এক, ‘আমাদের সংস্কৃতি’ সম্পর্কে দু’টি কথা বলবার আগে শুধু সংস্কৃতি নিয়ে একটু পর্যালোচনার দরকার আছে। দরকার আছে এই জন্যে যে, কেবল সংস্কৃতি’র-ই বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে ‘আমাদের সংস্কৃতি’র একটি অবকাঠামো আপনা-আপনিই সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি ‘সংস্করণ’ না হয় ‘সংস্কার’ এই বিশেষ্য পদ থেকে সংগঠিত। আর ‘সংস্কার’ অর্থ হচ্ছে- শুদ্ধিকরণ, শাস্ত্রীয় নীতিমালা এবং অনুষ্ঠানাদি দ্বারা পবিত্রকরণ, শোধনকরণ অথবা পতিত অবস্থা থেকে উদ্ধারকরণ, নির্মলকরণ, অলংকরণ, প্রসাধন, উৎকর্ষ সাধন, উন্নতি বিধান, মেরামতকরণ ইত্যাদি।
সংস্কৃতির ইংরেজি পরিভাষা হচ্ছে- Culture কালচারের সোজাসুজি অর্থ চাষ করা, কর্ষণ করা। সেই জন্য চাষকৃত জমিকে বলা হয় Cultured Land আবার পরিমার্জিত মানুষকে বলা হয় Cultured man.
‘সাকাফাহ’ সংস্কৃতির আরবি পরিভাষা। সফল হওয়া, শিক্ষা পাওয়া, প্রশিক্ষণ পাওয়া ইত্যাদি হচ্ছে সাকাফাহর বাংলা অর্থ ।
দুই, উপরের বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে অন্তত এতটুকু পরিষ্কার হলো- সংস্কৃতি একটি বিশুদ্ধ বিষয় বরং একটি শুদ্ধতম তাৎপর্যকে মান্য করে। সে আরো মান্য করে একটি বহিঃপ্রকাশের এবং একটি অন্তঃপ্রকাশের প্রগাঢ়তাকে- যা মানুষের যথার্থ পরিচিতি। আর মানুষ হিসেবে মানুষের আসল পরিচয়ই তার সংস্কৃতি।’
সেই জন্যই বলা হয়েছে যে, ব্যক্তি বা সমষ্টি আপন চিন্তা-চেতনা ও জীবনধারার মধ্য দিয়ে নিজেকে সজ্জিত, নন্দিত, পরিশীলিত ও সমাদৃত করতে পারে- তাকে বলা হয় সংস্কৃতিবান ও সত্য। সৃষ্টির সেরা মানুষ। তার এ শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা বজায় রাখা ও এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজন সংস্কৃতির।
Culture is the development of inner characteristics of a nation that differentiate it from other nations. আবার, Culture is that process through which the inner qualities develop. তেমনিভাবে Culture starts from faith & a particular faith creates special qualities.
অবশ্যই শিল্প এবং সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য আছে: Art is not Culture, art is the expression of ideas in various forms- poetry. music, dance, architecture, painting, etc. এক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে: To call dance and music Culture is to give a good name to bad things এইচ. জে. লাস্কির এই মন্তব্যটি খুব অর্থবহ। Culture is that what we are.
সংস্কৃতি সম্পর্কে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ভাবনাকে সামনে রাখতে পারি। তিনি বলেন
১. নিজেকে বাঁচাও, নিজেকে মহান করো, সুন্দর করো, বিচিত্র করো- এই কালচারে আদেশ…..
২. সংস্কৃতি মানেই আত্মনিয়ন্ত্রণ- নিজের আইনে নিজেকে বাঁধা ।’
সংস্কৃতির পরিচয় দিতে গিয়ে বদরুদ্দীন ওমর বলেন- জীবন চর্চারই অন্য নাম সংস্কৃতি। মানুষের জীবিকা তার আহার-বিহার, চলাফেরা, তার শোকতাপ, আনন্দ-বেদনার অভিব্যক্তি, তার শিক্ষা-সাহিত্য-ভাষা, তার দিন-রাত্রির হাজারো কাজকর্ম, সবকিছুর মধ্যেই তার সংস্কৃতির পরিচয়।
ইউনেস্কো সম্মেলনে জাতিসংঘ একটি চমৎকার সংজ্ঞা গ্রহণ করেছিল,
ব্যাপকতর অর্থে সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির অথবা সামাজিক গোত্রের বিশিষ্টার্থক,আত্মিক, বস্তুগত এবং আবেগগত চিন্তা এবং কর্মধারার প্রকাশ। শিল্প ও সাহিত্য-ই একমাত্র সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত নয়, মানুষের জীবনধারাও সংস্কৃতির অঙ্গ। মানুষের অধিকার, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য এবং বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অঙ্গ। সংস্কৃতি মানুষকে নিজের সম্পর্কে চিন্তা করার অধিকার এবং ক্ষমতা প্রদান করে। আমরা যে বিশেষভাবে যুক্তিবাদী মানুষ, যে মানুষের বিচারবুদ্ধি আছে এবং ন্যায়ের প্রতি আনুগত্য আছে তা আমরা অনুভব করতে পারি সংস্কৃতির মাধ্যমে। সংস্কৃতির মাধ্যমেই আমরা মূল্য নিরূপণ করি এবং ভাল-মন্দের মধ্যে নির্বাচন করতে শিখি। সংস্কৃতির মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে, আত্মসচেতন হয়ে নিজের অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে বোধসম্পন্ন, নিজের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শেখে, অনবরত নিজের সীমা অতিক্রম করে দক্ষতা অর্জন করে।
তিন, সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি তাৎক্ষণিক রেখাচিত্র আঁকার জন্যে আমরা কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের সংস্কৃতি বোঝবার জন্যে হলেও কবি কাজী নজরুল ইসলামেরই দ্বারস্থ হওয়া উচিত। দ্বারস্থ হওয়া উচিত তাঁর রচনার; তাঁর ভাষণ অভিভাষণের।
ইসলামের সত্যিকার প্রাণশক্তি গণতন্ত্র, সার্বজনীন ও সমানাধিকারবাদ। ইসলামের এই অভিনবত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব আমি স্বীকার করি, যাঁরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন, তাঁরাও স্বীকার করেন, ইসলামের এই মহান সত্যকে কেন্দ্র করে কাব্য কেন, মহাকাব্য সৃষ্টি করা যেতে পারে। – (কাজী নজরুল ইসলামের পত্র। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে লেখা)।
সংস্কৃতি কি আর কবি নজরুলের সংস্কৃতিই বা কি; তা বোঝবার জন্যে ঐ একটি উদ্ধৃতিই আমাদের জন্য যথেষ্ট ।
একজন পাকা রাধুনীর জন্যে যেমন সারা হাড়ির ভাত টিপে টিপে সিদ্ধ হয়েছে কি না তা বারবার পরখ করার দরকার হয় না; তেমনি একজন বোদ্ধা পাঠকের ক্ষেত্রেও উল্লিখিত তথ্যসূত্রটি তেমনি কোনো কাজে লাগতে পারে। তবুও কবি কাজী নজরুল ইসলামের আরো কিছু বক্তব্য আমরা তুলে ধরলাম:
১. আমি চাই, এই পর্বতের বিভোর থেকে বেরিয়ে আসুক তাজা তরুণ মুসলিম, যেমন করে শীতের শেষে বেরিয়ে আসে জরার খোলস ছেড়ে দল। বিশ্বের এই নব অভ্যুদয়-দিনে সকলের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে চলুক আমার নিদ্রাথিত ভাইয়েরা। (মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা)।
২. আমাদের ইসলামাবাদ হোক ওরিয়েন্টাল কালচারের পীঠস্থান- আরাফাত ময়দান। দেশ-বিদেশের তীর্থযাত্রী এসে এখানে ভীড় করুক। আজ নব জাগ্রত বিশ্বের কাছে বহু ঋণী আমরা, সে ঋণ আজ শুধু শোধই করব না- ঋণ দানও করব, আমরা আমাদের দানে জগত কে ঋণী করব- এই হোক আপনাদের চরম সাধনা। হাতের তালু আমাদের শূন্য পানে তুলে ধরেছি এতদিন, সে লজ্জা আজ আমরা পরিশোধ করব। আজ আমাদের হাত উপুড় করবার দিন এসেছে। তা যদি না পারি সমুদ্র বেশি দূরে নয়, আমাদের এ লজ্জার পরিসমাপ্তি যেন তারি অতল জলে হারিয়ে যায় চিরদিনের তরে। আমি বলি, রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনের মত আমাদেরও কালচারের, সভ্যতার, জ্ঞানের সেন্টার বা কেন্দ্রভূমির ভিত্তি স্থাপনের মহৎ ভার আপনারা গ্রহণ করুন। আমাদের মত শত-শত তরুণ খাদেম তাদের সকল শক্তি আশা-আকাঙ্ক্ষা জীবন অঞ্জলির মত করে আপনাদের সে উদ্যমের পায়ে অর্থ দেবে। (মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা)।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু স্বপ্নই দেখেননি, বরং শান্তিনিকেতনের মত আরেকটি সংস্কৃতিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ করেছেন। যে কেন্দ্রটি হবে আমাদের কেন্দ্র অর্থাৎ যেখানে চর্চা হবে আমাদের ঐতিহ্যের, আমাদের স্বাতন্ত্র্যের। সেই কারণে তিনি নিজের জাতিকে সতর্ক করেছিলেন এইভাবে
‘বাঙলার মুসলমানেরা হিন্দুর কালচার, শাস্ত্র, সভ্যতা প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত, তার শতাংশের একাংশও পরিচিত নয় সে তার নিজের ধর্ম, সভ্যতা ইত্যাদির সাথে।
—- মতিউর রহমান মল্লিক