সুদ ও জনস্বার্থবিরোধী ভাগ্যলিপির আখ্যান; জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫

একটি দেশের উন্নত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে জাতীয় বাজেট। বাজেট শুধুমাত্র দেশ ও জনগণের পেছনে কত টাকা আয়-ব্যয় হবে তার প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং একইসাথে এটি একটি দেশের উন্নয়নের রূপরেখা ও ভাগ্যনামা। আগামী এক বছরে একটি পরিবার কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারবে, সেই অর্থবছরে জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি কী হবে, ঢাকার একজন শিক্ষার্থী নিত্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ কতটা সহজে সংগ্রহ করতে পারবে অথবা রাজশাহীর একজন কৃষক তার উৎপাদিত আমের ন্যায্যমূল্য পাবেন কি-না– এগুলোর প্রতিটিই বাজেটের সাথে সম্পৃক্ত। এক কথায়, কোনো একটি দেশের ব্যক্তি পরিসর থেকে শুরু করে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় বিষয়াদি; এমনকি আন্তর্জাতিক বিশ্বে সেই দেশটির কূটনৈতিক পন্থা নির্ধারণ কেমন হবে– এ সবকিছুই বাজেটের সাথে সম্পৃক্ত। এজন্য বাজেটকে এক অর্থে একটি জাতির ভাগ্যলিপি হিসেবেও উল্লেখ করা যায়।

প্রতি বছরের ন্যায় ‘সুখি, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার’ স্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে এবারও জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেটের আকার চূড়ান্ত করা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৪.২ শতাংশ এবং চলতি বাজেটের তুলনায় ৪.৬ শতাংশ বেশি। প্রতি বছর বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেলেও কেন দেশের সামগ্রিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না, তা অবশ্যই পর্যালোচনার দাবি রাখে। পাশাপাশি বাজেটের কলেবর বৃদ্ধি আদৌ আমাদের জাতীয় উন্নয়নের জন্য সহায়ক নাকি বোঝা স্বরূপ, তাও আলোচনা করা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে বাজেটের খাতগুলোও বিশেষভাবে পর্যালোচনা করা দরকার।

 

📌 গুরুত্বপূর্ণ খাতসমূহের পর্যালোচনা

একটি দেশের বাজেটের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো হলো শিক্ষা, কৃষি ও স্বাস্থ্য। কারণ দেশের সকলেই এ খাতগুলোর উপর সরাসরি নির্ভরশীল এবং এগুলোর উপরেই দেশের অর্থনীতি, মানবসম্পদ ও সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশেরও প্রয়োজন ছিলো এ খাতগুলোতে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো বরাবরের মতোই অবহেলিত রয়েছে এ খাতগুলো। বর্তমান অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার প্রেক্ষিতে যদি আমরা বিস্তারিত আলাপ করি, সেক্ষেত্রে দেখা যায়–

শিক্ষা খাত

আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার বাড়লেও শিক্ষার হার এখনো আশানুরূপ পরিমাণে বাড়েনি। ১৯৯০ সালের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন এর সুবাদে প্রাথমিকে ধীরে ধীরে প্রায় শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হলেও এসব শিক্ষার্থীর অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক স্তর পার হতে পারছে না। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এর ২০২৩ সালের খসড়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিলো ৯২ লাখের বেশি। ২০২৪ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮১ লাখ ৬৬ হাজারে।

পারিবারিক দরিদ্রতা, শিক্ষার ব্যয়ভার মেটানোর অক্ষমতা এবং চাকরি নির্ভর পড়াশোনাকেই শিক্ষা হারের এ দুর্দশার কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারি হিসাব মতে দারিদ্র‍্যের হার ১৮.৭ শতাংশ বলা হলেও বাস্তব সংখ্যা এরচেয়ে দ্বিগুণ বেশি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর জরিপ অনুসারে, ২০২০ সালের শেষে দারিদ্যের হার ছিলো ৪২ শতাংশ। এর মাঝে দারিদ্র‍্যসীমার নিচে বাস করছে ২৮.৫ শতাংশ নাগরিক। এদিকে ভর্তি ফি, টিউশন ফি, শিক্ষার উপকরণ খরচ, প্রাইভেট-কোচিং বাবদ ইত্যাদি সবই এ বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে।

এর পাশাপাশি, গ্লোবালাইজেশনের সময়ে এসে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী যেখানে তথ্যপ্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল, সেখানে শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত সকল কিছুরই ব্যয়ভার সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইটি পণ্যগুলোর দাম দিনদিন বাড়ছেই। ডিজিটালাইজেশনের সময়ে এসে এমন লাগামহীন অবস্থা শিক্ষাব্যবস্থায় যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

অথচ এতসব কিছু বিচার বিবেচনায় না নিয়ে প্রতি বছর শিক্ষা খাতে বাজেটের হার কমছেই। শিক্ষাখাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে যেখানে বরাদ্দ ছিলো জিডিপির ১.৮৩ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে ১.৭৬ শতাংশে নেমে আসে। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আরও কমে এই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১.৬৯ শতাংশে, যা মোট বাজেটের ১১.৮৮ শতাংশ। অঙ্কের হিসেবে ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ইন্ডিপেনডেন্ট এর সূত্রানুযায়ী এ বছরের বাজেটে ৫৬ টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০০ কোটি টাকা। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় পাচ্ছে সাড়ে ৩ কোটি টাকার মতো। এবং বণিকবার্তার সূত্রানুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক রয়েছেন ১৫ হাজারের বেশি। সেক্ষেত্রে গাণিতিকভাবে প্রত্যেক শিক্ষকের পেছনে গবেষণা বাবদ অর্থ বরাদ্দ মাত্র ১ লক্ষ টাকার কিছু বেশি। একজন শিক্ষক মাত্র এই কয় টাকার উপর নির্ভর করে গবেষণায় কতটা মনোনিবেশ করতে পারবে বলে মনে হয়? তাহলে কেনই বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণার প্রতি অনীহা বা অনাস্থা প্রদর্শন করবে না?

আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও বর্তমান শিক্ষার মান হিসেবে এই খাতে বাজেটের পরিমাণ নিতান্তই কম। আইএলও এবং ইউনেস্কোর ভাষ্য অনুযায়ী, একটি দেশের শিক্ষাখাতে বরাদ্দের আন্তর্জাতিক মান মোট বাজেটের ২০ শতাংশ আর জিডিপির ৬ শতাংশ। এর তুলনায় যে নগণ্য বরাদ্দ আমাদের বাজেটে দেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে কীভাবে একটি দেশের শিক্ষার মানের উন্নতি আশা করা যায়? এছাড়া, গবেষণার জন্য তো আলাদা বাজেট নেই-ই। উচ্চশিক্ষার জন্য গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না পারছে একটি শিক্ষিত ও জ্ঞাননির্ভর জাতি গঠন করতে, না পারছে জাতীয় শিক্ষার মান উন্নত করতে। তারচেয়েও দুর্ভাগ্যজনক হলো এ বরাদ্দের ক্ষুদ্র একটি অংশই শিক্ষাখাতে সত্যিকারার্থে ব্যয় হয়, সিংহভাগ যায় মধ্যস্বত্বভোগী দুর্নীতিবাজ শ্রেণির পকেটে।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরোলেও শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষকদের মান, পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষার্থীদের আবাসান সংকট, গবেষণার দৈন্যদশা, জ্ঞানচর্চার সুষ্ঠু আবহ– এসবের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন নেই। সব মিলিয়ে অবস্থার চরম করুণ পরিপ্রেক্ষিতে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, শিক্ষাখাতে যতটুকু বাজেট দেওয়া হচ্ছে, তার সম্পূর্ণটাই কি এ খাতে ব্যয় হচ্ছে? কোথায় যাচ্ছে স্বল্প পরিমাণ বাজেটের অংশটুকুও? এই প্রশ্ন জাতির প্রতিটি সচেতন বিবেকের। কৃষি খাত

শত শত নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা এ অঞ্চলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত কৃষি। শুধু আমাদের দেশেরই নয়, বরং যে কোনো দেশেরই উন্নতি-অগ্রগতির প্রধান বাহন এ কৃষি খাত। আমরা দেখি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, চীন ও রাশিয়ার মতো শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের শিল্পখাতে গুরুত্ব দিতে গিয়ে কৃষিকে কখনোই অবহেলা করেনি। যার ফলে, সারা বিশ্বে গম, ধানসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদনেও শীর্ষস্থানে রয়েছে এ দেশগুলোই।

এদিকে বাংলাদেশের ৪৫ শতাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহের তাগিদেও কৃষির সাথে যুক্ত (অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩)। অথচ এ দেশের কৃষি খাতের অবস্থা দিনদিন ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর হচ্ছে। রপ্তানির পরিমাণ তো বৃদ্ধি পাচ্ছেই না, উল্টো যত দিন যাচ্ছে, আমদানির পরিসংখ্যান যেন তরতর করে বাড়ছে। যেখানে ইলিশ, পাট, চালসহ আরও নানান কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে ছিলো, সেখানে বর্তমান সময়ে এসে চাল, গম, ভোজ্যতেল, চিনি, ভুট্টা, ডাল, মসলা, ফল, নারকেল, নারকেলের শাঁস, সারসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি আমদানি করতে হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে ব্যয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ জাতীয় অর্থ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উপাত্ত অনুসারে, কৃষি পণ্য আমদানিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ১০ বিলিয়ন ডলারের (১ হাজার কোটি ডলার) বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) সূত্র অনু্যায়ী, একই অর্থবছরে সার আমদানিতে ব্যয় হয়েছে বিলিয়ন ডলারের (৫০০ কোটি) বেশি। ফলে দেখা যাচ্ছে, কৃষি পণ্য ও সার আমদানিতে বাংলাদেশকে বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, আগামী ১০ বছরে মূল্যস্ফীতি ও চাহিদা বাড়ার কারণে কৃষিতে আমদানির এ পরিমাণ বেড়ে তিনগুণও হতে পারে।

রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দামও। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে কৃষি বাজার। যে সবজি পূর্বে ৩০/৪০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যেত, তা এখন ১০০ টাকা ছুঁয়েছে। বেড়েছে চালের দাম, মাছের দাম, মুরগীর দামও। তেলের দামও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে এ দাম বাড়ানো হয়, অথচ যখন বিশ্ববাজারে দাম আবার কমে, তখন স্থানীয় বাজারে দাম কমার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না।

এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনৈতিক বাজেটের মাত্র ৪.৭ (বণিকবার্তা) শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কৃষি খাতে। যদিও গতবারের তুলনায় এবারের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বেশি, তবু বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিপ্রধান দেশের জন্য এমন বরাদ্দ খুবই আশঙ্কাজনক। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক জরিপে একটি ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে; সেই জরিপে দেখা যায়, খাবার কিনতে হিমশিম খাওয়া মানুষের হার ৬৮ শতাংশ। দেশের জনগণের এই দুর্দশা ঘোচাতে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন ছিলো এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু নতুন বাজেট আবারও হতাশ করেছে জনগণকে। কেননা, সেই পদক্ষেপের ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না বাজেটে। তার মানে আগামীতেও সহজে পরিবর্তন হচ্ছে না চলমান পরিস্থিতি। বাজেট আসছে যাচ্ছে, কিন্তু সেই পুরনো ভুত কাঁধে নিয়েই এগোচ্ছে গোটা জাতি।

স্বাস্থ্য খাত

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনো দেশে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য একজন ডাক্তার থাকা উচিত। কিন্তু, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি ২ হাজার ৫শ’ মানুষের জন্য একজন ডাক্তার রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে জনপ্রতি চিকিৎসা-ব্যয় গড়ে ৫৪ ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় পাঁচ হাজার ৯৯৪ টাকা। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর স্বাস্থ্যসেবা নিতে বহির্গমনকারী রোগীর সংখ্যা ৭ লাখ। বিডার হিসাবে, এ রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার দেশের বাইরে চলে যায়। দেশের বাইরে চিকিৎসা গ্রহণে এ বিপুল পরিমাণ ব্যয় এখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উপর আস্থার সংকটকেই সামনে নিয়ে আসছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, দেশে বিগত বছরগুলোয় সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো বাড়লেও চিকিৎসকের মান ও সেবার পরিধি প্রসারিত হয়নি। ফলে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাহিরেই যেতে হয় সামর্থ্যবানদের।

কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের কী অবস্থা? এখন পর্যন্ত দেশের সব অঞ্চলে সমানভাবে বিশেষায়িত সেবা পৌঁছায়নি। নির্ভুল রোগ নিরীক্ষা এবং বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগও দীর্ঘদিনের। এসব সংকটের কারণে রোগীদের বড় একটি অংশ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গিয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেলে বেসরকারি হাসপাতালে যায়। যখন সেখানেও প্রয়োজনীয় সেবা মেলে না, তখন যাদের সক্ষমতা রয়েছে, তারা বিদেশে চলে যায় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই, তারা? তারা তাদের সমস্যাবলি শরীরে নিয়েই জীবন অতিবাহিত করতে থাকে।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য মতে, দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের জন্য হাসপাতাল রয়েছে মাত্র ৮,৪৯৪। যার সবগুলো মিলিয়ে শয্যাসংখ্যা মাত্র ১ লক্ষ ৭৯ হাজার ৩০১ টি। জনসংখ্যার তুলনায় এ সংখ্যা যে অতি নগণ্য, তা পরিসংখ্যান দেখলেই বুঝা যায়।

চিকিৎসা ব্যবস্থার এহেন করুণ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট মাত্র ৫.১৯ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যা ৪১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। একটি দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের সকল জনগণের মৌলিক অধিকার চিকিৎসার জন্য এই ক্ষুদ্র অংশ কোনোমতেই যথেষ্ট নয়।

অন্যান্য

এ তো মাত্র কয়েকটি খাতের পর্যালোচনা। অন্য সবকটি খাতই পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে যথাযথ বাজেট নেই। এমন সব খাতে বরাদ্দ বেশি দিয়ে রাখা হয়েছে, যেগুলো আদতে মানুষের জীবনযাত্রার মানের কোনো পরিবর্তন আনছে না, দেশের সামগ্রিক উন্নতিতেও অবদান রাখছে না। পাশাপাশি কোনো খাতেই সঠিক ব্যয় হচ্ছে না। দুর্নীতিবাজ শ্রেণি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বরাদ্দকৃত এ প্রয়োজনের তুলনায় ক্ষুদ্রাংশও ঠিকঠাক পৌঁছাচ্ছে না জনগণের দোরগোড়ায়।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানীতে ৩.৮%, পরিবহন ও যোগাযোগে ১০.৪০% বরাদ্দ রেখে বাজেট করা হলেও তা কি আদৌ বাস্তবায়ন করা হয়? এ খাত দুইটির সাথে প্রক্রিয়াধীন ও প্রস্তাবিত বেশ কয়েকটি মেগা প্রজেক্ট জড়িত, যেগুলোর প্রত্যেকটিতে প্রতিনিয়ত বাস্তবায়ন ব্যয় বাড়ছেই। কখনো কখনো তা একই ধরনের প্রকল্পে উন্নত রাষ্ট্রের ব্যয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কাঁচামালের যোগান সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর। এক্ষেত্রে দেশীয় কাঁচামালের ব্যবস্থাপনা ও তা উপযোগী করে তোলার সদিচ্ছা মোটেও নেই। প্রযুক্তিও ব্যবহার হচ্ছে বিদেশীদের। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বও কোনো দেশী কোম্পানির কাছে নেই। প্রকৌশলীদের বেশিরভাগই বিদেশী। আর শ্রমিকদের মধ্যে দেশীয় যারা, তাদের মজুরি ও সুযোগ-সুবিধাও নিতান্তই সামান্য। তাহলে কার পেছনে ব্যয় হচ্ছে এত অর্থ?

বিদ্যুৎ উৎপাদনে ছোট-বড় সব বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলিয়ে উৎপাদন সক্ষমতা ২৫,৫৬৬ মেগাওয়াট হলেও এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৪,৭৮২ মেগাওয়াট উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। তার উপর এ অংশ থেকেই বিতরণ ক্ষতি হয়েছে ৮.৪৮%। যার ফলস্বরুপ এখনো ২১% বিদ্যুৎ আমদানি করতে হচ্ছে।

পরিবহন ও যোগাযোগে অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিনিয়ত নগরজীবনে মানুষকে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। যানজটের ফলে দীর্ঘ একটি সময় অপচয় হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে কর্মক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ সময়। নগরবাসীদের অধিকাংশই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করে। আর সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তো দিন দিন বাড়ছেই। কেবল ২০২১ সালেই সড়ক, রেল ও নৌ-পথে দুর্ঘটনায় নিহত হন ৮৫১৬ জন। একটা প্রতিবেদনে এ রকম দেখালেও মূলত বাস্তব সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।

বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিতে রেল ও নৌপথে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিলো। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে দেশের নৌ-পথ অর্ধেকের বেশি কমেছে। রেলপথ গুরুত্ব পায়নি, বরং রেলযাত্রার উপর বাড়তি করের বোঝা চাপানো হয়েছে। সড়কপথ বাড়লেও এসবের মান ও ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

📌 সুদভিত্তিক বাজেট

সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো প্রতিবারের মতো এবারের বাজেটও একটি সুদভিত্তিক বাজেট। আমরা যেখানে দেখতে পেলাম গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে বাজেটের যথেষ্ট বরাদ্দ নেই, সেখানে সুদের মতো একটি সম্পূর্ণ অযাচিত খাতেই ব্যয় হচ্ছে বাজেটের ১৪.২৪%। অর্থাৎ, মোট বাজেটের ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শুধু সুদ হিসেবেই দিতে হবে আগামী এক বছরে।

অথচ, এই সুদ কেবল ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, একইসাথে অর্থনৈতিক দিকে থেকে একটি ভয়াবহ বিষয়। ৯২% মুসলমানের দেশে ১৪.২৪% রাষ্ট্রীয় সুদ দেওয়া হচ্ছে কোনো কারণ ছাড়াই; অথচ এক ঢাকা শহরেই প্রতিরাতে লক্ষ লক্ষ শিশু না খেয়ে বস্তিতে ঘুমায়। শহরগুলোতে একজন শ্রমিক দৈনিক ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করে মাত্র ৭-৮ হাজার টাকা বেতন পায়। দারিদ্র্যের কারণে অনেক মা-বাবা তাদের আদরের সন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মা-বোন তাদের শরীর বিকিয়ে দিচ্ছে, পতিতাবৃত্তি করছে শুধুমাত্র দু’বেলা খাবারের জন্য। দরিদ্রতা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাড়ছে ধনী-গরীবের অর্থনৈতিক ভারসাম্যের দূরত্ব। কর্মসংস্থান তো বাড়ছেই না, বরং কোটি কোটি শিক্ষিত ও কর্মক্ষম মানুষ প্রতিদিন বেকার হচ্ছে, চাকরি হারাচ্ছে। বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারা যাচ্ছে। খাদ্য সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার, সামাজিক নিরাপত্তা খাত এর মতো যে সকল খাতে দুর্নীতি বেশি, সে সকল খাতে ব্যয় বেড়েছে। এতে সত্যিকার্থে জনগণ কোনো ধরনের সুফল পাচ্ছে, নাকি অনিরাপত্তা গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে?

যে কৃষি আমাদের ঐতিহ্য, যে কৃষি আমাদের দিয়েছিলো পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী রাষ্ট্রের মর্যাদা, সে কৃষিকে ধ্বংস করা হয়েছে, বরাদ্দকৃত বাজেটই যার প্রমাণ। অথচ সুদের পেছনে চলে যাচ্ছে বড় অঙ্কের অর্থ। শুধু কি তাই? এ সুদের পরিমাণ আমাদের শিক্ষা বাজেটের চেয়েও বেশি! আর মূল ঋণ তো আছেই! কিন্তু আমাদের আয় কোথায়? আয় না থাকলে ঋণ পরিশোধ হবে কীভাবে? ঋণের সুদ পরিশোধ করতেই তো বেহাল দশা, মূল ঋণ আমরা কীভাবে পরিশোধ করবো? অথচ

আমাদের দেশের যে সম্ভাবনা, আমাদের খনিজ সম্পদ, আমাদের কৃষি, আমাদের বনাঞ্চল, আমাদের যুব-সম্পদ, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর– এসব নিয়ে ভালোভাবে কাজ করলে মাত্র কয়েক বছরে সব ঋণ পরিশোধ করে আমাদের দেশকে পৃথিবীর অন্যতম ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতির সমৃদ্ধশালী একটি দেশে পরিণত করা সম্ভব। কিন্তু আমরা সেটি করতে পারছি না।

সুদভিত্তিক পুঁজিবাদীরা সমগ্র দুনিয়াকে শাসনকালে এমন এক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছে, যেটির কারণে আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষভাবে হোক বা পরোক্ষভাবে, জেনে হোক বা না জেনে সুদের সাথে জড়িয়ে পড়ছি, জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছি। ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিক খাতে মানুষের মুক্তি তো দূরের কথা, গোটা দুনিয়ার ৭০-৭৫% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, অনাহারে, অসুখী অবস্থায়, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। সুদের কারণে পাশ্চাত্য তাদের বাজারকে ঠিক রাখার জন্য লক্ষ লক্ষ টন খাবার ধ্বংস করছে, আবার একই সময়ে আফ্রিকার দেশগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে অনাহারে।

সুদের ব্যাপারে ইসলাম কত সুনির্দিষ্ট ও দূরদর্শী মূলনীতি দিয়েছিল, তা আল্লাহর রাসূল (সা.) এর বিদায় হজ্জের ভাষণ পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। রাসূল (সা.) আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণার পরেই যে সকল বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোকপাত করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো সুদ। তিনি সবাইকে সুদ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।

ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামের আলেমগণ, নেতাগণ সব সময়ই সুদের বিরোধিতা করে গিয়েছেন। তারা জনগনকে সুদবিহীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন। কারণ, এই সুদ ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য যেভাবে ডেকে নিয়ে আসে, সুদ বন্ধ করা ব্যতীত তা কখনোই মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সুদ ছাড়া অর্থনীতি পঙ্গু। এ অর্থব্যবস্থায় সুদ হলো তেলের মতো। তেল ছাড়া যেমন গাড়ি চলে না, সুদ ছাড়াও এই অর্থনীতি চলবে না। আবার এটি থাকলেও মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক সংকট হবেই। অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, শোষণ, সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য, বৈদেশিক রাজনীতিতে ভারসাম্যহীনতা, বৈদেশিক ঋণ, সামাজিক অবক্ষয়, যুদ্ধ-বিগ্রহ, পশ্চাৎপদতা, ঘুষ, দুর্নীতি, চারিত্রিক অবক্ষয়সহ সুদের ৭০টির বেশি অপকারিতার কথা বলেছেন রাসূল (সা.)। এসব বর্তমানে আমাদের দেশেও পরিলক্ষিত হচ্ছে।

 

📌 লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুদের ভয়াবহ আরেকটি কুফল হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। বর্তমানে দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার চলছে ৯.৮%। এই অবস্থার মাঝেও প্রস্তাবিত বাজেটে মুদ্রাস্ফীতির হারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে ৬.৫%। অথচ আমরা দেখেছি গত অর্থবছরে ৬% লক্ষ্যমাত্রা ধরেও তার লাগাম টেনে ধরতে পারেনি সরকার। বরং আকাঙ্ক্ষিত অঙ্কের চেয়ে অস্বাভাবিকভাবে ৩.৮% বেড়ে গেছে এই সংখ্যাটা।

 

📌 ঘাটতি নির্ভর বাজেট

অন্যদিকে প্রতিবারের ন্যায় এবারের বাজেটও সম্পূর্ণ ঘাটতি বাজেট। মোট বাজেটের পরিমাণ ৭ লক্ষ ৯৭ হাজার কোটি টাকা হলেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা মাত্র ৫ লক্ষ ৪১ হাজার কোটি টাকা। বাকী ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা পুরোটাই ঘাটতি থাকছে। যা মোট বাজেটের ৩২.১২ শতাংশ।

অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়েই এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে হবে। এই ঋণ নেয়ার ধারাবাহিকতা আজ নতুন নয়। প্রতিবছরই ঋণের বোঝা বাড়ছে। মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৭৪ ডলারে। টাকার হিসেবে যার পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজারের বেশি টাকা। সদ্য জন্মগ্রহণ করা শিশুটির উপরও এই ঋণের ভার বর্তাবে।

বাজেটের ক্ষেত্রে সাধারণত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি নিরাপদ সীমার মাঝে পড়ে। অথচ ২৩-২৪ অর্থবছরেরই ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৫.৫ শতাংশের বেশি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে এবারের বাজেটের আকার বাড়ছে চার দশমিক ছয় শতাংশ (ডেইলি স্টার)। এই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলা ঋণ ও প্রতিবছর যে ঘাটতি বাজেট করতে হচ্ছে, এ নিয়ে বাজেট কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ তো লক্ষ্যণীয় নয়ই, বরং নামেমাত্র যেনো বাজেট পেশ করতে হবে, এজন্যই বাজেট পেশ করা হচ্ছে।

কার্ল মার্ক্সের ভাষায়, “আর্থিক বিবৃতি প্রদান একপ্রকার ধর্মীয় আচার হয়ে দাড়িয়েছে, যা পালন করা হয় রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা ও সৌজন্য প্রকাশের মাধ্যমে এবং তার সম্ভাব্যতা প্রমাণের লক্ষ্যে ব্যবহৃত প্রভূত বাকচাতুরীর দ্বারা উচ্চকিত রূপে পাঠ করা হয় (যা কখনোই পাঁচ ঘণ্টার নিচে সম্পন্ন হওয়ার নয়) অর্থাৎ নানাবিধ নর্তন, কুর্দন, ভাব ও ভঙ্গিমার সঙ্গে চার ঘণ্টার একটি বক্তৃতা প্রদান করা হয়।”

 

📌 কালো টাকা সাদা করার জঘন্য নীতি

এদিকে এ বাজেট যেনো কালোবাজারি ও দুর্নীতিবাজদের জন্য নিদারুণ খুশির সংবাদ নিয়ে এসেছে। মাত্র ১৫% কর দিয়েই অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা হবে আইনানুগভাবে বৈধ। পঞ্চাশ লাখ টাকা ইনকাম করলে ৩০% টাকা কর দিতে হবে, কিন্তু কালো টাকা সাদা করতে ১৫% কর দিতে হবে। এখন যারা কালো টাকা সাদা করবে, তারা তো আর পঞ্চাশ লাখ টাকার মতো নামেমাত্র টাকা সাদা করবে না। তাদের টাকার অঙ্কই তো হবে কমপক্ষে কয়েকশ’ কোটি টাকা, তাহলে সেখানে কীভাবে এতো কম করহারে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়!?

এই ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অর্থনীতি বিশ্লেষকগণও। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানায়, “মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার এই ব্যবস্থা সৎ ও বৈধ আয়ের ব্যক্তি করদাতাকে নিরুৎসাহিত করার সংস্কৃতি গড়ে তুলবে”। ঘোষিত অর্থ ও সম্পদের ব্যাপারে কোনো কর্তৃপক্ষের প্রশ্ন করার সুযোগ না রাখা দেশে দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলবে বলে আশঙ্কা করছে টিআইবি।

 

📌 বেকারত্বের অভিশাপ

আমরা ইতঃপূর্বেই দেখেছি দেশের বর্তমান বেকারত্বের হার যেভাবে বাড়ছে, তা সত্যিই একটি জাতির জন্য উদ্বেগজনক। কেননা, বেকারত্ব একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে ভঙ্গুর করে দেয়, দেশজ উৎপাদন কমে যায় এবং অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ধাবিত করে। শুধু তাই নয়, বেকারত্বকে একটি জাতির জন্য অভিশাপ স্বরূপ বিবেচনা করা হয়। পাশাপাশি, যারা হতে পারতো দেশের উন্নয়নের সোপান, একটি দেশকে সামগ্রিকভাবে শক্তিশালী কারিগর, সেই বিপুল মানবসম্পদ নিদারুণভাবে অপচয় হচ্ছে। আবার, বেকার যুবসমাজ সহজেই নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। যার ফলে জাতির মূল্যবোধ ও নৈতিকতায় ঘটে চরম অধঃপতন। আর এই অবক্ষয় সামগ্রিকভাবে বিনষ্ট করে সামাজিক নিরাপত্তা।

এহেন পরিস্থিতিতেও, ৪ লক্ষ কর্মক্ষম যুবক বেকার থাকা সত্ত্বেও, এমনকি তাদের বিশাল একটি সংখ্যা শিক্ষার বিবেচনা সর্বোচ্চ স্তর তথা অনার্স-মাস্টার্স পাড়ি দেয়ার পরেও, তাদের বেকারত্ব নিরসনে বাজেটে নেই কোনো সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা বা নির্দেশনা। ভাসা-ভাসা সুরে দক্ষতা বৃদ্ধিসহ যেসব বিষয়ে বলা হচ্ছে, সেগুলোকেও যথেষ্ট মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। তবে তাহলে কোথায় সেই উদ্বেগ কাটানোর প্রচেষ্টার বহিঃপ্রকাশ? কেনই বা এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না নীতি-নির্ধারকগণ? কী সেই অজানা কারণ যা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে রেখেছে আমাদের মনে? প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে বের করা আমাদের সবারই একান্ত দায়িত্ব।

কেননা, এভাবে যদি একটি দেশ, একটি জাতি চলতে থাকে, তাহলে সে জাতির মধ্য থেকে কীভাবে মুক্তিকামী ব্যক্তিত্ব উঠে আসবে? রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিবর্তে অন্তঃসারশূন্যতার দিকে ধাবমান করা; সংস্কৃতিকে পাশ্চাত্যের নীতি-নির্ধারকদের হাতের পুতুল বানানো; চিকিৎসা, কৃষি, খাদ্য, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র নীতি– সবই ভিন্ন দেশের লবিগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়াই তো স্বাভাবিক!

এজন্য আল্লাহর রাসূলের (সা:) বিদায় হজ্জের ভাষণ অনুযায়ী, তাঁর দেখানো পথ অনুযায়ী আমাদের মুক্তির পর্যালোচনা, আগামীর নতুন বাংলাদেশ গড়ার পর্যালোচনা ও সুদমুক্ত ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতির ভিশন তুলে ধরা আবশ্যক। আমাদের সচেতনতা ও সংগ্রাম ছাড়া অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন অসম্ভব, সংকট থেকে মুক্তিও মিলবে না।
সবশেষে এটাই বলতে চাই,
লক্ষ্য করুন– এতো এতো জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ বাজেট, যার উপর গোটা জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হয়, সেটা নিয়ে কোনো পর্যালোচনা নেই, যৌক্তিক প্রস্তাবনাও নেই! বিশ্ববিদ্যালয়, রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকেও নেই কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনা! অনলাইনে যতটুকুই দেখা যায় বা কাজ আছে, তার সবই তথ্যনির্ভর পত্রিকালাপ! কেননা ৯০% মুসলিম জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ক্ষেত্র নিয়ে পর্যালোচনা ও সমালোচনা অসম্ভব; যদি না নিম্নোক্ত বিষয়ে পারদর্শী হয়-

  •  Philosophy of Politics.
  • International Economics.
  • Political Economy.
  • Philosophy of Economics.
  • General Economy.
  •  Economic System of Islam.
  • মাকাসিদ আশ-শারিয়িয়্যাহ।

এসব বিষয়ে কোনো পারদর্শীতা কিংবা জ্ঞান আমার নেই। তবুও সাধারণ নাগরিক হিসেবে এতটুকু বুঝি যে, এব্যাপারে সঠিক পর্যালোচনা এবং জাতীয় প্রস্তাবনা আমাদের দিতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট, রাজনৈতিক সংগঠন এবং সব ধরনের সিভিল সোসাইটির এব্যাপারে এগিয়ে আসার কোনই বিকল্প নেই।

সম্মিলিত উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতেই; ঋণ ও সুদনির্ভর অর্থনীতির নিগড় থেকে বের হয়ে এবং কথিত উন্নয়নের স্লোগান বাদ দিয়ে আমাদের ইন্ড্রাস্ট্রি, কৃষি, বন্দর, প্রতিরক্ষাকে উন্নত করতে হবে। শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, ক্ষুদ্রশিল্প, ছোট উদ্যোগ, মৎসশিল্প, পোল্ট্রি, সবজি উৎপাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের বন্দর, আমাদের প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক আয় সবকিছু নিয়েই সবাইকে কথা বলতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে। জাতীয় কর্মসংস্থান কৌশল কমিটি, জাতীয় স্বার্থ রক্ষা কমিটি, প্রতিরক্ষা কমিটি, নগর ও স্বাস্থ্য রক্ষা কমিটি এবং জাতীয় উন্নয়ন কমিটি করে এগিয়ে যেতে হবে।

  • কেননা আমাদের রয়েছে–• ১৩ কোটি কর্মক্ষম মানুষ
  • তারুণ্যদীপ্ত প্রতিরক্ষা খাত
  • ইন্ডাস্ট্রি-কেন্দ্রিক বিশাল সম্ভাবনা
  • দুনিয়ার সেরা কৃষি (যার মাধ্যমে আমাদের পক্ষে দশ বছরে সেরা ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া সম্ভব)
  • গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর
  • বিপুল পরিমাণে খনিজ সম্পদ
  • বনাঞ্চল
  • মৎসশিল্প ইত্যাদি

এসব নিয়ে মাত্র বিশ বছর ভালোভাবে কাজ করলে এ দেশের বেকারত্ব, দরিদ্র্যতা, খাদ্য সংকট, চিকিৎসা সংকট-সহ যাবতীয় সংকটের সমাধান তো হবেই, যাকাত নেওয়ার লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না; ইসলামী সভ্যতা যার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। জনবিরোধী এই দুর্ভাগ্যের উপাখ্যান ঘোষণার এই ক্ষণে এখন প্রয়োজন, দেশ ও জাতির স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন মুক্তিকামী যুবজনতার পক্ষ থেকে এক নয়া ন্যায়ভিত্তিক ইশতেহার ঘোষণা করার। সে প্রত্যাশায়…

৮৫১ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়।পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন।বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।
Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়।পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন।বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top