আজকের দিনে বাংলাদেশের যুব সমাজের চোখে চোখ রাখলে, সহজেই একটি বিষয় উপলব্ধি করা যাচ্ছে- জাতীয় এক হতাশা আমাদের মাঝে নিমজ্জিত হয়েছে। চতুর্দিকে দুর্নীতি, দরিদ্রতা, সংকট ও দুর্যোগ, বিভিন্ন আন্দোলনসহ হতাশাজনক ভবিষ্যৎ যখন বিভিন্ন ইস্যু হয়ে যুবসমাজের সামনে আসছে, তখন সে যুবসমাজের হতাশ না হওয়ার কোনো কারণ অবশিষ্ট থাকেনা। বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কাজ করা এবং কর্ম-ভাবনার বহু বিষয় রয়েছে। যেমন- নানাবিধ ইস্যু জারি থাকলেও, জাতীয় সংকট বহুমুখী। এই বহুমুখী সংকটকালের বেশ কিছু বিষয়কে যদি আমরা সামনে নিয়ে আসি তাহলে আমরা দেখতে পাই-
প্রথমত, সিলেট বিভাগসহ আরও ১৭ টি জেলা ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে বেহাল অবস্থায় নিমজ্জিত হয়েছে৷ এর অন্যতম একটি কারণ- আমরা আমাদের শহরগুলোকে, পানি ও নদী ব্যবস্থাপনাকে ঔপনিবেশিক শাসনামলের আলোকেই গড়ে তুলেছি, সে আলোকেই পরিকল্পনা সাজাই এবং উন্নয়ন খুঁজে বেড়ায়। যেমন, আমাদের শহরগুলোতে পানি নিষ্কাশনের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেই না; কিছুদিন আগে মাত্র দু’দিনের বৃষ্টিতে চট্টগ্রামে পুরো শহর ডুবে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিলো। শহরকে সুরক্ষা করার নাম দিয়ে আমরা নদীগুলোতে বাঁধ দিলেও, শহরে পানি নিষ্কাশনের জন্য নদীর সাথে সুন্দর সংযোগ স্থাপন করে বিভিন্ন ধরনের নগরায়ণ করা সম্ভব, এ বিষয়গুলো কখনো চিন্তা ও মানসপটে নেই না। ফলশ্রুতিতে, একটু বৃষ্টি হলেই শহরে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়; আর শহরের এই জলাবদ্ধতায়, পানি যাওয়ার রাস্তা না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই পানি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়, পরবর্তীতে দুর্গন্ধ নগরীতে পরিণত হয় এবং এসবের প্রভাব গ্রামাঞ্চলে গিয়ে পড়ছে।
অপরদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কোনো কারণ ছাড়াই বাঁধ ছেড়ে দেওয়া, তাদের চাপিয়ে দেওয়া বিভিন্ন নীতির কারণে মারাত্নক সংকট ও দূর্ভোগ নিয়মিত আমাদের পোহাতে হচ্ছে৷
আমাদের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকা যেমন সমস্যা; তেমনি একই সাথে যখন আমরা এসব পরিস্থিতিতে পড়ছি, সেই সময়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বড় ধরনের সঙ্কটকাল মোকাবেলা করার যে উদ্যোগ, সেখানে লক্ষ্য করলে দেখা যায়-
গত কয়েক বছরে বন্যা হওয়ার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে। এই জেলাগুলোতে যে হারে বন্যা হচ্ছে, অর্থাৎ প্রায় ছয় মাসের অধিক সময় ঐ অঞ্চলের বড় একটি অংশ তথা জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ বেকারত্বের মধ্যে নিমজ্জিত হচ্ছে; দিনের পর দিন পানিবন্দি! ভয়াবহ অবস্থায় সরকার, প্রশাসন, কোন রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় গোষ্ঠীর দেখা নেই; উদ্যোগ নেই, প্রতিবাদ নেই! এগুলো নিয়ে আজ পর্যন্ত তেমন কোনো কাজ, জাতীয় উদ্যোগ লক্ষ্য করিনি৷ এমনকি কোনো ইস্যুও লক্ষ্য করবেন না৷ অথচ, বন্যা হলেই আমাদের একটাই কাজ তা হলো- বিভিন্ন দল, ধর্মীয় জনগোষ্ঠী, সেলেব্রিটি ব্যক্তিদের ত্রাণ নিয়ে দৌড়ানোর হিড়িক পড়ে যায়; যাতে লোকসম্মুখে জনপ্রিয় হওয়া যায়। এভাবে প্রতিবছর ত্রাণের মাধ্যমে কি আদৌ এ সমস্যা থেকে স্থায়ী মুক্তি সম্ভব? এ সমস্যা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে কোন দল, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রস্তাবনা কিংবা উদ্যোগ নাই। এটি জাতির জন্য বড় আশংকা এবং হতাশার বিষয়৷
ল্যান্ডস্কেপ স্থপতি দিলিপ দা কুনহা, উনার একটা গবেষণায় দেখিয়েছেন, বন্যা বলতে আমরা যা বুঝি এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক কোনো ঘটনা নয়। তিনি তার অঙ্কিত ছক-এ দেখিয়েছেন, পানি যখন এসকল বিষয়কে অতিক্রম করে, কিছু শর্ত পূরণ করে, তখন এটাকে আমরা বন্যা বলি। কিন্তু পানি সেসকল শর্তগুলোকে অতিক্রম করছে না, অর্থাৎ মানুষের অব্যাবস্থাপনার কারণে সৃষ্ট এই দুর্দশা, এগুলোকে বন্যা বলা যায় না। এমনকি প্রকৃতিকেও দোষারোপ করা যায় না।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করলে বুঝা যায়, ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে নদীর নিয়ন্ত্রণ এ বিষয়টি যুগযুগ ধরে চলে আসা একটি শোষণ৷ আর ঔপনিবেশিক আমলে এ ধরনের বাঁধ দেওয়া, এগুলোকে বিভিন্ন দাতা সংস্থার মাধ্যমে শক্ত অবস্থানে নেওয়া, দেশীয় বিভিন্ন সম্পদ নষ্ট করা, দেশের নদীগুলোকে মৃত করে ফেলা, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে দুর্ভোগে ফেলে, শহর রক্ষার নাম দিয়ে শহরকেও আরেকটি বড় ধরনের দুর্ভোগের মধ্যে নিপতিত করা, এগুলো ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে ব্রিটিশ জায়োনিস্টদের কাজ ছিলো। এ কাজগুলো এখনো পর্যন্ত চরম মাত্রায় বিদ্যমান। অর্থাৎ এখনও আমরা মন-মানসে ব্রিটিশ জায়োনিজমের দাসত্ব করে যাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, সিভিল সোসাইটি কিংবা নাগরিক সমাজ; এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের কেউ কিন্তু এগুলোকে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করছে না। এখান থেকে উত্তরণের উপায় বাতলে দিচ্ছে না। অথচ এ নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা দেশের অন্যতম আয়ের উৎস, অর্থনীতিকে সচল রাখার বড় এক মাধ্যম। কিন্তু সে মাধ্যমকে আজকে উল্টো অর্থনৈতিক সংকট, ধ্বংস ও মানুষকে মহাদুর্দশায় নিপতিত করার অস্ত্রে পরিণত করেছি। বরাবরের ন্যায় আবারও ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে বেহাল অবস্থায় নিমজ্জিত হলো উপকূল অঞ্চলের লোকজন।
এ সকল পানি ব্যবস্থাপনা, নগর ব্যবস্থাপনা, নদী ব্যবস্থাপনা, সঙ্কট বা দুর্যোগগুলোকে মোকাবেলা করার জন্য রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাকারী, পানি বিশেষজ্ঞ, ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গ, বিজ্ঞানী, স্থপতিগণ সকলকে সাথে নিয়ে ও সকলের চিন্তাগুলোকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে এমন একটি ইশতেহার প্রণয়ন করা এবং জাতীয় রূপরেখা প্রণয়ন করা আবশ্যক ছিল। এ কাজগুলোকে নিয়ে আজ পর্যন্ত আমরা কোনো ইস্যু লক্ষ্য করলাম না।
দ্বিতীয়ত, প্রথম আলো কিংবা বণিক বার্তা-র মত পত্রিকাগুলোতে প্রায়শই দেখা যায় যে, গরিবরা মহাসংকটে, মধ্যবিত্তরা দুর্দশায়, এ ধরনের নানাবিধ প্রবন্ধ। টিসিবির পণ্যের জন্য হুমড়ি খেয়ে ঝাপিয়ে পড়ে কিংবা পরিচিত কাউকে দেখলেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবিত্তরা মুখ লুকাচ্ছেন কিংবা দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও মিলছে না টিসিবির থেকে কাঙ্ক্ষিত পণ্য, এজাতীয় খবর! বারবার একই অভিযোগ করা হচ্ছে, মানুষের যে চাহিদা এর ৫ শতাংশও সরকারি টিসিবি থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মানুষের আয়ের উৎসের সংকটের কারণে দেশ এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, গরীব এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা সত্যিই কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে তাদের দিন অতিবাহিত করছে।
এখন, আমরা এখন যদি পর্যালোচনা করি, যে শর্করা জাতীয় খাবার বাজার থেকে কিনতে হয়, যেমন- চাল, আলু ইত্যাদি। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আলুর দাম ছিল পনেরো টাকা কেজি। ২০২২ বা ২৩ সালেও ছিল তা ২৮ টাকা বা ৩০ টাকা কেজি। এবছর বা আজকের দিনে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজিতে গিয়ে সেটা পৌঁছেছে। কিন্তু আমরা যদি একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন লক্ষ্য করি, ২০১৮ সালে তাদের বেতন সর্বনিম্ন যে মজুরি ছিল একজন শ্রমিক ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা বেতন পেতো। বর্তমানে তার বেতন সর্বসাকুল্যে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা হয়েছে। বেতন অনুপাত অনুযায়ী ডাবল হওয়া তো দূরের কথা, একদমই বাড়েনি। কিন্তু ১৫ টাকার আলু ৬০ টাকায় পৌঁছেছে। পাশাপাশি পুরুষ গার্মেন্টস শ্রমিক, ভ্যানচালক, রিক্সাচালক বা এ ধরনের বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষদের ক্ষেত্রে যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই, তারা দুপুরের খাবার না খেয়ে হয়তো গার্মেন্টস এর আশেপাশে এলাকায় টং দোকানে রুটি বা বনরুটি ইত্যাদি খাবার খায়, তারাও সংকটে! কারণ এগুলোর মূল্যও প্রায় তিনগুণ বেড়েছে।
অপরদিকে নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তো আরো ভয়াবহ অবস্থা। নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ গার্মেন্টস সেক্টরেও বেশি। তারা টাকা বাঁচানোর জন্য সন্ধ্যায় টিফিন হিসেবে বা দুপুরের খাবার হিসেবে ঘর থেকে বিভিন্ন খাবার বানিয়ে নিয়ে আসে। কখনো চাল ভাজা, সস্তায় বিস্কুট, চানাচুর, কেউ আটা দিয়ে চাপটি, কেউ বা ডাল-ভাত কিংবা শুটকি তরকারী-ভাত। এই নারী শ্রমিকদের আয় যেখানে বৃদ্ধি পায়নি, যারা টাকা বাঁচানোর জন্য বাহিরে পর্যন্ত খান না, তাদের কাছে আলু বা চালের দাম কমেনি বরং কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের জন্য এই ধরনের খাবার বহন করা অনেক বেশি কষ্টকর হয়ে গিয়েছে। আমিষ জাতীয় যে খাদ্য দ্রব্যগুলো রয়েছে, সবগুলোরই কিন্তু ব্যাপক আকারে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সে তুলনায় আয়ের যে উৎস, তা খুবই নগন্য।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস পেশা থেকে অন্যান্য যেসব শ্রম পেশা আছে, সে তুলনায় শুধুমাত্র গার্মেন্টস সেক্টরে করোনাকালীন সময়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারিয়েছে। এছাড়া অন্যান্য যে শ্রেণী পেশার শ্রমিকগণ রয়েছে, তাদের কাজের যে ভয়াবহ অবস্থা অর্থাৎ আয়ের তুলনায় ব্যয়ভার অনেক বেশি। একটা পরিবারের মানুষের খাবার খরচ প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। কিন্তু যদি এক পরিবারে একজন মানুষ চাকরি করে তাহলে তাদের আয় ১২ হাজার টাকার বেশি না। সেক্ষেত্রে ক্ষুদে বিক্রেতা, ঠেলাগাড়ি টানা কিংবা পুরনো কাগজ সংগ্রহকারী লোকজন, দিনমজুর, বেসরকারি বা আধা সরকারি অফিসের কর্মচারী, যারা বিভিন্ন গাড়ির চালক, শিল্প শ্রমিক, হোটেল বয়, নারীদের ক্ষেত্রে গৃহকর্মী, ঝাড়ু দেওয়া কর্মী, পানি আনা, ক্যান্টিনে কাজ করা, কারখানায় নিম্ন স্তরের কাজ করা বা সেলাই করা মানুষ রয়েছে তাদের কি অবস্থা?
একটি জরিপ বলছে, ৪৯ ভাগ শ্রমিক একদম রুগ্ন এবং পুষ্টিহীন, যাদের গড় আয়ু কমে আসছে। বিশিষ্ট লেখক মাহমুদ শফিক তাঁর ঢাকা নগরের বিপন্ন পরিবেশ গ্রন্থের ‘অবধারিত মৃত্যু’ অধ্যায়ে লিখছেন, বকুল (তালাকপ্রাপ্ত একজন নারী যার রিকশাচালক স্বামী তাকে তালাক দিয়ে চলে গেছেন) বলেন: ‘আমার স্বামীর ছিল দানবের মতো দেহ। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। এখন বুঝতে পারি, রিকশা চালানো কত কষ্টের কাজ। কাজের শেষে দেহটা বিছানার সঙ্গে লেগে যেত। তার পাশে যে একজন মেয়েমানুষ শুয়ে আছে, সে তা মোটেও ভাবত না’। বিষয়টা ভাবতেও কেমন জানি গাঁ শিউরে উঠে…!
এরপর আমরা আরেকটি জরিপ যদি দেখি, প্রতি ১০ জন গার্মেন্টস শ্রমিকের মাঝে অধিকাংশই তিন বেলা খায় না। অথবা খেলেও পুষ্টিহীন খাবার খায়। এদের ৯৮ ভাগ পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে থাকে এবং এর মূল কারণ হিসেবে তারা দেখিয়েছে তারা ন্যায্য মজুরি পায় না। বাংলাদেশের ৮৭ ভাগ শ্রমিক; যারা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ কোম্পানি থেকে ঋণ নেয় এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে সুদের ঋণ গ্রহণ করে। ৮৭ ভাগ শ্রমিক সারা বছর ঋণগ্রস্ত থাকে এবং ৬৩ ভাগ শ্রমিক বাকিতে চাল-ডাল কিনে। এসব নিয়ে তাদেরকেও বিভিন্ন ধরনের অনিরাপত্তার মুখোমুখি হতে হয়।
একইসাথে তাদের খাদ্য যোগানের সাথে সাথে তাদের বড় একটি যোগানের ক্ষেত্র হচ্ছে চিকিৎসা। তাদের পুষ্টির যে অবস্থা এক্ষেত্রে আমরা যদি বিভিন্ন জরিপগুলো দেখি তাহলে দেখা যায়, প্রতিটি শিশু, প্রত্যেকটি ব্যক্তি অপুষ্টির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা শহর কিংবা চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ সকল শহরের কিছু জরিপ যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি; দারোয়ান, পিয়ন, ঝাড়ুদার, মেথর, কুলি, মালি ও বর্জ্য কাগজ সংগ্রহক, বিভিন্ন মেকানিক, দর্জি বা কারখানার শ্রমিক, বাইন্ডিং প্রেসে কিংবা মেটাল সংক্রান্ত কারখানায় কর্মরত যে শ্রমিকরা অর্থাৎ নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী যারা রয়েছে, তাদের অধিকাংশই কিন্তু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এর মূল কারণ হচ্ছে তাদের ক্যালরি গ্রহণের অভাব অর্থাৎ এক্ষেত্রে একটা নীরব হাহাকার চলছে!
প্রথমত, তাদের ওজন কমে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তাদের অসুস্থতা বেড়ে যায় এবং বৃদ্ধ শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মারা যাচ্ছে।
যে কোনো একজন শ্রমিক বিল্ডিংয়ে কর্মরত অবস্থায় পড়ে যাচ্ছে, তাকে পরিচর্যা করার কেউ নেই, হাড় ভেঙে যাচ্ছে কিংবা মারা গেলেও তার দায়ভারকে গ্রহণ করবে কে? এ নিয়ে কোনো নীতিমালা আমরা আজ পর্যন্ত লক্ষ্য করিনি। এভাবে শত শত শ্রমিক বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, যার জরিপ আজ পর্যন্ত কখনও হয়নি।
এরপর আসা যাক গার্মেন্টস শ্রমিকদের সন্তানদের ক্ষেত্রে; যাদেরকে শিক্ষিত বানানোর স্বপ্ন তাদের বাবা-মা দেখে। কিন্তু তাদের ব্যয়ভার বহন করে উঠতে পারে না; তাই তাঁদের বড় একটি অংশ তাদের সন্তানদেরকে এখন কর্মমুখী করার চেষ্টা করছে অর্থাৎ তাদের সন্তানরাও শ্রমিক হিসেবে গড়ে উঠছে। একইসাথে এই সন্তানরাও পুষ্টিহীন অবস্থায় বেড়ে উঠছে, কারণ পুষ্টিকর খাবার ও চিকিৎসা এতটাই ব্যয়বহুল, যা তাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয়না। ফলশ্রুতিতে তারা সুস্বাস্থ্যহীন প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠছে, দিনাতিপাত করছে।
কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ কী আদৌ এরকম একটা দেশ?
যেখানে এরকম দুরাবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের কোটি কোটি জনগণের পথ চলতে হচ্ছে। যেখানে আমরা কয়েকদিন আগে দেখলাম চট্টগ্রামের ইসলামী ব্যাংকের একটি শাখায় দেড়শ ভরির অধিক স্বর্ণ উধাও হয়ে গিয়েছে। অমুক ব্যাংকের টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিবিদ এ ধরনের লোকেরা কোটি টাকা বাহিরে পাচার করে নিশ্চিন্তে তাঁদের দিন পার করছে। কিন্তু সে পাচারের ক্ষেত্রে আমরা সুষ্ঠু সমাধান না দিয়ে চিন্তা করছি, কালো টাকা দেশে কেন ভোগ করতে পারে না, যার কারণে বাহিরে দেশে পাঠাচ্ছে। আবার কালো টাকা ভোগ করার সুবিধা যদি দেশে দেওয়া হয়, তাহলে সবাই এটি অর্জন করতে শুরু করবে। এসব নিয়েই তর্ক বিতর্ক শুরু হয়। এ বছর বাজেটে ১৫ % ভ্যাটের মাধ্যমে কালো টাকা বৈধ করার সিস্টেমেটিক ওয়েও দেখা যায়।
অথচ এসবের বিরুদ্ধে গণমুখী ব্যবস্থা নেওয়া কত বেশি জরুরি ছিল, সেসব নিয়ে কিন্তু আমাদের কোনো মাথাব্যথা কিংবা উদ্যোগ নেই।
- অপরদিকে হাজার হাজার শ্রমিক যারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে রেমিটেন্স পাঠায়, তারাও নানাবিধ কষ্টের মধ্য দিয়ে উপার্জন করে। তাদের পরিবারেরও শহর অঞ্চলে সকলেরই বাড়ি ভাড়া করে থাকা সম্ভব নয়, সন্তানের ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানো সম্ভব হয়না। তবে, তারা তুলনামূলকভাবে সচ্ছল। মূল বিষয় হলো, তাদের এই কষ্টের টাকা বাংলাদেশে আসছে, তাদের অর্থ উপার্জনের চেয়েও বড় বিষয় তারা পরিবার থেকে দীর্ঘদিন দূরে থাকে। কেউ বাংলাদেশে এসে হয়তো বিয়ে করে, তাকে আবার ফিরে যেতে হয়। আবার যারা বিবাহিত অবস্থায় গিয়েছে, বছরের পর বছর পরিবার সন্তান থেকে দূরে, মা-বাবা থেকে দূরে পড়ে থাকে। এত সকল ত্যাগের মধ্য দিয়ে তাদের পাঠানো রেমিটেন্সগুলো দেশে আসে। হয়তোবা এরচেয়ে বেশি পাঠানো সম্ভব ছিল, যদি তারা দক্ষ হতো। কিন্তু তাদের অধিকাংশ মানুষই অদক্ষ, এ ধরনের মানুষরাই বিদেশে যায়, এটাও আরেক জাতীয় দুর্বলতা।
আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ভিত্তি ও আয়ের অন্যতম উৎস বিদেশে থাকা রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের পাঠানো আয়। সবমিলিয়ে যখন তাদের পাঠানো কষ্টের টাকাগুলো/রেমিটেন্সগুলো দেশে আসে এবং নানাভাবে বাইরেই পাচার হয়ে যাচ্ছে, গোটা জাতি শোষিত হচ্ছে! এরচেয়ে বড় জাতীয় লজ্জা আর কি হতে পারে আমাদের জন্য!?
গত কয়েকবছরে প্রায় ২৫ লক্ষ শ্রমিক বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে খালি হাতে! কিন্তু কেউ কি খবর রেখেছে তাদের? বা তাদের কোনো মৌলিক দাবির? তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে? তাদের পারিবারিক অসহায়ত্বের কোনো সমাধান কি হয়েছে? জমি বিক্রি করে আমাদের টগবগে যুবকরা বিদেশে গিয়ে অসহায় চেহারা নিয়ে রাতদিন খেটে যায়, নির্যাতিত হয়; তাদেরকেই যখন খালি হাতে দেশে ফেরত পাঠানো হয়, তখন একটা লাইনও আমরা উচ্চারণ করি না! কোনো উদ্যোগ ও কর্মসূচি তো বহুদূর! আদৌ এর কোন সমাধান হয়েছে কি?
- এরপর যদি আসা যাক নারী শ্রমিকদের আলোচনায়, নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও ভয়াবহ দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা। নিয়মিতই দেশে প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের লাশ ফেরত আসছে। এক বছরে সবমিলিয়ে লাশ এসেছে ৪ হাজার ৮৮১ টি। এর মধ্যে নারীদের সংখ্যাও অনেক। সাড়ে তিন বছরে শুধু সৌদি আরব থেকে নারী শ্রমিকের লাশ এসেছে প্রায় সাড়ে তিনশ। তাঁদের মধ্যে ৫৩ জনই আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। আত্মহত্যার এই হার তিন বছর আগের চেয়ে ১৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মানে এই সময়ে তাঁদের ওপর নির্যাতনও ১৭ গুণ বেড়েছে! কোনটা আত্মহত্যা আর কোনটা হত্যা, তাইবা কে বলবে? কেনইবা পরিবারের জন্য নিবেদিতপ্রাণ আমাদের মায়েরা আত্নহত্যা করে? কেউ আছে আমাদের? আছে কোনো পররাষ্ট্রনীতি, কোনো বৈদেশিক শ্রম ও অধিকার মন্ত্রণালয়?
এ সকল পরিস্থিতিতে সত্যিকার সমাধান বা উত্তরণের উপায় বের করতে এগুলোকেই জাতীয় অর্থনৈতিক ইস্যু কিংবা বাংলাদেশের জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা বিভিন্ন ধরনের অহেতুক ইস্যুতে ব্যস্ত। ফলশ্রুতিতে যুবকরা কেন-ই-বা হতাশ হবেনা?
তৃতীয়ত, আমরা যদি লক্ষ্য করি, বাংলাদেশ আজ ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটে নিমজ্জিত। অপরদিকে এসকল জ্বালানি সংকট নিয়ে আমাদের কোনো কাজ নেই, থিসিস বা রিসার্চ পেপার নাই, কোনো প্রস্তাবনা নেই কিংবা সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে কর্মসূচি নেই। কিছুদিন আগেও আমরা দেখতে পেয়েছি, সেন্টমার্টিন নিয়ে এত কথা ও আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। অথচ, সেন্টমার্টিন নিয়ে কোনো ধরনের থিসিস বা প্রস্তাবনা নেই। আসলে সেখানে কী হয়েছিল? এখানে কী আমাদের কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা অথবা সুশীল সমাজের দুর্বলতা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না? এগুলো কেন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয় না?
- এরপর যদি আমরা লক্ষ্য করি, আমাদের পার্বত্য অঞ্চল এখনো পর্যন্ত একটি ধোঁয়াশায় নিপতিত হয়ে আছে। সেটি নিয়ে আমাদের কোনো কাজ নেই, বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ কারো কোনো গঠিত প্রস্তাবনা নেই কিংবা এ বিষয়ে আমাদের কোন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি নাই।
আমরা কিছুদিন আগে মেতে উঠলাম ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে। এখানে বড় প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল, আমাদের সম্মানজনক পররাষ্ট্রনীতি নেই কেন? পররাষ্ট্রনীতি থাকলেও সেটা আদৌ কী? অর্থাৎ সম্মানজনক পররাষ্ট্রনীতি যদি থাকতো, তাহলে এই নীতির উপর ভিত্তি করে ভিন্ন দেশের সাথে আমরা চুক্তি করতে পারতাম। সম্মানজনক পররাষ্ট্রনীতিই যেখানে নেই, সেখানে ছোটখাটো দুই-একটি ফেসবুকে স্ট্যাটাস কিংবা ছোট দুই-একটি খবর দেশের পলিসির কিই-বা পরিবর্তন করতে পারে। অর্থাৎ স্থায়ী মুক্তির জন্য কোনো ইশতেহার সামনে হাজির নেই, কোনো গবেষণা নেই, সুশীল সমাজের কাজ নেই, সেখানে যুব সমাজ কেন-ই-বা হতাশ হবে না?
- বাংলাদেশের দারিদ্র্য কিংবা যুব সমাজের হতাশা, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দেশের মৌলিক আলাপের বিষয় হওয়া দরকার ছিল; শিক্ষাব্যবস্থা। আর এই সেক্টর দক্ষ যুব সম্প্রদায়ের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হবে, পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন খাতসমূহকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে। এ ধরনের কোনোকিছুই কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি না অর্থাৎ আজকের এই যে ভয়াবহ বেকারত্ব সৃষ্টি হয়েছে, এর পেছনের অন্যতম কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা।
জাতীয় সংকট পূরণে এ শিক্ষাব্যবস্থা কোনো সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারছেনা। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি থেকে শুরু করে সকল বিষয়ে কোন প্রস্তাবনা নেই, কর্মপরিকল্পনা নেই।
সার্টিফিকেট ছাড়া ভিন্ন কোন অর্জনও নেই, বিবেকবোধ পর্যন্ত জাগ্রত হচ্ছেনা! বর্তমানে আমাদের এমন অবস্থা যে, রাস্তার পাশে বৃদ্ধ অসহায় নারীদের পড়ে থাকা, কিংবা যুবতী নারীরা শিশুসন্তান নিয়ে ফুটপাতে ঘুমাচ্ছে, বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করছে, শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্য ও সুস্থতাসহ সকল কিছু থেকে বঞ্চিতরা পথে ঘুমাচ্ছে, সেসকল মানুষজনের দিকে তাকানোর পরেও শিক্ষার্থী সমাজের ভবিষ্যৎ ভাবনা, দেশকে গঠন করার ভাবনা, কাজ করার মানসিকতা তৈরি হচ্ছেনা। অর্থাৎ এক ভয়াবহ মানসিক দাসত্বের মধ্যে দিয়ে বড় হচ্ছি কিংবা দিন পার করছি। তার মূল কারণও আখলাক ও আধ্যাত্মিকতাহীন এই শিক্ষাব্যবস্থা। এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা যদি হাজির থাকে, কেন-ই-বা আমাদের যুব সম্প্রদায় হতাশ হবেনা?
- গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয়ে আমাদের নজর দেওয়া আবশ্যক।
কিছুদিন আগে ঈদ গেল! শুধুমাত্র গত এক বছরে- প্রায় ০৭ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে। এছাড়া কিছু কিছু পরিসংখ্যান আমাদের আড়ালেই থাকে তা হচ্ছে- মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয়। রেলপথে দুর্ঘটনা ঘটছে, নদীপথেও দুর্ঘটনা ঘটছে; এগুলোকে শক্তিশালী করে সুন্দর একটি বিকল্প মাধ্যম বানানো যেত, কিন্তু নদীগুলোকেও আমরা হত্যা করছি।
অপরদিকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল সাইটে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কয়েক লক্ষ ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লক্ষ-লক্ষ ভুয়া চালক এখন বিদ্যমান। বিশেষ করে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মনির মারা যাওয়ার পর বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডক্টর শামসুল হক বলেছিলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ রাস্তার বাঁকগুলো অবৈজ্ঞানিক। যে ধরনের প্রশস্ততা থাকা দরকার সে ধরনের প্রশস্ততা নেই। রাস্তাগুলো যেখানে যে ধরনের বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরি করা দরকার ছিল সেগুলো নেই।
গাড়ির যে অবস্থা সেখানকার যে তদারকিসহ সকল জায়গাতেই একটা ব্যর্থতার পরিচয় আমরা দিয়ে যাচ্ছি। এগুলোকে জাতীয় ইস্যু, সংস্কার করা, সমাধান করা নিয়ে সে অর্থে দাবী উত্থাপন করতে দেখা যায়না, এমনকি জাতীয় রাজনীতি ও জাতীয় ইস্যুতে এ সকল বিষয়গুলোকে আমরা হরহামেশা অনুপস্থিত রেখে দিচ্ছি। অথচ দূর্ঘটনা আমাদের জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।
- সম্প্রতি হঠাৎ ব্যাপকভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে! দ্যা ডেইলি স্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী গত বছর ২০২৩ সালে ২৭৬২৪টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ দৈনিক ৭৭টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স মিডিয়া সেল থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সারা দেশে এই অগ্নিকাণ্ডে ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকা মূল্যের সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও অসংখ্য ঘটনা মিডিয়া কভারেজের বাইরে ছিল।
বিভিন্ন গ্যাস ফিল্ড, বিভিন্ন কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি বিষ্ফোরণ হয়ে বিভিন্ন বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। এসব কিন্তু সিস্টেমেটিক বিষয়ের সাথে জড়িত। অর্থাৎ এই বিষয়গুলো চাইলেই সমাধান করা সম্ভব। যখন মারা যাচ্ছে, তখন কিছু কথাবার্তা হচ্ছে, কিছু গ্রুপ ত্রাণ দিচ্ছে, কোন কোন সংগঠন আবার সমবেদনা জানিয়ে প্রেস ব্রিফিং করছে কিন্তু তারপরে কেউ এ ব্যাপারে এমনকি ট্রেড ইউনিয়ন থেকে শুরু করে কেউ কথা বলছে না, কেউ কোনো ভূমিকা রাখছে না। এ সকল ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যখন দেশ আগাচ্ছে, তখন যুব সম্প্রদায়ের মনে হতাশা তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
কারণ এই সময়ে বসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে। সামগ্রিকভাবে আইনের শাসনে ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২। ঋণ খেলাপের দিক থেকেও বাংলাদেশ প্রথম সারিতে অবস্থান করে। এভাবে করে বাংলাদেশে ধর্ষণ সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে, গত দুই বছরে ১৭ হাজারের অধিক নারী-শিশু ধর্ষিত হয়েছে। অর্থাৎ আইন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। এ সকল সহিংসতার দিক থেকে বাংলাদেশের ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। ২০০২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধর্ষণ ও গণধর্ষণের পর হত্যা, এছাড়াও বিভিন্ন যে হত্যাগুলো হয়েছে অর্থাৎ বিনা অপরাধে কিংবা হত্যা সংশ্লিষ্ট যে মামলাগুলো হয়েছে, তার ৯৭ ভাগেরই সাজা হয়নি। নাগরিক নিরাপত্তার বেলায়ও আমরা দেখতে পাই, ১১৩ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২ বা ১০৩ এ থাকছে। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনা, যানবাহন নির্মাণ-শিল্প, পাহাড়কাটা, জাহাজের কিংবা ট্রেনের নিচে অবহেলার জন্য দুর্ঘটনা, নানাবিধ কারণে শত শত হাজার হাজার মানুষ মরছে। বৈদ্যুতিক শক কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে, উচু জায়গা থেকে পড়ে গিয়ে একইভাবে হাজার হাজার শ্রমিক নিহত হচ্ছে। এর থেকেও বেশি নিহত হচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্ষণ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিনা অপরাধে হত্যার মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমরা সুষ্ঠু কোন সমাধান পাচ্ছিনা। আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো সমাধান হচ্ছে না অর্থাৎ ৯৭ ভাগ অপরাধী এ পর্যন্ত সাজারই বাইরে থেকে গেছে।
এ সকল পরিস্থিতিতে দেশের যুব সম্প্রদায়ের মূল অংশটি কিন্তু দেশ ছাড়ার জন্য উন্মুখ।
যে দেশে বেকারত্ব, যে দেশের কৃষি সংকট, যে দেশে সুস্থ শিক্ষার সংকট, যে দেশে এরকম অনিরাপত্তা! এই ধরনের সৃষ্ট সমস্যাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিণত করা, সেখানে গোটা প্রজন্মই যেন বড় হচ্ছে দেশ ছাড়ার স্বপ্ন নিয়ে।
তবে সেখানে একটি বড় অবদান রাখতে পারতো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহ। ক্ষমতাসীন দল কিংবা বিরোধী দল, তাঁদের কোন দল ক্ষমতায় আসার পরে প্রথমে কিছু ইনোভেটিভ, ভালো ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিগত ছয় মাসে বর্তমান সরকারের ক্ষেত্রে সেটিও কিন্তু আমরা লক্ষ্য করিনি। একইভাবে এই সকল জায়গাতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারতো বিরোধী দলগুলো, তারা কোনো ভূমিকা রাখছে না। মূল কথা হচ্ছে জাতীয় রাজনীতি চরম হাহাকারে নির্মিত হচ্ছে।
এ হাহাকারটা কিসের?
এ হাহাকার নেতৃত্বের হাহাকার, যুবক সমাজের প্রস্ফুটিত হওয়ার হাহাকার। কারণ শক্তিশালী যুববান্ধব নেতৃত্ব নেই, কিছু কথাবার্তা হলেও সেগুলো ফেসবুকের কিছু লেখালেখি, কিছু ইউটিউবের ভিডিও! অর্থাৎ কোনো ভিশনারি দলের পক্ষ থেকে শক্ত লিডারশিপ এবং জাতির সংকট উত্তরণের জন্য তাদের পক্ষ থেকে কোন যৌক্তিক আহ্বান করছেনা। যুব সমাজকেও গড়ে তোলার কোনো প্রচেষ্টা করছে না। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রে এর ভয়াবহ যে শূন্যতা, তার বড় প্রমাণ হচ্ছে তরুণ নেতৃত্ব তুলে আনার জন্য কোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক কোনো উদ্যোগ বর্তমানে আমরা লক্ষ্য করি না। বরঞ্চ নানাবিধ ইস্যুর ভীড়ে আমরা হারিয়ে যাচ্ছি। অথচ এই যুবসমাজকে গড়ে তোলার চেয়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সংস্কৃতিক যে উদ্যোগগুলো প্রয়োজন ছিল; এই প্রয়োজন সেখানে ব্যর্থ হচ্ছে। বেকারত্ব, শিক্ষা কাঠামো, দেশের অব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়গুলোকে নিয়েই কিন্তু ইস্যু হাজির হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেগুলো কেউ করতে পারছে না। মূলত এই প্রত্যেকটি কাজ ছিল বড় বড় রাজনৈতিক দল, সংগঠন, অর্থনৈতিক সংগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর। অথচ কেউ এক্ষেত্রে স্বার্থক কিংবা সফল হতে পারেনি।
আবার সকলের একটি মুখস্ত দোষ দেওয়ার জায়গা তৈরি হয়েছে, আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে, তারা কিছু করতে দিচ্ছেনা। আসলে কি আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে? নাকি বাহ্যিকভাবে কোনো নেতৃবৃন্দ দেখা গেলেও তাদের হাতে আসলে দেশ নেই। মাফিয়া সিন্ডিকেট কিংবা ডিপ স্টেটগুলো দেশ চালাচ্ছে। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলো তাদের মত করে সমস্ত কিছুকে শোষণ করে তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে। আমরা সম্পূর্ণ একটি নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছি।
আমরা যদি বিএনপি-জামাতের দিকে লক্ষ্য করি, তারা নির্বাচনের আগে একটু একটিভ হলেও বাকি সময়গুলোতে জাতীয় ইস্যু তারা নির্ধারণ করতে পারছে না। গণমুখী আহবান তাদের করতে হবে। এটা তাদেরকে করতে হবে, যদি তারা সামনে কিছু করতে চায়। তারা আধুনিকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, তারাই দীর্ঘদিন পর্যন্ত এ সংগ্রামকে এগিয়ে নেবে; এ ধরনের দৃঢ়তা তাদের জন্য আবশ্যক।
অর্থাৎ এই যে সংকট, এ সংকটগুলো কেন-ই-বা তৈরি হচ্ছে? এ প্রশ্ন কিন্তু আমরা করছি না। কারণ এ অবস্থা একদিনে হয়নি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা। কেন জাতীয় ব্যর্থতা?
- সমাজ গতিশীলতা হারিয়ে ফেলছে, আমরা ব্যক্তি পর্যায় থেকে কেউ কাজ করি না। কেউ দেশকে শক্তিশালী করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছি না।
- সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি শক্তি চেপে বসা।
- ডিপ-স্টেটগুলির নিয়ন্ত্রণ।
- আমাদের সামাজিক সচেতনতাকে সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলা। এ সকল কারণগুলোর মধ্য দিয়ে একটা অজানা দাসত্ব ব্রিটিশ আমলের ন্যায় চেপে বসে আছে।
ফলশ্রুতিতে জ্বালানি খাতের মতো এতো বড় খাত কিংবা সাধারণ একটি খাতের কোনো সুষ্ঠু নীতি তৈরি করতে পারি না। যেমন- জ্বালানি খাতের ভুল নীতির কারণে আজকে বিদ্যুৎ সংকটে পড়তে হচ্ছে। সত্যিকারের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নেই, থাকলেও তাদের নীতি সর্বদাই সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় তৈরি হয় এবং সে আলোকেই প্রস্তাবনা দেয়। আমদানি নির্ভর জ্বালানি খাত বানানোর মতো অন্যতম কারণও এটি। খাদ্যের ক্ষেত্রে একই ভাবে এটি আমদানি নির্ভর করে রেখেছে। খাদ্য বিশেষজ্ঞ আমাদের নেই? সে ধরনের নেতৃত্ব কি নেই? সত্যিই তো নেই। যেখানে বড় বড় গোষ্ঠীর দলগুলি ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে সেখানে যুবকদের অবস্থা কিইবা হবে?
এজন্য বলতে চাই,
জাতীয় ব্যর্থতাকে কাটিয়ে উঠতে, সমাজকে গতিশীল করতে, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে মুক্ত করতে, সামাজিক সচেতনতা এবং দাসত্ব থেকে মুক্ত একটি যুব সম্প্রদায়কে গড়ে তুলতে; সর্বপ্রথম যুবকদেরকে একটি জাতীয় ভিশন দেখাতে হবে। প্রত্যেকটি ব্যক্তি যেনো তার ব্যক্তি পর্যায়ে থেকে, নিজ ফিল্ডে জানা বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে পারে, উপমা তুলে ধরতে পারে। সংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা শিক্ষা বা অন্য কোনো মাধ্যমে যুবকদের গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাতে পারে। ভিশনারী এই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাহলেই আজকের এই দিনের হতাশা যুব সম্প্রদায়ের মাঝে আত্মবিশ্বাস আকারে ফিরে পাবে।
কারণ আমরা সংগ্রামী জাতি, যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করেই আমাদের আজানকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছি, জাতীয় সত্তাকে টিকিয়ে রেখেছি, ঈমানকে টিকিয়ে রেখেছি, আমাদের মাটি ও মানুষের মৌলিক যে চেতনা সেটিকে টিকিয়ে রেখেছি। অতএব এ সকল বিষয়কে যেহেতু আমরা টিকিয়ে রাখতে পেরেছি, অর্থনীতি, পানি, নগর, গার্মেন্টস, জ্বালানি সকল ব্যর্থতাকে কাটিয়ে উঠতে পারবো এবং জাতীয় নেতৃত্ব আমাদের যুব সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই দিতে পারবো, এ বিশ্বাস লালন করতে হবে এবং এটার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। অবশ্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে তার ওয়াদা অনুযায়ী নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য যোগ্য করে তুলবেন, ইনশাআল্লাহ।