বিংশ শতাব্দী জুড়ে হাজারো দুঃখ কষ্ট সহ্য করা সত্ত্বেও মানবতা তার প্রত্যাশিত শান্তি, সমৃদ্ধি, কল্যাণ ও সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি। না ইয়াল্টা কনফারেন্স এর প্রথমার্ধে আর না দ্বিতীয়ার্ধে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ১৯৪৫ এ অনুষ্ঠিত ১ম ইয়াল্টা কনফারেন্সের আগে বিশ্ব মানবতা দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের করুণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। ১ম বিশ্বযুদ্ধ উসমানী খিলাফত, রাশিয়ার রাজতন্ত্র, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের মতো সাম্রাজ্যগুলোর অবসান ঘটানোর বিনিময়ে ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসনকে গ্রহণ করে। অতঃপর ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় স্ট্যালিন, হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কোর মতো স্বৈরশাসকদেরকে নির্মূল করার জন্য । এই নোংরা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা মানবতাকে কঠিন মরণ যন্ত্রণা উপহার দিয়েছিলো।
বিশ্ব মানবতা যখন স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা করেছিলো তখন এই লক্ষ্যকে অনুধাবন করে ইয়াল্টা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । কিন্তু ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বহু সংগ্রামের পরেও বিশ্ব মানবতার পক্ষে এখনো সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
এই ব্যর্থতার পিছনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে :
১. ইয়াল্টা সম্মেলন; স্বাধীনতা, মানবাধিকার, প্রকৃত গণতন্ত্র এবং ন্যায়বিচারের মূলনীতি অনুসরণ করে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেনি।
২. ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে সকল একনায়কদের বরখাস্ত করা হয়নি। স্ট্যালিন যুদ্ধের পরেও তার স্বৈরশাসকের পদে দীর্ঘদিন বহাল ছিল এবং এই কারণে ১৯৪৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পৃথিবী “শীতল যুদ্ধের” অভিজ্ঞতা লাভ করে।
৩. ১৯৯০ সালের “শীতল যুদ্ধ” পরবর্তী সময়ে D-8 প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা নেতাদের পরিচালনায় পৃথিবী শান্তির পথ থেকে বিচ্যুত হয় এবং পশ্চিমা নেতারা শান্তির পরিবর্তে বিদ্বেষ ও শত্রুতার উপর নির্ভর করে- এমন একটি বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পছন্দ করে। সত্যের প্রকৃত বোঝা-পড়ার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থা গঠনের পরিবর্তে তারা সংঘাতময় বিশ্ব ব্যবস্থাকেই বেছে নেয়।
এর সবচেয়ে বড় ও সুস্পষ্ট প্রমাণ হলো, ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে স্কটল্যান্ডে ন্যাটোর সভায় ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের ভাষণ (এই ভাষণে বলা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলেও ন্যাটোর প্রয়োজনীয়তা এখনও শেষ হয়নি। ন্যাটোর প্রত্যেকটি দেশের পরবর্তী শত্রু হলো ইসলাম এবং এর অনুসারী মুসলমানরা)।
যেমনটা উপরে বলা হয়েছে, শান্তি এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা বিংশ শতাব্দীর শেষে একটি অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। D-8 গঠনের ধারণাটি ইস্তাম্বুলের ইরান প্রাসাদে ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত “উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা” বিষয়ক সম্মেলন চলাকালীন সময়ে হয়েছিলো। ১৫ই জুন ১৯৯৭ তারিখে মাত্র ৮ মাসের মধ্যে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সুচারুরূপে কমিশনগুলো তাদের উপর অর্পিত কাজ সম্পন্ন করে। সংস্থার চার্ট এবং D-8 এর কার্যবিধি শীর্ষ দেশগুলির রাষ্ট্র প্রধানগণের উপস্থিতিতে D-8 এর ইস্তাম্বুল ঘোষণার মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা হয়। সদস্য দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ সংস্থার এমন উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান। ফলে খুব দ্রুতই D-8 অঞ্চলে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটে।
যে দেশসমূহ নিয়ে D-8 গঠিত হয়েছিলঃ ১) তুরস্ক, ২) ইরান, ৩) মিশর, ৪) মালয়েশিয়া, ৫) ইন্দোনেশিয়া,৬) নাইজেরিয়া, ৭) বাংলাদেশ, এবং ৮) পাকিস্তান (পারমাণবিক)। ভৌগলিক দিক দিয়ে এই ৮ দেশের অবস্থান বিবেচনা করলে ডি-৮ এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু তা বুঝা কোন কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। অর্থনৈতিক রুটগুলোর উপর একটু চোখ বুলিয়ে আসি-
তুরস্কঃ ইউরোপ এবং এশিয়ার সংযোগস্থল। চানাক্কালের এবং বসফরাস প্রণালী দুটো তুরস্কের সীমানায়। তুরস্কের অধীনেই দু-দুটি প্রণালী। একই সাথে কেরচ প্রণালী তুরস্কের এই দুই প্রণালী ছাড়া অচল। অর্থাৎ তুরস্কের যদি চায় তাহলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩ টি প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। রাশিয়াকে এ পথেই বাণিজ্য করতে হয়।
মিশর ও ইরানঃ সুয়েজ ক্যানেল, বাব-আল মান্দেব এবং হরমুজ প্রণালী পাশাপাশি তিনটি প্রণালী। ইউরোপ থেকে এশিয়ার বাণিজ্য জাহাজের রুট একমাত্র এটিই।
মালেশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াঃ মালাক্কা প্রণালী হচ্ছে এই দুই দেশের অধীনে। জাপান, চীন, ও কোরিয়া উপদ্বীপের সকল বাণিজ্য এ প্রণালী দিয়েই করতে হয়।
পাকিস্তান-নাইজেরিয়া-বাংলাদেশঃ তিন দেশের সামর্থ্য সম্পর্কে সকলেই জানি। তেলসমৃদ্ধ দেশ নাইজেরিয়া, পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন পাকিস্তান এবং উৎপাদনশীল বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের অমূল্য সম্পদ। D-8 প্রতিষ্ঠার পরপরই ৮ টি দেশ নিজেদের মধ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। প্রথম পদক্ষেপ ছিল, ১৯৯৭ তে তুরস্কে উৎপন্ন হেলিকপ্টার পাকিস্তানে বিক্রি করা। ৮ টি দেশের মধ্যে ৬ টি দেশ ভিসা চুক্তি স্বাক্ষর করে। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয় D-8 এর অধীনে। টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, লোহা, স্টীল, ফার্মাসিটিক্যাল এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে খুব দ্রুতই। সেই সাথে Shipping and Maritime Service এর ক্ষেত্রে সকল দেশ চুক্তিবদ্ধ হয়। D-8 বর্তমানে নিষ্ক্রিয় হলেও কাজ থেমে নেই। তুরস্ক থেকেই যেহেতু এর উৎপত্তি, তাই তুরস্ককেই ভূমিকা পালন করতে হবে D-8 কে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে।
এই “নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা” এমন একটি প্রকল্প যা ৩ ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে । যথাঃ-
- D-8 নিউক্লিয়াস ইনস্টলেশন।
- ডি-৬০, ডি-১৬০ এবং ১০ টি বিশ্ব সংস্থার অংশগ্রহণ এর মাধ্যমে বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ থেকে বাঁচতে এবং সত্য ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি নতুন বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ৬০০ কোটি নিপীড়িত মানুষ একত্রিত হবে।
- দ্বিতীয় ইয়াল্টা সম্মেলন, D-8 এবং ডি-১৬০ একত্রে সত্য ও ইনসাফের ভিত্তিতে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য একত্রিত হবে। এই নতুন বিশ্ব প্রতিষ্ঠার মূল শর্ত হলো সত্য ও ন্যায়ের সৌধের উপর দাঁড়িয়ে শান্তিময় বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে মজলুমের হক্ব নিশ্চিত করা। এই কারণে D-8 কে এই শান্তিময় পৃথিবীর মূল ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং D-8 লোগোতে থাকা ৬ টি তারকা এই মূলনীতি গুলোকেই ব্যক্ত করে ।
D-8 এমন একটি সংস্থা যা বড় বড় কথা বলার পরিবর্তে কাজ করার নীতি গ্রহণ করে। বিশেষজ্ঞদের দ্বারা গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে প্রাথমিক কাজের সূচনা করেছে এবং উপসংহারে এসেছে প্রতিটি দেশের পরিকল্পনা এবং কর্মসূচী ঠিক করার মাধ্যমে। কোন দেশ কোন পরিকল্পনা পরিচালনা করবে এবং কোন কাজে কে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে সে পরিকল্পনাও সদস্য দেশগুলার মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।এই পরিকল্পনা প্রক্রিয়া চলাকালীন তুরস্ককে শিল্প ক্ষেত্রের প্রকল্পগুলির নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিলো। অন্যান্য সকল দেশের ন্যায় তুরস্কও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে D-8 প্রকল্পে অংশ নেয়। এই ক্ষেত্রে তুরস্কের ৫৪ তম সরকারের ক্ষমতার সময় বড় বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তুরস্কের ৫৪ তম সরকারের কৃষিজ ওষুধের উৎপাদন প্রকল্পটি এই সময়ে সমাপ্তকৃত প্রকল্পগুলির মধ্যে অন্যতম। D-8 গৃহীত প্রতিটি প্রকল্প এর সদস্য দেশগুলোর উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম। এই বিষয়গুলি অবিলম্বে উপলব্ধি করা সদস্য দেশগুলির জনগণ এবং মানবতা উভয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । তাই, স্বপ্ন দেখি একটি শক্তিশালী উম্মাহর… সায়েম মুহাইমিন


