হাজার হাজার বছর ধরে ধর্ম মানুষের চলার পথের পাথেয়। শুধু তাই নয়, মানবজাতির ইতিহাসে ধর্ম চিরদিনই নূতন পথের সন্ধান দিয়েছে। ধর্মের নামে অনেক রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে – আবার ধ্বংসের গহ্বরে বিলীন হয়ে গিয়েছে। এর প্রভাবে মানুষ উৎকর্ষ ও আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হয়েছে। আবার এর জন্য ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম অধ্যায়ের সংযোজন হয়েছে। কেউ অপরিসীম শান্তি পেয়েছে – কেউ জীবনকে একটা নিছক মায়া হিসেবে গ্রহণ করেছে। ধর্ম মানুষকে অপরিসীম শক্তি ও শিল্প-নৈপুণ্যের অধিকারী করেছে। আবার কেউ অন্ধবিশ্বাসে জর্জরিত হয়েছে – কেউ মূঢ়তায় কাতর হয়েছে। কিন্তু যারা এটাকে যথার্থ পর করেছে, তাদের জন্য বয়ে এনেছে শান্তির প্রবাহ।
সুতরাং বিভিন্ন ধর্মে বাহ্যিকভাবে যতই বিরোধ থাকুক না কেন – তাদের অন্তরে কোথাও যেন মিলের একটা সুর অনুরণিত হচ্ছে। এই সুরই হল ধর্মীয় উপজীব্য। দর্শনের সঙ্গে এর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ধর্মের মতবাদ যাই হোক না কেন – হোক সে উন্নত, হোক সে একেশ্বরবাদী বা সর্বেশ্বরবাদী, ধর্ম মূলগতভাবে এক সর্বময় শক্তির মহা বিধান লিপি। আর একটু সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয় যে, সেই সর্বময় শক্তির ইচ্ছানুযায়ী জীবন-পদ্ধতি গড়ে তোলাই ধর্ম। সে পদ্ধতি হবে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিচার করার পদ্ধতি। যতক্ষণ না আমরা মনে করতে পারবো যে, সমগ্র সৃষ্টির অন্তরালে এক মহান সদিচ্ছা নিহিত আছে- ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের উদ্দেশ্য ঠিক কিংবা আমরা সঠিক পথে চলছি কিনা, তা চিন্তা করার কোনোই মানে হয় না। আসল কথা, আমরা যদি সেই মহান সত্তাকে বিশ্বাস না করি – তাহলে কীসের জন্য আমরা আমাদের ভালো-মন্দ বিচার করব? কোন একটা সত্তার বিশ্বাস ছাড়া নৈতিকতার নামে সঠিকভাবে পথ চলা সম্ভবপর নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে – কাজের উদ্দেশ্য সবার জন্য এক কি না।
ভালো-মন্দ সম্পূর্ণ আপেক্ষিক শব্দ। সময়, কাল ও পরিবেশের উপর ভিত্তি করে এটা গড়ে উঠে।
আমরা যদি কালের বর্তমান গতিকে ধর্মবিরোধী বলে মনে করি – তাহলে নীতির রাজ্যে ধর্মীয় ভাবধারার প্রতিফল যথার্থভাবে ধরা পড়বে। একজাতীয় তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহল সর্বদাই প্রচার করে বেড়াচ্ছেন যে, ধর্ম হচ্ছে প্রাচীন যুগের এক বিশ্বাস। বিজ্ঞানের যুগে এর কোনো স্থান নেই। বিজ্ঞানের অবিরাম জয়যাত্রা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেবে। মানুষ ক্রমেই এক নতুন জীবন-দর্শনের সন্ধান পাবে। সেখানে সর্বেশ্বরবাদ মতবাদের কোন স্থান থাকবে না।
বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় এই সরল মতবাদে আধুনিকতার নাম-নিশানাও নেই- তা হলো বহু প্রাচীন। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য বিশ্বাসের সঙ্গে এর তুলনা করা যেতে পারে। সে যুগে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীগণ মনে করতেন, বিশ্ব রহস্যের সমাধান সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে। কাজেই সেখান থেকেই মানুষ ঈশ্বর সদৃশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে। বিংশ শতাব্দীর মনীষীরা এ ব্যাপারে আরও বেশি রক্ষণশীল। তারা অদৃশ্যবাদী বিজ্ঞানে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে পাননি। কারণ যতই গবেষণা এগিয়েছে, বিশ্বের রহস্য বৈচিত্র্য ততই জটিল হয়ে দাড়িয়েছে। কীভাবে পৃথিবী সৃষ্টি হলো এবং কীভাবেই বা এতে জীবনের উন্মেষ হল, তা আজ বিজ্ঞানের দ্বারা সঠিকভাবে বলা যায় না। আমরা কি উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি, তারও যথার্থ কোন উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারেনি। এই শেষোক্ত প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের ভালো-মন্দের সংজ্ঞা নির্দেশ করা উচিত নয়। কারণ এগুলো হলো আপেক্ষিক শব্দ এবং মানবসত্তার অন্তর্নিহিত জ্ঞানের সঙ্গে এদের সংযোগ রয়েছে। সুতরাং ভালো-মন্দের বিচার না করতে পারলে নৈতিকতার মানদণ্ড নিরূপণ করাও অর্থহীন।
এই সত্য কথাটি আজ বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করেছেন। গবেষণার দ্বারা যখন তারা সর্বেশ্বরবাদী সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছেন – তারা নীতির রাজ্যে বিজ্ঞানের নিয়ন্ত্রণের কথাও ভুলতে বসেছেন। তবে তার মানে এই নয় যে, বিজ্ঞানের উপর তাঁরা আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। বিজ্ঞান মানুষকে অসীম কীর্তির অধিকারী করতে পারে, সন্দেহ নাই – কিন্তু এর সঙ্গে মানুষের নৈতিকতাবোধের কোন সম্বন্ধ নাই। বিজ্ঞান বিশ্বের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটায়। পর্যবেক্ষণ ও সৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ আইন দ্বারা বিজ্ঞান আমাদের জীবনবোধ সম্বন্ধে কোন ধারণা দিতে পারে না। বিজ্ঞানের কোন শক্তিশালী মতবাদই অস্বীকার করতে পারে না যে, নৈতিকতার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের কোন স্থান নেই। অপরপক্ষে এটা সম্পূর্ণ ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে।
ধর্মীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই আমরা নৈতিক মানের মূল্যায়ন করতে পারি। আমি সব সময় বলেছি, সর্বেশ্বরবাদী নীতিতে সব সময়ই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং আমরা কোন একটা ধর্ম গ্রহণ করব কি করব না, সেটা সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা ও যুক্তির আলোকে যাচাই করে দেখতে হবে। তাহলেই আমরা বুঝতে পারব, কোন ধর্মের সঙ্গে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের কতটুকু সম্বন্ধ আছে। কিন্তু এর অর্থ ধর্মের মূল ভিত্তি থেকে সরে আসা নয়। কারণ ধর্মই আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারে – করে তুলতে পর নতুন জীবনের অধিকারী, যা ব্যক্তি জীবনের অনেক ঊর্ধ্বে। ধর্মই একমাত্র বিশ্বাস, যা বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে মৈত্রীর সেতুবন্ধন স্থাপন করতে পারে। বর্তমান সমস্যা বিক্ষুব্ধ সমাজে এই জাতীয় মৈত্রীর অশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই দিক থেকে বিচার করে আমরা দেখতে পাই যে, মানব জীবনের উন্নতির ক্ষেত্রে ধর্ম কেবল অতীতের জিনিস নয়, কিংবা অতীতের সস্তা কিছু নয় – ধর্ম হচ্ছে সর্বকালের সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক।
আজকের ধর্ম
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমান বিশ্বে ধর্মীয় প্রবণতা ক্রমেই কমে আসছে। তার মানে এই নয় যে, মানবপ্রকৃতি নীতিভ্রষ্ট হয়েছে। এর দ্বারা মানুষ এখনও ত্যাগ ও আদর্শের মহিমায় মহিমান্বিত হতে পারে কিংবা লোভ ও নিষ্ঠুরতার পঙ্কিল গহ্বরে নিপতিত হতে পারে । তাছাড়া এমন কোন চিহ্ন নেই, যার দ্বারা আমরা বলতে পারি মানুষ তার আত্মজীবনের সঙ্গে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের মিলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের মত আন্দোলন কি ধর্মীয় ভাবধারার ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হয়েছে? এ সমস্ত ভাবধারা ধর্মের এক নিঃস্ব বিকল্প হলেও আমরা এ কথা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, বর্তমান মানব সমাজও প্রাচীন মানবজাতির মতই ধর্মাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এর মূল সত্য গোপন করার জন্যে মানুষ কতই-না বিকল্প ব্যবস্থার আশ্রয় নিয়েছে।
সত্যই মানুষকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ধর্মের কর্ণধারগণ তাদের মৌলিক কর্তব্য পালনে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। আর এই কর্তব্য হল রাজনৈতিক বিধিব্যবস্থার সঙ্গে ধর্মীয় নীতির সমন্বয় সাধন। আজকের জটিল সমাজ থেকে অনেক ধর্মীয় বিশ্বাস দূরে সরে গিয়ে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও আমরা দেখতে পাব যে, আমাদের যুগ সংশয়ের যুগ। এই যুগে আমাদের ধর্মীয় নেতাদের পরাজয়-বিক্ষুদ্ধ পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
বিজ্ঞানের দুর্বার জয়যাত্রা ও শিল্প, বাণিজ্য ও রণকৌশলের প্রয়োগের মাধ্যমে তথাকথিত মামুলি সামাজিক আদান-প্রদান অচল হয়ে পড়েছে। জীবনযাপনে প্রধান যে প্রয়োজন, যেমন – খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান ইত্যাদি এক অতি জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এমন এক সময় ছিল, যখন এগুলি এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। মানুষ যুগ যুগ ধরে খাদ্য-বস্ত্রের অন্বেষণ করেছে, দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করেছে- আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন যুগে সমাজ এত জটিল ছিল না। তাই এর সমাধানও সহজ ছিল এবং মানুষের মনে কোনো জটিল সমস্যার সৃষ্টি করত না। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রচণ্ড অভিযান আমাদের সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাকে ওলট-পালট করে দিয়েছে। মানুষের সমস্ত কার্যকলাপের মধ্যে দিগন্ত বিস্তৃত জটিলতা দানা বেঁধে উঠেছে। বিজ্ঞানের বদৌলতে আমরা আজ এমন জিনিস লাভ করেছি, যা পূর্বে মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি। তাছাড়া এগুলো পাওয়ার জন্য কেউ নীতিগতভাবে প্রস্তুতও ছিল না। এর ফল দাঁড়িয়েছে আমরা প্রয়োজনীয় নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছি – অর্থনৈতিক কলাকৌশলও আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। তাই আমরা বর্তমান পরিবেশে খাপছাড়া হয়ে পড়েছি। সমাজের এই জটিলতা দূরীকরণে মানুষের যে সুতীব্র বাসনা রয়েছে, তা বর্তমানের বহু ভাবধারায় লক্ষ্য করা যায়। এই সমস্ত ভাবধারার পারস্পরিক সংঘাত আমাদের এই কথাই মনে করিয়ে দেয় যে, সমাজের স্থায়িত্ব ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে।
আজকের ঝঞ্ঝাপূর্ণ সামাজিক অর্থনীতি শুধু আমাদের বস্তুগত জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, এর প্রতি আমাদের বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়েছে স্বভাবতই রাজনীতি ও অর্থনীতি, নৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সমালোচনায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছে। এর কারণ আমাদের ধর্মীয় নেতাগণ বর্তমানে বিক্ষুব্ধ জগতের সমস্যা সমাধানে খুব কমই কাজে এসেছেন। এর ফলে সামাজিক অর্থনীতির প্রচণ্ড ধাক্কা আমাদের নৈতিক মূল্যবোধকে আলোড়িত করে তুলেছে, জন্ম দিয়েছে নতুন ভাবধারার।
সামাজিক অর্থনীতির পটভূমিকায় ভালো-মন্দ বিচার করা যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি আধ্যাত্মিক মূল্যায়নের মাধ্যমেও এর বিচার করা যায় না। শুধু এই কারণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বহুলোক কেমন যেন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে – অবশ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোড়ন এর জন্যে অনেকাংশে দায়ী। বর্তমান রাজনৈতিক ভাবধারার বিজয়ের মাধ্যমে কিংবা প্রচলিত অর্থনৈতিক পদ্ধতিকে নতুনভাবে গড়ে তুললেই কি এর প্রকৃত সমাধান পাওয়া যাবে? এই প্রশ্ন আজ সবার মনে সংশয়ের সৃষ্টি করেছে, ক্রমেই এই ধারণা আমাদের মনে বদ্ধমূল হচ্ছে যে, রাজনৈতিক ও সামাজিক মতাদর্শের দ্বন্দ্ব ছাড়াও বর্তমান বিশ্বব্যাপী আলোড়নের মূলে আরও কিছু আছে। এ বিষয়টি হচ্ছে- নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি আমাদের চরম অবজ্ঞা। এখন আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছি যে, যুগের সমস্যা হচ্ছে ‘নৈতিকতার’ সমস্যা।
মানুষের ভালো-মন্দের বিচারে ও তার সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে-সমস্ত নীতিবোধ সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিল, তা এখন এক কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তার অনেকগুলোই বর্তমান যুগে অসমাপ্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্মীয় নেতা বর্তমানে প্রচলিত সামাজিক বিধিব্যবস্থাকে ধর্মের সগোত্রীয় বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন এবং এভাবেই তারা মানুষের বাস্তব আকাঙ্ক্ষাকে পরিপূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
শতাব্দীর প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো আজ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো আজ ধ্বংসের পথে। যে-সমস্ত সামাজিক বিধান ঐ সমস্ত বিশ্বাসের সঙ্গে সন্বন্ধযুক্ত ছিল, তারা আজ ভাঙ্গনের পথে। এটা শুধু কোন একটা সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় তা আজ সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণভাবে বলতে গেলে ধর্ম আজ সর্বত্রই অস্তের পথে। কোন কোন জায়গায় বিজ্ঞানের যুগের শিশুসুলভ আবেগের আতিশয্যে কিংবা দেবদেবীর প্রগাঢ় অর্চনার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় ভাবধারাকে নস্যাৎ করবার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি আগেই বলেছি, আমাদের সমকালীন প্রবল জাতীয়তাবোধের এমন একটা প্রগাঢ় বাহ্যিক আবরণ আছে, এটাকে অনেকেই ধর্মসদৃশ ভেবে ভুল করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধর্মের সঙ্গে এর আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। ভালো-মন্দের চূড়ান্ত ধারণায় ধর্মের উন্মেষ। কিন্তু জাতীয়তাবাদের এই ধরনের ধারণার কোন স্থান নেই-সেখানে এগুলো সম্পূর্ণ আপেক্ষিক। কোন জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে এতে ভালো-মন্দের বিচার করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং এভাবেই আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের চরম অবমাননা করা হয়েছে।
আমরা যে কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই এই সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করি না কেন আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে নৈতিক শিক্ষা ধর্ম থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে, আজ পর্যন্ত অন্যকোনো বিকল্প নীতিবোধ আবিষ্কৃত হয়নি। এমন কি বিধর্মী নৈতিকতা যে চলতে পারে, তার কোন নজির কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেহেতু এর চিহ্ন আমরা কোথাও খুঁজে পাইনি, সেজন্য মানব সভ্যতায় যে দিগন্ত একদিন ধর্মীয় বিশ্বাসে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল, তা আজ ক্রমেই শূন্য হয়ে পড়েছে। চারিদিক থেকে হতাশা যেন আমাদের গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। এই হতাশা মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনের হতাশা – তা হলো ভালো-মন্দ বোধশক্তির চরম শূন্যতা।
সংগ্রামের সর্বব্যাপী তিক্ততা আজ সমগ্র মানবতাকে আলোড়িত করে তুলেছে। জাতিতে জাতিতে, গোত্রে গোত্রে আজ স্বার্থের যে হানাহানি, শক্তির যে নারকীয় প্রতিযোগিতা, সত্যের এই যে বিশ্বব্যাপী অবমাননা – সবলের দুর্বলকে শোষণা করার যে স্পৃহা, তার মূলে রয়েছে নৈতিক মূল্যবোধের অভাব। নৈতিকতার এই সংকট আজ সমগ্র মানব সমাজকে
হতাশ করে তুলেছে এবং এর ফলেই জন্ম নিয়েছে জাতিগত দ্বন্দ্ব। অশেষ দুঃখভোগ মানুষকে জর্জরিত করেছে। আশার কথা-আজ আমাদের সমাজে এ ধারণা ক্রমশই প্রসার লাভ করেছে যে, নৈতিক নিয়ন্ত্রণের অভাবেই আজ আমাদের এ দশা-আমাদের চালচলন বাঁধভাঙা নদীর মতো প্রবাহিত হয়েছিলো বলেই আমাদের এই অবস্থা।
ধর্ম এবং পাশ্চাত্য
ইসলামের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। অনেকের মত আমরাও বাত্যাবিক্ষুব্ধ পরিবেশে বাস করছি। সবার জন্য অনিবার্য নৈতিক সঙ্কটের দিন ঘনিয়ে এসেছে। আমাদের সমাজব্যবস্থা আজ আলোড়িত। কালের অনেক অমূল্য বিধিবিধান পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার তাগিদে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। এই বিধি বিধানের অনেকগুলো ইসলামের অন্য অপরিহার্য ছিল-যদিও সামঞ্জস্যহীন যে ছিল না, একথা অবশ্য আমি বলছি না। ইসলামের নামে বিভিন্ন স্লোগান ও ইসলামের পথে মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাস করার জন্য যতই চিৎকার করা হোক না কেন, অধিকাংশ মুসলমানের নিকট ইসলাম একটা আচার-অনুষ্ঠানের ধর্মে পরিণত হয়েছে এবং খুব কম মানুষই তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধর্মের বিধি -বিধানগুলো প্রয়োগ করেছে। পাশ্চাত্য ভাবধারায় অনুপ্রাণিত তথাকথিত প্রগতিবাদীরাও এটা অস্বীকার করতে পারে না। সবার মুখেই যেন একটা কথা পরিহাস করছে- ‘আধুনিককাল ধর্মীয় চিন্তা বিরোধী’। এখন এটা দিবালোকের মত পরিষ্কার যে, কালের প্রবণতা ধর্মীয় চিন্তার বিরোধী নয়। এই ভাবধারা পাশ্চাত্যপ্রসূত। এর সঙ্গে পাশ্চাত্যের ইতিহাসগত অভিজ্ঞতার মিল নেই। এর কারণ হলো, পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদগণ যতই ধর্মের বিরুদ্ধে বলুন না কেন, মনে করতে হবে এটা তাঁর খ্রিষ্ট ধর্মের অভিজ্ঞতারই ফল। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ইসলামে এর স্বীকৃতি নেই। সত্যিকথা বলতে কি, খ্রিষ্টধর্ম শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। এই ধর্ম চিরদিন মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা, তার অর্থনীতি, রাজনীতি ও পার্থিব জগৎ থেকে নিজেকে চিরদিন পৃথক করে রেখেছে। এর প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জীবনের মধ্যে আকাশ-পাতাল বৈষম্য গড়ে উঠেছে। খ্রিস্টধর্মে আত্মা ও জড় পরস্পর বিরোধী। পার্থিব জগতকে শয়তানের রাজত্ব বলে গণ্য করা হয়। সুতরাং এর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে শয়তানের সম্পর্কের সঙ্গেই তুলনা করা হয়। এ কারণে পার্থিব জগৎ থেকে মুক্তি পাবার জন্য মানুষের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এর দ্বারাই মানুষ তার চরম বিকৃতি থেকে আদর্শের পথে ফিরে যেতে পারে। সর্বেশ্বরবাদের প্রতিষ্ঠাতা এম.টি পলের মতে – “সমস্ত পাপের মূলে রয়েছে দেহ ভোগের স্পৃহা।” কাজেই খ্রিষ্টীয় নীতিবোধে মানবজীবনের শারীরিক অনুভূতির প্রতিফলন নাই। আজ কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না যে, ইন্দ্রিয়-ভোগের প্রতি ঘৃণা খ্রিস্টধর্মের মূল বিষয়। প্রতিটি যুগে গীর্জাগুলি যখন ইউরোপীয় নৈতিকতার মূল কেন্দ্র ছিল, তখন এর শিক্ষার যৌক্তিকতা কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। সে যুগে জীবনের ইন্দ্রিয়গত অনুভূতিকে শুধু নিকৃষ্টই ধরা হত না, বরং আধ্যাত্মিক জীবনের অন্যতম শত্রু বলে গণ্য করা হতো। এমনকি, বর্তমান যুগে যখন পাশ্চাত্য মানস খ্রিষ্টানদের প্রভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং সর্বত্রই অধিকার আদায়ের জোয়ার এসেছে তথাপি খ্রিস্টধর্ম সেই পুরানো মতবাদের কোন পরিবর্তন হয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে হজরত মুহাম্মদ (সঃ)-কে আধ্যাত্মিক জগতের আদর্শ মানব বলে স্বীকার করা হয় না। কারণ তিনি ইন্দ্রিয় ভোগ করেছেন এবং তা তার অনুসারীদেরকেও অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কোন আধুনিক ব্যাখ্যাই খ্রীষ্টধর্মের ইন্দ্রিয় বিরোধী মনোভাবকে অস্বীকার করতে পারে না। আজ পাশ্চাত্যের চাপে পড়ে সেটা যতই পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হোক না কেন, ইতিহাসকে কোনোদিন অস্বীকার করা যাবে না। এই উভয় সংকট সম্বন্ধে খ্রিষ্টধর্ম তার অনুসারীদের মধ্যে যে সংশয়ের ভাব সৃষ্টি করেছে, তা আমরা আরও গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারব, যদি ইন্দ্রিয় ভোগের মৌলিক অনুভূতিকে আমরা সমস্ত পাপের মূল বলে মনে করি। কিন্তু খ্রিষ্টানদের গির্জা অসাধ্য সাধন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাস্তবক্ষেত্রে মানবজীবন থেকে এ কামনা সে বিদূরিত করতে পারেনি। এই কারণেই মধ্যযুগের প্রারম্ভে গীর্জার বাণী ও মানুষের চিরন্তন প্রবণতার সঙ্গে একটা আপোষ-রফা করার চেষ্টা করা হয়। সুতরাং ইউরোপীয় ও আমেরিকান সমাজ ধর্মের মূলনীতি থেকে যে অনেকদূর সরে গিয়েছেন সেই জন্য তাদের নীতিবোধকে দায়ী করা চলে না। এ দোষ হলো ধর্মের , যে ধর্ম মানুষকে ভালোবাসতে শিক্ষা দিয়েছে বটে, কিন্তু পার্থিব জগৎ সম্বন্ধে নেতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এটা মেনে চলা কি সত্যই সম্ভব? তাছাড়া খ্রিষ্টধর্ম তার শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগেরও কোনো নিদর্শন রেখে যায়নি। ধর্মের তত্ত্বগুলো শুধু তত্ত্বই হয়ে থেকেছে, তা কোনোদিন মানুষের প্রয়োজনে আসেনি। এমনকি, বর্তমান খ্রিষ্টান চিন্তাবিদগণ সেই পূর্বের ভাবধারা আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে। নিচের উদ্ধৃতি এর সাক্ষ্য দেবে
“ধর্মের নীতিকথাগুলি মেনে চলা খ্রিষ্টানদের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু এগুলি বাস্তবে প্রয়ােগ করা যাবে না। যিশু খ্রিস্টের বাণী এবং নীতিকথা আজ বাস্তবে প্রয়োগ করা অসম্ভব।”
(ই বারকার এবং আর প্রিস্টন রচিত “ক্রিশ্চানস ইন সোসাইটি” থেকে সংগৃহীত: সাল ১৯৩৯, পৃঃ ২৮)
কিন্তু একজন মুসলমান একটা সম্পূর্ণ পৃথক ধর্মীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত। এটা কখনই আশা করা যায় না যে, মানুষ ব্যক্তিগত সমস্যার কথা চিন্তা না করে নীতিকথা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ জাতীয় ভাবধারা খ্রিষ্টান সমাজে চলে আসছে। বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতার নৈতিক ও সামাজিক অপতনের পশ্চাতে ধর্মের এই সকরুণ ভাবধারা বিশেষভাবে কাজে করছে। কারণ পনেরোশ’ বছরেরও আগে পাশ্চাত্যের এই নৈতিকতা খ্রিষ্টধর্ম থেকেই নেয়া হয়েছিল, অর্থাৎ ১৫শ’ বছরেরও আগে এই ধর্মীয় নীতিবোধ পাশ্চাত্য সভ্যতাকে এই বলে শিক্ষা দিয়েছে যে, নীতি কোনোদিন বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। যে-সমস্ত বাধাবিপত্তি আজ পাশ্চাত্য সভ্যতাকে আলোড়িত করে তুলেছে, তার জন্য এই দ্বৈত নীতিবোধই বিশেষভাবে দায়ী। এই ভাবধারা অন্তরের মূল্যবোধ ও সুবিধাবাদের মধ্যে একটি পরিষ্কার সীমারেখা টেনে দিয়েছে এবং এই অন্তরালে কোন কোন সম্প্রদায় গর্হিত কাজ করে চলেছে। এর বিরুদ্ধে যত প্রতিবাদ করা হোক না কেন, পাশ্চাত্যের কোন রাজনীতিবিদ বা অর্থনীতিবিদ তার নৈতিকতাতে সুবিধাবাদের উপর স্থান দেননি। কারণ গত ১৫শ’ বছর ধরে খ্রিষ্টধর্ম এই শিক্ষাই দিয়ে এসেছে যে, ধর্ম একটা শৌখিন চিন্তাধারার প্রতিফলন মাত্র এবং তা শুধু গির্জাতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে।
কিন্তু অপরপক্ষে অন্যান্য কাজকর্ম এর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এর কারণ হলো, গত কয়েক শতাব্দী ধরে পাশ্চাত্য সভ্যতা ধর্ম মানেই খ্রিষ্টধর্ম বলেই মনে করে এসেছে। তারা বাহ্যিকভাবে ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। এর ফল এই দাঁড়িয়েছে যে, তারা খ্রিষ্টধর্ম ব্যর্থতাকে সকল ধর্মেরই চূড়ান্ত পরাজয় বলে ধরে নিয়েছে। বাস্তব ক্ষেত্রে যে ধর্মের সঙ্গে আদৌ পরিচিত নয় – তার ফলাফল সম্বন্ধেও হতাশ হয়ে পড়েছে।
আজ পাশ্চাত্যের অধিবাসীগণ পৃথিবীর শক্তিশালী ধর্ম সম্পর্কেও সংশয় প্রকাশ করছে। কিন্তু প্রতিদানে পৃথিবীর মানুষকে কিছুই দিতে পারেনি। অপরপক্ষে এমন এক ধর্ম তারা প্রচার করছে, যাতে সামাজিক মূলনীতির নাম-নিশানাও খুঁজে পাওয়া যায় না – তাতে আছে শুধু নীতিবাক্যের ক্লান্তিকর উৎপীড়ন। এই ধর্ম অগণিত উপাসনালয়ের জন্ম দিয়েছে – একটা অস্পষ্ট লাগামহীন তত্ত্ব সোচ্চারিত করেছে কিন্তু ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতির জন্য কোন কথাই উপস্থাপন করেনি। তাদের মতে কেবলমাত্র উপাসনালয়ই মানুষকে শোষণ ও উৎপীড়নের কবল থেকে মুক্তি দিতে পারে। তথাকথিত নিরপেক্ষ ক্ষমতাসীন নেতাদেরকে তাদের অন্যায় সামাজিক নীতিকথা নিরীহ মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে এই ধর্ম পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছে। তাই ধর্মের কথা পাশ্চাত্যবাসীদের মনে ভয়ের সঞ্চার করেছে। তারা আশঙ্কা করছে যে, ধর্ম হয়ত আবার শোষণ ও পীড়নের শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
অনুদিত


