১৯ শে রমজান, ঐতিহাসিক বঙ্গবিজয় দিবস

আমরা যদি গত দুই হাজার বছরের বিশ্বব্যবস্থা ও সভ্যতাসমূহের ইতিহাসকে পর্যালোচনা করি, তবে দেখবো প্রতিটি সভ্যতায় ফেরাউনি সভ্যতার শোষণ, সুদভিত্তিক অর্থনীতি ও ভয়াবহ আগ্রাসনের ধারাবাহিকতা উপস্থিত ছিল।

ইতিহাস সাক্ষী দেয়, বাংলা অঞ্চলও সে ধারাবাহিক জুলুমের করুণ অধ্যায় পার করেছিলো। তৎকালীন সেনদের নিষ্ঠুর অত্যাচার, ব্রাহ্মণদের শোষণ, ভয়াবহ দারিদ্র্যতা তার অন্যতম প্রমাণ। এ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বৌদ্ধ ও নিম্ন শ্রেণির হিন্দুরা একজন ত্রাণকর্তার অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন। বহুকাল ধরে চলমান জুলুম থেকে মুক্তির আশায় ভিক্ষু সম্প্রদায় মির্জাপুর গিয়ে বখতিয়ার খিলজির সঙ্গে দেখা করেন, তাদেরকে অত্যাচার থেকে বাঁচাতে আবেদন করেন। (আমরা জানি, পূর্ব থেকে চলমান মুসলিম ব্যবসায়ীদের সহমর্মিতা এবং তৎকালীন সময়ে অন্যান্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের আদালত ও আখলাকী ভিত্তির প্রশংসা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এটি সবাইকে ন্যায়ভিত্তিক মুসলিম শাসনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করায় এবং স্বয়ং বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই ধারণা করতে থাকেন যে, ইসলামী সভ্যতাই এ অঞ্চলে মুক্তি আনতে পারে)।
আবার শোষিত মানুষের করুণ চিৎকার, ভিক্ষুদের মুক্তির আর্তনাদ মুসলিম নেতাদেরও অজানা ছিলো না।
তারপরই মূলত বাংলা অঞ্চলে বখতিয়ার খিলজির আগমন ঘটে এবং এ মহান মুজাহিদের প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মণ্য শাসনের অবসান ঘটে।

বৌদ্ধরা, নিম্ন শ্রেণির হিন্দুরা ব্রাহ্মণদের পতন এবং মুসলমানদের বঙ্গবিজয়কে স্বাগত জানান। এটিকে তারা ‘ভগবানের দান স্বরূপ’ বলেও আখ্যা দেন।

এ প্রেক্ষিতে ইতিহাসের যে বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে– 

  • কী এমন বিষয় ছিলো যা উপমহাদেশকে ইসলামের জন্য এমনভাবে প্রস্তুত করেছিলো?
  •  কিসের ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলিমের বসবাস এখানে?
  • এখানকার সমাজবিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্বের ইতিহাস জানা ও পর্যালোচনা কি জরুরী নয়?
  •  উপমহাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির করুণ ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়ে প্রায় সাতশত বছর ন্যায়ভিত্তিক সাম্রাজ্য পরিচালনা; অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, ধর্মীয় সম্প্রীতি, প্রতিরক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা; ইসলামের প্রাণসত্তাকে বুঝা ও সকল চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে যোগ্য আসনে পৌঁছানো ইসলামী সভ্যতার পতনের (সাময়িক) কারণই-বা কী?
  •  ইসলামী সভ্যতার পতনের (সাময়িক) পরবর্তী জায়নবাদী বৃটিশদের ২০০ বছরের শাসন, তাদের নিকৃষ্ট গণহত্যা ও মানবতার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ আগ্রাসনের পর এখনো কেন সবার এত ভালবাসা ইসলামের প্রতি?
  • অতীতের সে প্রাণসত্তা কিংবা চেতনার কোনো ঘাটতি নেই কেন? গ্রামের কৃষক, শহুরে শ্রমিক অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সে রূহানী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি এত আবেগের উৎসস্থলই-বা কী, যা ৮০০ বছরে কর্ডোভায় নেই কিন্তু বাংলার প্রতিটি গ্রামে মুয়াজ্জিনের আযানে ফুটে উঠে?

এসব নিয়ে আলাপ জরুরী।

এ ক্রান্তিকালে ইতিহাসের বয়ান তৈরি ও আমাদের ইতিহাসের সাথে মেলবন্ধন তৈরিতে বিশেষভাবে স্মরণ করতে হবে বাংলার স্বর্ণালী সালতানাতকে।

মুসলিম শাসনামলের দুনিয়ায় ৭শ বছর ‘ভারতীয় উপমহাদেশ’ সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলো। গোটা উপমহাদেশ আদালত, ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি, সর্বোচ্চ উৎপাদন ও আকাশচুম্বী সহমর্মিতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে।
তখন অর্থনীতিতে বাংলা অঞ্চল ছিলো মুসলমানদের গর্বের অঞ্চল ও কৃষিতে নতুন ধারা সৃষ্টিকারী পথপ্রদর্শক। এ অঞ্চলে উৎপাদিত তিনশোর অধিক পণ্য ও খাদ্যদ্রব্য নিজস্ব জাহাজে পৌঁছে যেতো দুনিয়ার ৮০ টি অঞ্চলে।
আবার বাংলার অর্থনীতি, কৃষি, সমাজিকব্যবস্থার সাথে সাথে প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও আমাদের গর্বিত হাতছানি দেয়; বুজুর্গ উমেদ খাঁ এর মতো সেনাপতি, ইবনে হোসেনের মতো নৌ-সেনাপতি, দেওয়ান মুনাওয়ার খানের মতো বীর যোদ্ধারা আজও আমাদের উজ্জীবিত করে।
অত্যাচারী রাজা আচক নারায়ণের বিরুদ্ধে বারো আউলিয়া সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরউদ্দিন ও বদর পীরদের বিজয়াভিযান; গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে শাহ জালালের বিজয়াভিযান– সবই যেন ‘আন্দরকিল্লা’র মতোই বিজয়ের নিশান বহনকারী ইতিহাস।

আমাদের হারিয়ে যাওয়া ‘দারসবাড়ি’গুলো আজও হাহাকার করে, মক্তবগুলোও অসহায়ত্ব নিয়ে তাকায়। তখন আগা বাকের খাঁ, শায়েস্তা খাঁ, সেকান্দার গাজীদের কথা স্মরণ করতে বাধ্য হই।

রুমি, জামি, হাফিজ, গাঞ্জেশকর, বুল্লে শাহ, আমীর খসরু, আলাওলদের কাব্য-গানের যৌবনভরা বাংলা অঞ্চলকে নতুন করে দেখতে ইচ্ছে হয়। গিয়াস উদ্দিনদের দরগাতে গিয়ে নাশিদ, আজান, জিকিরের মজলিসেও বসতে ইচ্ছে হয়। কারণ এসবই আমাদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের মহাসমুদ্র!

ইতিহাসের সাক্ষী, ইতিহাসের প্রশ্ন, ইতিহাসের স্মরণ সবই এ কথা বলে যায়, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজিরাই আমাদের সিপাহসালার। আমরা তাদের আধ্যাত্মিক সন্তান; আবার শুরু হওয়া মহাজুলুমের বিপরীতে নতুন সভ্যতা বিনির্মাণের পথ আমাদেরকেই পাড়ি দিতে হবে।

১০৩৭ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।
Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top