সুলতান আব্দুল হামিদ হান। উসমানীয় খিলাফতের ৩৪তম সুলতান, উম্মাহর দরদী  খলিফা, অদ্যবধি ইসলামী খিলাফতের সর্বশেষ খলিফা ও উম্মাহর মহান মুজাহিদ, যাঁর স্বপ্ন ছিল এক শক্তিশালী উম্মাহর। উম্মাহর এই দরদী সুলতান ১৮৪২ সালে খিলাফতের রাজধানী ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন। ১০ বছর বয়সেই তিনি তাঁর মাকে হারান। শৈশব থেকেই তিনি বিচক্ষণ এবং গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। ২৬ বছর বয়সে  ১৮৬৮ সালে, চাচা  খলিফা আব্দুল আজিজের সাথে ইউরোপ ভ্রমণ করেন। এ সময় তিনি স্বচক্ষে পাশ্চাত্যকে দেখার সুযোগ লাভ করেন। তিনি দেখতে পান প্রযুক্তিগত দিক থেকে খিলাফত পিছিয়ে পড়ছে। সেই সাথে দুনিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ইউরোপের আগ্রাসী মেজাজকেও উপলব্ধি করার সুযোগ হয়।

তোপকাপি প্রাসাদ

সুলতান আব্দুল হামিদ হানের সুলতান হওয়া ছিল এক প্রকার কাকতালীয় ঘটনা।  তাঁর পিতা সুলতান আব্দুল মাজিদের সময়কালের ১৮ বছর তিনি খিলাফতের তৃতীয় উত্তরাধিকারী হিসেবেই ছিলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই তাঁর পিতা সুলতান আব্দুল মাজিদ ইন্তেকাল করেন। অতঃপর তাঁর চাচা আব্দুল আজিজ ৩১ বছর বয়সে নিহত হন যদিও সেসময় এটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ইহুদীরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উসমানীয় খেলাফতকে ধ্বংস করার ব্যাপারে ছিল বদ্ধ-পরিকর এই হত্যাকান্ড ছিল তার-ই অংশ বিশেষ। সুলতান আব্দুল মাজিদের পর ক্ষমতায় আসেন সুলতান আব্দুল হামিদের বড় ভাই সুলতান ৫ম মুরাদ। কিন্তু মানসিক বিকারগ্রস্ত হওয়ায় কিছুদিন পরই খিলাফতের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে খিলাফতের দায়িত্ব আসে সুলতান আব্দুল হামিদ হানের কাঁধে। এভাবে এক প্রকার কাকতালীয় ভাবে ৩১ ডিসেম্বর ১৮৭৬ সালে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন সুলতান আব্দুল হামিদ হান।

সুলতান আব্দুল হামিদ হান যখন খিলাফতের দায়িত্বে আসেন ততোদিনে খিলাফত  রাজনৈতিক ভাবে অনেক পিছিয়ে পড়ে। একদিকে বিশাল ঋণের বোঝা অন্যদিকে  নব্য তুর্কীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এতটাই শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে যায় যে, সুলতান আব্দুল হামিদ হান ক্ষমতায় আসার পরেই  কানুনে আসাসি ঘোষণা করতে বাধ্য হন, যার ফলে খলিফা শুধুমাত্র একটি অলঙ্কারিক পদে রূপান্তরিত হয়। এসময় পাশারা ছিল লাগামহীন। কিন্তু তিনি সকল কিছুকে মেনে নিয়ে এমনকি ইংরেজদের স্বার্থে কাজ করা মিহদাত পাশাকে প্রধান উজির করার শর্তও মেনে নেন এবং যথা সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন।

এদিকে ১৮৭৭ সালে খিলাফতের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাশিয়ান শ্বেত ভাল্লুক ক্রিমিয়া যুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সুলতানও যুদ্ধকে ব্যবহার করে কানুনে আসাসি বাতিল করেন এবং নির্বাহী ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেন। গাজী ওসমান পাশা প্লেভনায় ঐতিহাসিক প্রতিরোধ গড়ে তুললেও এই যুদ্ধে খিলাফত পরাজিত হয়। পরিস্থিতি তখন এমন রূপ লাভ করে যে, এদিক অন্যান্য পরাশক্তিগুলো নিত্যদিন বাহির থেকে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে প্রাসাদের ভিতর ইহুদী এবং তাদের সহযোগী অযোগ্য পাশারা নিয়মিতই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মূলত এসময় সারাবিশ্বে উপনিবেশবাদীদের জয়জয়কার। যেহেতু তখনো বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে মুসলমানরা অবস্থান করছে এবং উসমানী খিলাফত যতদিন বহাল তবিয়তে থাকবে ততোদিন উপনিবেশিকদের পক্ষে সমগ্র পৃথিবীকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে অসম্ভব। সুতরাং খিলাফতের পতন তথা মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রীয় শাসনকে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের পরিকল্পনা যথাযথ ভাবেই কাজ করছিলো কিন্তু পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ান সুলতান আব্দুল হামিদ হান। তারা ঋণের ভারে নুজ্ব্য এবং অভ্যন্তরীণ ভাবে বিশৃঙ্খল খিলাফতকে বারবার যুদ্ধে জড়াতে উস্কানি দিতে থাকে। কিন্তু সুলতান কোনভাবেই যুদ্ধে জড়ানোর পক্ষপাতি ছিলেন না। কারণ তিনি জানতেন যুদ্ধে জড়ানোর অর্থ খিলাফতের নিশ্চিত ধ্বংস ডেকে আনা। ১ম বিশ্বযুদ্ধে তাই হয়েছিল।

তৎকালীন বিশ্বব্যবস্থায় সুলতান আব্দুল হামিদ হান বহু পূর্বেই বুঝতে পেরেছিলেন উসমানী খিলাফতের সময় ফুরিয়ে এসেছে। বিশেষ করে খিলাফত টিকিয়ে রেখে উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে সংগ্রাম করার মতো প্রজ্ঞাবান আলেমগণের অভাব খুব বেশি পরিলক্ষিত হয়। ক্ষমতা গ্রহণ করে সুলতান দেখতে পেলেন উসমানীয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সংকটাপন্ন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি কোনো যুদ্ধবিগ্রহের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু মন্ত্রী পরিষদসহ উপদেষ্টা পরিষদ, বিভিন্ন লবি ও প্রভাবশালী কতক ব্যক্তির কারণে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হন, যা পরবর্তীতে বড় ধরণের পরাজয় ও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন করে গোটা খিলাফত ব্যবস্থাকে। যদিও সুলতান আব্দুল হামিদ হান পরবর্তীতে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন,

আমি সবসময় যুদ্ধ বিগ্রহের বিরুদ্ধে ছিলাম। আমার পরেও যারা আসবে,তাদেরকে নসিহত করবো দীর্ঘ কিংবা সংক্ষিপ্ত কোনো যুদ্ধে না জড়াতে। আমি আরো আগে একবার বলেছিলাম,যুদ্ধে বিজয় অর্জন করলেও ,পরাজিত হওয়ার মতোই তা জাতিকে অনেক বেশি ক্লান্ত করে দেয়।

এ ব্যাপারে উসমানী খিলাফতের তৎকালী যুদ্ধমন্ত্রী ও নব্য তুর্কিদের অন্যতম প্রধান নেতা আনোয়ার পাশার একটি উক্তি উল্লেখ করছি। আনোয়ার পাশা হচ্ছে সেই ব্যক্তি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যার একক জেদ ও হঠকারিতার ফলেই খিলাফত জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে। যার ফলে খিলফতের পতন ত্বরান্বিত হয়। সেই আনোয়ার পাশা পরবর্তীতে তিনি বলেন, জামাল, আমাদের আসল মুসিবতটা কি জান?…আমরা বিপ্লব সংঘটিত করেছি। কিন্তু নিজেদের অজান্তে কখন যে জায়োনিস্টদের ক্রিড়নকে পরিণত হয়েছি টেরই পাইনি। আসলে আমরা ছিলাম নির্বোধ।”

সুলতান তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর দেখলেন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম সংকট বিরাজমান ,অভ্যন্তরীণ অবস্থা খুবই নাজুক। সাধারণত আমরা ইতিহাসে পড়ে থাকি মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ার দরুণ পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু থেকে ছিটকে পড়ে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে সামনে আনা হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এ ধারণা ভুল। সুলতান আব্দুল হামিদ হান এর জলন্ত উদাহরণ। সুলতান আব্দুল হামিদ হান ব্যাপক ভাবে শিল্পায়ন করেন। যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান, সমরাস্ত্র তৈরি, জাহাজ তৈরি, সাবমেরিন ক্রয়সহ আরো নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যার ফলে ক্রিমিয়া যুদ্ধের কিছু সময় পর সংগঠিত গ্রীস যুদ্ধে খিলাফত জয় লাভ করে, এমনকি ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে শুরু করে। এভাবে দক্ষ নেতৃত্বের পরিচালনায় খিলাফত ক্রমেই ‍দূৃর্বলতা কাটিয়ে উঠতে শুরু করে। মূলত প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে পড়ার কারণে নয় বরং রাজনৈতিক চেতনাকে হারিয়ে ফেলা, ক্রিটিক্যাল থিংকিং থেকে দূরে সরে যাওয়ায় মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কেননা সঠিক নেতৃত্বে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন খুব দ্রুতই বিকাশ লাভ করে। কিন্তু রাজনৈতিক চেতনাহীন, ক্রিটিক্যাল থিংকিং করতে না পারা জাতি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের শিখরে থাকলেও সহসাই তাদের পতন ঘটে। যেমনটা উনবিংশ শতাব্দীতে মুসলমানদের ক্ষেত্রে ঘটে। মুসলিম উম্মাহ এসময় এক উম্মাহর চেতনা থেকে বহুদূরে গিয়ে জাতীয়তাবাদী চিন্তায় আক্রান্ত হয়। আরব-তুর্কী জাতীয়তাবাদ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এছাড়াও অভ্যন্তরীণভাবে বিভিন্ন দল, মতবাদ ও কথিত সংস্কারের উদ্ভব হতে থাকে। শত বছর ধরে চলমান ফরাসি বিপ্লবোত্তর জাতীয়তাবাদের ঢেউই মূলত খিলাফতকে প্রাণশূন্য করে দেয় যা পরবর্তীতে মুসলিম উম্মাহর পতন ডেকে আনে।

খিলাফতের অভ্যন্তরীণ অবস্থা যখন এই তখন পাশ্চাত্য উসমানী রাষ্ট্রকে ভাগ করে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পাশ্চাত্য সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ না করলেও শিক্ষা,আইন, প্রতিরক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তাদের চিন্তা ও প্রভাব মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়,যা আজও লক্ষ্যণীয়!

অতঃপর একে একে আরব জাতীয়তাবাদ,তুর্কি জাতীয়তাবাদ,গোত্র ও আঞ্চলিকতাবাদের ভিত্তিতে কয়েকটি গোষ্ঠী গড়ে উঠে যা ব্যাপকভাবে মুসলমানদের খিলাফতের ঐক্যকে নষ্ট করার জন্য কাজ করতে থাকে। অত্যন্ত দূরদর্শী একজন নেতা,আলেম ও মুজাহিদ হওয়ায় সুলতান আব্দুল হামিদ হান বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর উদ্যোগ যতই শক্তিশালী হোক না কেনো,সামগ্রিকভাবে গোটা খিলাফত ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিনি মনে করতেন যে, এই ভঙ্গুর খিলাফতকে যদি ইউরোপের রক্তচক্ষু থেকে বাঁচাতে হলে পাশ্চাত্যের রাজনীতির বিরুদ্ধে নতুন রাজনীতি দাঁড় করাতে হবে। আজ হোক কাল হোক দূর্বল এই খিলাফত ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু ছত্রভঙ্গ এই মিল্লাতকে তো ঘুরে দাঁড়াতে হবে। যদি ঘুরে দাঁড়াতেই হয় তবে ইসলামী ঐক্য প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। তাই তিনি প্যান ইসলামিজম নামের নতুন রাজনীতির কথা চিন্তা করেন এবং সে আলোকে রূপরেখা প্রণয়ন করেন। এই আন্দোলনের কাজ হলো, উম্মাহকে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা; মানবতাকে মুসলিম উম্মাহ কেন্দ্রিক করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ ঐক‌্য প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধারার আন্দোলন গড়ে তোলা; যারা উম্মাহ কেন্দ্রিক স্বার্থ চিন্তা করে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করে যাবে।

তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ত্বরিকতগুলোকে উম্মাহর শক্তিতে উজ্জীবিত করতে থাকেন এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের গুরুত্ব আলেমদের বুঝাতে থাকেন। প্যান ইসলামিজম আন্দোলনকে বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি ‘হজ্জ’ কে কাজে লাগান। আমরা সকলেই জানি যে, হজ্জ হলো মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও মেলবন্ধনের প্রতীক এবং রাজনৈতিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাই তিনি হজ্জকে বিশেষভাবে কাজে লাগান এবং হজ্জকে কেন্দ্র করে গোটা উম্মাহর কাছে পুনর্জাগরণের বার্তা পৌঁছাতে থাকেন।

ছবি- হিজাজ রেলওয়ে

ইসলামী ঐক্যের এই চিন্তাকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি ইস্তাম্বুল-হিজাজ রেলপথের উপর গুরুত্বারোপ করেন এবং তিনি হিজাজ রেলপথকে মদিনা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেন।

মদিন
ছবিঃ মদিনা স্টেশন

 

অতঃপর তিনি চীন,আফ্রিকা ও উপমহাদেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি ও আলেম প্রেরণ করে নানাবিধ সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকেন। বিশেষ করে চীন অঞ্চলে হামিদিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। আফ্রিকা অঞ্চলেও বড় বড় খানকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে নানাবিধ সহযোগিতা প্রদান করেন। অতঃপর তিনি শায়খুল ইসলামকে প্রধান করে ঐক্য আন্দোলনের জন্য বিশেষ কমিশন গঠন করেন। এক্ষেত্রে তাঁর প্রথম লক্ষ্য ছিল, এ আন্দোলনকে প্রভাবশালী শক্তিতে রূপান্তরিত করা; দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল, বিশ্বজনীন আন্দোলনে রূপদান করা এবং তৃতীয় লক্ষ্য ছিল, উম্মাহর চিন্তাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছড়িয়ে দেয়া।

ইসলামী পুনর্জাগরণ এর বীজ বপনের ক্ষেত্রে:

-তিনি ঐক্য আন্দোলনকে একটি সামগ্রিক আন্দোলনে রূপদান করেন।

-রাজনীতি(জিহাদ) ও ইজতিহাদী সিদ্ধান্তকে একত্রিত করার একটি ধারা সৃষ্টি করেন।

-উম্মাহর চিন্তাবিদ ও মুজাহিদদের সামনে নতুন ধারা তৈরির চিন্তা উপস্থাপন করেন,যার উদ্দেশ্য ছিলো যুগের আলোকে এ চিন্তার উপর ভিত্তি করে নানাবিধ আন্দোলন গড়ে তোলা।

-জিহাদ ও তাসাউফকে একত্রিত করেন।

-মাসলাহাতের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেন।

– ধৈর্য ও ইস্তিকামাতের সাথে যুগের পর যুগ মুক্তি আন্দোলন পরিচালনা করার উদাহরণ পেশ করেন।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি বলেন- সুলতান আব্দুল হামিদ হানের রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র বিশ্বের মুসলমাননদের এক পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করা। নিশ্চয়ই এটি ছিলো মুসলিম উম্মাহর উপর পাশ্চাত্যের পরিচালিত উপনিবেশিক শাসনের বিপরীতে পাল্টা শক্তিশালী পদক্ষেপ।

 তিনি খেলাফত ও রাষ্ট্রের জন্য দূরদর্শী পদক্ষেপ নিতে থাকেন। কুদসে যায়নবাদী ইহুদী গোষ্ঠী আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য ভূমি দাবি করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। বিচারিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অটল ও অবিচল। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়ন, প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধির দিকে জোরালো পদক্ষেপ প্রণয়ন করা সহ যায়নবাদী ইস্যুতে দূরদর্শীতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দেন।

সুলতান আব্দুল হামিদ হানের সময়কালকে যদি আমরা মূল্যায়ন করতে যায়, তাহলে দেখতে পাই, পাশ্চাত্যের শক্তিশালী প্রোপাগান্ডা ও মিথ্যাচার এর মূল কারণ ছিল ইসলামী ঐক্য আন্দোলন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাডি সুলতান নামক মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তারা একটি ষড়যন্ত্রমূলক বয়ান পৃথিবীবাসীর সামনে উপস্থাপন করে এবং বিদ্রোহগুলোকে ভিন্নভাবে দেখিয়ে পৃথিবীর মানুষের সামনে আব্দুল হামিদ হানের একটি নির্মম, রক্তলোলুপ চিত্র দাঁড় করায়। ফলশ্রুতিতে, এখনো আমরা তাঁর মহত্ত্ব বুঝতে ভুল করে থাকি। এছাড়াও হাজার হাজার সাহিত্যভাণ্ডার, উপন্যাস, কবিতা ও ডকুমেন্টারিসহ মুভি, সিরিয়ালে তারা আব্দুল হামিদ হানকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে থাকে। তারা মূলত মহান মুজাহিদ এর রেখে যাওয়া ঐক্য আন্দোলনকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলো। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, পাশ্চাত্যের এই প্রোপাগান্ডার সফলতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলমানরা-ই। পাশ্চাত্যের সুদূর পরিকল্পনাগুলোর বিরুদ্ধে মহান এই সুলতান সোচ্চার ছিলেন ও নতুন জাগরণের রূপরেখা দিয়েছেন বলে তারা আব্দুল হামিদ হানের বিরুদ্ধে চরমভাবে ষড়যন্ত্র করেছে।

বহিরাগত চক্রান্ত এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, শাইখুল ইসলাম থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় মুজাদ্দিদরা পর্যন্ত তাঁর বিরোধীতা করা থেকে থেমে থাকেননি। কিন্তু তিনি কী ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন? অবশ্যই ছিলেন না কিন্তু তিনি কোনো ক্রমেই একজন জালিম এবং ব্লাডি সুলতান ছিলেন না। কেননা তাঁর যতই ভুলভ্রান্তি থাকুক না কেনো, তিনি তাঁর ৩৩ বছরের শাসনামলে এমন কোনো কাজ করেননি যে, তাঁকে ব্লাডি সুলতান উপাধি দেয়া যেতে পারে। ইসলামের শত্রুদের দ্বারা এমন উপাধি দেওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। কেননা তিনি পাশ্চাত্যের জীবন দর্শনকে নয়, ইসলামের জীবন দর্শনের আলোকে মুসলিম উম্মাহকে পুনরায় খিলাফতের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর অসাধারণ প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড উইলিয়াম। তিনি বলেন,”শুনেছিলাম সুলতান আব্দুল হামিদ তাঁর লাঠি দিয়ে আঘাত করলে কৃষ্ণসাগর উত্তাল হয়ে যায়।আজ একথার মর্ম বুঝলাম।

সময়কে পরিবর্তনের জন্য এ মুজাহিদের পদক্ষেপ গুলোর অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞা অনুধাবন করতে‌ পেরে তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর অটোভন বিসমার্ক বলেছিলেন- ইউরোপের সমস্ত মানুষের বুদ্ধিমত্তার ৯০% ছিলো আব্দুল হামিদের, % আমার নিজের এবং বাকি % সমস্ত ইউরোপবাসীর!”

সুলতান আব্দুল হামিদ হান শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর কথার উপর অটল ছিলেন। হিকমতের নামে ইহুদীদের এক বিন্দু ছাড় দেননি। সেজন্য হয়তো তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিন ও বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে তিনি ছিলেন আপোষহীন। সুলতান আব্দুল হামিদ হানের ইখলাস ও ইস্তিকামাতের সিক্ত বীজ হলো ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সর্বোত্তম মিরাস। তাঁর রেখে যাওয়া আন্দোলন হলো সবচেয়ে বড় সমাধান। অর্থাৎ বিকল্প ভিন্ন ধারা সৃষ্টি করা, ভিন্ন ধরণের এমন এক বয়ান সৃষ্টি করা, যা উম্মাহকে নতুনভাবে জাগ্রত করবে। যার ফসল আজকের মানবতার মুক্তি আন্দোলন‘। মহান এই মুজাহিদের পথ ধরেই তাঁর উত্তরসূরীরা তাঁর পথে হেঁটে ইসলামী সভ্যতাকে পুনর্জাগরিত করে তুলবে, ইনশাআল্লাহ।

১০ ই ফেব্রুয়ারি মহান সুলতানের ১০৪ তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান এর ভাষায়ই আমরা দু’আ চাই-

“জান্নাত মাকান,

সুলতান আব্দুল হামিদ হান।”

১৪১৫ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক, ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।
Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক, ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top