বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম।
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ,
আমাকে এমন একটি কনফারেন্সে আমন্ত্রণ করার জন্য সর্বপ্রথম “ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট” কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং একই সাথে শ্রোতাদেরও আমাকে শুনতে আসার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি সব সময়ই যুবকদের সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমি বিশ্বাস করি, কেউ যখন যুবকদের নিয়ে কথা বলে তখন সে ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলে। কারণ আজকের যুবকরাই আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আমাদের ভবিষ্যতকে বুঝার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে, আমাদের ইতিহাস এবং বর্তমানকে বুঝা। আমি আজ সংক্ষেপে আমাদের ইতিহাস ও বর্তমান বিশ্বকে তোমাদের সামনে তুলে ধরবো। আমার আজকের বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে, তোমাদেরকে অনুপ্রাণিত করা যাতে তোমরা শুধুমাত্র তোমাদের দেশেরই নয় বরং সমগ্র উম্মাহর, সমগ্র মানবতার সার্বিক অবস্থা পরিবর্তন, উন্নতি এবং পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারো।
যেমনটা আবুল কাসেম হাজ্জ আল হামাদ বলেছেন, বিগত প্রায় ১৩শ বছর ছিল ইসলামের বিশ্বজনীনতার সময়। আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমরা ইসলামের বিশ্বজনীনতার আরেকটা যুগের সূচনা করতে চলেছি যেটা এখন প্রতিষ্ঠিত নেই। আর ইতিহাসই আমাদেরকে এই পথ দেখাচ্ছে। ইসলামী সভ্যতার সেই ১৩শ বছরে এমন একটা সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত ছিল, যা পুরো পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল শাসন করেছে। এ সভ্যতায় ছিল উন্নত রাষ্ট্র, যেখানে বিদ্যমান ছিল উন্নত সংস্কৃতি, সামাজিক উন্নতি, সামাজিক উপাদান, সরকার ও আইন ব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা, শিল্প, বিজ্ঞান ইত্যাদি। এই সভ্যতা ছিল অনেক দিক থেকেই অপ্রতিদ্বন্দী। আইন, দর্শন, শিক্ষা, মিস্টিসিজম, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, কলা, বাণিজ্য, অর্থনীতি, প্রশাসন, স্থাপত্য, চিকিৎসাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সভ্যতা একেবারেই অনন্য। এমনকি এই সভ্যতা তার সবচেয়ে দূর্বল সময়েও ঐসকল আক্রমণকারীদের পরাজিত করেছে যারা তাদের উপর প্রভাবশালী হওয়ার কিংবা তাদের উপর দখলদারিত্ব চালানোর চেষ্টা করেছিল। এসকল আক্রমণকারীরা, যাদের শক্তিশালী কোন ধর্ম বিশ্বাস ছিল না, তারা মঙ্গোলদের মতোই বিলীন হয়ে গিয়েছে। আর যাদের ক্রসেডারদের মতো শক্তিশালী বিশ্বাস ছিল তারা অপসারিত হয়েছে।
কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে মুসলিম বিশ্ব এমনকি গোটা বিশ্বে ক্ষমতার পালা বদল ঘটে। এবার বিশ্ব ক্ষমতা চলে আসে ইউরোপীয়দের হাতে, যারা রেঁনেসার মাধ্যমে তাদের অন্ধকার যুগকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে এসেছিল। শিল্প বিপ্লব এবং সাম্রাজ্যবাদের সূচনার মধ্য দিয়ে জাতীয়তা এবং বিশ্বাসের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষত, সামরিক প্রযুক্তির বিকাশের মাধ্যমে ক্ষমতার এই ভারসাম্যহীনতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। নেপোলিয়নের মাধ্যমে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে মুসলিম বিশ্বের একেবারে কেন্দ্রে প্রচুর পরিমাণে সামরিক অভিযানের সূত্রপাত ঘটে। এসকল সামরিক অভিযান ব্যর্থ হয়ে গেলেও সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। কলম্বাসের আমেরিকায় গণহত্যা চালানো থেকে শতাব্দি কাল ধরে সাম্রাজ্যবাদ পুরো দুনিয়াতে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছিল এবং সব জায়গায় তাদের এই নৈরাজ্যকে বয়ে চলছিল। তারা পুঁজিবাদকে ধারণ করে এমন বহুজাতিক কোম্পানি এবং সামরিক ক্ষমতার উপর ভর করে আফ্রিকা এবং এশিয়ার শ্রম বাজার সহ অপরাপর ক্ষেত্রে লুটপাট, রাহাজানি চালিয়ে যাচ্ছিল। সাম্রাজ্যদীরা তাদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে উপস্থিত বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে চতুর্মুখী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে মানুষ মারার দিক থেকে তাদের সমকক্ষ আর কেউ নেই। তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকায় প্রায় ১০ মিলিয়ন বেসামরিক মানুষ হত্যা করেছে। অথচ, এই সকল অঞ্চলে প্রায় ১৩০ মিলিয়ন আদিবাসী ছিল। ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর আগে এই অঞ্চলে জনসংখ্যার ৯০-৯৫ ভাগই ছিল ভূমিপুত্র। উনিশ শতকের শেষের দিকে তথাকথিত ইন্ডিয়ান যুদ্ধ শেষে উত্তর আমেরিকায় ২ লক্ষ ৩৮ হাজারেরও কম বেসামরিক আদিবাসী অবশিষ্ট থাকে। অথচ এটা স্পষ্ট যে, ১৪৯২ সালে কলম্বাস যখন আমেরিকায় আসে তখন সেখানে মিলিয়ন, মিলিয়ন আমেরিকান আদিবাসী বাস করতো। ১৮৩৫ থেকে ১৮৪৫ এর মাঝামাঝি সময়ে বেলজিয়াম ১০-১৫ মিলিয়ন কংগোসকে হত্যা করেছে। একই সময়ে ডাচরা ইন্দোনেশিয়ায় তিন লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করে। ফরাসিরা ১৮৩০ সাল থেকে আলজেরিয়ায় ১৩২ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে ১০ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করে। ইতালি, লিবিয়ার দুই তৃতীয়াংশ এবং ইথিওপিয়ার ২ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করে। অন্যদিকে বৃটিশরা ভারতে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনে ৩৫ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করে। একই ভাবে রাশিয়ানরা মিলিয়ন, মিলিয়ন এশিয়ানকে নির্মূল করে। যখন মুসলিম বিশ্বের একেবারে কেন্দ্রে ১৯৪৮ সালে পশ্চিমা জায়োনিস্টরা নতুন করে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তখন তারা ১০ হাজারের অধিক মানুষকে হত্যা করে এবং ফিলিস্তিনের ৬০ ভাগ মানুষকে তাদের বাপ দাদার ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করে পবিত্র এই ভূমিকে দখল করে নেয়। এখনো মিলিয়ন, মিলিয়ন মানুষ শরণার্থী ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
ঔপেনিবেশিকরা তাদের উপনিবেশিকতা চাপিয়ে এই পবিত্র ভূমির ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে ধুলিস্যাৎ করে দিতে চায়। তাদের এইসব গণহত্যা শুধুমাত্র নিরপরাধ মানুষ আর সমাজকে ধ্বংস করছে এমনটি নয়, বরং একটি দেশ, গোটা জাতি এবং তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে চিরতরে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। আজকে তাদের প্রায় ১৩০ মিলিয়নের বেশি ইজরায়েলি অবৈধ আবাসন, ১১০টি এয়ারপোর্টসহ অন্যান্য স্থাপনাসমূহের মাধ্যমে এই অঞ্চলে প্রায় আশি শতাংশের বেশি ভূ-ভাগে অবৈধ দখলাদারিত্বের জাল বিছিয়ে বসেছে। ৮০% এর বেশি ইজরায়েল অধিবাসীদের জন্য নীতিবহির্ভূত আবাসন স্থাপন করেছে। বর্তমানে ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর করা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে (যা এখনো পূর্ণ প্রতিফলিত) আমরা স্পষ্টভাবে ইজরায়েল রাষ্ট্রের কর্মনীতি সম্পর্কে জ্ঞাত হতে পেরেছি।
ইজরায়েল, প্রত্যক্ষ উপনিবেশিকতার মাধ্যমে সারা মুসলিম জাহানের পবিত্র হৃদয়ে দখলদারিত্বকে অব্যাহত রেখেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, নতুন আরব রাজনীতিতে বড় বড় যুদ্ধের সূচনা হয়। ১৯৪৮ সালের পূর্বে ফিলিস্তিন অঞ্চলটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির অনুগামী আরব বুর্জোয়া শ্রেণির নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল যারা ছিল উপনিবেশ-পক্ষপাতি। বিশেষত মিসর, জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়া ইত্যাদি ফিলিস্তিন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অভিজাত শ্রেণিগুলো ছিল এই ক্ষেত্রে অধিক অগ্রগামী। ৪৮ এর বিপর্যয়ের পর, বিভিন্ন আরব দেশসমূহ রাজতন্ত্রের পরিবর্তে রিপাবলিক পন্থাকে সাদর সম্ভাষণ জানানো শুরু করে। তবে সৌদি আরব, গাদ্দাফির শাসনাঞ্চল, মরক্কো এবং জর্ডান অঞ্চলে পূর্বের মতোই রাজতন্ত্র বজায় থাকে। আবার কিছু আরবদেশে পুঁজিবাদের বিপরীতে সমাজতন্ত্রকে বেছে নেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তবে এই আন্তঃকোন্দল এবং ওলোট-পালটের পেছনে সামরিক শক্তি এবং অভিজাত শ্রেণির অন্তঃর্দ্বন্দ্ব ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়ে পড়ে। কিন্তু ৬৭ এর পরাজয় এবং তার ধংসাত্মক ফলাফলের কারণে খুব দ্রুতই এসব সমাজতন্ত্রী রিপাবলিক দলগুলো নিজেদের গ্রাউন্ড হারিয়ে ফেলে । একইসাথে সময়ের আলোকে উত্থিত হতে শুরু করে PLO প্ল্যাটফর্মের আন্ডারে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনবাসীর সকল প্রতিরোধসমূহ।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মূলত স্বাধীনতাকামী এবং প্রতিরোধ বাহিনীদের একের পর এক আন্দোলন ইজরায়েলি আগ্রাসনের মোকাবেলায় দৃঢ় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে। ১৯৮২ সালে ইজরায়েলের পুনর্বার লেবানন দখলের প্রচেষ্টার পর থেকেই মূলত ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের হাওয়া বদলাতে শুরু করে। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে বাম ও সেক্যুলার মতাদর্শী দলের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনবাসীর আন্দোলন ক্রমেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরিশোধিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট ইসলামী আন্দোলনে রূপ নেয়। জাগরণ ঘটে “হামাস” বা “ইসলামি জিহাদ” বা “হিযবুল্লাহ” নামের ইসলামী ট্যাগ সমৃদ্ধ আন্দোলনসমূহের। সর্বোপরি, ইসলামী আন্দোলনসমূহ সার্বজনীনভাবে তাদের হিসেব মিলিয়ে ওঠে ২০০০-২০০৩ সালের কোন্দলের সময়ে। এসব ইসলামী আন্দোলন সমূহের স্বরূপ নিয়ে স্বয়ং সময়ই সাক্ষ্য দান করে। পরবর্তী বছরগুলোতে যখন লেবাননে হিযবুল্লাহর হাতে এবং গাজাতে হামাসের হাতে ইজরায়েল একের পর এক নাজেহাল হয়ে পালিয়ে যায়, ঘটনাচক্রের প্রবাহে ফিলিস্তিনবাসীর কর্তৃত্ব আপনা-আপনিই ইসলামী আন্দোলনসমূহের ঘাড়ে ন্যস্ত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে ইজরায়েলের সাথে চলমান যুদ্ধের ফলাফল গোটা আরব দুনিয়াতেই ইসলামী আন্দোলনসমূহ নিয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। বিশেষত হামাস এবং হিযবুল্লাহর কাছে ইজরায়েলের পলায়ন এবং পরাজয়ে আরববাসীর হৃদয়ে নতুন ঢেউ খেলে যায়। সমগ্র আরব বিশ্বেই তখন ইসলামী আন্দোলনসমূহ রাজনৈতিক বৈধতা পেতে শুরু করে। তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, আরব রাষ্ট্রগুলোর উপর জোর করে, লোভ দেখিয়ে কিংবা ভয় দেখিয়ে ইজরায়েল তাদের শাসন/শোষণ নীতি প্রণয়ন করতে অক্ষম। ইজরায়েলের এসব হুংকার, আল্টিমেটাম, ভীতি প্রদর্শন কোন কিছুই ইসলামী আন্দোলনগুলোকে থামাতে পারেনি, পারবেও না ইনশা-আল্লাহ।
একাবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষ দিকে আরব বিশ্বের অবস্থা এতোটাই করুণ হয়ে গিয়েছিল যে, হতাশ নাগরিকরা বারবার বলছিল, যথেষ্ট হয়েছে, আর না। একদিকে দুর্বল ও দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রগুলো নিজেদের জনগণের কোটি কোটি সম্পদ লুট করে নিচ্ছিলো, অন্যদিকে ইরাক এবং আফগানিস্তানের উপর পশ্চিমারা যে ভয়ংকর আগ্রাসন চালাচ্ছিল তা থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। অনেক অঞ্চলে আল কায়েদা এবং আইএস এর মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং সহিংসতার সৃষ্টি করে চলছিল। এরই মধ্যে, প্রাচ্যের কিছু দেশ যেমন তুরস্ক, ইরান এমনকি ইজরায়েলও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিভিন্ন সেক্টরে উন্নয়ন করে যাচ্ছিল। সেখানে আরব বিশ্বের নাগরিকরা দেখছিল, তাদের উন্নয়ন স্থবির হয়ে আছে, না হয় আরও পশ্চাৎপদ হচ্ছে। ২০১০ এর নভেম্বরে, মিশরে মুবারক সরকার এক নির্লজ্জ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে যার ফলাফল, বিরোধীদলগুলো নির্বাচনে একটি আসনও পায়নি। যেসব দেশে ধরে নেওয়া হয়েছিল অবাধ এবং সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসকেরা ক্ষমতায় এসেছে, সেসব দেশের শাসকেরাও তাদের নাগরিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি চরম মাত্রায় উদাসীন ছিল। এমনকি তারা এমন শাসন ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, যেখানে উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এভাবে মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন এবং তিউনিসিয়ায়ও রাজতন্ত্রের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে।
আরব বিশ্ব যেহেতু ক্ষোভে জ্বলছিলো, এটাকে বিস্ফোরিত করতে প্রয়োজন ছিল সামান্য একটু স্ফুলিঙ্গের। ২০১০ এর ডিসেম্বরে এক সাধারণ তিউনিসিয়ান বিক্রেতাকে পুলিশ তার পণ্য বিক্রি করতে না দিলে, অর্থনৈতিকভাবে হতাশ সেই বিক্রেতা প্রকাশ্যে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনায় পুরো দেশে বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। যেমনটা লেনিন একবার বলেছিলেন, “There are decades where nothing happens and there are weeks where decades happen” ঠিক এমনটাই আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ২০১১ সালে। কয়েকদিনের মধ্যেই পুরো তিউনিসিয়া জুড়ে বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে পড়ে এবং অভ্যুত্থানের ২৮ দিনের মধ্যে স্বৈরচারী শাসক বেন আলী তার ২৩ বছরের স্বৈরশাসন গুটিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। দ্রুতই বিপ্লবী চেতনার হাওয়া বইতে শুরু করে মিশরেও। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে হুসনি মুবারকের পদত্যাগের জন্য আন্দোলন করে। মাত্র ১৮ দিনের অভ্যুত্থানে ২৯ বছরের স্বৈরশাসনকে বিদায় জানাতে বাধ্য হয় মুবারক। ২০১১ সালের ফ্রেবুয়ারির মধ্যে ইয়েমেন, লিবিয়া, মরোক্কো, জর্ডান, বাহরাইনে হাজার হাজার মানুষ মুক্তি এবং পরিবর্তনের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। মার্চ মাসে তাদের সাথে যোগ দেয় আরও কয়েক হাজার সিরিয়ান। একসময় যা কল্পনাতীত ছিল, তাই তখন দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে ৪টি রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং স্বৈরশাসনের পরিবর্তে সেখানে গণতান্ত্রিক নির্বাচন জায়গা দখল করে নেয়।
আরব বিশ্বে সংগঠিত এই বিপ্লবগুলো ছোটখাটো কোন আন্দোলন ছিল না। এগুলো ছিল বিশাল বড় গণঅভ্যুত্থান। কিন্তু, শীঘ্রই বিপ্লবের বিরুদ্ধ-শক্তি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে আরব বসন্তের মাধ্যমে আরব বিশ্ব যা অর্জন করেছিল, যে রাজনৈতিক দিগন্তের উন্মোচন ঘটেছিল, তা পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে ফেলে। একই সাথে, “শোষণ ও দুর্নীতির অবসান” এবং “গণতান্ত্রিক শাসন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি”র যে স্বপ্ন তারা দেখতে শুরু করেছিলো, তার চূড়ান্ত অবসান ঘটে। এটা কেবল পশ্চিমা শক্তি কর্তৃক তৈরিকৃত নীতিগুলো সাথে আপোষই ছিল না বরং এটা ছিল জনগণের ইচ্ছাকে অসম্মান করা এবং তাদের স্বাধীনতা, মর্যাদা, সাম্যতা, আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ও মত প্রকাশের অধিকারকে অস্বীকার করা।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ছয় দশকের বেশি সময় ধরে যখনই মুসলিমরা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে চেষ্টা চালিয়েছে, তখনই তাদের চেষ্টাকে দমন করা হয়েছে এবং বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ১৯৫৩ সালে ইরানে, ১৯৯২ সালে আলজেরিয়ায়, ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনে, ২০১৩ সালে মিশরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টি দিলেই তা পরিষ্কার হয়ে উঠে। প্রকৃতপক্ষে, এই চিত্র আরও ভয়ংকর এবং ভবিষ্যৎ প্রকারান্তে অনিশ্চিত। আমরা এমন এক ক্রান্তিলগ্নে বসবাস করছি, যখন বিপর্যয়ের সকল উপাদান আমাদের সামনে জেঁকে বসেছে। যদিও আমরা মুসলমানরা পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক। মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৯০% উন্নয়নশীল দেশ রয়েছে যেখানে বেশিরভাগই মুসলিম রাষ্ট্র। ৪শ মিলিয়ন আরব, তুরস্ক ও ইরানের অন্তর্ভুক্ত মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ৫৫০ মিলিয়ন এবং আফগানিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া জুড়ে রয়েছে ৯০০ মিলিয়ন মুসলমান বসবাস করে। এই জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ৩০ বছরের কম এবং এখনো তারা জানে না, তাদের ভবিষ্যৎ কী? আরব বিশ্বে প্রতিদিন ৬০ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। ১৩০ মিলিয়নের বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে। একই অবস্থা বাংলাদেশেও। এখানে দারিদ্র্যের হার ২০% এরও বেশি। অর্থাৎ, প্রতিদিন কয়েক মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন পার করে। নিরক্ষরতার হার অঞ্চলভেদে ৩০% থেকে ৫০%। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে দুর্নীতি এখন প্রকট ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৫ সাল, এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। ধারণা করা হয়, ৬০০ বিলিয়ন মিশরীয় পাউন্ড বা ৪০ বিলিয়ন ডলার শুধুমাত্র দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়েছিল। সে বছর শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যেই সামরিক ব্যয় ২২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। যুবসমাজের মধ্যে বেকারত্ব নজীরবিহীন অবস্থায় পৌঁছেছে। অঞ্চলভেদে ৩০% থেকে ৭৫%। যদিও মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো দরিদ্র নয়, কিন্তু তাদের এসব সম্পদ মাত্র গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে পুঞ্জিভূত । ২০০৮ এর দুর্ঘটনার পর, আরবরাষ্ট্র আমেরিকার অর্থনীতিতে প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। এই অর্থ মুসলিম বিশ্বে বিনিয়োগ করার পরিবর্তে তারা শুধুমাত্র সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতির দেশ আমেরিকায় বিনিয়োগ করে। একটু চিন্তা করে দেখুন তো, মুসলিম বিশ্ব এই অর্থ দিয়ে কী কী করতে পারতো?
আমাদের এখন একটি নতুন ভিশন প্রয়োজন, প্রয়োজন একটি নতুন শক্তি কাঠামো। বিশ্ব শক্তি এখন যাদের হাতে তারা প্রচণ্ড মাত্রায় লোভী। বহুজাতিক (Multinational) কর্পোরেশনগুলো লোভী। তারা শুধু পৃথিবীকে দুর্দশার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। এর প্রভাব ভয়ানক, বিশেষ করে তরুণদের জীবনে। মাত্র ১ শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ২০০ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ২০ মিলিয়ন, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ৫৫ মিলিয়ন, ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৩ মিলিয়ন, ১.৩ মিলিয়ন আফগানিস্তানে, ১ মিলিয়ন ১৯৮০ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধে। বেশিরভাগ সময়ই এই যুদ্ধগুলোর পেছনে কলকাঠি নাড়ে পশ্চিমারা। হাজার হাজার মানুষ বসনিয়ায় এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ আফ্রিকায় মারা যাচ্ছে এসব যুদ্ধের ফলে। বর্তমান বিশ্বে ৭৫ মিলিয়নের বেশি শরণার্থী ও উদ্বাস্তু রয়েছে। এদের বেশিরভাগই মুসলিম। এটি এমনই এক প্রকট সমস্যা যা অতি দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন। যদি এই মানুষগুলোর জন্য বসবাসের ব্যবস্থা না করা হয়, এদের স্বাভাবিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বন্ধ হয়ে যাবে। পুরো বিশ্ব জুড়ে দারিদ্র্য পীড়িত মানুষের সংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক। অর্থাৎ প্রতি বছর ৩.৫ বিলিয়ন মানুষ ১০০০ ডলার এর কমে জীবন পরিচালনা করছে। এদের মধ্যে ১.২ বিলিয়ন শিশু এবং ১.৫ বিলিয়ন নারী। কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। শুধুমাত্র দারিদ্র্য এবং ক্ষুধার জন্য প্রতিদিন ২৫,০০০ মানুষ মারা যাচ্ছে, যার বেশিরভাগই শিশু। বিশ্বের জনসংখ্যার ৮০% অর্থাৎ ৫.৫ বিলিয়ন মানুষ প্রতিদিন ১০ ডলার এর কমে জীবন পরিচালনা করে। যেখানে কিনা বিশ্বজুড়ে ১০০ জন মানুষ, হ্যাঁ! মাত্র ১০০ জন মানুষ বিশ্বের আয়ের ২৫ শতাংশের মালিক। একটু কল্পনা করুন তো, মাত্র ১০০ জন ব্যক্তি! আমরা এমনই এক নীতিবহির্ভূত, ন্যায়বিচারহীন পৃথিবীতে বসবাস করছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধনী ব্যক্তিরা জনসংখ্যার মাত্র ০.১%। মানে, হাজারের মধ্যে একজন ধনী। আর তার হাতেই সে দেশের সম্পদের ২০% এর বেশি থাকে। এভাবে মাত্র ১০ জন ধনীর সে দেশের মোট সম্পদের অর্ধেকের বেশি ভোগ করে যেখানে কিনা ৪০% দরিদ্র, কিছুই পায় না। দেখুন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এমন একটা ইস্যু যা পুরো মানবজাতির অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্য হুমকিস্বরুপ। অথচ এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি সজাগ দৃষ্টি না দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য ডিফেন্স সেক্টরে তারা প্রতিবছর ২ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। সংক্ষেপে, ধনী এবং শক্তিশালীরাই বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।
জর্জ ওয়েল তার বিখ্যাত এক উপন্যাসে এভাবে বলেছিল, “War is peace, Freedom is slavery and Ignorance is strength”। আজকে আমরা এমনই এক অদ্ভুত পৃথিবীতে বাস করছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তির নামে ইরাক, আফগানিস্তান ও অন্যান্য অঞ্চল ধ্বংস করতে সৈন্য পাঠায়। তারা প্রমাণ করতে চায়, যুদ্ধ আসলেই শান্তি (War is peace) । দেশপ্রেমের ফাঁকা বুলি ছড়িয়ে, আইন পাশ করে, স্বাধীনতা রক্ষার নামে আমেরিকা নিজেই তার নাগরিকদের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়েছে। স্বাধীনতাই দাসত্ব (Freedom is slavery), তাই তারা অনবরত সংবাদ মাধ্যমের বাকস্বাধীনতা বন্ধ করে দিচ্ছে। ২০১১ সালে, আরব বসন্তের মাধ্যমে যে বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হলো তা লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমার খুব স্পষ্ট ভাবেই মনে আছে, আমি তখন এমন এক অঞ্চলে ছিলাম, যেখানে আরববিশ্বের এই আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ নতুন এক সংস্কারের আশায় রাস্তায় নেমে এসেছিল। কিন্তু শেষে কী হলো? বিপ্লবের বিরোধী শক্তি এই পরিবর্তন দমন করতে উঠে পড়ে লাগল এবং শেষ পর্যন্ত সফলও হলো। সমাজের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ছিল। কারণ সংস্কার ও পরিবর্তনের এই আন্দোলন, রাজনৈতিক অত্যাচার ও অর্থনৈতিক শোষণের উপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো জুলুমপূর্ণ শাসন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বদলে দিত। স্বৈরশাসনের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন হতো। কিন্তু এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষগুলো অজ্ঞতার দারুণ বুঝতেই পারলো না এতো কষ্ট করে অর্জিত অধিকার সমূহকে বিপ্লবের বিরুদ্ধ-শক্তি কী কৌশলে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে তাদের কাছ থেকে। এজন্যই তারা বলে, অজ্ঞতাই শক্তি (Ignorance is strength)।
আজ আমাদেরকে ঐতিহ্য ও মানবিক অগ্রগতিকে সমন্বয় করে এমন একটি পরিবর্তন আনতে হবে যা একই সাথে নির্ভরযোগ্য এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন। আমাদেরকে “Mother of Civilization” তৈরি করতে হবে। সার্বজনীন নীতিগুলোর উপর ভিত্তি এমন একটি সভ্যতার দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে যেখানে থাকবে আলাদত, স্বাধীনতা, সাম্য এবং শান্তি। এটি শুধু ধনী কিংবা শক্তিশালীদের জন্যই না, এটি হবে সকল বর্ণের, ধর্মের মানুষের জন্য। সমগ্র মানবতার জন্য। আর এর ভিত্তি হবে ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। আমাদেরকে এমন একটি প্রকল্প হাতে নিতে হবে, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারি। যেমনটা কুরআন আমাদেরকে বলছে, “আল্লাহ মানুষের অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করে”। এটাই সফলতার পূর্বশর্ত। পরির্বতনের জন্য আমাদের নিজেদেরকে আগে পরিবর্তন করতে হবে।
যুবকেরা, তরুণ বয়সে তোমরা যখন জীবনের জাহাজে আরোহণ করতে যাচ্ছো, তোমাদের কর্মপন্থা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য যেন এই পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। বিশ্বপরিবর্তনের যে আন্দোলনের সাথে তোমরা যুক্ত হয়েছো, সে আন্দোলনের সফলতার জন্য তোমাদের নিজেদেরকে আগে পরিবর্তন করতে হবে। নিজেদেরকে গড়ে তুলতে হবে। তখনই কেবল আল্লাহ তোমাদের আন্দোলনে সফলতা দিবেন। শুধুমাত্র নিজেদের সমাজ কিংবা দেশ নিয়ে চিন্তা করো না। তোমাদের চিন্তা হতে হবে উম্মাহ কেন্দ্রিক। তোমাদেরকে এমন একটি মহৎ প্রকল্প হাতে নিতে হবে যা কিনা উম্মাহর অবস্থা পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। তোমাদেরকে তোমাদের প্রজেক্ট ঠিক করে নিতে হবে। প্রতিটা সমাজ, প্রতিটা কমিউনিটির নিজস্ব কিছু প্রজেক্ট বা প্রকল্প রয়েছে। প্রজেক্ট যাই হোক না কেন অবশ্যই সেখানে থাকতে হবে ন্যায়বিচার, মূল্যবোধ এবং সুশাসন । একই সাথে তা অত্যাচার, অবিচার, শোষণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে।
মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করতে, মুসলিমদের অবস্থার পরিবর্তন করতে আমাদেরকে একই সাথে একটি স্থানীয় প্রকল্প এবং একটি বৈশ্বিক প্রকল্প হাতে নিতে হবে। স্থানীয় প্রকল্পটি আদালত, স্বাধীনতা, সাম্য, সুশাসন ও ইহসানের উপর ভিত্তি করে স্থানীয় জনগণের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। একই সাথে আমাদের বৃহত্তর বা বৈশ্বিক প্রকল্পটি নিয়েও কাজ করতে হবে। আমরা মুসলিমরা এক উম্মাহর অংশ। উম্মাহর জন্য কাজ করতে আমাদেরকে একটি বৈশ্বিক প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে একসাথে কাজ করতে হবে। এই মহান প্রকল্পটি বিশ্বজুড়ে অন্যায়, অত্যাচার, অবৈধ আধিপত্য নিরসনে কাজ করবে। এক্ষেত্রে ফিলিস্তিন হচ্ছে সর্বোত্তম উদাহরণ, সংগ্রামের আদর্শ প্রতীক। এটা এজন্য নয় যে ফিলিস্তিনের সংগ্রাম অন্যদের চেয়ে অনন্য। ফিলিস্তিনি জনগণদের দুর্দশা, আফগানিস্তান, সিরিয়া, কাশ্মীর, রোহিঙ্গাদের দুর্দশার চেয়ে আলাদা নয়। কিন্তু ফিলিস্তিন কেন সংগ্রামের আদর্শ প্রতীক? এটা জানতে হলে আমাদের বুঝতে হবে, ইজরায়েল আসলে কিসের প্রতিনিধিত্ব করে? ইজরায়েল হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর বিভক্ত ও বিভাজনের প্রতীক। তাই উম্মাহর ঐক্যের জন্য প্রয়োজন ইজরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সবাইকে একত্রে সংগ্রাম করা।
আমি বলছি না যে এই সংগ্রামটা মুসলিমদের সাথে ইহুদীদের। ইহুদীরা এই উম্মাহর অংশ ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। প্রকৃতপক্ষে ইজরায়েল রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার এই প্রকল্পটি ইহুদীবাদকে জায়োনিজম নামক ধ্বংসাত্মক শক্তি থেকে বাঁচানোর জন্য। জায়োনিজম ইহুদী ধর্মকে একটি মহান ধর্ম নয়, বরং একটি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করছে। আর তাই, আমরা এখানে লড়াই করছি নিপীড়ন, স্বৈরাচার, দখল ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। আর এর প্রতিটাই ইজরায়েল প্রতিনিধিত্ব করে। তাই ইজরায়েলের সাথে আমাদের লড়াই মূলত মানবতার মুক্তির লড়াই। এই লড়াই শুধু মুসলমানদের না। এ লড়াই যেকোন স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্যই। এ সংগ্রামে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমেই আমরা একটি আদর্শ, বসবাসযোগ্য নতুন এক পৃথিবী গড়তে পারবো। যেখাবে থাকবে না শোষণ, অত্যাচার, আধিপত্যবাদের জুলুম। যে পৃথিবীতে থাকবে আদালত, স্বাধীনতা, সাম্যতা এবং সত্যিকারের শান্তি। এই মহৎ প্রকল্পের জন্য আমাদের প্রয়োজন একদল যোগ্য মানুষ। হ্যাঁ, আমাদের প্রয়োজন তোমাদের মতো যুবকদের, যারা এ সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিবে, সার্বজনীন ন্যায়বিচার, সত্য, স্বাধীনতা ও শান্তির জন্য কাজ করবে।
আমি যখন মুসলমানদের সাথে কথা বলি, আমি তাদেরকে ১৫টি পরামর্শ দিই যার উপর ভিত্তি তারা তাদের প্রজন্মকে যোগ্য ভাবে গড়ে তুলতে পারবে। আর এর মাধ্যমেই আমরা আমাদের উম্মাহর জন্য, মানবতার জন্য স্থানীয় এবং বৈশ্বিক পরিবর্তন সাধন করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
১) যুবকদের প্রতি আমার প্রথম পরামর্শ কিংবা উপদেশ হচ্ছে, “নিজেকে জানো”। তুমি যদি এমন এক আন্দোলনের সাথে থাকো কিংবা যুক্ত হতে চাও, যে আন্দোলনের কিনা বিশাল এক মহৎ লক্ষ্য রয়েছে, সে আন্দোলনে সফলতার জন্য প্রথমে তোমার নিজেকে জানতে হবে। নিজের যোগ্যতা এবং সামর্থ্য সম্পর্কে জানো। সেগুলোকে আরও শক্তিশালী করো। নিজের দুর্বলতাগুলোকে খুঁজে বের করো। সেগুলোকে আমলে নাও । প্রত্যেকের কিছু না কিছু দুর্বলতা আছে, আসক্তি আছে। তোমার আসক্তি কোথায় খুঁজে বের করে তা দূর করো।
জ্ঞানের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করো। জ্ঞান অন্বেষণ করো, ইতিহাস পড়ো। দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করো। তোমাকে জানতে হবে, তুমি কে? তুমি কিসের প্রতিনিধিত্ব করতেছো? তোমার যোগ্যতাগুলো কী কী? তোমার দুর্বলতা কোথায়? এটাই সফলতার প্রথম পদক্ষেপ।
২) আমার দ্বিতীয় পরামর্শ হচ্ছে, “ভুল-ত্রুটি মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করো”। কেউ তোমার ভুল ধরিয়ে দিলে, নির্দ্বিধায় মেনে নেও। ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে সংশোধন করো। অহংকারী হয়ো না। মানুষ মাত্রই ভুল করে। বিনয়ী হও।
৩) কখনোই, কোন অবস্থায়ই “হাল ছেড়ে দিবে না”। ব্যর্থতাকে ভয় পেয়ো না। বেশিরভাগ উদ্ভাবকরা সফল হওয়ার আগে অনেকবার ব্যর্থ হয়েছেন। ধৈর্য এবং অধ্যবসায় এমন দুটি মহৎ গুণ যা এই আন্দোলনের প্রতিটা যুবকের অর্জন করা উচিৎ। এই দুটো মহৎ গুণ তোমাদের ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক উন্নতি ও সাফল্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে।
৪) “জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি ফোকাস রাখো”। মহৎ এবং বৃহৎ স্বার্থে কাজ করো। শুধু নিজের পরিবার, সমাজ কিংবা দেশের জন্য না, উম্মাহর জন্য, মানবতার জন্য কাজ করো। এমন কিছু করো যা কিনা তোমার চেয়েও বড়। এমন কিছু করো, যা কিনা আরও ১০০ জন মানুষকে উপকৃত করবে। সক্রিয় ও কর্মঠ থাকো। আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে মিশনমুখী হও।
৫) “মানবতার মুক্তির জন্য একটা কমন উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করো”। এমন এক উদ্দেশ্য, যা পুরো মানবজাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। নিজেকে বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে চিন্তা করো। নিজের জন্য, নিজের পরিবার, প্রতিবেশী, সমাজ, রাষ্ট্র, উম্মাহ এবং মানবতার জন্য কাজ করো। অহংকার ও লোভ, খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখো।
৬) “চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে কৌশলী হও”। বড় করে চিন্তা করো। নিজের ভাবনাকে প্রসারিত করো। “Think globally even when you act locally”। উদাহরণ হিসেবে আমি তোমাদেরকে দাবা এবং ব্যাকগ্যামন খেলোয়াড়দের কথা বলতে চাই। দাবা খেলোয়াড় তার গুটির শক্তি এবং যোগ্যতা সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা রাখে। প্রতিপক্ষের চাল ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে, সে অনুযায়ী সে তার পরবর্তী চাল চালে। সুদূরপ্রসারী চিন্তা করে। আবার, ব্যাকগ্যামন খেলোয়াড় পরিস্থিতি বুঝে সে অনুযায়ী চাল দেয়। আমাদেরকে যেমন সুদূরপ্রসারী চিন্তা করতে হবে, একই সাথে বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতেও চিন্তা করতে হবে।
৭) “বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাকে (ক্রিটিক্যাল থিংকিং) গুরুত্ব দেও”। ক্রিটিক্যাল থিংকিং করার জন্য যোগ্যতা অর্জন কর। প্রশ্ন কর। যুক্তি দিয়ে উত্তর বোঝার চেষ্টা কর। সত্যকে সামনে নিয়ে আসো, যদি সেটা প্রচলিত স্টিস্টেমের বিপরীতেও যায়। এটা খুব সহজ কোন কাজ না। নবীগণের মিশনই ছিল এটা। মুসা (আঃ) ফেরাউনকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, মুহাম্মদ (সঃ) কুরাইশ এবং তৎকালীন বিশ্ব শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।
মানব ইতিহাসকে ক্রিটিক্যাল থিংকিং এর মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা। আমাদের চিন্তায় যা কিছুই মানবিক বা মানুষের থেকে এসেছে, সেটা প্রশ্নাতীত নয়; বরং যে কোনো ধরনের আলোচনার জন্য উন্মুক্ত।
৮) “সময় এবং জীবনের সঠিক ও সুষম বিন্যস্ততা বজায় রাখো”। তোমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হচ্ছে সময়। এই সময়কে অপচয় করো না। অহেতুক কাজে তোমাদের সময় যেন ব্যয় না হয়। সময়ের সর্বোচ্চ সৎ ব্যবহার করো। সময় এমনই এক অমূল্য বস্তু যা একবার চলে গেলে আর কখনোই ফিরে আসবে না। টাইম ম্যানেজমেন্টকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে নেও।
৯) “একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম নীতির মধ্য দিয়ে জীবন যাপন কর”। জীবনে নিয়মানুবর্তিতা, সংযম এবং শৃঙ্খলা না থাকলে কোনো কাজেই নিজের সর্বোচ্চটুকু দিতে পারবেনা। নিজের জীবনকে এমন ভাবে গুছিয়ে নেও, যেন তোমার চারপাশের মানুষ তোমাকে তাদের জীবনের রোল মডেল হিসেবে বেছে নেও।
হাকিকতে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে জ্ঞান অর্জন করো। মানবতার কল্যাণের জন্য কাজ করে যাও। তোমাদের সময় ও জীবন সুসংগঠিত না হলে এটি সম্ভব হবেনা।
১০) “সকল ক্ষেত্রেই সর্বোৎকৃষ্ট, সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ পন্থায় নিজেকে উপস্থাপন করো।” যারা তোমাদের সাথে খারাপ আচরণ করে তাদের প্রতি তোমরা ভালো আচরণ কর। পিতামাতা এবং পরিবারের প্রতি পরিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করো। কেউ যদি নিজের পরিবার, পিতামাতার প্রতিই তার দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতে না পারে, সে কীভাবে বিশ্বের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করতে পারবে?
১১) “ধর্মীয় গোঁড়ামি মূলক আচরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখো।” বিশ্বজনীন ন্যায়ের আন্দোলন ধারণাকে পোষণ করে নিজেকে গোটা মানবতার জন্য প্রস্তুত করো। সাম্প্রদায়ীকতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখো। তোমাদের প্রতি আমার এই পরামর্শটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি সবসময় মাথায় রাখবে।
১২) নিজের ব্যক্তিসত্ত্বাকে সবসময় “নফসের গোলামী থেকে মুক্ত রাখো”। আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার পূর্বে নিজেই নিজের কাজের আত্মপর্যালোচনা করো। মনে রাখবে, আমরা আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম জাতি এজন্যই যে, আমরা ভালো মন্দের পার্থক্য করে, নফসের গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে মানবতার বৃহত্তর কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
১৩) “আধ্যাত্মিকতাকে তোমার জীবনের সাথে অর্থবহ করে তোলো।” মানবতার মুক্তির জন্য কাজ করতে হলে আখলাক এবং আধ্যাত্মিকতাই হবে তোমাদের ভিত্তিমূল। অন্যথায়, আন্দোলন চালিয়ে নিতে প্রতি পদে পদে বাধাগ্রস্ত হবে এবং আন্দোলন কখনো সফলতার মুখ দেখবে না।
১৪) “আল-কুরআন এর সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোল।” তোমাদের সকল কাজের আঞ্জাম এই মহা গ্রন্থ থেকে অন্বেষণ করো।
-সৃষ্টিকর্তার সাথে তোমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হবে তাওহীদ।
-মানুষের সাথে তোমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হবে তাজকিয়াহ।
-বিশ্বের সাথে তোমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হবে ইমরান।
বেশি বেশি মৃত্যুর কথা স্মরণ কর। এই জীবন ক্ষণস্থায়ী। মনে রেখো, যারা একদিন দুর্দান্ত ভাবে এই পৃথিবীতে পদার্পণ করতো, তারা আজ মাটির নিচে। একদিন তোমাদেরকেও এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। চিন্তা করো, এই পৃথিবীতে তোমরা তোমাদের পদচিহ্ন কীভাবে রেখে যেতে চাও? মানবতার কল্যাণের জন্য কী কী কাজ করে যেতে চাও যার মাধ্যমে মানুষ তোমাদেরকে তোমাদের মৃত্যুর পরও শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে?
১৫) তোমাদের প্রতি আমার সর্বশেষ পরামর্শ বা উপদেশ হলো- এমন কিছুর সাথে নিজেদেরকে যুক্ত করো যা মানবতার মুক্তির জন্য কাজ করে। আর মানবতার মুক্তির মূল মেথডোলজি ইসলাম ব্যতীত অন্য কারো কাছে নেই এবং ইসলাম ছাড়া তা কোনদিনও সম্ভব নয়। সুতরাং মানবতাকে মুক্তি দিতে হলে, তোমাদেরকেই নেতৃত্বের স্থান গুলোতে সমাসীন হতে হবে। রাজনীতি করতে হবে। তোমাদের রাজনীতি হবে তোমাদের আধ্যাত্মিকতারই বহিঃপ্রকাশ।
[অনুবাদঃ সায়েম মুহাইমিন, নাফিসা নাজমী ও মুশফিকুর রহমান।]