মানুষের অতীত কার্যাবলির সমষ্টি ইতিহাস বলে পরিচিত হয়েছে। ইতিহাস সর্ম্পকে দুটি প্রশ্ন রয়েছে, যা সবসময় আমাদের ভাবিয়ে তুলে। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে – যা কিছু ইতিহাসে ঘটেছে তা কেন ঘটেছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে – যা ঘটেছে তা কিভাবে ঘটল।
ইতিহাস ব্যাখার প্রয়োজন রয়েছে। এতে করে আমরা আমাদের অতীত ভুলের কথা জানতে পারি। এর ফলে আমরা সামনের ভুল থেকে বাঁচতে পারি। সাবধান ও সর্তক হতে পারি। এখন আমি কয়েকটি ইতিহাস দর্শন নিয়ে আলোচনা করব। তারপর ইসলামের ইতিহাস দর্শন বলব।
বিখ্যাত দার্শনিক পলিবিয়াস, যিনি ঈসা (আঃ) এর পূর্বে জন্ম নিয়েছেন, তিনি ইতিহাস দর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন – প্রথমে কোনো দেশে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। রাজতন্ত্র বলতে তিনি বুঝিয়েছেন অত্যাচারী নয়, এমন এক শাসকের শাসন। এর পরে আসে স্বৈরতন্ত্র। স্বৈরতন্ত্র বলতে তিনি বুঝিয়েছেন অত্যাচারী নয়, এমন এক শাসকের শাসন। এরপর স্বৈরতন্ত্রের পতন হয় এবং আসে সম্মিলিত শাসন। এভাবে ইতিহাসে রাজনীতির চাকা ঘুরতে থাকে। তিনি তার বইতে অনেক উদাহরণ দিয়েছেন।
এরপর আসে স্পেংগলারের ইতিহাস দর্শন। তিনি বলেছেন প্রত্যেক সংস্কৃতি নিজ সময়ে রাজত্ব করে গিয়েছে। তারপর তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর সংস্কৃতির পুনর্জীবন সম্ভব নয়। এই মতের কোনো সত্যিকার ভিত্তি নাই। এই মত গ্রহণ করলে ইসলামের পুনর্জীবন আর সম্ভব নয়। সুতরাং এ মত গ্রহণ করা যায় না। সংস্কৃতি ও সভ্যতার পুনর্জীবন হয় কিছুটা ভিন্নভাবে। ইতোমধ্যে আমরা দেখছি যে ইসলামের পুনর্জীবন হচ্ছে।
এরপর হেগেলের ইতিহাস দর্শন আসছি। হেগেলের মতকে বিপরীতের সমন্বয় বলা যেতে পারে। ইতিহাসের একটি অধ্যায়ে সভ্যতা ও সংস্কৃতির গোটা রূপটি মিলে একটি সভ্যতার যোগ হয়। এরপরে বিপরীত ধ্যান ধারণার জন্ম নেয়। প্রথমটিকে তিনি থিসিস বলেছেন। এবং দ্বিতীয়টিকে তিনি এন্টি-থিসিস বলেছেন। পরবর্তীতে এ দুটির সংঘাতে সমন্বয় বা সিনথেসিস হয়।
হেগেলের মতে মানুষের কর্মের কোনো স্বাধীনতা নেই। মানুষের উচিত নয় নিজেকে স্বাধীন মনে করা। সবকিছু ইতিহাসের গতিতে ঘটছে। এটা ইসলামের তকদিরের চেয়ে অনেক ভিন্ন। ইসলামের তকদিরের একটি অংশ হচ্ছে তদবির বা চেষ্টা। কিন্তু হেগেলের মতে কোনো তদবিরের স্থান নাই। সুতরাং এই মতকে গ্রহণ করা যায় না। এই মত গ্রহণ করলে অতীতের দিকে ফিরে তাকাবার কোন প্রশ্ন উঠে না। অতীত তার যা কিছুু দেয়ার তা দিয়ে দিয়েছে। এই মত গ্রহণ করলে চিরন্তন বলে কিছু থাকে না। কিন্তু সত্য ও মিথ্যা চিরন্তন।
এখন আমি মার্কসীয় ইতিহাস আলোচনা করব। মার্কসীয় দর্শনের মূলকথা সামগ্রিকভাবে উৎপাদন ব্যবস্থায় একটি সমাজের কাঠামো রচনা করে। উৎপাদন ব্যবস্থায় সে বস্তুভিত্তি যার উপর আইন ও রাজনীতি ব্যবস্থা দাঁড়ায়। মানুষ তার কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীন নয়। সবকিছু নির্ভর করে উৎপাদন ব্যবস্থার উপরে। মার্কসের এ মতামত গ্রহণ করা যায় না। মার্কসের মতে সামাজিক পরির্বতনের একমাত্র কারণ উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন। এটা সঠিক নয়। সামাজিক পরির্বতনের অনেক কারণ আছে। উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন ও অন্য কোনো বিষয়ের প্রভাবে হয়ে থাকে। মার্কস মনে করেন যে নৈতিকতাও উৎপাদন পদ্ধতির মতো হয়ে থাকে। একথা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। নৈতিকতার মূল দিকগুলো সবসময়ই এক।
এখন আমি ইসলামের দর্শন ইতিহাস আলোচন করব। ইসলামের দৃষ্টিতে সকল শক্তি মূলত আল্লাহ পাকের। অন্যদের যা শক্তি তা আল্লাহর দেয়া। সব পরির্বতনের কারণ বস্তুশক্তি। এটা ইসলাম স্বীকার করে না। ইসলাম বস্তুশক্তি ও জাগতিক শক্তিকে চূড়ান্ত মনে করে না। বদরের যুদ্ধই তার প্রমাণ। যেখানে তিন শতাধিক মুসলিম দুর্বল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মক্কার মোশরেকদের বিপুল সংখ্যার বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল।
ইতিহাস দর্শনের অন্যতম দিক হচ্ছে মানুষের উন্নতি অবনতির আভ্যন্তরীণ তাৎপর্য পেশ করা। সবকিছু বস্তুশক্তিতে হয় না। যেমন রোম নগর রাষ্ট্র ছিল। তাদের লোকবল অস্ত্রবল তেমন কিছু ছিল না। তা সত্ত্বেও তারা বিশ্বরাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল। তেমনিভাবে মদিনার ছোট নগর রাষ্ট্রটি এক বিশাল এবং উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল। আল্লাহ প্রয়োজনমত ইতিহাসে হস্তক্ষেপ করেন। যেমন বদর যুদ্ধে করেছিলেন। এবং মদিনা রাষ্ট্রের অগ্রগতিতে করেছিলেন। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন যে তিনি শান্তি সৃষ্টি করার জন্য এক জাতি দ্বারা অন্য জাতিকে প্রতিহত করেন (সূরা হজ্জ) কিন্তু সাধারণভাবে আল্লাহ তা’য়ালা হস্তক্ষেপ করেন না। মানুষকে আল্লাহ তা’য়ালা স্বায়ত্তশাসন দিয়েছেন। খেলাফতের মর্যাদা এটাই এবং তাকদিরের মূল তাৎপর্য এটাই।
ইসলামের ইতিহাস দর্শনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চারিত্রিক গুণাবলির উপর অধিক গুরুত্বারোপ দেয়া। মানব ইতিহাসে বিভিন্ন জাতির উন্নতি অবনতির জন্য আল্লাহ তা’য়ালা সূরা আল আছরে নৈতিক গুণাবলির কথা বলেছেন।
‘‘ সময়ের কসম মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। যদি তারা বিশ্বাসী না হয়। যদি তারা নেক কাজ না করে। সত্যের ব্যাপারে এবং সবর করার ব্যাপারে একে অপরকে উৎসাহ না দেয়।”
ইতিহাসের গতিধারায় মানুষ কোনো কালের পুতল নয় – যা মার্কসবাদ ও হেগেলের দর্শনে দেখা যায়। মানুষের ভূমিকা সক্রিয় এ কথা ইসলাম স্বীকার করেছে। মানুষকে খলীফা স্বীকারের প্রকৃত তাৎপর্য এটাই। মানুষের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা সন্দেহ নাই। কিন্তু মানুষের স্বাধীনতার সীমাও অত্যন্ত ব্যাপক। এই ব্যাপক সীমায় মানুষ সক্রিয়ভাবে দায়িত্বপালন করে,করতে হয়,ইহাই ইসলামের মত।


