প্রতি বছর ১১ জ্যৈষ্ঠ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যেহেতু তিনি কলকাতায় ভালো ছিলেন না, তাই তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। বাংলাদেশ সরকার তাঁর থাকার জন্য সব ব্যবস্থাই করে। ঢাকায়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয় তারঁই ইচ্ছানুসারে। প্রতি বছর তাঁর জন্মবার্ষিকীতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী পৃথক বাণী প্রদান করেন।

কবি-সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে একটি সত্য আমাদের মানা উচিত যে, তাদের বিচার করতে হবে প্রধানত তাদের সাহিত্যকর্ম দ্বারা। তাদের রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে বিচার করা ঠিক নয় এবং তাদের মহান সাহিত্যকর্মকে খাটো করাও সঙ্গত নয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, যখন ফররুখ আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম, আল্লামা ইকবাল এবং রবীন্দ্রনাথের কথা আসে, তখনই কিছু লোকের কাছে তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটাই প্রবল হয়ে ওঠে।

যেমন- কবি রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তাঁর বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা, শিবাজীকে জাতীয় বীর মনে করা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা এসবকেই প্রধান মনে করা হয় এবং তার সাহিত্যকর্মকে প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয় না। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীরভাবে হিন্দু দর্শনে বিশ্বাস করতেন। তিনি বেদ, উপনিষদের কথাই প্রচার করেছেন। কিন্তু এরপরও তাঁর সাহিত্যকর্ম বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং সেভাবেই তাকে বিচার করা উচিত।

তেমনিভাবে আল্লামা ইকবাল আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। সেটাই তাঁর ক্ষেত্রে বড় করে দেখা হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন উর্দু-ফার্সি সাহিত্যের একজন মহাকবি; সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন মুসলিম দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। তিনি কোনো গোত্র, ধর্ম বা এলাকার বিরুদ্ধে ছিলেন না। তিনি প্রধানত নিজের জাতির কথাই বলেছেন।

একইভাবে কবি ফররুখ আহমদের কথা এলেই তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শকে বড় করে দেখা হয়। তাঁর সাহিত্যকর্মকে কিছু লোক মোটেই গুরুত্ব দিতে চান না। কিন্তু তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি ইসলামের বাণী তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন। কোনোভাবেই তিনি কোনো ধর্ম বা জাতির বিরুদ্ধে ছিলেন না।

কাজী নজরুল ইসলাম একজন বিশ্বমানের কবি ছিলেন। বাংলা কিংবা অন্য যেকোনো ভাষায় তাঁর মানের খুব স্বল্পসংখ্যক কবিই রয়েছেন। তাঁর কবিতা ও গান বহুমুখী। স্বাধীনতার চেতনা উজ্জীবিত করার জন্য তিনি রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন। ব্রিটিশ শাসনামলে তাঁর কবিতা অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে জাতিকে লড়াই করার অনুপ্রেরণা জোগায়। শুধু তা-ই নয়, তাঁর গান ও কবিতা সব সময় যেকোনো স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তিনি বহু ইসলামী গান ও কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতায় তিনি কুরআনের অংশবিশেষ অনুবাদ করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী তুলে ধরেছেন। এছাড়া তিনি হিন্দু জনগোষ্ঠী, গরিব এবং বঞ্চিতদের জন্যও কবিতা লিখেছেন।

আমরা লক্ষ্য করেছি, তাকে ‘অসাম্প্রদায়িক কবি প্রমাণ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়। নজরুল ইসলাম অবশ্যই সব মানুষের অধিকার চাইতেন; গরিবের, নারীর, অন্য সবার। কিন্তু তিনি অসংখ্য ইসলামী গান ও কবিতা রচনা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী লেখা এবং আমপারার কাব্য অনুবাদকে সাম্প্রদায়িক কাজ মনে করেননি। নিজের সম্প্রদায়ের জন্য, নিজের জাতির জন্য লেখা অন্যায় এবং সাম্প্রদায়িক হতে পারে না।

নজরুল-সাহিত্যের মৌলিক ইসলামী চরিত্রকে অস্বীকার করা ইসলাম বিদ্বেষেরই পরিচায়ক। সমাজ যদি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় এবং সেই সমাজ ও রাষ্ট্র যদি ইসলামের ভিত্তিতে চলে এবং অমুসলিমদের পূর্ণ অধিকার বহাল রাখা হয়, তাহলে তা সাম্প্রদায়িকতা নয়। একইভাবে কোনো সমাজ যদি খ্রিষ্টান কিংবা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় এবং সে সমাজ ও রাষ্ট্র ওই মতাদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত হয়, তা সাম্প্রদায়িক হবে না, যদি মুসলিম বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের মানবাধিকার বহাল থাকে।

কবি নজরুল ইসলামের সঠিক মূল্যায়ন যে বাংলাদেশে হচ্ছে, তা বলা যায় না। আমরা যতটুকু জানি, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের বাংলা সাহিত্য কোর্সে নজরুলের যথাযোগ্য মূল্যায়ন হচ্ছে না। দ্রুতই এর অবসান হওয়া দরকার। আশা করি সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ দিকে নজর দেবে।

৯৫৯ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of শাহ আব্দুল হান্নান

শাহ আব্দুল হান্নান

শাহ আব্দুল হান্নান (১৯৩৯ – ২০২১) ছিলেন একজন বাংলাদেশী ইসলামী দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, লেখক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ সেবক। তিনি বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং ধারার পথিকৃৎ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশের প্রথম সারির ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দি ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড এর চেয়ারম্যানও ছিলেন। এর বাইরে তিনি দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানসহ দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাকালীন সদস্য ছিলেন।
শাহ আব্দুল হান্নান ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে বেশ কিছু বই লিখেছেনঃ
১। ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা
২।ইসলামী অর্থনীতি দর্শন ও কর্মকৌশল
৩।নারী সমস্যা ও ইসলাম
৪।নারী ও বাস্তবতা
৫।সোস্যাল ল অব ইসলাম
৬।দেশ সমাজ ও রাজনীতি
৭।বিশ্ব চিন্তা
৮।সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম
৯।উসুল আল ফিকহ
১০। ল ইকনোমিক অ্যান্ড হিস্টোরি
১১। আমার কাল, আমার চিন্তা
Picture of শাহ আব্দুল হান্নান

শাহ আব্দুল হান্নান

শাহ আব্দুল হান্নান (১৯৩৯ – ২০২১) ছিলেন একজন বাংলাদেশী ইসলামী দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, লেখক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ সেবক। তিনি বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং ধারার পথিকৃৎ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশের প্রথম সারির ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দি ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড এর চেয়ারম্যানও ছিলেন। এর বাইরে তিনি দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানসহ দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাকালীন সদস্য ছিলেন।
শাহ আব্দুল হান্নান ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে বেশ কিছু বই লিখেছেনঃ
১। ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা
২।ইসলামী অর্থনীতি দর্শন ও কর্মকৌশল
৩।নারী সমস্যা ও ইসলাম
৪।নারী ও বাস্তবতা
৫।সোস্যাল ল অব ইসলাম
৬।দেশ সমাজ ও রাজনীতি
৭।বিশ্ব চিন্তা
৮।সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম
৯।উসুল আল ফিকহ
১০। ল ইকনোমিক অ্যান্ড হিস্টোরি
১১। আমার কাল, আমার চিন্তা

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top