাত্ত্বিক একে ‘দেশী’ শব্দ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ‘দেশ’ শব্দের সঙ্গে যে ভৌগোলিক পরিচিতি সম্পৃক্ত তাতে এ শ্রেণীর শব্দের এ নামকরণ যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। কিছু শব্দকে ‘দেশী’ বললে বাদবাকী শব্দগুলোকে ‘বিদেশী’ বলতে হয়। এটিও যুক্তিসঙ্গত নয়। ভৌগোলিক বা রাষ্ট্রগত- ‘বিদেশ’- আগত ধরলে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা এবং উর্দু ও হিন্দীকে কোন শ্ৰেণী বলা যাবে? আমাদের মতে ‘দেশী শব্দ’ ও ‘বিদেশী শব্দ’-এর পরিবর্তে ‘দেশজ শব্দ’ বা ‘খাঁটি বাংলা শব্দ’ এবং ‘অপর বা অন্যান্য ভাষার শব্দ’ নামকরণ বাঞ্ছনীয় ।
৩. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে অস্ট্রিকও দ্রাবিড় ভাষা থেকে এসেছে। সুকুমার সেন ও বিজয়চন্দ্র মজুমদারও এ মত সমর্থন করেন। দ্রষ্টব্য সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত, Majumdar, History of the Bengali Language । মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, বাংলা ভাষায় দ্রাবিড় প্রভাব নগণ্য। বরং দ্রাবিড় ভাষায় বাংলার কিছু কিছু প্রভাব থাকার সম্ভাবনা বেশি। দ্রষ্টব্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’, পৃ: ৫৭
৪. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দেখিয়েছেন যে, কোল বা মুন্ডা ভাষাভাষীরা একদা বাংলা ভাষাভাষীদের সঙ্গে একত্রে বাস করত। প্রধানত সে কারণে বাংলা ভাষায় কোল বা মুন্ডা প্রভাব লক্ষণীয়। ঐ পূ: ৫৪-৫৮।
৫. অনেকেই ‘তৎসম’, ‘অর্ধতৎসম’ ও ‘তদ্ভব’ শব্দের পরিবর্তে যথাক্রমে ‘সংস্কৃত’, ‘বিকৃত সংস্কৃত’ ও ‘সংস্কৃতজাত’ শব্দ ব্যবহারের পক্ষপাতী। সংস্কৃত থেকে বাংলায় কৃতঋণ শব্দগুলি সংস্কৃত বানানে লেখা হলেও উচ্চারণের পরিবর্তন ঘটেছে। তাই ‘সংস্কৃত’ শব্দের চাইতে ‘তৎসম’ শব্দই বেশি যুক্তিযুক্ত। ‘অর্ধতৎসম’ পরিবর্তিত তৎসম বিধায় ‘অর্ধতৎসম’ বা ‘বিকৃত তৎসম’ যে-কোনো একটি ব্যবহার করা যেতে পারে। ‘তদ্ভব’ ও ‘সংস্কৃতজাত’ শব্দ দু’টি সমার্থক। বাংলা ব্যাকরণে আগে থেকে চলে এসেছে বলে দ্ব্যর্থবোধকতা এড়ানোর জন্য আমরা ‘তৎসম’, ‘অর্ধতৎসম’ ও ‘তদ্ভব’- এ শব্দগুলোই ব্যবহার করেছি।
৬. লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি বঙ্গ অধিকার করেন।
৭. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’, পৃ: ৫৬-৫৮।
৮. ফরাসি, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ প্রভৃতি ভাষার অনেক শব্দ সরাসরি বাংলায় এসেছে। আবার ইংরেজির মাধ্যমেও অনেকগুলো এসেছে। সেগুলোকে ইংরেজি প্রভাবজাত না বলে সে-সব ভাষা থেকে আগত বলা হয়ে থাকে। তেমনি বহু আরবি শব্দ ফারসি, তুর্কী ও অন্যান্য ভাষার মাধ্যমে এলেও সেসব ভাষার প্রভাবজাত না বলে সরাসরি আরবি শব্দ বলাই ভালো। এগুলো অন্য ভাষার মাধ্যমে বিকৃত হয়ে এসে আবার স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাছাড়া ফারসি ভাষার প্রভাব থাকলেও তুর্কী ও অন্যান্য ভাষার প্রভাব খুবই ক্ষীণ হয়ে এসেছে।


