বিজ্ঞানীদের মতে প্রতিটি কো্ষের (Cell) যেমন একটা নিউক্লিয়াস (Nucleus) থাকে, তেমনিভাবে আদর্শ হিসেবে সেকুলারিজমের উত্থানের আগ পর্যন্ত সভ্যতা ও শিক্ষার Nucleus বা কেন্দ্র ছিল ধর্ম। এখানে উল্লেখ্য, নাস্তিকতা ইতিহাসে কোনাে সভ্যতার ভিত্তি ছিল না। শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল একটি নৈতিক ভিত্তি সৃষ্টি করা, নৈতিক মূল্যবােধসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টি করা। এ কথা ইসলামের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। ইসলামী যুগের শুরুতে, মধ্যযুগে এবং অতি সাম্প্রতিককালেও ঔপনিবেশিক যুগের আগ পর্যন্ত মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ছিল কোরআন, হাদীস ও রসুল (স.) এর সীরাতের ওপর বা ফিকহের ওপর। মােটকথা, এর সবগুলাের ওপর গুরুত্ব দেয়ার সাথে সাথে ইতিহাস, ভূগোল, রাষ্ট্রপরিচালকদের কর্তব্য, সরকারি নীতিমালা অথবা শাসনকর্মের নিয়ম-কানুন নিয়ে আলোচনা করারও শিক্ষা দেয়া হয়েছে। হযরত আলী রা, কর্তৃক মালিক আল আশতারকে পাঠানাে চিঠিতে গভর্নর বা রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব কী, সে ব্যাপারে আলােকপাত করা হয়েছে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শিক্ষার মর্মমূলে ছিল ধর্ম বা ইসলাম, চরিত্র ও নৈতিকতা । প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞান যা-ই শিক্ষা দেয়া হতাে, তা ছিল এ মূলকে কেন্দ্র করেই।
বৌদ্ধদের ইতিহাসেও দেখা যায় একই সত্যের পুনরাবৃত্তি। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষা প্রদান করা হতো, তার মধ্যেও দেখা যায় শিক্ষাব্যবস্থার মূলে ছিলো চরিত্র বা বৌদ্ধধর্মের নৈতিকতা। এর সাথে তারা ভারতে প্রচলিত অন্যান্য বিদ্যাকেও শামিল করে নিয়েছিলেন। হিন্দুধর্মের প্রাথমিক যুগের দিকে তাকালে দেখা যায় বিদ্যা শিক্ষার মূল ছিলো ‘বেদ’। বেদ মানেই বিদ্যা। তাদের প্রাচীন ফিলোসোফির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল বেদ। অর্থাৎ শিক্ষার কেন্দ্র এটাই ছিল। এর সাথে প্রয়োজনকে সামনে রেখে যুদ্ধবিদ্যা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বা অর্থনীতি ও অন্যান্য শাস্ত্রও যোগ করা হয়েছিলো। খ্রিষ্টানদের অতীতে গেলে দেখা যায়, তাদের শিক্ষাও ছিলো গির্জাকে কেন্দ্র করে। প্রতিটা গির্জা একটা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সেখানে যা পড়ানো হতো তার মূলভিত্তি ছিল বাইবেল।
আঠারো শতকে পাশ্চাত্যে মুক্তবুদ্ধি আন্দোলন শুরু হয় এবং এর প্রভাবে আধুনিক সেকুলার মতবাদ পাশ্চাত্য ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শিক্ষাকে ধর্ম থেকে আলাদা করা হলো। এভাবে যে ব্যবস্থা গড়ে উঠল, তাতে মানুষ নিতান্ত স্বার্থপর হয়ে গড়ে উঠল। তারা ভােগবাদী হয়ে পড়ল। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে গেল। সে ধর্মের আর কোনাে কাজ হয় না, তার প্রতি সম্মানও কমে গেল । নীতিবোধের যে শ্রেষ্ঠত্ব বা প্রাধান্য, তাও লােপ পেল। নীতিহীনতা, স্বার্থপরতা নিয়ে মানুষ গড়ে উঠল। এই স্কুলে জেনারেলরা গড়ে উঠলেন, পলিটিশিয়ান ও চিন্তাবিদেরা তৈরি হলেন। তাদের মনের গভীরে এই মনােভাব স্থায়ী হলাে যে, জনসমাজের জন্য ধর্মের প্রয়ােজন নেই, চাই সেটা পার্লামেন্ট, মার্কেট, স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্যাংক যাই হোক না কেন । এই যে ব্যক্তিগত এক ধরনের মন-মানসিকতা গড়ে উঠল, তার ভিওিতে তাদের সামাজিক আচরণ তৈরি হলাে।
এর ফলে সব ক্ষেত্রে তার প্রভাব কার্যকর হলাে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সোশ্যাল ডারউইনিজম প্রবেশ করল, অর্থাৎ Survival of the Fittest-কে মূলমন্ত্র করে নেয়া হলাে। অর্থাৎ কেবল যােগ্যতমরাই টিকে থাকবে। এর মানে যারা যােগ্যতম নয়, তারা ধ্বংস হোক, এতে কিছু আসে যায় না। প্রাকৃতিক ক্রিয়াকে আমরা বাধা দেবাে কেন? এভাবেই কোনাে জাতি যদি এ উপমহাদেশের লােক হয়ে কিংবা আফ্রিকা বা চীনের লােক হয়ে প্রতিযােগিতায় যােগ্যতম প্রমাণিত না হয় বা টিকতে না পারে, তারা হেরে যাবে । এথানে কোনাে নীতিবোধ, দয়ামায়ার প্রয়ােজন নেই। এটাই বরং যুক্তিযুক্ত যে, যােগ্যতাকে আমরা এগিয়ে দিলাম। এটাই সোশ্যাল ডারউইনিজম, যা ছিল খ্রিষ্টান ধর্মের বিরোধী, ইসলামের বিরােধী ।
কিন্তু পুঁজিবাদ যখন সেকুলারিজমের (যার প্রকৃত অর্থ রাষ্ট্র থেকে ধর্ম বর্জনবাদ) সঙ্গী হলো, তখন ইউরোপে শ্রমিকদের এমনভাবে শোষণ করা হলো যে, তাদের শুধু বেঁচে থাকার অবস্থায় রেখে দেয়া হলাে। তাও শুধু উৎপাদনের স্বা্র্থে। পরে এর প্রতিক্রিয়াতেই কমিউনিজমের জন্ম হলাে, সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটল। অর্থনীতির ক্ষেত্রে মুক্তবুদ্ধির মতবাদ বা সেকুলারিজম আরােপের ফল হলো- অর্থনীতিতে অমানবিকতা ও নীতিহীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল । আরো বলা হলো ‘এটা হচ্ছে পজিটিভ সায়েন্স’। অর্থনীতি একটি অবিমিশ্র বিজ্ঞান, এর মধ্যে নীতিবোধ থাকবে না, নীতি থাকবে না। যেমন- বাতাস বা পানির জন্য আমরা কোনাে নীতি দিই না, তেমনি অর্থনীতির কোনাে নীতি থাকবে না। এটা নিজের গতিতে চলবে। এগুলাের পরিণাম অর্থনৈতিক সঙ্কট। এটা হয়েছে অতি লােভ এবং অতি আকাক্ষা থেকে এবং সুদ এটাকে সাহায্য করেছে। সুদ না থাকলে এটা কখনােই হতাে না।
একই সাথে সেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানেরা দুনিয়া বিজয়ে বের হয়ে গেল । ঐ ব্রিটেন, জার্মানি, ইতালি, স্পেন ও নেদারল্যান্ডস প্রায় সারা দুনিয়া দখল করে নিল। দুই আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও আফ্রিকার প্রায় ১০০ শতাংশ এবং এশিয়া প্রায় ৭০ শতাংশ দখল করে নেয়া হলাে। তা করতে গিয়ে এরা পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হলাে এবং ওইসব দেশের স্থানীয়দের সাথে পর্যন্ত যুদ্ধ করেছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মুক্তবুদ্ধির অনুসারীরা সারা দুনিয়া জয় করেছিল। তাদের নীতিহীনতা এই বিজয় এনে দিলাে। কেননা, কোনাে নীতিবাদী সমাজ এভাবে পররাজ্য আক্রমণ করতে পারে না; দখল করতে পারে না। তারা লুট করল বিশ্বকে। আফ্রিকার মতো একটি সমৃদ্ধ মহাদেশকে বিরান করে ফেলল। লােহাসহ নানা ধরনের খনিজ সম্পদ, স্বর্ণ, হীরা সবই তারা লুট করে নিয়ে গেল । দক্ষিণ আমেরিকাকে স্পেনীয়রা লুট করল। ব্রিটিশরা আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাকে লুট করল, যেমন আফ্রিকাকে করা হয়েছিলো । লুটতরাজ ছিল এদের আসল কাজ।
পাশ্চাত্য সভ্যতার গর্ভ থেকে অত্যন্ত ক্ষতিকর চারটি মতবাদের জন্ম হয়েছে। ফ্যাসিজম, কমিউনিজম, ক্যাপিটালিজম এবং সেকুলারিজম।
স্রষ্টাকে যারা কোনাে স্থান দিতে রাজি নয়, তারা পরিবার ও জেন্ডার ইস্যুতে পশুর মতাে হয়ে গেল। তারা মনে করল, পরিবারের গুরুত্ব নেই এবং এটি হলাে নারীদের দাবিয়ে রাখার প্রতিষ্ঠান, তাদের দাস বানানাের জন্য। তারা বরং পশুর মতো থাকাই ভালো মনে করল । পরিবার গঠন করার নাকি প্রয়ােজন নেই। যদি কেউ পরিবার গঠন করেও তবে এটা হবে নিছক সন্তান জন্মদানের জন্য। অর্থাৎ তা পশুর মতোই হবে। এমনও হতে পারে, একটা কমিউন হবে, সেই কমিউনে ১০০ পুরুষ ও ১০ নারী থাকবে। কার শিশু কেউ জানবে না। সবাই মিলে শিশুদের পালন করবে।
তারা এমন একটা ধারণাও নিয়ে এলাে যে, ততদিন পর্যন্ত একটা পশু তার বাচ্চা লালন করে, যতদিন সে নিজের খাবার নিজে খেতে না পারে । বাঘ ও কুকুর তাদের বাচ্চাদের ততদিন পর্যন্ত পালন করে, যতদিন বাচ্চা নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে। মানুষকেও তাই করতে হবে। মনােভাব এমন- কেন ৩০ বছর পর্যন্ত খাটবো আমি? কেন ত্যাগ স্বীকার করব? সন্তান জন্ম নিয়েছে এবং প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সে এখন বড় হয়েছে। সে নিজেই নিজের কাজ করে বেড়াক। আমার কোনাে দায়-দায়িত্ব নেই। আমার স্বার্থ কেন ত্যাগ করব? আমি কেন আমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বাদ দেবাে? সুতরাং পরিবারব্যবস্থার যে বর্তমান দুর্দশা, সেটার অনেকটা-ই সেকুলার মতাদর্শের কারণেই।
এর সমাধান কী? আমার জানা মতে, দুইভাবে এর সমাধান হতে পারে। একটা হলাে, মুসলিম হিসেবে আমরা আল্লাহ তা’য়ালার কাছে, তাঁর নির্দেশনার দিকে যাই বা নিজেদের সােপর্দ করি । তাকে সব সময় অবলম্বন করতে হবে। তার ওপর আস্থা রেখেই জীবন যাপন করতে হবে। তার কাছে আমরা সবদিক দিয়েই আবদ্ধ ও দায়বদ্ধ। তাকে বাদ দেয়া চলবে না কিছুতেই। এটি হলাে মুসলিম হিসেবে আমাদের বক্তব্য। হিন্দু হিসেবে যদি কেউ বলেন, তাহলে বলতে হবে স্রষ্টার দিকে যাওয়া, নৈতিকতার দিকে যাওয়া, ধর্মের দিকে ফিরে যাওয়া। তাই সমাধান হিসেবে বলছি, যেভাবেই হােক, মানুষকে নৈতিক শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে হবে। নৈতিক শিক্ষার জন্য ধর্ম ছাড়া আর কোনাে ভিত্তি নেই।
মুসলিম দেশে ইসলামকে ভিত্তি করতে হবে এবং অমুসলিমদের জন্য বিকল্প থাকবে। অমুসলিমদের দেশে তাদের ধর্মকে কেন্দ্র করে, তাদের নৈতিকতার ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সেখানে মুসলিমদের জন্য বিকল্প থাকবে বলেই আশা করি। এভাবে যদি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তবে আশা করা যায়, ভালাে মানুষ তৈরি হওয়া শুরু হবে। রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবার- সব ক্ষেত্রেই ভালাে লােক তৈরি হবে। ভালা লােক তৈরি হলে সব ক্ষেত্রে ভালাে আসবে। কেবল থিওরি দিলে কিছুই হবে না, মানবতা পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ তাে শুরু করতে হবেই।
ইসলাম বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে নয়
এখানে উল্লেখ করতে চাই, প্রফেসর ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর বই “আত-তাওহীদ”-এ উল্লিখিত তাঁর মন্তব্যের কথা । তিনি বলেছেন,
God is not against science. God is the condition of science, not an enemy of science.
আল্লাহ আছেন বলেই তিনি একটা শৃঙ্খলা স্থাপন করেছেন। আল্লাহ আছেন বলেই বিজ্ঞানের সূত্র বের করা সম্ভব হয়েছে । আল্লাহ না থাকলে কোনাে শৃঙ্খলা থাকত না, কোনাে বিজ্ঞানও সৃষ্টি হতো না।
আমরা বুঝতে পারি, মানবজাতি ছিল মূলত ধার্মিক, সেটাকে সেকুলাররা সেকুলারমনা করে দিয়েছে। তাদের আবার ধার্মিকমনা করতে হবে; ইসলামীমনা করতে হবে। ধার্মিক মন ও সেকুলার মনের মধ্যে পার্থক্য কী? ইসলামী মন হচ্ছে সেই মন- যা কোনাে সমস্যা হলে এর সমাধান খোজে কুরআন ও সুন্নাহতে। তারপর অন্য দিকে। অপৎদিকে সেকুলার মন চিন্তা করে না আল্লাহর কিতাবে কী আছে? সে ভাবে, আমাদের যুক্তিবাদী পণ্ডিতেরা কী বলেছেন, রাজনৈতিক পণ্ডিতেরা কী বলেছেন কিংবা রাশিয়া, চীন, আমেরিকা, কানাডা কী করেছে। তারা দুনিয়াকে ধার্মিক মন থেকে সেকুলার মনের দিকে নিয়ে গেল। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, সমগ্র দুনিয়াকে একটি নৈতিক ছকে নিয়ে আসা; ধার্মিক মন ফিরিয়ে আনা।
সূত্রঃ বিআইআইটি কর্তৃক প্রকাশিত “উন্নত চিন্তা, মহৎ জীবন, আদর্শ সমাজ” গ্রন্থ।


