জাতির মূলস্তম্ভ দ্বীন ও ভাষা; বাংলাদেশে আমাদের জাতিসত্তার ইশতেহার

বিশ্বায়নের এ যুগে আমরা এমন অবস্থায় উপনীত হয়েছি যে, বর্তমান অবস্থাকে বুঝতে হলে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে রাখতে হয়।
১. বিশ্বজনীনতা
২. আঞ্চলিকতা
এ দুটি বিষয়কে সামনে রাখার কারণে একটি মূলনীতিকে গ্রহণ করতে হয়, তা হলো ‘বিশ্বজনীন হওয়া ব্যতীত স্বীয় অঞ্চলকে ধারণ করা যায় না। ফলশ্রুতিতে আমাদের পন্থা, আমাদের লক্ষ্যমাত্রার সাথে একটি বিষয়কে জড়িয়ে নিতে হয়, সেটি হলো আমাদের বর্তমান দুনিয়া কোন অবস্থায় আছে তা নির্ণয় করা, নিজের রাষ্ট্র ও সমাজকে পর্যালোচনা করে সংকট এবং ভবিষ্যতের সমাধান নিয়ে সর্বদা সচেতন থাকা। আর যদি ইসলামী সভ্যতার সন্তান হিসেবে, সম্মানিত জাতির সন্তান হিসেবে বিশ্বের সামনে আমরা বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানরা না দাঁড়াতে পারি, আমাদের অধিকার ও মর্যাদাকে তুলে ধরতে না পারি, তাহলে উম্মাহকে জাগিয়ে তোলা অনেকটাই অসম্ভব। কারণ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় একশো কোটি মুসলমানের বসবাস, আর এ মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যকই কথা বলে বাংলা ভাষায়। এ সংখ্যা ত্রিশ কোটি। তাই স্বাভাবিকভাবেই একশো কোটি মুসলমানের কেন্দ্রবিন্দু এ বাংলা অঞ্চল-ই। সুতরাং যদি আমরা, ত্রিশ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান এ অঞ্চল থেকে জাগ্রত না হই, তাহলে একশো কোটি মুসলমানকে জাগ্রত করা অসম্ভব।
এজন্য আমাদের ভবিষ্যত ও নতুন দুনিয়া প্রতিষ্ঠা বা শান্তিপূর্ণ একটি বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আল মাওয়ার্দীর তত্ত্বকে সামনে হাজির রাখতে হবে। এ তত্ত্বের মধ্যে তিনি ছয়টি বিষয় সম্পর্কে বলেছেন, যার একটি হলো الدين المتّبع, অর্থাৎ এমন একটি দ্বীন সমাজের মধ্যমণি বা কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে থাকতে হবে, যা অনুসরণযোগ্য।
ইমাম মাওয়ার্দীর মূলনীতিগুলোকে ‘Normative values’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়ে থাকে, যার অর্থ মানুষ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে এমন একটি বিষয়। নরম্যাটিভ ভ্যালু মূলত এমন মূল্যবোধ যা সকল পর্যায়ের মানুষ গ্রহণ করে নেয়। এটি সহজাত মূল্যবোধ যা গ্রহণ করতে প্রশ্ন বা চিন্তাভাবনার প্রয়োজন হয় না। আল মাওয়ার্দীর মূলনীতিসমূহকে এ নামকরণের কারণ হলো তার উত্থাপিত মূলনীতিসমূহ সহজাত, যা মানুষের আকল স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে নেয়। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবো, বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম অঞ্চলে দ্বীন হিসেবে ইসলামকে সবাই মেনে নিচ্ছে। তারা দ্বীন কতটুকু পালন করছে বা গ্রহণ করছে, তারচেয়েও বড় বিষয় হলো তারা সবাই দ্বীন অনুসরণ করার চেষ্টা করছে, তাদের মাঝে এ দ্বীনের গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে মূল আলাপ হল, তা অবশ্যই অনুসরণ যোগ্য হতে হবে, এবং যদি তা অনুসরণ যোগ্য না হয় তবে তা কখনোই দ্বীনুল মুত্তাবাআ হতে পারবে না।
সুতরাং আমরা যে অঞ্চলেই থাকি না কেন, এটি আমাদের জন্য আবশ্যকীয় একটি বিষয়। এটির সাথে পরবর্তী বিষয়গুলোও সম্পৃক্ত, অর্থাৎ সামগ্রিক আদালত, সামগ্রিক নিরাপত্তা, সমাজে সম্পদের প্রাচুর্য ও সুষ্ঠু বন্টন থাকা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বাস্তবধর্মী স্বপ্ন থাকা, যে স্বপ্ন মানুষের মাঝে ভিশন ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে তুলে ধরবে। এভাবেই আল মাওয়ার্দী তার তত্ত্বটিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এবং এটি বাস্তবিকভাবেই গ্রহণযোগ্য। যদি মুসলিম উম্মাহ কিংবা বা যে কোনো জাতি, গোষ্ঠী এটি পালন করে, তাহলে সেখানে আদালত, শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই আমরা যদি দ্বীনুল মুত্তাবাআকে জাতির সামনে সঠিকভাবে হাজির করতে না পারি, তাহলে বুঝতেই পারছি যে, সেই শান্তিপূর্ণ দুনিয়ার দিকে, সত্যিকারের জাতিসত্তা বিনিমার্ণের দিকে আমরা হাঁটতে পারবো না, জাতির রূহকে উপলব্ধি করতে পারবো না। এজন্য আমাদের অন্যতম কাজ ও প্রধান স্তম্ভ হলো–
জাতির সামনে দ্বীনের সঠিক ব্যাখ্যা হাজির করা। যুগ, সময় এবং স্থানের প্রেক্ষাপটের আলোকে দ্বীনকে সুন্দরভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা, চিন্তাকে নবায়ন করা। তাই আমরা যদি ইসলামী সভ্যতার মহান উসূলী ধারা ‘আহলুর রায়’ ধারাকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি, একইভাবে এ ধারার ছয়জন মহান ব্যক্তিত্বকে সামনে রেখে আমরা আমাদের পরবর্তী ব্যক্তিত্ব তৈরি এবং সেই লক্ষ্য পানে এগিয়ে চলার চেষ্টা করতে পারি, তাহলে অবশ্যই নতুন এক দিগন্তের পুনঃউন্মোচন হবে, ইনশাআল্লাহ্‌।
সেই ছয়জন মহান ব্যক্তিত্বরা হলেন

• হযরত উমর (রা.)

প্রথমত আল্লাহর রাসূলের (স.) সহচরদের মধ্যে তিনি জ্ঞানের ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন। তার হাত ধরেই মূলত আহলুর রায় ধারার চিন্তা বিকশিত হয়। তার যে চিন্তা, তা অর্ধ পৃথিবীর চেয়েও বেশি জায়গা জয় করছে, কুদুস জয় করছে, এমনকি সে সময়ের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সভ্যতাগুলোর পতন হয়েছিলো এবং সেগুলো ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলো। দ্বিতীয়ত তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি সমগ্র পৃথিবীতে আদালতের ধারণাকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করছেন যে, আজ পর্যন্ত তার মতো কোনো শাসক আসেননি এবং কারো শাসন তার শাসন ও ন্যায়পরায়ণতার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারে। তৃতীয়ত তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামী সভ্যতাকে ধারাবাহিকতা দান করার জন্য প্রতিষ্ঠানসমূহ নির্মাণ করেছেন। চতুর্থত তিনিই সর্বপ্রথম ইজতেহাদকে সুস্পষ্ট ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন। পঞ্চমত তিনি জ্ঞানের বহু শাখার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। এভাবে উমর (রা.) আমাদের জন্য বিশাল একটি দ্বার উন্মোচন করেছেন।

• ইমাম আবু হানিফা (র.)

তিনি হযরত উমর (রা.) এর ধারাকে অনুসরণ করে, আরও উন্নত করে সামনে নিয়ে এসেছেন। তিনি ইসলামী সভ্যতার জ্ঞানদর্শন ও জ্ঞানতত্ত্বে নতুনভাবে রূহ সঞ্চার করেছেন। ইসলামের বিশ্বজনীনতাকে সামগ্রিকভাবে সামনে নিয়ে আসায় তাকে ‘ইসলামের বিশ্বজনীন রূপের প্রখর দৃষ্টিমান সাধক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন পরবর্তী মুতাফাক্কির মুজতাহিদগণ!

• ইমাম গাজ্জালী (র.)

তিনি তার আগের চারশো বছরের সারসংক্ষেপ করে পরের ছয়শো বছরকে প্রভাবিত করেছেন। এজন্য তাকে ‘ইসলামী সভ্যতার সারমর্ম’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। চিন্তকেরা অনেকেই ইসলামী চিন্তা দর্শনের ইতিহাস লেখার সময় ‘ইমাম গাজ্জালী পূর্ববর্তী’ আর ‘ইমাম গাজ্জালী পরবর্তী’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন! (যদিও এ সংজ্ঞায়ন যৌক্তিক নয়, তবুও এর দ্বারা ইমাম গাজ্জালীর প্রভাব সম্বন্ধে আন্দাজ করা যায়)

• ইমাম শাতেবী (র.)

যে সময়ে আমাদের ট্র্যাডিশনাল, ক্লাসিকাল ফিকহ non functional হয়ে যাচ্ছিলো, আন্দালুসিয়ার পতন ঘটছিলো এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহ মোঙ্গলদের আক্রমণে একদম নাস্তানাবুদ হয়ে গেছিলো, সবাই কিয়ামতের জন্য অপেক্ষা করছিলো, সে সময়েই তিনি তার অমর গ্রন্থ “মুয়াফাকাত” এর মাধ্যমে আমাদের অস্তিত্বের অংশ ‘ফিকহ’ এর ক্ষেত্রে মাকাসিদের মাধ্যমে নতুন ডাইমেনশন সৃষ্টি করেছেন।

• ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (র.)

ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর জন্ম ১৭০৭ সালে, যে সালে সুলতান আওরঙ্গজেব মৃত্যুবরণ করেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই মুঘল সালতানাতের পতন শুরু হয়। ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর ৫৭ বছরের জীবন কাটে এ ভয়াবহ সংঘাতপূর্ণ সময়েই। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৭৬৫ সালে। জীবদ্দশায় তিনি পাশ্চাত্যের ক্ষমতায়ন ও ডেভেলপমেন্টকে খুব ভালোভাবে দেখেছিলেন, তখন তিনি বলেন, “বর্তমানে আমাদের বিদ্যমান যে ধারণা, তা দিয়ে আর ইসলামী সভ্যতাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।” তখন তিনি তার অমর গ্রন্থ “হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা” রচনা করেন। বড় সুফি হওয়া সত্ত্বেও তিনি বলেন, “কায়িম বিল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহর নামে আমি টিকে থাকবো৷” (সুফিবাদের ধারণা ছিলো ‘ফানাফিল্লাহ’, অর্থাৎ আল্লাহর অধীনে নিজেকে বিলীন করে দেওয়া।) শুধুমাত্র এ কারণেই সমগ্র পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সকল আন্দোলন তার ছাত্রদের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছিলো। এমনকি পরবর্তীতে তৈরি হওয়া সকল মুক্তি আন্দোলনও এ ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছিলো।

• আল্লামা ইকবাল

তিনি পাশ্চাত্যের গগণবিজয়ী আধিপত্যকালীন সময়ে মুসলিম উম্মাহর সুদীর্ঘ সময়কার চিন্তাগত স্থবিরতা, জড়গ্রস্ততার বিপরীতে জ্ঞানকে যুগের সমালোচনার নিরিখে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে জিহাদ ও ইজতেহাদের কাঠামো বয়ান সামনে নিয়ে এসেছিলেন তার অমর গ্রন্থ “Reconstruction of the Religious Thought in Islam” এর মাধ্যমে। এ গ্রন্থের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ জাগ্রত হয়।
এভাবে যদি আমরা ছয়জন ব্যক্তিত্বকে দেখি, তাহলে আমাদের পথ-পন্থা কী হবে, আমরা কীভাবে অগ্রসর হবো, আমাদের জাতিকে কী দিতে হবে– এসব কিছুই আমাদের সামনে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হবে। এ ব্যক্তিদের সামনে রেখেই আমরা আমাদের জ্ঞান চর্চা চালিয়ে যাবো। আমরা যা শিখবো, তা জাতির কল্যাণে কাজে লাগানোর স্বপ্ন দেখবো, চিন্তা করবো এবং বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবো। সেক্ষেত্রে আল্লাহ অবশ্যই ফলাফল দিবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। পাশাপাশি যদি আমাদের সোশিওলজি, সোশিওকালচারকে বুঝতে চাই এবং সেই রূহকে ধারণ করতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের এ অঞ্চলকে খুব ভালোভাবে পাঠ করতে হবে। এ মাটি, এ আবহাওয়া, এ পরিবেশ, এ সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করা ব্যতীত কখনোই ধার করা কোনো বিষয় দিয়ে আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারবো না, জাতির সামনে দ্বীনুল মুত্তাবাআকে সামগ্রিকভাবে উপস্থাপন করতে পারবো না। যেমন আমরা যদি লক্ষ্য করি, ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী তার “হুজ্জাতুল্লাহুহিল বালিগা” দিল্লিতে বসে লিখলেও তা সমগ্র উপমহাদেশের সোশিওলজির সাক্ষ্য দেয়। “ফতোয়ায়ে আলমগীরি” আরবী ভাষায় লিখা হলেও তা মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের রূহের উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা, ব্রাহ্মণরা ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশানের সোশিওলজিকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং সেগুলোকে পাঠ করতে বাধ্য করেছে, ফলশ্রুতিতে আমরা সমাধানের দিকে ধাবিত হতে পারছি না। এজন্য আমাদের জাতির রূহকে বুঝতে হলে নিজেদের ফিকহ বা বর্তমান সময়ের সমাজবিজ্ঞানকে, অঞ্চলের মানুষ ও ভূমিকে খুব ভালোভাবে বুঝে সেই আলোকে ইশতেহার রচনা করতে হবে। এটি দ্বীনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

‘বাংলা ভাষা’ তথা মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহৎ ভাষা

বিগত ৩০০ বছর যাবত বাংলা ভাষা নিয়ে প্রকৃত অর্থে কোনো কাজ হচ্ছে না। এজন্য নতুন করে বাংলা ভাষাকে পুনর্জাগরিত করা, বাংলা ভাষাকে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচিত হতে হবে, এর কোনোই বিকল্প নেই। এক্ষত্রে আশার দিক হলো এত জুলুম, অত্যাচারের মাঝেও বাংলা ভাষা হারিয়ে যায়নি, বরং সে তার আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। আমরা তার নিজস্ব হরফে এখনো তাকে চর্চা করে যাচ্ছি, নতুন করে পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছি যা পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই সম্ভব হয়নি। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে নিভে যায়নি আমাদের বাংলা ভাষার স্বকীয়তা!
বাংলা ভাষার অবস্থান অনেক উচ্চে। এখনো স্ব-মহিমায় বলতে পারা যায়, “বাংলা মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ ভাষা।” আরবী ছিলো সাধারণ একটি কওমের ভাষা, কিন্তু সেটি একটি বিশ্বজনীন ভাষায় রুপান্তরিত হয়েছে। আমরা বাংলা ভাষাকে বিশ্বজনীন করতে চাই না, তবে–
৪০ কোটি মানুষের ভাষা হিসেবে নতুন করে জাগরিত করতে চাই।
জাতিসত্তাকে বোঝার জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে প্রস্ফুটিত করতে চাই।
আমাদের সংস্কৃতিকে বহনের সর্বপ্রধান মাধ্যম হিসেবে নতুন করে উত্থান ঘটাতে চাই। আর এ উত্থানকাব্যে বড় অগ্রগামী ভূমিকা পালন করবে আমাদের যুবকরা, ইনশাআল্লাহ।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এটি কীভাবে সম্ভব? সেক্ষেত্রে উল্টো প্রশ্ন হলো, কেন সম্ভব নয়?
যে হিব্রু ভাষার গত ৬ হাজার বছরে কোনো অস্তিত্ব ছিলো না, সে হিব্রু ভাষাকে কি নতুন করে জাগরিত করে আন্তর্জাতিক ভাষায় পরিণত করা হয়নি?
উসামানী ভাষার হরফ পরিবর্তন করে আজকের তুর্কি ভাষা তৈরি করা হয়েছে, মাত্র ৮০ বছরের ব্যবধানে সকল জ্ঞানকে তুর্কি ভাষায় রূপায়ন করে জাগরিত করা হয়নি?
আজ থেকে কয়েকশো বছর আগেও চাষীদের বা গ্রাম্যদের ভাষা ছিলো উর্দু। এটি কি এখন একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা নয়?
আজ থেকে দেড়শো বছর আগেও হিন্দি ভাষার কোনো অস্তিত্ব ছিলো না, সেই হিন্দি ভাষা কি আজ উপমহাদেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে না?
শেক্সপিয়ার কি একাই ইংরেজি ভাষাকে দাঁড় করাননি?
তাহলে কেন হাজার বছর ধরে চলে আসা মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহৎ ভাষা এবং সেই সাথে ৪০ কোটি মানুষের ভাষা বাংলাকে কেন আমরা নতুন করে দাঁড় করাতে পারবো না? কেন তা সম্ভব নয়? আমরা অবশ্যই পারবো। যদিও হতাশার দিক রয়েছে, কিন্তু এ ধরনের হতাশার দিক সকল অঞ্চলেই রয়েছে।
বড় বড় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, বৃটিশদের দ্বারা প্রভাবিত পণ্ডিতরা আমাদের প্রতিনিয়তই বোঝানোর চেষ্টা করে যে, বাংলা ভাষা মুসলমানদের ভাষা নয়, বাংলা ভাষায় মুসলমানদের তেমন কোনো কাজ হয়নি, কোনো মৌলিক জ্ঞান চর্চা হয়নি, তাই এর দ্বারা জাগরণ সম্ভব নয়! কিন্তু বাস্তবতা যা, তা একটি উদাহরণের মাধ্যমেই ফুটে ওঠে। উসমানীদের নিজেদের লিখিত ১৮ লক্ষ পৃষ্ঠার ইতিহাস তাদের সামনে আছে, সুলাইমানীয়া লাইব্রেরি এখনো দাঁড়িয়ে আছে, অথচ মাত্র একজন লেখক উসমানী আমলে প্রতি ১০০ বছরে মাত্র ৫০ জন করে চিন্তকের তালিকা দেখিয়েছেন, যাদের প্রায় প্রত্যেকের কমপক্ষে ৮০ টি করে বই আছে! যে সুবিশাল উসমানী খেলাফত ছয়শো বছর গোটা বিশ্বকে সবেচেয়ে বেশি প্রভাবের সাথে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাদের সম্পর্কেই বলা হয় যে, উসমানীদের সাধারণ তলোয়ার চালানো ছাড়া ভিন্ন কোনো কিছু করার যোগ্যতা ছিলো না বা ওই অর্থে কোনো কিছু ছিলো না!
উসমানীদের তুলনায় বাংলা অঞ্চলের মুসলমানরা কোনো ডকুমেন্ট রেখে যেতে পারেনি, দুইশো বছরের ব্রিটিশ আগ্রাসন আমাদের সবকিছুকে নিঃশেষ করে দিয়েছে! উসমানী অঞ্চল বা তুর্কিশ অঞ্চল, যেখানে ঔপনিবেশিক শাসনই প্রতিষ্ঠা হয়নি, সে অঞ্চলের ইতিহাসকেই যদি এভাবে অস্বীকার করা হয়, মিথ্যা ইতিহাস চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে দুইশো বছর শোষণের শিকার আমাদের বাংলা অঞ্চলের মুসলমানদের ইতিহাস, ডকুমেন্ট তো মুছে ফেলা হবেই। আর যেহেতু কোনো ডকুমেন্ট অবশিষ্ট নেই, তাই তা অস্বীকার করা হবেই এবং আমাদেরকে নানাভাবে হীনমন্য করা হবেই! এবং এটিই স্বাভাবিক!
পাশাপাশি আমরা এটিও দেখতে পাই, ওরিয়েন্টালিস্ট ও ব্রাহ্মণ্যদের লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস সর্বাবস্থায়ই আমাদের আত্মবিশ্বাসের জায়গায় আঘাত করেছে। তারা আমাদের ইতিহাসবিহীন জাতিতে পরিণত করতে চাচ্ছে, এটিই তাদের উদ্দেশ্য।
আমরা যদি এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে নতুন করে ডায়ালগ সৃষ্টি করতে পারি; বাংলার ত্বহা আব্দুর রহমান তৈরি করতে পারি, আল্লামা ইকবাল তৈরি করতে পারি; ইমানুয়েল কান্টের তত্ত্ব খন্ডন করে নতুন এক তত্ত্ব বাংলা ভাষায় দাঁড় করাতে পারি, তাহলে অবশ্য-অবশ্যই বাংলা ভাষাকেও সেভাবে হাজির করতে পারবো। আর বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অনুবাদ, ক্লাসিক গ্রন্থের বাংলা ব্যাখ্যা, ক্লাস, গবেষণা প্রবন্ধ, প্রস্তাবনাসহ নিজেদের যোগ্য করার মধ্য দিয়ে ক্লাসিক গ্রন্থ লেখার দিকে ধাবিত করা এখন আমাদের অন্যতম ইশতেহারে পরিণত হয়েছে। একইসাথে মৌলিক চিন্তা ও জ্ঞানের দিক দিয়ে দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করতেও বাংলায় বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার তৈরি আমাদের অন্যতম ভিশনে রূপ নিয়েছে।
দ্বীন এবং ভাষাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আমরা যে যে আন্দোলন শুরু করেছি, তার নাম দিয়েছি ‘জ্ঞান ও সভ্যতার পুনর্জাগরণের আন্দোলন’। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের নিকট ভবিষ্যৎ নিকট অতীতের চেয়ে অনেক ভালো হবে, ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে, যে বিষয়টি বলতে চাই, দ্বীন এবং ভাষা যেহেতু জাতির মূল স্তম্ভ, আর এ দুটি বিষয়কে কেন্দ্রে রেখেই আমরা আমাদের আন্দোলন শুরু করেছি, তাই পুনরায় নিখিল ভারতের ইসলামী সভ্যতার পুনর্জাগরণের চিন্তা এবং ভিত্তি নির্মাণের সংগ্রাম এ বাংলা অঞ্চল থেকেই শুরু হবে, তার ভিত্তি প্রস্তর এ ভূমিতেই হবে– এটিও আমরা বিশ্বাস করি। এজন্যই আমরা বলতে চাই, ৭০০ বছরের সালতানাতের সাক্ষ্য বহনকারী দারসবাড়ি, আতিয়া মসজিদ এবং আন্দরকিল্লার সন্তান হিসেবে, ঈসা খাঁ, উমিদ শাহ ও শরীয়তুল্লাহর উত্তরসূরী হিসেবে এ অঞ্চলের যুবকদের মধ্যে ঈমান গ্রোথিত রয়েছে, তাদের মধ্যে সেই চেতনার রূহ এখনো বিদ্যমান। তাই আমরা যদি জাতির উপর পড়ে থাকে আস্তরণ বা ছাই সরিয়ে দিতে পারি, তাহলে জাতির ভিতরে লুকিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি নতুন করে জেগে উঠবে। এ আগ্নেয়গিরি হবে আগামীর মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার, ভবিষ্যৎ নির্মানের অন্যতম স্তম্ভ এবং আমাদের পুনর্জাগরণের মিনার, ইনশাআল্লাহ।
১৫০০ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়।পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন।বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।
Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়।পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন।বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top