মুসলিম শিল্পের একত্ব এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বীগণ

ইসলামী শিল্পকলার একত্ব নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন। যদিও, ইতিহাসবিদেরা ভৌগোলিক বা কালানুক্রমিকভাবে পৃথক বিপুলসংখ্যক বিচিত্র মোটিফসমূহ উপাদান-উপকরণ এবং রীতিপ্রকরণ লক্ষ্য করে থাকেন, তবুও সমস্ত ইসলামী শিল্পকলার প্রবল বাস্তবতা হচ্ছে এর উদ্দেশ্য রূপের একত্ব কর্ডোভা থেকে মিন্দানাও পর্যন্ত দেশগুলো ইসলামে দীক্ষিত হবার পরই এর শিল্পকলায় একই রকম গঠনগত বৈশিষ্ট্য এবং বিকাশ স্পষ্ট হয়ে উঠে এতে দেখা যায়, রীতি বা শৈলির অগ্রাধিকার এবং অন্তহীনতার অগ্রাধিকার। সমস্ত ইসলামী শিল্পকলায় কুরআন এবং হাদীসের অতিশয় উদ্দীপক শব্দমালা, আরবী এবং ইরানী কাব্যের অথবা ইসলামী সাহিত্যের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অভিব্যক্তিগুলোর শরণ নিয়েছে এবং সেগুলো ব্যবহার করেছে, আরবী লিখন শিল্প বা ক্যালিগ্রাফিতে সেসবের রূপ দিয়েছে। একইভাবে, যুগের পর যুগ ধরে সকল মুসলমান কোরআন তেলাওয়াতে এবং আযানে সাড়া দিয়েছে গভীরতম আবেগের সঙ্গে, এমন কি সেসবের আরবী অর্থ সামান্য বুঝে বা না বুঝেই। এসব ক্ষেত্রে তাদের বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গমনকারী যুক্তি এবং বিচার বুদ্ধি, বোধশক্তি সক্রিয় না হলেও তাতে ইন্দ্রিয়জ এবং ইনটুইটিভ বৃত্তিসমূহ সম্পূর্ণ সক্রিয় হয়ে ওঠে- এসথেটিক বা নান্দনিক মূল্যগুলোর মান লাভের প্রত্যাশ্যায়। প্রকৃতপক্ষে তাদের নান্দনিক উপলব্ধি, যাদের তাত্ত্বিক উপলব্ধি পঠন এবং প্রণিধানের জন্য যথেষ্ট, তাদের এসথেটিক উপলব্ধির মতই একইরূপ প্রবল- কেননা নান্দনিক মূল্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে আশু ইনটুইশন হামেশাই অগ্রবর্তী। এক্ষেত্রে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরগামী বোধশক্তি যেন একটি গৌণভূমিকা পালন করে, কেবলমাত্র সহযোগিতার হাতই প্রসারিত করে। ইসলামের নান্দনিক মূল্যের শক্তি এবং তার শৈল্পিক একত্ব, যা চূড়ান্ত রকমে স্বতন্ত্র ও বিচিত্র সাংস্কৃতিক সমাবেশের মধ্যে থেকে এমনিতরো শৈল্পিক একত্ব সৃষ্টি করে যে, আটলান্টিকের পূর্ব উপকূল থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম তীর পর্যন্ত, যে পর্যটক সফর করে সে এমন একটি অঞ্চলে ভ্রমণ করে, যা এর ইসলামিক স্থাপত্যের, যা লতাপাতার শিল্পরূপ আরবী লিখন শিল্প পদ্ধতির দ্বারা অলংকৃতকরণে, তা তার কাছে সুপরিচিত ঠেকে ভিন্ন ভিন্ন জাতি, বর্ণ, ভাষা এবং জীবন পদ্ধতির মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যে লক্ষ্য ইসলাম যে সাহিত্যিক দৃষ্টিকার্য এবং সাংগীতিক মূল্য সৃষ্টি করেছে, সে বিষয়ে সে উপলব্ধি করে একটি অভিন্ন অনুভূতি

 

“Misconceptions on the Nature of Islamic Art” শীর্ষক যে প্রবন্ধটির প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাচ্ছে, তাতে আমরা অলংকরণ, চিত্রণ, স্থাপত্য, সাহিত্য, সঙ্গীত এবং শিল্পতত্ত্বের ক্ষেত্রে তথাকথিত প্রাচ্যবিদ পন্ডিতদের পান্ডিত্যের কিছু নমুনা তুলে ধরেছি। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা একজন করে জাঁদরেল পাশ্চাত্য পন্ডিত্যের মতামত নিয়ে আলোচনা করেছি, যেমন, Richard Ettinghausen. H. G. Farmer, M. S. Dimand, T. W. Arnold, E. Herzfeld, K. A. C. Creswell, G. Von Grunebaum. এঁদের প্রত্যেকরই খ্যাতির মূলে রয়েছে অংশত বা সম্পূর্ণত অবদানের জন্য। এদের প্রত্যেকেই এই ভ্রান্ত ধারণা, বরং বলা যায়, এই পক্ষপাতদুষ্টতার শিকার হয়েছেন যে, যুগ যুগ ধরে মুসলিম জাতির শিল্পকলায় কোন অবদান রাখা তো দূরের কথা, বিপরীত পক্ষে, ইসলাম শিল্পকলাকে বাধাগ্রস্থ বা সীমিত করেছে, এবং তাতে করে, তাদের শৈল্পিক প্রবণতাগুলোকে নষ্ট করেছে। ইসলামের নন্দনতাত্ত্বিক বিকাশের একমাত্র দৃষ্টান্ত হচ্ছে আরবী, কোরআনিক আইনগুলো তর্জমার মাধ্যমে এই ঐতিহ্য ভঙ্গের মধ্যে Ettinghausen সেই মনোপলির অবসানের সূচনায় কিছুটা মজার সঙ্গে উপভোগ করেছেন। প্রত্যেকেই দেখবার চেষ্টা করেছেন অন্ধগোড়ামী থেকে মুক্ত, যে শিল্পকর্মই মুসলমানরা সৃষ্টি করেছে, তা তারা করতে পেরেছে ইসলামকে ডিঙ্গিয়ে এবং ইসলামের নির্দেশমালাকে লংঘন করে। তাদের মতে মুসলিম অভিজাত বা রাজন্যবর্গ তাদের মহলে বা পাঠাগারে মানুষ এবং জীবজন্তুর চিত্রিত প্রতিকৃতি উপভোগ করেছেন এবং এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, এবং তৎসহ তারা সঙ্গীতেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, ইসলামের নির্দেশ অমান্য করে যে “সঙ্গীত মাদকতা সৃষ্টি করে এবং ব্যভিচারে উৎসাহিত করে।” তারা সামান্যই উপলব্ধি করেছেন যে, নান্দনিকতার দিক দিয়ে তথাকথিত পাপাশ্রয়ী শিল্পকলা, পুরোপুরি ইসলাম সম্মতই বটে- মুসলিম বিশ্বের শিল্পকলার সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মের মধ্যে অনু পরিমাণ স্থান দখল করে আছে।

 

এদের মধ্যে কেউ কেউ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যারও প্রয়াস পেয়েছেন। প্রকৃতি শূন্যতা বরদাস্ত করেনা, এই যুক্তিতে তারা দাবী করেন যে, মুসলমান আর্টিষ্টরা তাদের সকল শিল্পকর্মের সম্মুখ ভাগ নক্সার দ্বারা আচ্ছাদিত করেছে। কেউ কেউ সম্পূর্ণ বিপরীত মত পেশ করেছেন। তাদের যুক্তি এই যে, মুসলিম শিল্পীরা রঙ বা বর্ণপাগল, যারা সাদামাটাভাবে শূন্য রংয়ের উজ্জ্বল ঝলক সৃষ্টি করতে চেয়েছেন এবং এতে করে তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রতিভার জন্য যে সাধনা এবং আগ্রহ আবশ্যক তা লাঘব করে কতিপয় রংয়ের নেশায় বিনষ্ট শিল্পী শিল্পকর্মকে কেবলমাত্র মোহ সৃষ্টির প্রয়াসে পর্যবসিত করেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে এদের কারোরই একথা কখনো মনে হয়নি যে, তারা পাশ্চাত্য শিল্পকলার লক্ষ্য ও মান অনুযায়ী ইসলামী শিল্পকলার বিচার করছেন, এবং কখনো কেউ এই অভিযোগটি উত্থাপন করেননি। মুসলিম সংস্কৃতির প্রকাশক শিল্পকর্মের যে ব্যাখ্যা তারা দিয়েছেন তা বিভ্রান্তিকর, মানুষের এতে হাসি পায় Titus Burckhardt এবং Louis Massignon এর ব্যাখ্যায় সত্যদর্শনের সাফল্যেরর ঝলক এবং ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে Earnst Kuhnel এর ঠাণ্ডা আত্মসংযমকে বাদ দিলে, ইসলামী আর্টের ইতিহাসবিদেরা একমত হয়ে পাশ্চাত্য নতুন তত্ত্বের আলোকে ইসলামী শিল্পকর্মের বিচার করেছে। এদের প্রত্যেকেই হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়েছেন এমন এক শিল্পকর্মে যাতে কোনো প্রতিমা, প্রতিকৃতি নেই। নাটক নেই, প্রকৃতিবাদ নেই, তাদের গ্রন্থাদি পাঠ করে তাতে প্রত্যেকেই বিভ্রান্ত হন, কারণ তারা এতে পাশ্চাত্য শিল্পের এমন কিছুই পাননা যার সঙ্গে ইসলামী শিল্পকর্মকে সম্পৃক্ত করতে পারেন তারা বিভ্রান্ত যে, আধ্যাত্মিক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে ইসলামী শিল্পকর্মের উপর তারা তাদের আগাম রায় দিয়ে বসেছেন

 

আর একটি প্রবন্ধনের মাধ্যমে আমরা গ্রীক শিল্পের প্রকৃতি এবং আলেকজান্ডারের অভিযানের পর থেকে গ্রীক-শিল্পের প্রতি নিকটপ্রাচ্যের শিল্প ঐতিহ্যের প্রতিক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেছি। গ্রীক শিল্পের সারকথা হচ্ছে প্রকৃতিবাদ, তবে একথা মনে করা ঠিক হবেনা যে গ্রীক শিল্প প্রকৃতির সরল ফটোগ্রাফিক অনুকরণমাত্র, বরং এ হচ্ছে একটি প্রাকসিদ্ধ ধারণার ইন্দ্রিয়জ সম্পদের প্রতিরূপ, যে ধারণাটিকে প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণার অংশত তাৎক্ষণিক রূপ। প্রকৃতি তার প্রত্যেকটি সৃষ্টির মধ্যে স্থাপন করেছে সনাতন গ্রীক সংস্কৃতির পর্বতশীর্ষ এলাকায় দীর্ঘসরু উঁচুভূমির অনুরূপ একটি ধারণা। তার থিওরির মতে, পাথর কেঁটে মানুষের প্রতিমা নির্মাণ হচ্ছে সর্বোচ্চ শিল্প। মানুষের সম্পর্কে ধারণা হচ্ছে, সে প্রকৃতির সবচেয়ে ঐশ্বর্যপূর্ণ এবং সবচেয়ে জটিল entelechy। এর গভীরতা এবং অন্তর্গত বৈচিত্র্য হচ্ছে শিল্পীর অনুসন্ধান আবিষ্কার ও প্রকাশের জন্য একটি অন্তহীন খনি। এই কারণেই মানুষ হচ্ছে “সমস্ত কিছুর বিচার ও পরিমাপের মানদন্ড”। সে সৃষ্টির চূড়া সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সকল প্রকার মূল্যের বাহক ও কংক্রীট রূপদাতা। এ কারণে খোদ ঐশী সত্ত্বাকে ধারণা করা হয়েছে তার প্রতিমূর্তিতে, ধর্মকে মনে করা হয়েছে মানবতাবাদ এবং ঐশী সত্ত্বার উপাসনা হয়েছে মানুষের অন্তরতম প্রকৃতির অন্তহীন গভীরতা এবং বৈচিত্র্যের অনুধ্যান। গ্রীক বা হেলেনিক সংস্কৃতির এই সার নির্যাসের প্রতিফলনই সমগ্র হেলেনিক সভ্যতার শিল্পের জন্য আবশ্যক হয়ে উঠেছিলো।

 

নিকটপ্রাচ্য আমাদের সামনে উপস্থাপন করে একটি সম্পূর্ণ বিপরীত ঐতিহ্য। এখানে মানুষ হচ্ছে ঐশী সত্ত্বার একটি নিমিত্তক মাত্র, যাকে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন ইবাদত করার জন্য। মানুষ কখনোই নিজেই কোন চরম লক্ষ্য নয় এবং নিশ্চয়ই কোনো কিছুর পরিমাপের মানদন্ড নয়। মানদন্ড ঐশী সত্ত্বা স্থাপন করেন। এই মানদন্ড থেকে নিষ্পন্ন বিধিবিধানসমূহ মানুষের জন্য আইন। এখানে কোনো প্রমিথিউস নেই, স্রষ্টার ভূমিতে আছে কেবল একজন দাস বা ভৃত্য, যে আদেশ পালন করলে আশীষ লাভ করে, আদেশ পালনে ভুল করলে আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় এবং আদেশ লংঘন করলে ধ্বংস হয়। অবশ্য আল্লাহর ঐশীত্ব হচ্ছে একটি mysterium, একটি tremendum এবং একটি fascinosum। একারণে আল্লাহর ঐশী হচ্ছে মানুষের একটি আবিষ্টতা, তার স্থির ধারণা, তার সার্বক্ষণিক চিন্তা হচ্ছে এই ঐশী অভিপ্রায় কি এবং তা কিভাবে কাজ করে; আল্লাহ কেন্দ্রীকতাই হচ্ছে তার ভাগ্য। এ থেকেই মানুষ অর্জন করে তার তাৎপর্যতার গৌরব এবং তার বিশ্বজাগতিক মর্যাদা। অপরিহার্যভাবেই তাই নিকটপ্রাচ্যের সভ্যতা হচ্ছে নিকটপ্রাচ্য সংস্কৃতির এই বৈশিষ্ট্যের একটি প্রকাশ।

প্রকৃতি এবং সর্বোপরি মানব প্রকৃতি হচ্ছে ঐশী স্থান দখলের প্রবলতম প্রতিযোগী এবং প্রমিথিউস মোটেই কোন কাহিনী নয়, বরং প্রভৃত্ব অর্জনের জন্য ঐশী সত্ত্বার সঙ্গে মানুষের সংগ্রামের মিত্র কাব্যিক উপাখ্যান মাত্র। প্রথমত, নিকটবর্তী গ্রীস এবং মিশর ঐশী সত্ত্বা এবং প্রকৃতি বিষয়ে যে ধরনের প্রলোভন এবং বিভ্রান্ত সৃষ্টি করেছে তা অবশ্যই রুখতে হবে এবং চৈতন্য থেকে নির্বাসিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সমস্ত চৈতন্যকে অবশ্যই নিমগ্ন করতে হবে ঐশী এলাকার অভ্যন্তরে যা হচ্ছে এর উৎস, এর আদর্শ, এর প্রভু এবং ভাগ্য। তাই আলেকজান্ডারের অনেক পূর্বে নিকটপ্রাচ্যের শিল্প প্রকৃতিবাদ থেকে বন্ধন মুক্তির জন্য ষ্টাইলাইজেসন উদ্ভাবন করে। নিশ্চয়ই নিকটপ্রাচ্য যখন গ্রীকদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং নিকটপ্রাচ্যের জনমানুষের উপর গ্রীক সভ্যতা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন ষ্টাইলাইজেসন বা শৈলীকরণ আরো প্রবল এবং আরো জোরদার হয়ে উঠে।

 

ইহুদীদের নিকটপ্রাচ্যের আর একটি সংস্কৃতি এবং ধর্ম ইহুদীবাদ, সাম্রাজ্যবাদী হেলেনিজমের মোকাবেলা করে সাহসিকতার সঙ্গে এবং সম্ভবত সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় দূর্ঘটনা হচ্ছে Philo। আধুনিক কালে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এবং ধর্ম দ্বারা এর সৌন্দর্যতাত্ত্বিক অভিন্দ্রিয়তা অংশত বিকৃত হয়ে পড়লে, বিশেষ করে ইউরোপীয় রোমান্টিসিজমের আবির্ভাবকাল থেকে সেই বেপরোয়া অযৌক্তিক এবং বৈশেষিক প্রকৃতিবাদীর আর্বিভাবের পর, জাতি, জনগোষ্ঠী, রক্ত ও বালি, মা-রাশিয়া, ঈশ্বর-রাজা- দেশ ইত্যাদির অন্ধ মোকাবেলায় ইহুদীদের বিশ্বস্ততার সঙ্গে মূল নিকটপ্রাচ্যের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তার শিল্পকলাকে অনুসরণ করেছে। তুমি খোদাই করে কোন প্রতিমা বানাবেনা“- এই নির্দেশকে ইহুদীরা পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে কেবল একটি আত্মরক্ষার নির্দেশ হিসেবেই দেখেনি বরং নন্দনতত্ত্বের একটি মূলনীতি হিসেবে উপলব্ধি করেছে তাদের সিনাগণগুলো শিল্পকর্মের দিক দিয়ে শূন্যই ছিল, মুসলিম বিশ্ব ছাড়া অন্য সর্বত্র, মুসলিম বিশ্বে তারা ইসলামের বিকাশমান অগ্রগতিকে অনুকরণ করেছে। পবিত্র গ্রন্থের কাব্য মাধুর্যের দ্বারা তাদের নন্দনতাত্ত্বিক চাহিদা সম্পূর্ণ পূরণ হয় এবং ঐশী সত্ত্বাকে প্রত্যক্ষ করার ব্যাপারে তাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সকল দাবী অস্বীকৃত হয়। তাদের বিশ্বাস দাবী করে এবং স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ঐশী সত্ত্বাকে এই ধরনের স্নায়বিক ইন্দ্রিয়ের সাহায্য ছাড়া স্বজ্ঞার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে হবে। আর তা না হলে তা ঐশী সত্ত্বাই নয়। সমস্ত সত্ত্বার আদি নীতি স্বজ্ঞার মাধ্যমে উপলব্ধির প্রয়াসে ইন্দ্রিয়ের সাহায্য যত নেয়া হবে, ততই সে স্বজ্ঞার বিষয় হবে অধিকতর ইন্দ্রিয়াতীত, ততই দৃষ্টি হবে বিশুদ্ধতর

 

টীকা

১. এই সিদ্ধান্তের প্রমাণ এই বাস্তবতা যে, মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র একই এসথেটিক মূল্যগুলোর প্রাধান্য, মূল্যন্তর বিন্যাসের শীর্ষবিন্দুতে রয়েছে সুন্দর, আরবী ক্যালিগ্রাফিক, কুরআনুল কারীম কপি করার পূণ্য; কুরআনের আয়াত দ্বারা মানুষের বাড়ি-ঘর, মসজিদ, সরকারী দালানকোঠা অলংকরণ, একটি মাত্রার স্বল্প কয়েকটি সূরের উপর ভিত্তি করে উৎপন্ন রাগিনীতে তা আবৃত্তি করা এবং এর বিশিষ্ট্যত্বক শব্দগুলোর দ্বারা সাহিত্যিক পত্র-পুস্তুকাদির অলংকরণ।

২. দ্র: বর্তমান গ্রন্থকারের প্রবন্ধ …. “Misconception of the Nature of the Work of Art in Islam” Islam and the Modern Age, vol. I. No 2. (May 1970) পৃ. ২৯-৪৯।

৩. দ্র: বর্তমান গ্রন্থকারের প্রবন্ধ …. “On the Nature of the Work of Art in Islam” Islam and the Modern Age. vol. I. No 2. (August 1970) পৃ. ৬৪-৮১।

৪. অতিবর্তিতা বা অতীন্দ্রিয়তার সংজ্ঞার একটি আবশ্যক শর্ত এই যে, যুক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা সরাসরি অতিবর্তী বা অতীন্দ্রিয়কে উপলব্ধি করতে হবে, অর্থাৎ প্রবর্তন প্রক্রিয়ায় ইন্দ্রিয়গুলো যদি সামান্যতম ভূমিকাও পালন করে তেমন অবস্থায় যে বস্তুটিকে উপলব্ধি করা হল তা কিছুতেই অতিবর্তী হতে পারে না।

 

অনুবাদঃ অধ্যাপক শাহেদ আলী।

৬০০ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী (১৯২১-১৯৮৬) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অথরিটি হিসেবে সুপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব। তার জন্মভূমি ফিলিস্তিনে কলেজ শিক্ষা সমাপনের পর ১৯৪১ সালে তিনি বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক; যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর নেওয়ার পর ১৯৫২ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন । ফারুকী এ সময়ে ইংরেজি, আরবি ও ফরাসি- এ তিনটি ভাষায় গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ এ চার বছর ইসলামের ওপর উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণা করে কাটান। পরবর্তীতে মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলাম ধর্ম ও আমেরিকার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্মের ওপর পোস্ট ডক্টরেট করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয় । স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ফিলিস্তিন সরকারের গ্যালিলির জেলা গভর্নর নিযুক্ত হন। এভাবে প্রশাসনিক ক্যারিয়ার দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার প্রশাসক জীবনের অবসান ঘটে, যখন ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী ইসরাইলী দখলদার বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে ফিলিস্তিনীরা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যান। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মুসলিম পরিবারের মতো ফারুকীর পরিবারও ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে লেবাননে আশ্রয় নেন। এ ছিলো ফারুকীর জীবনের সন্ধিক্ষণ মুহূর্ত। শত অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি নিজের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গঠনে সফল হন। আবাসিক অধ্যাপক হিসেবে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচীর ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক রিসার্চ এ অধ্যাপক হিসেবে, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে Islamic and History of Religions এর অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়া তিনি বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ইসলামিক ইন্টেলেকচুয়ালিজম-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ইসমাইল ফারুকী শুধু আত্মিকভাবে ইসলামের ধারণা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরেননি; নিজের কাজকর্ম, গবেষণা, শিক্ষকতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। ড. রাজী বহু আন্তর্জাতিক জার্নাল ও ম্যাগাজিনে শতাধিক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রকাশিত The Cultural Atlas of Islam, Historical Atlas of the Religions of the World, Trialogue of the Abrahamic Faiths, Christian Ethics, Al Tawhid : Its Implications for Thought and Life. প্রভৃতি গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৯৮৬ সালের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজ বাসায় আততায়ীর গুলিতে অধ্যাপক ইসমাইল রাজী আল ফারুকী ও তার স্ত্রী লুইস লামিয়া ফারুকী শহীদ হন। এ শাহাদাতের মধ্য দিয়ে এ কালে মুসলিম চিন্তার জগতের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা খসে পড়ে এবং একজন সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবীর কর্মঘন জীবন নীরব হয়ে যায়। তথাপি বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামি চিন্তার বিকাশে অগ্রপ্রতীক হিসেবেই বিবেচিত ড. ফারুকী।
Picture of ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী (১৯২১-১৯৮৬) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অথরিটি হিসেবে সুপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব। তার জন্মভূমি ফিলিস্তিনে কলেজ শিক্ষা সমাপনের পর ১৯৪১ সালে তিনি বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক; যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর নেওয়ার পর ১৯৫২ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন । ফারুকী এ সময়ে ইংরেজি, আরবি ও ফরাসি- এ তিনটি ভাষায় গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ এ চার বছর ইসলামের ওপর উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণা করে কাটান। পরবর্তীতে মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলাম ধর্ম ও আমেরিকার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্মের ওপর পোস্ট ডক্টরেট করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয় । স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ফিলিস্তিন সরকারের গ্যালিলির জেলা গভর্নর নিযুক্ত হন। এভাবে প্রশাসনিক ক্যারিয়ার দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার প্রশাসক জীবনের অবসান ঘটে, যখন ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী ইসরাইলী দখলদার বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে ফিলিস্তিনীরা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যান। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মুসলিম পরিবারের মতো ফারুকীর পরিবারও ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে লেবাননে আশ্রয় নেন। এ ছিলো ফারুকীর জীবনের সন্ধিক্ষণ মুহূর্ত। শত অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি নিজের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গঠনে সফল হন। আবাসিক অধ্যাপক হিসেবে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচীর ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক রিসার্চ এ অধ্যাপক হিসেবে, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে Islamic and History of Religions এর অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়া তিনি বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ইসলামিক ইন্টেলেকচুয়ালিজম-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ইসমাইল ফারুকী শুধু আত্মিকভাবে ইসলামের ধারণা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরেননি; নিজের কাজকর্ম, গবেষণা, শিক্ষকতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। ড. রাজী বহু আন্তর্জাতিক জার্নাল ও ম্যাগাজিনে শতাধিক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রকাশিত The Cultural Atlas of Islam, Historical Atlas of the Religions of the World, Trialogue of the Abrahamic Faiths, Christian Ethics, Al Tawhid : Its Implications for Thought and Life. প্রভৃতি গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৯৮৬ সালের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজ বাসায় আততায়ীর গুলিতে অধ্যাপক ইসমাইল রাজী আল ফারুকী ও তার স্ত্রী লুইস লামিয়া ফারুকী শহীদ হন। এ শাহাদাতের মধ্য দিয়ে এ কালে মুসলিম চিন্তার জগতের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা খসে পড়ে এবং একজন সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবীর কর্মঘন জীবন নীরব হয়ে যায়। তথাপি বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামি চিন্তার বিকাশে অগ্রপ্রতীক হিসেবেই বিবেচিত ড. ফারুকী।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top